ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ব্যক্তি ও সংস্থার কবজায় ব্যাংক

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:৩০:১৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩ অক্টোবর ২০২২
  • / ৬ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ প্রতিবেদন: বিশ্বব্যাংক মনে করে দেশের ব্যাংকিং খাত প্রায়ই বিশেষ ব্যক্তি ও সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে। এ জন্য এ খাতে জেঁকে বসেছে অনিয়ম-দুর্নীতি। সম্ভব হচ্ছে না সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। বিশেষ করে ঋণ অনুমোদন, প্রস্তাব যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে প্রভাবশালী এই গোষ্ঠী। এ ছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তি ও ব্যবসায়িক গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। উৎপাদনশীলতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে খেলাপি ঋণ। এর ফলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। জুন-২০২২ পর্যন্ত ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। একই সঙ্গে এটি দেশের ব্যাংক খাতের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, যার বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে। বৃহস্পতিবার ‘বাংলাদেশ কান্ট্রি ইকোনমিক মেমোরেন্ডাম চেঞ্জিং অব ফেব্রিক’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে ও সামষ্টিক অর্থনীতির স্বার্থে খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ওই প্রতিবেদনের একাংশে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা; পরিচালকদের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া; পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা বৃদ্ধি। পরিচালকদের দায়িত্ব পালন ও জবাবদিহির জায়গা তৈরিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং ব্যয়বহুল ব্যাংকের ব্যর্থতা এড়াতে সম্পদের গুণমান উন্নত করতে হবে। এ জন্য দেশের রাষ্ট্রায়ত্তসহ তফসিলি ব্যাংকগুলোকে আরও বেশি জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ইদানীং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত আসছে। যে নীতিমালাগুলো দিচ্ছে সেগুলো ঋণখেলাপিদের আরও উৎসাহিত করছে। অন্যদিকে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন ভালো গ্রাহক। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোও খেলাপি ঋণ আদায়ে বিমুখ হয়ে পড়েছে। কারণ এর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হয় না। পরিচালনা পর্ষদের নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা স্রেফ একটা রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি, যা অবসান হওয়া খুবই জরুরি।

বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক ও বিশেষ গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ থাকলেও বর্তমানে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে, যা সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল ব্যবহার থেকে দুষ্প্রাপ্য আর্থিক সংস্থানকে সরিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো প্রায়ই ব্যক্তি বা সংস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যাদের অ-আর্থিক সংস্থাগুলোতে যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। এ ছাড়া বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর মালিকরা বর্তমানে অনেক ব্যাংকের বোর্ডে বসে আছেন। এ জন্য স্বাধীন পরিচালকের কার্যকারিতা বেশ দুর্বল। যদিও সংশ্লিষ্ট পক্ষের লেনদেনের ওপর কিছু বিধিনিষেধ কাগজে-কলমে বিদ্যমান। সেই বিধিবিধান আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে সর্বোত্তম কার্যক্রম এবং বাস্তবে নিজেদের কার্যকলাপে কয়েকটি বাধা রয়েছে। সেগুলো তারা মানেন না। যেমন একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি পরিচালকদের ঋণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমতি ঠেকাতে এক ব্যাংকের পরিচালকরা অন্য ব্যাংকের ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারেন, যাতে সংশ্লিষ্ট পক্ষ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ না হয়। ব্যাংক খাতে এ ঘটনাটি উদ্বেগজনক জায়গায় পৌঁছেছে। অথচ খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ এটিও। বিশ্বব্যাংকের অনুমানের ভিত্তিতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মোট ঋণের অন্তত ২০ শতাংশ পরিচালকদের দেওয়া হচ্ছে। আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হলে পরিচালকরা অন্যান্য ব্যাংক থেকে সরাসরি বা পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে বা নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আগের ঋণ নিয়মিতকরণ করে দেখাচ্ছেন, যা নিয়ম ও নীতিবহির্ভূত।

খেলাপি ঋণ এক বছরে বেড়েছে ২৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা: বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, জুন-২০২২ পর্যন্ত ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ সোয়া লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ২৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা, যা রীতিমতো উদ্বেগজনক ও ইতিহাসের রেকর্ড।

সূত্র জানায়, গত বছর ডিসেম্বরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। আলোচ্য ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। গত মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বেড়েছে আরও ১১ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। ওই ছয় মাসে বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। গত বছর জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। এক বছরে অর্থাৎ গত বছর জুনের তুলনায় চলতি বছর জুনে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। এর আগেও একবার খেলাপি ঋণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে ছিল। পরে তা আবার কমে আসে। কিন্তু কখনই সোয়া লাখ কোটি টাকা ছাড়ায়নি। এবারই প্রথম খেলাপি ঋণ সোয়া লাখ কোটি ছাড়াল। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখানে একটা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর তা হলো, ব্যাংক খাতে অপেশাদার আচরণ। যারা পরিচালনা পর্ষদে ঢোকেন তারাই অপেশাদার আচরণ করেন। এতে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম প্রভাবিত হয়, যা ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। এতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যায় বলে তিনি মনে করেন।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে সেগুলো নিম্নরূপ: আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। প্রাথমিক আইন, যেমন ব্যাংক কোম্পানি আইন (১৯৯১) এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের (১৯৯৩) ওভারহল সম্পূর্ণ করা উচিত, যাতে এটিকে আন্তর্জাতিক সর্বোত্তম অনুশীলনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করা যায়, যার মধ্যে বাজেটের ন্যূনতম খরচসহ সমস্যা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমাধানের বিধানগুলোয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ আইনের অপারেশনাল স্বাধীনতা বাড়ানো উচিত, যাতে এটি একটি সময়োপযোগী এবং সাশ্রয়ী পদ্ধতিতে সম্ভাব্য ব্যাংক সংকট মোকাবিলা করার জন্য পর্যাপ্ত ক্ষমতা রাখতে সক্ষম হয়। খেলাপি ঋণ কমাতে ও ঋণখেলাপিদের চেনাতে উৎসাহিত করা উচিত এবং বিভিন্ন এনপিএল ক্লাসের জন্য আদালতে ও আদালতের বাইরে রেজোলিউশনের কার্যকর পূর্ণ পরিসরের প্রস্তাব দেওয়া উচিত। দেউলিয়া পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে। এনপিএল রেজোলিউশনের জন্য একটি পাবলিকলি ফান্ডেড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ব্যবহার করার সম্ভাব্যতা ও করপোরেট গভর্ন্যান্স এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে এ-জাতীয় সংস্থাগুলোর দ্বারা কীভাবে কাজ করে সেগুলোর আলোকে বাংলাদেশেও পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

ব্যক্তি ও সংস্থার কবজায় ব্যাংক

আপলোড টাইম : ০৯:৩০:১৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩ অক্টোবর ২০২২

সমীকরণ প্রতিবেদন: বিশ্বব্যাংক মনে করে দেশের ব্যাংকিং খাত প্রায়ই বিশেষ ব্যক্তি ও সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে। এ জন্য এ খাতে জেঁকে বসেছে অনিয়ম-দুর্নীতি। সম্ভব হচ্ছে না সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। বিশেষ করে ঋণ অনুমোদন, প্রস্তাব যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে প্রভাবশালী এই গোষ্ঠী। এ ছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তি ও ব্যবসায়িক গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। উৎপাদনশীলতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে খেলাপি ঋণ। এর ফলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। জুন-২০২২ পর্যন্ত ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। একই সঙ্গে এটি দেশের ব্যাংক খাতের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, যার বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে। বৃহস্পতিবার ‘বাংলাদেশ কান্ট্রি ইকোনমিক মেমোরেন্ডাম চেঞ্জিং অব ফেব্রিক’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে ও সামষ্টিক অর্থনীতির স্বার্থে খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ওই প্রতিবেদনের একাংশে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা; পরিচালকদের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া; পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা বৃদ্ধি। পরিচালকদের দায়িত্ব পালন ও জবাবদিহির জায়গা তৈরিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং ব্যয়বহুল ব্যাংকের ব্যর্থতা এড়াতে সম্পদের গুণমান উন্নত করতে হবে। এ জন্য দেশের রাষ্ট্রায়ত্তসহ তফসিলি ব্যাংকগুলোকে আরও বেশি জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ইদানীং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত আসছে। যে নীতিমালাগুলো দিচ্ছে সেগুলো ঋণখেলাপিদের আরও উৎসাহিত করছে। অন্যদিকে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন ভালো গ্রাহক। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোও খেলাপি ঋণ আদায়ে বিমুখ হয়ে পড়েছে। কারণ এর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হয় না। পরিচালনা পর্ষদের নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা স্রেফ একটা রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি, যা অবসান হওয়া খুবই জরুরি।

বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক ও বিশেষ গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ থাকলেও বর্তমানে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে, যা সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল ব্যবহার থেকে দুষ্প্রাপ্য আর্থিক সংস্থানকে সরিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো প্রায়ই ব্যক্তি বা সংস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যাদের অ-আর্থিক সংস্থাগুলোতে যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। এ ছাড়া বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর মালিকরা বর্তমানে অনেক ব্যাংকের বোর্ডে বসে আছেন। এ জন্য স্বাধীন পরিচালকের কার্যকারিতা বেশ দুর্বল। যদিও সংশ্লিষ্ট পক্ষের লেনদেনের ওপর কিছু বিধিনিষেধ কাগজে-কলমে বিদ্যমান। সেই বিধিবিধান আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে সর্বোত্তম কার্যক্রম এবং বাস্তবে নিজেদের কার্যকলাপে কয়েকটি বাধা রয়েছে। সেগুলো তারা মানেন না। যেমন একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি পরিচালকদের ঋণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমতি ঠেকাতে এক ব্যাংকের পরিচালকরা অন্য ব্যাংকের ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারেন, যাতে সংশ্লিষ্ট পক্ষ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ না হয়। ব্যাংক খাতে এ ঘটনাটি উদ্বেগজনক জায়গায় পৌঁছেছে। অথচ খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ এটিও। বিশ্বব্যাংকের অনুমানের ভিত্তিতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মোট ঋণের অন্তত ২০ শতাংশ পরিচালকদের দেওয়া হচ্ছে। আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হলে পরিচালকরা অন্যান্য ব্যাংক থেকে সরাসরি বা পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে বা নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আগের ঋণ নিয়মিতকরণ করে দেখাচ্ছেন, যা নিয়ম ও নীতিবহির্ভূত।

খেলাপি ঋণ এক বছরে বেড়েছে ২৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা: বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, জুন-২০২২ পর্যন্ত ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ সোয়া লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ২৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা, যা রীতিমতো উদ্বেগজনক ও ইতিহাসের রেকর্ড।

সূত্র জানায়, গত বছর ডিসেম্বরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। আলোচ্য ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। গত মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বেড়েছে আরও ১১ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। ওই ছয় মাসে বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। গত বছর জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। এক বছরে অর্থাৎ গত বছর জুনের তুলনায় চলতি বছর জুনে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। এর আগেও একবার খেলাপি ঋণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে ছিল। পরে তা আবার কমে আসে। কিন্তু কখনই সোয়া লাখ কোটি টাকা ছাড়ায়নি। এবারই প্রথম খেলাপি ঋণ সোয়া লাখ কোটি ছাড়াল। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখানে একটা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর তা হলো, ব্যাংক খাতে অপেশাদার আচরণ। যারা পরিচালনা পর্ষদে ঢোকেন তারাই অপেশাদার আচরণ করেন। এতে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম প্রভাবিত হয়, যা ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। এতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যায় বলে তিনি মনে করেন।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে সেগুলো নিম্নরূপ: আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। প্রাথমিক আইন, যেমন ব্যাংক কোম্পানি আইন (১৯৯১) এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের (১৯৯৩) ওভারহল সম্পূর্ণ করা উচিত, যাতে এটিকে আন্তর্জাতিক সর্বোত্তম অনুশীলনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করা যায়, যার মধ্যে বাজেটের ন্যূনতম খরচসহ সমস্যা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমাধানের বিধানগুলোয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ আইনের অপারেশনাল স্বাধীনতা বাড়ানো উচিত, যাতে এটি একটি সময়োপযোগী এবং সাশ্রয়ী পদ্ধতিতে সম্ভাব্য ব্যাংক সংকট মোকাবিলা করার জন্য পর্যাপ্ত ক্ষমতা রাখতে সক্ষম হয়। খেলাপি ঋণ কমাতে ও ঋণখেলাপিদের চেনাতে উৎসাহিত করা উচিত এবং বিভিন্ন এনপিএল ক্লাসের জন্য আদালতে ও আদালতের বাইরে রেজোলিউশনের কার্যকর পূর্ণ পরিসরের প্রস্তাব দেওয়া উচিত। দেউলিয়া পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে। এনপিএল রেজোলিউশনের জন্য একটি পাবলিকলি ফান্ডেড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ব্যবহার করার সম্ভাব্যতা ও করপোরেট গভর্ন্যান্স এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে এ-জাতীয় সংস্থাগুলোর দ্বারা কীভাবে কাজ করে সেগুলোর আলোকে বাংলাদেশেও পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।