ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ভাগ্যান্বেষণে মরণযাত্রা!

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:২৩:০২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ মে ২০১৯
  • / ২৪৭ বার পড়া হয়েছে

37 Bangladeshi migrants reportedly drown off Tunisia coast

ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবি : ৩৭ বাংলাদেশিসহ নিহত ৬০ : জীবিত উদ্ধার ১৪
সমীকরণ প্রতিবেদন:
‘হঠাৎ করে নৌকাটি ডুবে যায়। মুহূর্তে শুরু হয় হুড়োহুড়ি। দেখতে না দেখতেই ভূমধ্যসাগরের ঠা-া পানিতে আমার আশপাশের অনেক মানুষ তলিয়ে যায়। আমার চোখের সামনে আমার দুই আত্মীয় ভেসে গেল সাগরে। আমি নিজেও প্রায় ডুবে যাচ্ছিলাম। বাঁচার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি, এ সময় একটি জেলে নৌকা এসে আমিসহ কয়েকজনকে উদ্ধার করে।’ সাংবাদিকদের সামনে এভাবেই ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন ভয়াবহ নৌকাডুবির পর প্রাণে বেঁচে যাওয়া বাংলাদেশের সিলেটের ছেলে বিল্লাল আহমেদ।
মর্মান্তিক এ ঘটনার বর্ণনা দেয়ার সময় কোনোভাবেই কান্না থামাতে পারছিলেন না ৩০ বছর বয়সী বিল্লাল। তার মতো আরো অনেকেই ভাগ্যের অন্বেষণে অবৈধভাবে সমুদ্র পথে লিবিয়া থেকে ইউরোপের দেশ ইটালিতে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এ লক্ষ্যে গত বৃহস্পতিবার লিবিয়ার জুয়াড়া নামের এক এলাকা থেকে সাগরে নৌকা ভাসান। তিউনিসিয়ার কাছাকাছি গিয়ে বড় নৌকা থেকে তাদের তুলনামূলক ছোট একটি নৌকায় তোলা হয়। এ সময় অতিরিক্ত ওজনের চাপে বিভিন্ন দেশের ৭৫ জন অভিবাসীপ্রার্থীসহ নৌকাটি ডুবে যায়। এতে ৬০ জন নিহত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নৌকায় ৫১ জন বাংলাদেশি, ৩ জন মিসরীয় ও কয়েকজন ছিল মরক্কোর নাগরিক। পরে উদ্ধারকর্মী ও জেলেরা সাগর থেকে ১৪ জন বাংলাদেশিকে উদ্ধার করলেও বাকি ৩৭ বাংলাদেশির কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তারা সবাই নিহত হয়েছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ও আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলো। এদিকে উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশি নাগরিকদের ফেরত আনতে বাংলাদেশ থেকে একটি প্রতিনিধি দল পাঠানো হচ্ছে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন সংবাদিকদের জানিয়েছেন। তিনি আরো জানান, তিউনিসিয়ায় বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস না থাকায় সঠিক তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে লিবিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ সিকান্দার আলি দূতাবাসের একজন কর্মকর্তাকে ইতোমধ্যেই তিউনিসিয়া পাঠিয়েছেন। উদ্ধার অভিযান নিয়ে তিউনিসিয়ার রেড ক্রিসেন্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে, জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এর আগে চলতি বছরের প্রথম ৪ মাসে নৌকা ডুবে ১৬৪ জন মারা গেছে বলে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার তথ্য রয়েছে। গত জানুয়ারি মাসের এক নৌকাডুবির ঘটনাতেই ১১৭ জন নিখোঁজ হয়। ২০০৫ সালেও এই ভূমধ্যসাগরের আলজেরিয়া উপকূলে মর্মান্তিক একটি নৌকা থেকে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি নাগরিককে আলজেরিয়ার কোস্টগার্ড উদ্ধার করে। তবে উদ্ধারের আগে অনাহারে সেবার দুই সহোদরসহ ১২ জন বাংলাদেশি নাগরিক মারা যায়। উদ্ধার হওয়া বিল্লাল এখন তিউনিসিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলীয় শহর জার্জিসে রেড ক্রিসেন্টের একটি জরুরি আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই পেয়েছেন। বিল্লাল তার স্বপ্নযাত্রার বর্ণনা দিয়ে বলেন, বিদেশ সমন্ধে কোনো পূর্বধারণা ছিল না তার। স্বপ্নের বাস্তবায়নের জন্য তার বাবা জমি বিক্রি করে পাঁচ লাখ ৯০ হাজার টাকা দালালের হাতে তুলে দেন। ছয় মাস আগে তিনি ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঘর ছাড়েন। এরপর নিদারুণ কষ্টের মধ্য দিয়ে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত পৌঁছেন। ত্রিপোলিতে দালালরা তাদের একটি আস্তানায় নিয়ে গেলে আরো প্রায় ৮০ জন বাংলাদেশির সঙ্গে তাদের দেখা হয়। তাদের সবাইকে পশ্চিম লিবিয়ার একটি কক্ষে তিন মাস আটকে রাখা হয়। সেখানেও এক দুঃসহ জীবন। এরপর গত বৃহস্পতিবার উত্তর লিবিয়া জুয়াড়া নামক উপকূলীয় এলাকা থেকে বড় একটি নৌকায় তুলে ইউরোপের উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয়। ওই নৌকাটি তিউনিসিয়া উপকূলে পৌঁছানোর পর রাবারের একটি ছোট নৌকায় তোলার সময়ই দুর্ঘটনা ঘটে।
লিবিয়ায় থাকার অভিজ্ঞতার বর্ণনা করে বিল্লাল আহমেদ আরো বলেন, আমি ভেবেছিলাম আমি লিবিয়াতেই মারা যাব। একটি ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হতো। দিনে একবার খাবার দেয়া হতো। কোনো দিন খাবার জুটত না। খাবারের জন্য কাঁদতাম। ৮০ জন মানুষের জন্য একটি টয়লেট ছিল। গোসল করতে পারতাম না। বিল্লালের মতো একই বর্ণনা দিয়েছেন উদ্ধার হওয়া মিসরের অভিবাসী ২১ বছর বয়সী মানজুর মোহাম্মদ মেতওয়ালা। তিনি জানান, ওই নৌকায় সবাই পুরুষ ছিল। ছোট নৌকায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই নৌকাটি ডুবে যায়। আমরা সারারাত সাগরের ঠা-া জলে সাঁতার কেটেছি। ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনায় কতজন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, শনিবার লিবিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত যে বার্তা পাটিয়েছেন, তাতে জানানো হয়েছে, ওই নৌকায় ৫১ জন বাংলাদেশি ছিল। উদ্ধার হওয়া ১৬ জনের মধ্যে ১৪ জন বাংলাদেশি নাগরিক রয়েছে। সে হিসাবে ৩৭ জন বাংলাদেশি নিহত হওয়ার কথা জানতে পেরেছি। তবে এই সংখ্যার বিষয়ে আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি।
লিবিয়াতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সিকান্দার আলি জানিয়েছেন, দূতাবাস থেকে নৌকাডুবির ঘটনার ব্যাপারে খোঁজ নেয়া হচ্ছে। তবে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে যুদ্ধাবস্থা জারি থাকায় যাত্রা বিলম্বিত হচ্ছে। তিউনিস প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, নৌকাডুবির পর তিউনিস সেনাবাহিনী অভিবাসীদের উদ্ধারে একটি মাছ ধরার নৌযান নিয়ে ঘটনাস্থলে যায়। তারা জীবিতদের পাশাপাশি ৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করে। তিউনিসিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা টিএপির তথ্য অনুযায়ী ডুবে যাওয়া নৌকায় ৭০ জনেরও বেশি অভিবাসী ছিল। সি ফ্যাক্স উপকূলের ৪০ নটিক্যাল মাইল দূরে নৌকাটি ডুবে যায়। দেশটির রাজধানী তিউনিস থেকে ওই জায়গার দূরত্ব প্রায় ২৭০ কিলোমিটার।
এদিকে, ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ৪ যুবকের সলিল সমাধি ঘটেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। নিহতদের পরিবারে এখন শোকের মাতম চলছে। এ ছাড়া আরো দু’জন নিখোঁজ রয়েছে তাদের স্বজনদের কাছে খবর এসেছে। তারা হলেন ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মহিদপুর গ্রামের সিরাজ মিয়ার ছেলে লিটন আহমদ (২৪), মনতু মিয়ার ছেলে আহমদ মিয়া (২৫), একই গ্রামের হারুন মিয়ার ছেলে আবদুল আজিজ (২৪) ও মানিককুনা গ্রামের আফজাল মাহমুদের ছেলের মৃত্যুর খবর তারা পেয়েছেন। আজিজের ভাই মফিজুর রহমান জানান, তার চাচা মুয়িদপুর গ্রামের দিলাল আহমদ ফোনে নৌকাডুবির ঘটনা জানিয়েছেন। আহসান হাবিব শামিম ও কামরান আহমেদ মারুফ নামের অপর দুই যুবক নিখোঁজ রয়েছে। আহসান হাবিব শামীম সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদের ভাই। মৌলভীবাজার জেলার কুলাউরায় তার গ্রামের বাড়ি। আর কামরান আহমেদ মারুফ তার শ্যালক। শামীমের মামা ইউপি সদস্য সাহেদ আহম্মদ জানান, শামীমরা ৭ ভাই, ৩ বোন। এর মধ্যে ২ ভাই ফ্রান্স, ১ ভাই সৌদি আরব ও ১ ভাই আরব আমিরাতে থাকে। এক ভাই শাহরিয়ার আলম সামাদ সিলেটে থাকে। শামীম সবার ছোট ছিল। নিহত শামীমের বড় ভাই শাহরিয়ার আলম জানান, ইতালিতে যাওয়ার জন্য তিন মাস আগে শামীম বাড়ি থেকে বের হয়। পরে লিবিয়া হয়ে সাগর পথে ইতালি যাওয়ার সময় নৌকাডুবিতে সে মারা যায়। নিহত মারুফ সিলেটের গোলাপগঞ্জের শরীফগঞ্জ ইউনিয়নের কুদুপুর গ্রামের ইয়াকুব আলির ছোট ছেলে। মারুফের সঙ্গে একই নৌকায় থাকা মাছুম আহমেদের বরাত দিয়ে তার বড় ভাই মাসুদ আহমেদ জানিয়েছেন, মারুফকে বাঁচানোর জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। সাগরে ডুবে গেছে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

ভাগ্যান্বেষণে মরণযাত্রা!

আপলোড টাইম : ১০:২৩:০২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ মে ২০১৯

ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবি : ৩৭ বাংলাদেশিসহ নিহত ৬০ : জীবিত উদ্ধার ১৪
সমীকরণ প্রতিবেদন:
‘হঠাৎ করে নৌকাটি ডুবে যায়। মুহূর্তে শুরু হয় হুড়োহুড়ি। দেখতে না দেখতেই ভূমধ্যসাগরের ঠা-া পানিতে আমার আশপাশের অনেক মানুষ তলিয়ে যায়। আমার চোখের সামনে আমার দুই আত্মীয় ভেসে গেল সাগরে। আমি নিজেও প্রায় ডুবে যাচ্ছিলাম। বাঁচার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি, এ সময় একটি জেলে নৌকা এসে আমিসহ কয়েকজনকে উদ্ধার করে।’ সাংবাদিকদের সামনে এভাবেই ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন ভয়াবহ নৌকাডুবির পর প্রাণে বেঁচে যাওয়া বাংলাদেশের সিলেটের ছেলে বিল্লাল আহমেদ।
মর্মান্তিক এ ঘটনার বর্ণনা দেয়ার সময় কোনোভাবেই কান্না থামাতে পারছিলেন না ৩০ বছর বয়সী বিল্লাল। তার মতো আরো অনেকেই ভাগ্যের অন্বেষণে অবৈধভাবে সমুদ্র পথে লিবিয়া থেকে ইউরোপের দেশ ইটালিতে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এ লক্ষ্যে গত বৃহস্পতিবার লিবিয়ার জুয়াড়া নামের এক এলাকা থেকে সাগরে নৌকা ভাসান। তিউনিসিয়ার কাছাকাছি গিয়ে বড় নৌকা থেকে তাদের তুলনামূলক ছোট একটি নৌকায় তোলা হয়। এ সময় অতিরিক্ত ওজনের চাপে বিভিন্ন দেশের ৭৫ জন অভিবাসীপ্রার্থীসহ নৌকাটি ডুবে যায়। এতে ৬০ জন নিহত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নৌকায় ৫১ জন বাংলাদেশি, ৩ জন মিসরীয় ও কয়েকজন ছিল মরক্কোর নাগরিক। পরে উদ্ধারকর্মী ও জেলেরা সাগর থেকে ১৪ জন বাংলাদেশিকে উদ্ধার করলেও বাকি ৩৭ বাংলাদেশির কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তারা সবাই নিহত হয়েছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ও আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলো। এদিকে উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশি নাগরিকদের ফেরত আনতে বাংলাদেশ থেকে একটি প্রতিনিধি দল পাঠানো হচ্ছে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন সংবাদিকদের জানিয়েছেন। তিনি আরো জানান, তিউনিসিয়ায় বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস না থাকায় সঠিক তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে লিবিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ সিকান্দার আলি দূতাবাসের একজন কর্মকর্তাকে ইতোমধ্যেই তিউনিসিয়া পাঠিয়েছেন। উদ্ধার অভিযান নিয়ে তিউনিসিয়ার রেড ক্রিসেন্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে, জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এর আগে চলতি বছরের প্রথম ৪ মাসে নৌকা ডুবে ১৬৪ জন মারা গেছে বলে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার তথ্য রয়েছে। গত জানুয়ারি মাসের এক নৌকাডুবির ঘটনাতেই ১১৭ জন নিখোঁজ হয়। ২০০৫ সালেও এই ভূমধ্যসাগরের আলজেরিয়া উপকূলে মর্মান্তিক একটি নৌকা থেকে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি নাগরিককে আলজেরিয়ার কোস্টগার্ড উদ্ধার করে। তবে উদ্ধারের আগে অনাহারে সেবার দুই সহোদরসহ ১২ জন বাংলাদেশি নাগরিক মারা যায়। উদ্ধার হওয়া বিল্লাল এখন তিউনিসিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলীয় শহর জার্জিসে রেড ক্রিসেন্টের একটি জরুরি আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই পেয়েছেন। বিল্লাল তার স্বপ্নযাত্রার বর্ণনা দিয়ে বলেন, বিদেশ সমন্ধে কোনো পূর্বধারণা ছিল না তার। স্বপ্নের বাস্তবায়নের জন্য তার বাবা জমি বিক্রি করে পাঁচ লাখ ৯০ হাজার টাকা দালালের হাতে তুলে দেন। ছয় মাস আগে তিনি ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঘর ছাড়েন। এরপর নিদারুণ কষ্টের মধ্য দিয়ে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত পৌঁছেন। ত্রিপোলিতে দালালরা তাদের একটি আস্তানায় নিয়ে গেলে আরো প্রায় ৮০ জন বাংলাদেশির সঙ্গে তাদের দেখা হয়। তাদের সবাইকে পশ্চিম লিবিয়ার একটি কক্ষে তিন মাস আটকে রাখা হয়। সেখানেও এক দুঃসহ জীবন। এরপর গত বৃহস্পতিবার উত্তর লিবিয়া জুয়াড়া নামক উপকূলীয় এলাকা থেকে বড় একটি নৌকায় তুলে ইউরোপের উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয়। ওই নৌকাটি তিউনিসিয়া উপকূলে পৌঁছানোর পর রাবারের একটি ছোট নৌকায় তোলার সময়ই দুর্ঘটনা ঘটে।
লিবিয়ায় থাকার অভিজ্ঞতার বর্ণনা করে বিল্লাল আহমেদ আরো বলেন, আমি ভেবেছিলাম আমি লিবিয়াতেই মারা যাব। একটি ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হতো। দিনে একবার খাবার দেয়া হতো। কোনো দিন খাবার জুটত না। খাবারের জন্য কাঁদতাম। ৮০ জন মানুষের জন্য একটি টয়লেট ছিল। গোসল করতে পারতাম না। বিল্লালের মতো একই বর্ণনা দিয়েছেন উদ্ধার হওয়া মিসরের অভিবাসী ২১ বছর বয়সী মানজুর মোহাম্মদ মেতওয়ালা। তিনি জানান, ওই নৌকায় সবাই পুরুষ ছিল। ছোট নৌকায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই নৌকাটি ডুবে যায়। আমরা সারারাত সাগরের ঠা-া জলে সাঁতার কেটেছি। ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনায় কতজন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, শনিবার লিবিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত যে বার্তা পাটিয়েছেন, তাতে জানানো হয়েছে, ওই নৌকায় ৫১ জন বাংলাদেশি ছিল। উদ্ধার হওয়া ১৬ জনের মধ্যে ১৪ জন বাংলাদেশি নাগরিক রয়েছে। সে হিসাবে ৩৭ জন বাংলাদেশি নিহত হওয়ার কথা জানতে পেরেছি। তবে এই সংখ্যার বিষয়ে আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি।
লিবিয়াতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সিকান্দার আলি জানিয়েছেন, দূতাবাস থেকে নৌকাডুবির ঘটনার ব্যাপারে খোঁজ নেয়া হচ্ছে। তবে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে যুদ্ধাবস্থা জারি থাকায় যাত্রা বিলম্বিত হচ্ছে। তিউনিস প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, নৌকাডুবির পর তিউনিস সেনাবাহিনী অভিবাসীদের উদ্ধারে একটি মাছ ধরার নৌযান নিয়ে ঘটনাস্থলে যায়। তারা জীবিতদের পাশাপাশি ৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করে। তিউনিসিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা টিএপির তথ্য অনুযায়ী ডুবে যাওয়া নৌকায় ৭০ জনেরও বেশি অভিবাসী ছিল। সি ফ্যাক্স উপকূলের ৪০ নটিক্যাল মাইল দূরে নৌকাটি ডুবে যায়। দেশটির রাজধানী তিউনিস থেকে ওই জায়গার দূরত্ব প্রায় ২৭০ কিলোমিটার।
এদিকে, ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ৪ যুবকের সলিল সমাধি ঘটেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। নিহতদের পরিবারে এখন শোকের মাতম চলছে। এ ছাড়া আরো দু’জন নিখোঁজ রয়েছে তাদের স্বজনদের কাছে খবর এসেছে। তারা হলেন ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মহিদপুর গ্রামের সিরাজ মিয়ার ছেলে লিটন আহমদ (২৪), মনতু মিয়ার ছেলে আহমদ মিয়া (২৫), একই গ্রামের হারুন মিয়ার ছেলে আবদুল আজিজ (২৪) ও মানিককুনা গ্রামের আফজাল মাহমুদের ছেলের মৃত্যুর খবর তারা পেয়েছেন। আজিজের ভাই মফিজুর রহমান জানান, তার চাচা মুয়িদপুর গ্রামের দিলাল আহমদ ফোনে নৌকাডুবির ঘটনা জানিয়েছেন। আহসান হাবিব শামিম ও কামরান আহমেদ মারুফ নামের অপর দুই যুবক নিখোঁজ রয়েছে। আহসান হাবিব শামীম সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদের ভাই। মৌলভীবাজার জেলার কুলাউরায় তার গ্রামের বাড়ি। আর কামরান আহমেদ মারুফ তার শ্যালক। শামীমের মামা ইউপি সদস্য সাহেদ আহম্মদ জানান, শামীমরা ৭ ভাই, ৩ বোন। এর মধ্যে ২ ভাই ফ্রান্স, ১ ভাই সৌদি আরব ও ১ ভাই আরব আমিরাতে থাকে। এক ভাই শাহরিয়ার আলম সামাদ সিলেটে থাকে। শামীম সবার ছোট ছিল। নিহত শামীমের বড় ভাই শাহরিয়ার আলম জানান, ইতালিতে যাওয়ার জন্য তিন মাস আগে শামীম বাড়ি থেকে বের হয়। পরে লিবিয়া হয়ে সাগর পথে ইতালি যাওয়ার সময় নৌকাডুবিতে সে মারা যায়। নিহত মারুফ সিলেটের গোলাপগঞ্জের শরীফগঞ্জ ইউনিয়নের কুদুপুর গ্রামের ইয়াকুব আলির ছোট ছেলে। মারুফের সঙ্গে একই নৌকায় থাকা মাছুম আহমেদের বরাত দিয়ে তার বড় ভাই মাসুদ আহমেদ জানিয়েছেন, মারুফকে বাঁচানোর জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। সাগরে ডুবে গেছে।