ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ভাষার মাস, আত্মপ্রত্যয়ের মাস

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:২৭:১৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০১৯
  • / ৩৪০ বার পড়া হয়েছে

খুলে যাক চেতনার দুয়ার
ফেব্রুয়ারি শুধু ভাষার মাস নয়, আত্মপ্রত্যয়ে উজ্জীবিত হওয়ারও মাস। ১৯৫২ সালের এই মাসে বাঙালি জাতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল। প্রাণের ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বন্দুকের নলকে অগ্রাহ্য করেছিল। বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছিল। একই সঙ্গে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামও বেগবান হয়েছিল। তারই সূত্র ধরে এসেছিল উনসত্তরের গণ-আন্দোলন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। এলো স্বাধীন বাংলাদেশ। তাই ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি নিয়ে আমাদের এত অহংকার, এত গর্ব। আজ সারা দেশে এই মাসের সূচনা হবে নানা আনুষ্ঠানিকতায়। ঢাকায় মাসের প্রথম দিন থেকেই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে শুরু হবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শুরু হবে নানামুখী সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। সারা মাসই চলবে এসব আয়োজন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই পাকিস্তানি শাসকরা ঘোষণা করেছিল ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। প্রতিবাদী তরুণরা সেদিন তাদের মুখের ওপর জানিয়ে দিয়েছিল, ‘না’। তার পরই স্লোগান ওঠে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। সেই আন্দোলন ছড়িয়ে যায় বাংলার আনাচকানাচে। আন্দোলন ক্রমেই বেগবান হতে থাকে। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তা তুঙ্গে ওঠে। একুশে ফেব্রুয়ারি বন্দুকের নল অগ্রাহ্য করে মিছিল এগিয়ে যায়। পাকিস্তানি পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। শহীদ হন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ আরো অনেকে। কিন্তু শাসকের বুলেট আন্দোলন থামাতে পারেনি। মাতৃভাষার জন্য বুকের রক্ত দেওয়ার এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আর সেই বিরল আত্মদানের স্বীকৃতিও মিলেছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীতেই আজ একুশে ফেব্রুয়ারিকে পালন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হচ্ছে সেই শহীদদের, যাঁরা ঢাকার রাজপথে ভাষার জন্য তাঁদের জীবন দিয়ে গেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এমন এক গর্বিত অহংকারের উত্তরাধিকারী হয়েও আমরা আজ পর্যন্ত আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বত্র বাংলার প্রচলন নিশ্চিত করতে পারিনি। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিচ্ছি। ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, এরপর ১৯৯৪ সালে বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম করেছে, অথচ আমরা বাংলা লিখছি যে যার ইচ্ছামতো। প্রাণপ্রিয় বাংলা ভাষাকে প্রকৃত মর্যাদা দিতে আমাদের এই স্বেচ্ছাচারিতা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। বাংলা ভাষাকে ভালোবাসতে হবে। বৈশ্বিক প্রয়োজনে আমাদের ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষাও শিখতে হবে। একই সঙ্গে মাতৃভাষার চর্চাকেও গুরুত্ব দিতে হবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়াতে হবে। জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানীরাও বাংলায় তাঁদের গবেষণাপত্র ও অন্যান্য রচনা উপস্থাপন করেছেন। অথচ এখন অনেকে ‘বাংলায় লিখতে পারি না’ বলে একধরনের বিকৃত গর্ব বোধ করে থাকেন, যা তাঁদের মানসিক দৈন্যকেই প্রকাশ করে। ভাষার মাসে আমাদের চেতনাকে শাণিত করতে হবে, মাতৃভাষার প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতে হবে, বাঙালিত্বকে আলিঙ্গন করতে হবে। কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, প্রাত্যহিক জীবনে তার প্রয়োগ ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকেও আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

ভাষার মাস, আত্মপ্রত্যয়ের মাস

আপলোড টাইম : ১০:২৭:১৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০১৯

খুলে যাক চেতনার দুয়ার
ফেব্রুয়ারি শুধু ভাষার মাস নয়, আত্মপ্রত্যয়ে উজ্জীবিত হওয়ারও মাস। ১৯৫২ সালের এই মাসে বাঙালি জাতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল। প্রাণের ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বন্দুকের নলকে অগ্রাহ্য করেছিল। বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছিল। একই সঙ্গে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামও বেগবান হয়েছিল। তারই সূত্র ধরে এসেছিল উনসত্তরের গণ-আন্দোলন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। এলো স্বাধীন বাংলাদেশ। তাই ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি নিয়ে আমাদের এত অহংকার, এত গর্ব। আজ সারা দেশে এই মাসের সূচনা হবে নানা আনুষ্ঠানিকতায়। ঢাকায় মাসের প্রথম দিন থেকেই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে শুরু হবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শুরু হবে নানামুখী সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। সারা মাসই চলবে এসব আয়োজন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই পাকিস্তানি শাসকরা ঘোষণা করেছিল ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। প্রতিবাদী তরুণরা সেদিন তাদের মুখের ওপর জানিয়ে দিয়েছিল, ‘না’। তার পরই স্লোগান ওঠে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। সেই আন্দোলন ছড়িয়ে যায় বাংলার আনাচকানাচে। আন্দোলন ক্রমেই বেগবান হতে থাকে। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তা তুঙ্গে ওঠে। একুশে ফেব্রুয়ারি বন্দুকের নল অগ্রাহ্য করে মিছিল এগিয়ে যায়। পাকিস্তানি পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। শহীদ হন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ আরো অনেকে। কিন্তু শাসকের বুলেট আন্দোলন থামাতে পারেনি। মাতৃভাষার জন্য বুকের রক্ত দেওয়ার এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আর সেই বিরল আত্মদানের স্বীকৃতিও মিলেছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীতেই আজ একুশে ফেব্রুয়ারিকে পালন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হচ্ছে সেই শহীদদের, যাঁরা ঢাকার রাজপথে ভাষার জন্য তাঁদের জীবন দিয়ে গেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এমন এক গর্বিত অহংকারের উত্তরাধিকারী হয়েও আমরা আজ পর্যন্ত আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বত্র বাংলার প্রচলন নিশ্চিত করতে পারিনি। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিচ্ছি। ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, এরপর ১৯৯৪ সালে বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম করেছে, অথচ আমরা বাংলা লিখছি যে যার ইচ্ছামতো। প্রাণপ্রিয় বাংলা ভাষাকে প্রকৃত মর্যাদা দিতে আমাদের এই স্বেচ্ছাচারিতা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। বাংলা ভাষাকে ভালোবাসতে হবে। বৈশ্বিক প্রয়োজনে আমাদের ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষাও শিখতে হবে। একই সঙ্গে মাতৃভাষার চর্চাকেও গুরুত্ব দিতে হবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়াতে হবে। জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানীরাও বাংলায় তাঁদের গবেষণাপত্র ও অন্যান্য রচনা উপস্থাপন করেছেন। অথচ এখন অনেকে ‘বাংলায় লিখতে পারি না’ বলে একধরনের বিকৃত গর্ব বোধ করে থাকেন, যা তাঁদের মানসিক দৈন্যকেই প্রকাশ করে। ভাষার মাসে আমাদের চেতনাকে শাণিত করতে হবে, মাতৃভাষার প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতে হবে, বাঙালিত্বকে আলিঙ্গন করতে হবে। কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, প্রাত্যহিক জীবনে তার প্রয়োগ ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকেও আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে।