ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ভারতে কোভিড সুনামি : হুমকিতে বাংলাদেশ?

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:১০:১৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১ মে ২০২১
  • / ৫৫ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ প্রতিবেদন:
কয়েক সপ্তাহ আগেও ভারত ভেবেছিল যে তারা করোনাভাইরাসের আপদ দূর করে দিয়েছে। কিন্তু সেই দেশটি এখন কোভিড প্যানডেমিকের ‘গ্রাউন্ড জিরো’ বা কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। গত প্রায় দু সপ্তাহ ধরে খোদ রাজধানী দিল্লিসহ ভারতের অনেকগুলো জায়গায় সংক্রমণ নাগালের বাইরে চলে গেছে। সেই সাথে চলছে মৃত্যুর মিছিল। গতকাল শুক্রবার দেওয়া সরকারি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে গত ২৪ ঘন্টায় আরো নতুন সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩,৮৬,৪৫২ জন যেটি একদিনে সংক্রমণের আরো একটি নতুন রেকর্ড। এই সময়ে মারা গেছে প্রায় ৩৫০০ জন। মার্কিন সাময়িকী দ্য আটলান্টিকের এক রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছে, ”ভারতে এখন সংক্রমণের ঢেউ নয়, খাড়া উঁচু দেয়াল তৈরি হয়েছে।” এবং এই দেয়াল যে খুব সহসা নিচু হবে সে সম্ভাবনা বিশেষজ্ঞরা দেখছেন না, বরঞ্চ তারা বলছেন সামনের দিনগুলোতে এটির উচ্চতা বাড়তেই থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের রোগতত্ত্ববিদ ভ্রমর মুখার্জিকে উদ্ধৃত করে আটলান্টিক বলছে সামনের মাসে এই সময়ে ভারতে কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা দিনে ৪,৫০০ হতে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন তা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। দিল্লিতে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক মার্কিন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ ডাইনামিকস, ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিসির পরিচালক ড. রামানান লক্ষ্মীনারায়ণ বিবিসিকে বলেন এই মাপের মানবিক বিপর্যয় তিনি তার জীবনে আগে দেখেননি। ”হাসপাতালে মানুষ শুধু অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে। এ ঘটনা তো অত্যন্ত দরিদ্র দেশে হয়। এই ট্রাজেডি ঘটছে দিল্লির মত শহরে। গ্রামাঞ্চলে মানুষের পরিণতি তাহলে কি হচ্ছে অনুমান করতে পারেন!”
প্রশ্ন হচ্ছে কেন ভারতে এই পরিস্থিতি তৈরি হলো? এর জন্য কি ভারতে শনাক্ত নতুন ধরনের করোনাভাইরাস-যেটিকে ‘ভারত ভ্যারিয়েন্ট‘ বলা হচ্ছে – সেটিই প্রধানত দায়ী, নাকি সাধারণ মানুষের এবং সরকারের অসতর্কতা এবং অবহেলার ফলে এই পরিণতি? নাকি এই ট্রাজেডির পেছনে রয়েছে ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশা? এসব প্রশ্ন নিয়ে জোর বিতর্ক শুরু হয়েছে। কিন্তু সেই সাথে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে ভারতে কোভিডের এই লাগামহীন তাণ্ডবের প্রভাব বাকি বিশ্বের ওপর কীভাবে পড়বে বা পড়ছে?
অর্ধেক পৃথিবীর টিকা কর্মসূচি হুমকিতে:
শুধু বিশেষজ্ঞরাই নয়, বিশ্বের রাজনীতিকরাও বুঝতে পারছেন যে, যার দোষেই তা হোক না কেন ভারতে কোভিডের এই মহামারি বাকি বিশ্বের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে। প্রথম কথা, বিশ্বের অর্ধেক দেশের – যার মধ্যে ভারতের প্রতিবেশী বাংলাদেশও রয়েছে – টিকা কর্মসূচি বড় ধরণের হুমকিতে পড়েছে। ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী দেশ। ঐ একটি দেশেই বিশ্বের ৬০ শতাংশ ভ্যাকসিন তৈরি হয়। মাসে সাত কোটি ডোজ ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষমতা রয়েছে ভারতে। সে কারণে বিশ্বের ৯২টি দেশ অপেক্ষা করে ছিল যে তাদের ভ্যাকসিনের চালান আসবে ভারত থেকে। বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর জন্য সস্তায় বা বিনা মূল্যে কোভিড ভ্যাকসিন সরবরাহরে জন্য কোভ্যাক্স নামে আন্তর্জাতিক যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, ভারত সেখানে ২০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু প্রথমে কাঁচামালের অভাবে সিরামের কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়া এবং তারপর বর্তমান পরিস্থিতির জেরে নিজের প্রয়োজনের বিবেচনায় ভারত সরকার টিকা রপ্তানি সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ভারতে এখন দিনে ৩০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া দিচ্ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন জনগণকে বাঁচাতে তাদের এখন দিনে কমপক্ষে তিনগুণ বেশি টিকা দিতে হবে। উদ্বিগ্ন ভারত সরকার সম্প্রতি ঘোষণা করেছে ১৮ বছরের বেশি যে কেউই টিকা নেওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন, এবং জানা গেছে গত কয়েকদিন ধরে মানুষজন অনলাইনে গিয়ে পাগলের মত রেজিস্ট্রেশন করছেন। আর এর অর্থ হলো যে নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে ভারত আবার কবে ভ্যাকসিন রপ্তানি করবে তা অনিশ্চিত। ভারত ভ্যাকসিন রপ্তানি স্থগিত করার পর আফ্রিকার রোগ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক জন এনকেনগাসন বলেন ভারতের এই সিদ্ধান্ত তাদের মহাদেশের ভ্যাকসিন কর্মসূচির জন্য ‘সর্বনাশ‘ বয়ে আনবে। আফ্রিকার সিংহভাগ দেশই কোভ্যাক্স থেকে তাদের সরবরাহ পাচ্ছে। ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত ভারত থেকে সেখানে দুই কোটি ৮০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিনের চালান আসে। মার্চ এবং এপ্রিলে আরো নয় কোটি ডোজ আসার কথা ছিল, কিন্তু তা এখন অনিশ্চিত। যুক্তরাষ্ট্রের মারকেটাস জর্জ মেসন ইউনিভার্সিটির ড শ্রুতি রাজাগোপালান সিএনএনকে বলেছেন, ভারতের এই পরিস্থিতির জন্য বিশ্বের টিকা কর্মসূচি অন্তত কয়েক মাসের জন্য পিছিয়ে যাবে।
পাশের দেশ বাংলাদেশের টিকা কর্মসূচিও সংকটে পড়েছে। সেখানে প্রথম ডোজ টিকা আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এমনকি দ্বিতীয় ডোজ সম্পন্ন করতে প্রয়োজনীয় যে প্রায় ১৩ লাখ ডোজের জন্য ভারতের ওপর ভরসা করে বসেছিল বাংলাদেশ, তা পাওয়ার সম্ভাবনা এখন প্রায় শূন্য। ফলে, সময়মত সবাই দ্বিতীয় ডোজ পাবেন কিনা তা পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। মরিয়া হয়ে চীন এবং রাশিয়া থেকে টিকা কেনার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ, কিন্তু সময় কত লাগবে বলা কঠিন। ভ্যাকসিনের সংকটের পাশাপাশি আরো যে উদ্বেগ বিশ্বজুড়ে তৈরি হয়েছে তা হলো ভারতে এই আগুনের মত ছড়িয়ে পড়া সংক্রমণের পেছনে সেদেশে শনাক্ত নতুন ধরনের করোনাভাইরাস – যেটিকে বলা হচ্ছে ‘ভারত ভ্যারিয়েন্ট‘- সেটিই দায়ী কিনা? দুই বার মিউটেট করা অর্থাৎ পরিবর্তিত নতুন এই করোনাভাইরাস-ই কি এত মৃত্যুর কারণ? যে সব ভ্যাকসিন বাজারে রয়েছে সেগুলো কি এর বিরুদ্ধে কাজ করবে?
বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। কারণ হিসাবে তারা বলছেন, ভারত যথেষ্ট ‘সিকোয়েন্সিং’ করছে না বা করতে পারছে না বলে এখনও বোঝা যাচ্ছেনা যে ‘ভারত ভ্যারিয়েন্ট’ ঠিক কতটা সংক্রামক এবং কতটা বিপজ্জনক। তবে ‘ভারত ভ্যারিয়েন্ট’ যে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে তার আলামত স্পষ্ট। এখন পর্যন্ত বিশটির মত দেশে এটি শনাক্ত হয়েছে যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনও রয়েছে। বাংলাদেশ এখনও এ নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না, তবে নতুন ধরনের এই ভাইরাসটি আটকাতে ভারতের সাথে দুই সপ্তাহের জন্য সীমান্ত বন্ধ রাখা হয়েছে। ঢাকার শীর্ষ একজন ভাইরোলজিস্ট এবং সরকারের কোভিড বিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ভারত থেকে ভাইরাসটি আসা বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব। ”সীমান্ত বন্ধ করে হয়তো কিছুটা বিলম্ব করানো যাবে, কিন্তু ভাইরাস ঠেকানো সম্ভব নয়।” তাহলে বাংলাদেশের সামনে এখন বিকল্প কী? তার উত্তর ছিল, ”সতর্ক থাকতে হবে, ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, এবং সবচেয়ে বড় কথা মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। শতভাগ মানুষ যেন বাইরে মাস্ক পরে। এসবই এই মুহূর্তে আমাদের একমাত্র করণীয়।” বিশ্বের অনেক বিশেষজ্ঞের মত ড. ইসলামও মনে করেন ভারতে যেভাবে সংক্রমণ ছড়িয়েছে তার প্রধান কারণ ছিল অবহেলা, অসতর্কতা। ”ভারত মনে করেছিল তারা বিপদ কাটিয়ে উঠেছে। নির্বাচন করেছে। জনসমাবেশ করেছে। এবং তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ভোগ করছে। অবিশ্বাস্য বিশৃঙ্খলতা।” এত মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসাবে ডা. ইসলাম প্রধানত দায়ী করেন ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে। ”মানুষতো অক্সিজেনের জন্য মারা যাচ্ছে। দিল্লিতে শুধু অক্সিজেনের অভাবে ২৫ জন মারা গেছে, ভাবতে পারেন।”
নজরুল ইসলাম মনে করেন বাংলাদেশে ‘ভারত ভ্যারিয়েন্ট’ ঢুকলেও পরিস্থিতি হয়ত ততটা ভয়াবহ হবেনা, কারণ ”অতটা বিশৃঙ্খল আচরণ এখন বাংলাদেশে নেই। মানুষজন অপেক্ষাকৃত সচেতন হতে শুরু করেছে।’ তারপরও তিনি বলেন, ভারতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশকে অবশ্যই চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখতে হবে, অক্সিজেনের উৎপাদন এবং মজুদ নিশ্চিত করতে হবে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

ভারতে কোভিড সুনামি : হুমকিতে বাংলাদেশ?

আপলোড টাইম : ০৯:১০:১৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১ মে ২০২১

সমীকরণ প্রতিবেদন:
কয়েক সপ্তাহ আগেও ভারত ভেবেছিল যে তারা করোনাভাইরাসের আপদ দূর করে দিয়েছে। কিন্তু সেই দেশটি এখন কোভিড প্যানডেমিকের ‘গ্রাউন্ড জিরো’ বা কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। গত প্রায় দু সপ্তাহ ধরে খোদ রাজধানী দিল্লিসহ ভারতের অনেকগুলো জায়গায় সংক্রমণ নাগালের বাইরে চলে গেছে। সেই সাথে চলছে মৃত্যুর মিছিল। গতকাল শুক্রবার দেওয়া সরকারি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে গত ২৪ ঘন্টায় আরো নতুন সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩,৮৬,৪৫২ জন যেটি একদিনে সংক্রমণের আরো একটি নতুন রেকর্ড। এই সময়ে মারা গেছে প্রায় ৩৫০০ জন। মার্কিন সাময়িকী দ্য আটলান্টিকের এক রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছে, ”ভারতে এখন সংক্রমণের ঢেউ নয়, খাড়া উঁচু দেয়াল তৈরি হয়েছে।” এবং এই দেয়াল যে খুব সহসা নিচু হবে সে সম্ভাবনা বিশেষজ্ঞরা দেখছেন না, বরঞ্চ তারা বলছেন সামনের দিনগুলোতে এটির উচ্চতা বাড়তেই থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের রোগতত্ত্ববিদ ভ্রমর মুখার্জিকে উদ্ধৃত করে আটলান্টিক বলছে সামনের মাসে এই সময়ে ভারতে কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা দিনে ৪,৫০০ হতে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন তা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। দিল্লিতে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক মার্কিন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ ডাইনামিকস, ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিসির পরিচালক ড. রামানান লক্ষ্মীনারায়ণ বিবিসিকে বলেন এই মাপের মানবিক বিপর্যয় তিনি তার জীবনে আগে দেখেননি। ”হাসপাতালে মানুষ শুধু অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে। এ ঘটনা তো অত্যন্ত দরিদ্র দেশে হয়। এই ট্রাজেডি ঘটছে দিল্লির মত শহরে। গ্রামাঞ্চলে মানুষের পরিণতি তাহলে কি হচ্ছে অনুমান করতে পারেন!”
প্রশ্ন হচ্ছে কেন ভারতে এই পরিস্থিতি তৈরি হলো? এর জন্য কি ভারতে শনাক্ত নতুন ধরনের করোনাভাইরাস-যেটিকে ‘ভারত ভ্যারিয়েন্ট‘ বলা হচ্ছে – সেটিই প্রধানত দায়ী, নাকি সাধারণ মানুষের এবং সরকারের অসতর্কতা এবং অবহেলার ফলে এই পরিণতি? নাকি এই ট্রাজেডির পেছনে রয়েছে ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশা? এসব প্রশ্ন নিয়ে জোর বিতর্ক শুরু হয়েছে। কিন্তু সেই সাথে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে ভারতে কোভিডের এই লাগামহীন তাণ্ডবের প্রভাব বাকি বিশ্বের ওপর কীভাবে পড়বে বা পড়ছে?
অর্ধেক পৃথিবীর টিকা কর্মসূচি হুমকিতে:
শুধু বিশেষজ্ঞরাই নয়, বিশ্বের রাজনীতিকরাও বুঝতে পারছেন যে, যার দোষেই তা হোক না কেন ভারতে কোভিডের এই মহামারি বাকি বিশ্বের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে। প্রথম কথা, বিশ্বের অর্ধেক দেশের – যার মধ্যে ভারতের প্রতিবেশী বাংলাদেশও রয়েছে – টিকা কর্মসূচি বড় ধরণের হুমকিতে পড়েছে। ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী দেশ। ঐ একটি দেশেই বিশ্বের ৬০ শতাংশ ভ্যাকসিন তৈরি হয়। মাসে সাত কোটি ডোজ ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষমতা রয়েছে ভারতে। সে কারণে বিশ্বের ৯২টি দেশ অপেক্ষা করে ছিল যে তাদের ভ্যাকসিনের চালান আসবে ভারত থেকে। বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর জন্য সস্তায় বা বিনা মূল্যে কোভিড ভ্যাকসিন সরবরাহরে জন্য কোভ্যাক্স নামে আন্তর্জাতিক যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, ভারত সেখানে ২০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু প্রথমে কাঁচামালের অভাবে সিরামের কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়া এবং তারপর বর্তমান পরিস্থিতির জেরে নিজের প্রয়োজনের বিবেচনায় ভারত সরকার টিকা রপ্তানি সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ভারতে এখন দিনে ৩০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া দিচ্ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন জনগণকে বাঁচাতে তাদের এখন দিনে কমপক্ষে তিনগুণ বেশি টিকা দিতে হবে। উদ্বিগ্ন ভারত সরকার সম্প্রতি ঘোষণা করেছে ১৮ বছরের বেশি যে কেউই টিকা নেওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন, এবং জানা গেছে গত কয়েকদিন ধরে মানুষজন অনলাইনে গিয়ে পাগলের মত রেজিস্ট্রেশন করছেন। আর এর অর্থ হলো যে নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে ভারত আবার কবে ভ্যাকসিন রপ্তানি করবে তা অনিশ্চিত। ভারত ভ্যাকসিন রপ্তানি স্থগিত করার পর আফ্রিকার রোগ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক জন এনকেনগাসন বলেন ভারতের এই সিদ্ধান্ত তাদের মহাদেশের ভ্যাকসিন কর্মসূচির জন্য ‘সর্বনাশ‘ বয়ে আনবে। আফ্রিকার সিংহভাগ দেশই কোভ্যাক্স থেকে তাদের সরবরাহ পাচ্ছে। ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত ভারত থেকে সেখানে দুই কোটি ৮০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিনের চালান আসে। মার্চ এবং এপ্রিলে আরো নয় কোটি ডোজ আসার কথা ছিল, কিন্তু তা এখন অনিশ্চিত। যুক্তরাষ্ট্রের মারকেটাস জর্জ মেসন ইউনিভার্সিটির ড শ্রুতি রাজাগোপালান সিএনএনকে বলেছেন, ভারতের এই পরিস্থিতির জন্য বিশ্বের টিকা কর্মসূচি অন্তত কয়েক মাসের জন্য পিছিয়ে যাবে।
পাশের দেশ বাংলাদেশের টিকা কর্মসূচিও সংকটে পড়েছে। সেখানে প্রথম ডোজ টিকা আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এমনকি দ্বিতীয় ডোজ সম্পন্ন করতে প্রয়োজনীয় যে প্রায় ১৩ লাখ ডোজের জন্য ভারতের ওপর ভরসা করে বসেছিল বাংলাদেশ, তা পাওয়ার সম্ভাবনা এখন প্রায় শূন্য। ফলে, সময়মত সবাই দ্বিতীয় ডোজ পাবেন কিনা তা পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। মরিয়া হয়ে চীন এবং রাশিয়া থেকে টিকা কেনার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ, কিন্তু সময় কত লাগবে বলা কঠিন। ভ্যাকসিনের সংকটের পাশাপাশি আরো যে উদ্বেগ বিশ্বজুড়ে তৈরি হয়েছে তা হলো ভারতে এই আগুনের মত ছড়িয়ে পড়া সংক্রমণের পেছনে সেদেশে শনাক্ত নতুন ধরনের করোনাভাইরাস – যেটিকে বলা হচ্ছে ‘ভারত ভ্যারিয়েন্ট‘- সেটিই দায়ী কিনা? দুই বার মিউটেট করা অর্থাৎ পরিবর্তিত নতুন এই করোনাভাইরাস-ই কি এত মৃত্যুর কারণ? যে সব ভ্যাকসিন বাজারে রয়েছে সেগুলো কি এর বিরুদ্ধে কাজ করবে?
বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। কারণ হিসাবে তারা বলছেন, ভারত যথেষ্ট ‘সিকোয়েন্সিং’ করছে না বা করতে পারছে না বলে এখনও বোঝা যাচ্ছেনা যে ‘ভারত ভ্যারিয়েন্ট’ ঠিক কতটা সংক্রামক এবং কতটা বিপজ্জনক। তবে ‘ভারত ভ্যারিয়েন্ট’ যে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে তার আলামত স্পষ্ট। এখন পর্যন্ত বিশটির মত দেশে এটি শনাক্ত হয়েছে যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনও রয়েছে। বাংলাদেশ এখনও এ নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না, তবে নতুন ধরনের এই ভাইরাসটি আটকাতে ভারতের সাথে দুই সপ্তাহের জন্য সীমান্ত বন্ধ রাখা হয়েছে। ঢাকার শীর্ষ একজন ভাইরোলজিস্ট এবং সরকারের কোভিড বিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ভারত থেকে ভাইরাসটি আসা বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব। ”সীমান্ত বন্ধ করে হয়তো কিছুটা বিলম্ব করানো যাবে, কিন্তু ভাইরাস ঠেকানো সম্ভব নয়।” তাহলে বাংলাদেশের সামনে এখন বিকল্প কী? তার উত্তর ছিল, ”সতর্ক থাকতে হবে, ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, এবং সবচেয়ে বড় কথা মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। শতভাগ মানুষ যেন বাইরে মাস্ক পরে। এসবই এই মুহূর্তে আমাদের একমাত্র করণীয়।” বিশ্বের অনেক বিশেষজ্ঞের মত ড. ইসলামও মনে করেন ভারতে যেভাবে সংক্রমণ ছড়িয়েছে তার প্রধান কারণ ছিল অবহেলা, অসতর্কতা। ”ভারত মনে করেছিল তারা বিপদ কাটিয়ে উঠেছে। নির্বাচন করেছে। জনসমাবেশ করেছে। এবং তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ভোগ করছে। অবিশ্বাস্য বিশৃঙ্খলতা।” এত মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসাবে ডা. ইসলাম প্রধানত দায়ী করেন ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে। ”মানুষতো অক্সিজেনের জন্য মারা যাচ্ছে। দিল্লিতে শুধু অক্সিজেনের অভাবে ২৫ জন মারা গেছে, ভাবতে পারেন।”
নজরুল ইসলাম মনে করেন বাংলাদেশে ‘ভারত ভ্যারিয়েন্ট’ ঢুকলেও পরিস্থিতি হয়ত ততটা ভয়াবহ হবেনা, কারণ ”অতটা বিশৃঙ্খল আচরণ এখন বাংলাদেশে নেই। মানুষজন অপেক্ষাকৃত সচেতন হতে শুরু করেছে।’ তারপরও তিনি বলেন, ভারতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশকে অবশ্যই চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখতে হবে, অক্সিজেনের উৎপাদন এবং মজুদ নিশ্চিত করতে হবে।