ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ব্যাংকিং খাতকে বাঁচাবে কে? অসহায় অর্থমন্ত্রী

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৬:৩৫:৩৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ মে ২০১৮
  • / ৩২৯ বার পড়া হয়েছে

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের অভিযোগের জবাবে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রাজ্জাক যা বলেছেন, তার সারমর্ম হলো ঋণখেলাপির দায় শুধু ক্ষমতাসীনদের নয়। আমাদের প্রশ্ন হলো, বিএনপির আমলে শুরু হওয়া খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি আওয়ামী লীগ আমলে এসে কমেছে না বেড়েছে? যদি বেড়ে থাকে তার দায় আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে।
দুই দলের এই নালিশ-পাল্টা নালিশের মধ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একটি নতুন তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ব্যাংকের পরিচালকেরা পরস্পর যোগসাজশ করে ঋণ দেওয়ার ফলেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। কিন্তু এসব তথ্যের চেয়েও উদ্বেগজনক হলো, অর্থমন্ত্রী অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেছেন, ‘কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করব জানি না।’ তিনি এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন একটানা সাড়ে নয় বছর। এখন খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন, সেটি যদি না জানেন, তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে?
আমরা লক্ষ করছি, সরকার ফি বছরই জনগণের করের অর্থে মূলধন জোগান দিয়ে সরকারি ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখছে। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকেরা তো ব্যাংকগুলোকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। সরকার বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের জবাবদিহির আওতায় না এনে একই পরিবারের চারজনকে ব্যাংকের পরিচালক এবং একনাগাড়ে নয় বছর পরিচালক পদে থাকার সুযোগ দিয়েছে। এ নিয়ে ব্যাংকার, বিশেষজ্ঞদের আপত্তিও সরকার আমলে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা খাত চলে আইনকানুনের ভিত্তিতে। সেই আইনটিই যদি ত্রুটিপূর্ণ হয় কিংবা পরিচালকদের স্বেচ্ছাচারী হওয়ার পথ প্রশস্ত করে, তখন আর কিছুই করার থাকে না।
অর্থমন্ত্রী আরও স্বীকার করেছেন, আগ্রাসী ব্যাংকিং হয়েছে। ব্যাংকিং আগ্রাসী হোক আর রক্ষণশীল হোক, ব্যাংক থেকে দেওয়া ঋণ তো ফেরত আনতে হবে। ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে ব্যাংকিং আইনের সংস্কার করতে হবে। কিন্তু সরকার আইন সংস্কারের নামে ব্যাংক পরিচালকদের পরস্পর পিঠ চুলকানোর সুযোগ করে দিয়েছে। এখন নিরুপায় হয়ে অর্থমন্ত্রী আহাজারি করছেন। আইন প্রতিপালনের ক্ষেত্রে নজরদারি প্রতিষ্ঠান হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর মতো সেই প্রতিষ্ঠানও সম্ভবত অসহায়। তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। উদাহরণ হিসেবে ফারমার্স ব্যাংকের কথা বলা যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম ধরল, তখন সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে হয়তো ব্যাংকটি এতটা দুরবস্থায় পড়ত না।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা এবং ব্যাংকগুলোর মূলধন বাড়ানো। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থের চেয়ে জাতীয় স্বার্থ অনেক বড়। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাংকিং খাতকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনার বিকল্প নেই। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি সরকার আগ্রাসী নীতি নিয়ে থাকে, তাহলে আদায়ের ক্ষেত্রে কেন নমনীয় হবে? প্রয়োজনে ঋণ আদালত আইন সংশোধন করতে হবে। অনেক ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে যেমন বিচারের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া আছে, ঋণ আদালতের মামলায়ও সেটি করা হোক। তাতে কোনো খেলাপি ঋণগ্রহীতা আদালতে একটি মামলা ঠুকে বছরের পর বছর ঋণ আটকে রাখতে পারবেন না।
অর্থমন্ত্রী অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেই ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা কাটবে না; বরং তাঁকে এই অসহায়ত্ব থেকে বেরিয়ে এসে খেলাপি ঋণ আদায়ে একটি টেকসই কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। কার আমলে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি শুরু হয়েছে, সেই বিতর্কের চেয়েও জরুরি হলো খেলাপি ঋণটি আদায় করা। অন্যথায় ব্যাংকিং খাতের নৈরাজ্য চলতেই থাকবে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

ব্যাংকিং খাতকে বাঁচাবে কে? অসহায় অর্থমন্ত্রী

আপলোড টাইম : ০৬:৩৫:৩৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ মে ২০১৮

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের অভিযোগের জবাবে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রাজ্জাক যা বলেছেন, তার সারমর্ম হলো ঋণখেলাপির দায় শুধু ক্ষমতাসীনদের নয়। আমাদের প্রশ্ন হলো, বিএনপির আমলে শুরু হওয়া খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি আওয়ামী লীগ আমলে এসে কমেছে না বেড়েছে? যদি বেড়ে থাকে তার দায় আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে।
দুই দলের এই নালিশ-পাল্টা নালিশের মধ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একটি নতুন তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ব্যাংকের পরিচালকেরা পরস্পর যোগসাজশ করে ঋণ দেওয়ার ফলেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। কিন্তু এসব তথ্যের চেয়েও উদ্বেগজনক হলো, অর্থমন্ত্রী অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেছেন, ‘কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করব জানি না।’ তিনি এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন একটানা সাড়ে নয় বছর। এখন খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন, সেটি যদি না জানেন, তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে?
আমরা লক্ষ করছি, সরকার ফি বছরই জনগণের করের অর্থে মূলধন জোগান দিয়ে সরকারি ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখছে। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকেরা তো ব্যাংকগুলোকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। সরকার বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের জবাবদিহির আওতায় না এনে একই পরিবারের চারজনকে ব্যাংকের পরিচালক এবং একনাগাড়ে নয় বছর পরিচালক পদে থাকার সুযোগ দিয়েছে। এ নিয়ে ব্যাংকার, বিশেষজ্ঞদের আপত্তিও সরকার আমলে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা খাত চলে আইনকানুনের ভিত্তিতে। সেই আইনটিই যদি ত্রুটিপূর্ণ হয় কিংবা পরিচালকদের স্বেচ্ছাচারী হওয়ার পথ প্রশস্ত করে, তখন আর কিছুই করার থাকে না।
অর্থমন্ত্রী আরও স্বীকার করেছেন, আগ্রাসী ব্যাংকিং হয়েছে। ব্যাংকিং আগ্রাসী হোক আর রক্ষণশীল হোক, ব্যাংক থেকে দেওয়া ঋণ তো ফেরত আনতে হবে। ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে ব্যাংকিং আইনের সংস্কার করতে হবে। কিন্তু সরকার আইন সংস্কারের নামে ব্যাংক পরিচালকদের পরস্পর পিঠ চুলকানোর সুযোগ করে দিয়েছে। এখন নিরুপায় হয়ে অর্থমন্ত্রী আহাজারি করছেন। আইন প্রতিপালনের ক্ষেত্রে নজরদারি প্রতিষ্ঠান হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর মতো সেই প্রতিষ্ঠানও সম্ভবত অসহায়। তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। উদাহরণ হিসেবে ফারমার্স ব্যাংকের কথা বলা যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম ধরল, তখন সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে হয়তো ব্যাংকটি এতটা দুরবস্থায় পড়ত না।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা এবং ব্যাংকগুলোর মূলধন বাড়ানো। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থের চেয়ে জাতীয় স্বার্থ অনেক বড়। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাংকিং খাতকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনার বিকল্প নেই। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি সরকার আগ্রাসী নীতি নিয়ে থাকে, তাহলে আদায়ের ক্ষেত্রে কেন নমনীয় হবে? প্রয়োজনে ঋণ আদালত আইন সংশোধন করতে হবে। অনেক ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে যেমন বিচারের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া আছে, ঋণ আদালতের মামলায়ও সেটি করা হোক। তাতে কোনো খেলাপি ঋণগ্রহীতা আদালতে একটি মামলা ঠুকে বছরের পর বছর ঋণ আটকে রাখতে পারবেন না।
অর্থমন্ত্রী অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেই ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা কাটবে না; বরং তাঁকে এই অসহায়ত্ব থেকে বেরিয়ে এসে খেলাপি ঋণ আদায়ে একটি টেকসই কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। কার আমলে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি শুরু হয়েছে, সেই বিতর্কের চেয়েও জরুরি হলো খেলাপি ঋণটি আদায় করা। অন্যথায় ব্যাংকিং খাতের নৈরাজ্য চলতেই থাকবে।