ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বেসরকারি শিক্ষকদের রাজনীতির লাগাম টানার উদ্যোগ : মাউশি

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৫:৩১:২০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ মে ২০১৮
  • / ৩২৮ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ ডেস্ক: বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পথ বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে নীতিমালা করতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মন্ত্রী পরিষদের এমন উদ্যোগে সায় মিলেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। বিষয়টি নিয়ে এখন কাজ করছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক প্রতিবেদন ও শিক্ষকদের অধিক মাত্রায় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার আলোকে এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তবে সরকারের এমন উদ্যোগকে সংবিধান ও নাগরিকবিরোধী বলে আখ্যা দিয়েছেন শিক্ষক নেতারা। আগামী নির্বাচনে শিক্ষকদের নির্বাচনের বাইরে রাখার জন্য কিছু দুর্নীতিবাজ আমলা এমন অপতৎপরতা শুরু করেছে বলে অভিযোগ তাদের। শিক্ষক নেতারা জানান, ২০১১ সালে স্থানীয় নির্বাচনে শিক্ষকদের অংশগ্রহ ঠেকাতে প্রজ্ঞাপন হয়েছিল। কিন্তু হাইকোর্টে গিয়ে এটি টিকেনি। এছাড়া আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার নীতিমালাতেও শিক্ষকদের পেশার বাইরে রাজনীতিসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকা- করার অধিকার স্বীকৃত।
চলতি বছরের শুরুর দিকে রাজধানীর প্রেসক্লাবে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবিতে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করেন কয়েকটি শিক্ষক সংগঠন। এরমধ্যে একটির নেতৃত্ব দেন বিএনপিপন্থি শিক্ষক নেতা নজরুল ইসলাম রনি। তিনি রাজধানী মিরপুরের সিদ্ধার্থ স্কুলে প্রধান শিক্ষক। স্থানীয় এমপিকে ম্যানেজ করে প্রায় ১৫ দিনব্যাপী আন্দোলন চলাকালীন সময় তিনি স্কুলে এক মিনিট সময় দেয়নি। শুধু নজরুল ইসলাম রনি নন, সারা দেশে বেসরকারি শিক্ষকরা রাজনীতি, ব্যবসাসহ বিভিন্ন লাভজনক কাজে সম্পৃক্ত। তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ব্যক্তিগত কাজে বেশি সময় দেন। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বেসরকারি শিক্ষকদের রাজনীতি সীমিত বা নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত এসেছে সরকারের পক্ষ থেকে। গত ২৯ শে মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের চাকরি নিয়ন্ত্রণের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো বিধি-বিধান না থাকায় তারা অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হওয়ায় সার্বক্ষণিক রাজনীতি করেন। ফলে তারা শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ততটা আগ্রহী হন না। এ কারণে মাঠ পর্যায়ে এসব শিক্ষকের চাকরি নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সময় দুরূহ হয়ে পড়ে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসের পাক্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদন মিলেছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। চিঠিটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আসার পর গত ৩০ শে এপ্রিল বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সরকারি এমন উদ্যোগের ব্যাপক প্রক্রিয়া দেখিয়েছে বেসরকারি শিক্ষক ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা। তাদের অভিযোগ, নির্বাচনে আগের সরকারের ভিতরে থাকার একটি পক্ষ শিক্ষকদের উস্কানোর চেষ্টা করছে। কোনো এ ধরনের আইন করতে পারবে না। কারণ ইউনেষ্কো ও আইএলও ৪৬টি ধারায় শিক্ষক রাজনীতি করতে পারবে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট বলা আছে। শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হলে আগে ইউনেস্কো ও আইএলও সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে হবে বলে জানান তারা।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অর্ধশতাধিক শিক্ষক মনোনয়নের দৌড়ে নেমেছেন। জনমত গড়ে তুলতে স্কুল-কলেজে পড়ানো বাদ দিয়ে তারা নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করেছেন। মনোনয়ন নিশ্চিত করতে রাজধানীতে ছুটে যাচ্ছেন দলের শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের কাছে। এছাড়া এমপিওভুক্তসহ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অসংখ্য শিক্ষক সরাসরি রাজনীতিক দলের পদে রয়েছেন। শিক্ষকতা মহান পেশা হলেও পাঠদানে তাদের মনোযোগ নেই। অনেক শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সে দলের শিক্ষক নেতারা এলাকার সালিশ মীমাংসা নিয়ন্ত্রণ করেন। বাজার কমিটি, অটোরিকশা সমিতিসহ বিভিন্ন ধরনের বিতর্কিত সংগঠনে তারা যুক্ত হয়ে সুবিধা নেন। কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসন থেকে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করতে চান আওয়ামী লীগ সমর্থিত শিক্ষক সংগঠনের বৃহত্তম মোর্চা ‘জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্টে’র নেতা ও বাংলাদেশ কলেজে শিক্ষক সমিতির (বাকশিস) সভাপতি অধ্যক্ষ আসাদুল হক। তিনি শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ভাইস চেয়ারম্যান ও রাজধানীর তেজগাঁও মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ। আসাদুল হক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণসহ ১১ দফা দাবিতে শিক্ষকদের নিয়ে আন্দোলন করছেন। তার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয়করণের আন্দোলনের নামে সারা দেশে শিক্ষকদের বার বার মাঠে নামানো হচ্ছে। এতে শিক্ষা কার্যক্রম ভীষণ বিঘিœত হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রণালয়কে দাবি পূরণের কোনো ধরনের আশ্বাস না দিতে পরামর্শ দিয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে মাউশি সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়ে শিক্ষকদের সতর্ক করেছে।
শিক্ষকদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কিনা এ প্রশ্নে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর মাহাবুবুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আমরা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করতে প্রস্তুত। তিনি বলেন, বাস্তবতার আলোকে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় মতামত তৈরির জন্য অধিদপ্তরের কলেজ ও প্রশাসনের পরিচালককে বলে দিয়েছি। এ ব্যাপারে কলেজ ও প্রশাসনের পরিচালক প্রফেসর শামসুল হুদা বলেন, তারা নামে বেসরকারি শিক্ষক। কিন্তু শতভাগ সরকারি বেতনভুক্ত। কিন্তু সারা দেশে লাখ লাখ শিক্ষকদের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাদের বার্ষিক পারফরমেন্স রিপোর্ট (এসিআর) পর্যন্ত নেই। এ বিষয়টি আমরাও উদ্বিগ্ন। গুরুত্ব দিয়ে আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি। সরকারি চাকরিজীবী যেমন চাকরিরত অবস্থায় রাজনীতি ও ব্যবসা করতে পারেন না, বেসরকারি শিক্ষকদের তেমননি রাজনীতি ও ব্যবসা বন্ধ করার পক্ষে আমি। এ ব্যাপারে রাজধানীর তেজগাঁও মহিলা কলেজে অধ্যক্ষ ও জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্ট’ ও বাংলাদেশ কলেজে শিক্ষক সমিতির (বাকশিস) সভাপতি অধ্যক্ষ আসাদুল হক বলেন, কোনো দিন এটা করা সম্ভব হবে না। কারণ ইউনেস্কো ও আইএলওতে স্পষ্ট বলা আছে শিক্ষকরা রাজনীতি করতে পারবে এবং স্বপদে বহাল থাকতে পারবে। তিনি বলেন, সরকারের ভিতরে থাকা একটা মহল নির্বাচনের আগে শিক্ষকদের উস্কে দিতে এসব অপতৎপরতা শুরু করেছে। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও প্রবীণ শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, শিক্ষকরা রাজনীতি করতে পারবে না এটা ঠিক না। আর বিধি বিধান নেই বিষয়টি সঠিক না। কারণ শিক্ষকদের নৈতিক স্খলন অন্যান্য অপরাধের জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুনির্দিষ্ট আইন আছে। শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোটের সভাপতি অধ্যক্ষ সেলিম ভূইয়া বলেন, এটি হবে কালো আইন। সরকার ইচ্ছে করলেও এটি করতে পারবে না। কারণ আইনে কাভার করবে না। একটি সরকার যখন স্বৈরাচার হয়ে যায় তখন এ ধরনের কালো আইন করতে চায়। তিনি বলেন, স্থানীয় নির্বাচনে শিক্ষকরা অংশ নিতে পারবে না সরকারের এ প্রজ্ঞাপন হাইকোর্ট কর্তৃক বাতিল হয়েছিল। তার প্রশ্ন, শিক্ষকরা রাজনীতি করবে না তো আমলা, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করবে?

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

বেসরকারি শিক্ষকদের রাজনীতির লাগাম টানার উদ্যোগ : মাউশি

আপলোড টাইম : ০৫:৩১:২০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ মে ২০১৮

সমীকরণ ডেস্ক: বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পথ বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে নীতিমালা করতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মন্ত্রী পরিষদের এমন উদ্যোগে সায় মিলেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। বিষয়টি নিয়ে এখন কাজ করছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক প্রতিবেদন ও শিক্ষকদের অধিক মাত্রায় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার আলোকে এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তবে সরকারের এমন উদ্যোগকে সংবিধান ও নাগরিকবিরোধী বলে আখ্যা দিয়েছেন শিক্ষক নেতারা। আগামী নির্বাচনে শিক্ষকদের নির্বাচনের বাইরে রাখার জন্য কিছু দুর্নীতিবাজ আমলা এমন অপতৎপরতা শুরু করেছে বলে অভিযোগ তাদের। শিক্ষক নেতারা জানান, ২০১১ সালে স্থানীয় নির্বাচনে শিক্ষকদের অংশগ্রহ ঠেকাতে প্রজ্ঞাপন হয়েছিল। কিন্তু হাইকোর্টে গিয়ে এটি টিকেনি। এছাড়া আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার নীতিমালাতেও শিক্ষকদের পেশার বাইরে রাজনীতিসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকা- করার অধিকার স্বীকৃত।
চলতি বছরের শুরুর দিকে রাজধানীর প্রেসক্লাবে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবিতে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করেন কয়েকটি শিক্ষক সংগঠন। এরমধ্যে একটির নেতৃত্ব দেন বিএনপিপন্থি শিক্ষক নেতা নজরুল ইসলাম রনি। তিনি রাজধানী মিরপুরের সিদ্ধার্থ স্কুলে প্রধান শিক্ষক। স্থানীয় এমপিকে ম্যানেজ করে প্রায় ১৫ দিনব্যাপী আন্দোলন চলাকালীন সময় তিনি স্কুলে এক মিনিট সময় দেয়নি। শুধু নজরুল ইসলাম রনি নন, সারা দেশে বেসরকারি শিক্ষকরা রাজনীতি, ব্যবসাসহ বিভিন্ন লাভজনক কাজে সম্পৃক্ত। তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ব্যক্তিগত কাজে বেশি সময় দেন। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বেসরকারি শিক্ষকদের রাজনীতি সীমিত বা নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত এসেছে সরকারের পক্ষ থেকে। গত ২৯ শে মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের চাকরি নিয়ন্ত্রণের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো বিধি-বিধান না থাকায় তারা অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হওয়ায় সার্বক্ষণিক রাজনীতি করেন। ফলে তারা শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ততটা আগ্রহী হন না। এ কারণে মাঠ পর্যায়ে এসব শিক্ষকের চাকরি নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সময় দুরূহ হয়ে পড়ে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসের পাক্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদন মিলেছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। চিঠিটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আসার পর গত ৩০ শে এপ্রিল বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সরকারি এমন উদ্যোগের ব্যাপক প্রক্রিয়া দেখিয়েছে বেসরকারি শিক্ষক ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা। তাদের অভিযোগ, নির্বাচনে আগের সরকারের ভিতরে থাকার একটি পক্ষ শিক্ষকদের উস্কানোর চেষ্টা করছে। কোনো এ ধরনের আইন করতে পারবে না। কারণ ইউনেষ্কো ও আইএলও ৪৬টি ধারায় শিক্ষক রাজনীতি করতে পারবে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট বলা আছে। শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হলে আগে ইউনেস্কো ও আইএলও সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে হবে বলে জানান তারা।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অর্ধশতাধিক শিক্ষক মনোনয়নের দৌড়ে নেমেছেন। জনমত গড়ে তুলতে স্কুল-কলেজে পড়ানো বাদ দিয়ে তারা নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করেছেন। মনোনয়ন নিশ্চিত করতে রাজধানীতে ছুটে যাচ্ছেন দলের শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের কাছে। এছাড়া এমপিওভুক্তসহ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অসংখ্য শিক্ষক সরাসরি রাজনীতিক দলের পদে রয়েছেন। শিক্ষকতা মহান পেশা হলেও পাঠদানে তাদের মনোযোগ নেই। অনেক শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সে দলের শিক্ষক নেতারা এলাকার সালিশ মীমাংসা নিয়ন্ত্রণ করেন। বাজার কমিটি, অটোরিকশা সমিতিসহ বিভিন্ন ধরনের বিতর্কিত সংগঠনে তারা যুক্ত হয়ে সুবিধা নেন। কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসন থেকে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করতে চান আওয়ামী লীগ সমর্থিত শিক্ষক সংগঠনের বৃহত্তম মোর্চা ‘জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্টে’র নেতা ও বাংলাদেশ কলেজে শিক্ষক সমিতির (বাকশিস) সভাপতি অধ্যক্ষ আসাদুল হক। তিনি শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ভাইস চেয়ারম্যান ও রাজধানীর তেজগাঁও মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ। আসাদুল হক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণসহ ১১ দফা দাবিতে শিক্ষকদের নিয়ে আন্দোলন করছেন। তার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয়করণের আন্দোলনের নামে সারা দেশে শিক্ষকদের বার বার মাঠে নামানো হচ্ছে। এতে শিক্ষা কার্যক্রম ভীষণ বিঘিœত হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রণালয়কে দাবি পূরণের কোনো ধরনের আশ্বাস না দিতে পরামর্শ দিয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে মাউশি সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়ে শিক্ষকদের সতর্ক করেছে।
শিক্ষকদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কিনা এ প্রশ্নে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর মাহাবুবুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আমরা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করতে প্রস্তুত। তিনি বলেন, বাস্তবতার আলোকে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় মতামত তৈরির জন্য অধিদপ্তরের কলেজ ও প্রশাসনের পরিচালককে বলে দিয়েছি। এ ব্যাপারে কলেজ ও প্রশাসনের পরিচালক প্রফেসর শামসুল হুদা বলেন, তারা নামে বেসরকারি শিক্ষক। কিন্তু শতভাগ সরকারি বেতনভুক্ত। কিন্তু সারা দেশে লাখ লাখ শিক্ষকদের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাদের বার্ষিক পারফরমেন্স রিপোর্ট (এসিআর) পর্যন্ত নেই। এ বিষয়টি আমরাও উদ্বিগ্ন। গুরুত্ব দিয়ে আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি। সরকারি চাকরিজীবী যেমন চাকরিরত অবস্থায় রাজনীতি ও ব্যবসা করতে পারেন না, বেসরকারি শিক্ষকদের তেমননি রাজনীতি ও ব্যবসা বন্ধ করার পক্ষে আমি। এ ব্যাপারে রাজধানীর তেজগাঁও মহিলা কলেজে অধ্যক্ষ ও জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্ট’ ও বাংলাদেশ কলেজে শিক্ষক সমিতির (বাকশিস) সভাপতি অধ্যক্ষ আসাদুল হক বলেন, কোনো দিন এটা করা সম্ভব হবে না। কারণ ইউনেস্কো ও আইএলওতে স্পষ্ট বলা আছে শিক্ষকরা রাজনীতি করতে পারবে এবং স্বপদে বহাল থাকতে পারবে। তিনি বলেন, সরকারের ভিতরে থাকা একটা মহল নির্বাচনের আগে শিক্ষকদের উস্কে দিতে এসব অপতৎপরতা শুরু করেছে। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও প্রবীণ শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, শিক্ষকরা রাজনীতি করতে পারবে না এটা ঠিক না। আর বিধি বিধান নেই বিষয়টি সঠিক না। কারণ শিক্ষকদের নৈতিক স্খলন অন্যান্য অপরাধের জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুনির্দিষ্ট আইন আছে। শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোটের সভাপতি অধ্যক্ষ সেলিম ভূইয়া বলেন, এটি হবে কালো আইন। সরকার ইচ্ছে করলেও এটি করতে পারবে না। কারণ আইনে কাভার করবে না। একটি সরকার যখন স্বৈরাচার হয়ে যায় তখন এ ধরনের কালো আইন করতে চায়। তিনি বলেন, স্থানীয় নির্বাচনে শিক্ষকরা অংশ নিতে পারবে না সরকারের এ প্রজ্ঞাপন হাইকোর্ট কর্তৃক বাতিল হয়েছিল। তার প্রশ্ন, শিক্ষকরা রাজনীতি করবে না তো আমলা, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করবে?