ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বেপরোয়া ধর্ষণ : চার মাসে ১৫৩৮টি মামলা

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১১:০২:০৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০১৯
  • / ৩২১ বার পড়া হয়েছে

তদন্তের অগ্রগতি গ্রেফতার বিচার কার্যক্রম সাজা হতাশাজনক
সমীকরণ প্রতিবেদন:
গত ৪ মাসে (চলতি বছরের জানুয়ারি-এপ্রিল) ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে ১৫৩৮টি। আর গত সাড়ে ৫ বছরে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে ২৮৩৫টি। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়, দেশে নারী ও শিশু ধর্ষণ অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। ধর্ষকের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী ও কর্মজীবী নারীরাও। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং ধর্ষণ করে নৃশংসভাবে হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে যাত্রীবাহী বাসেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। মাদকে আসক্তি, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, অপসংস্কৃতি সর্বোপরি সামাজিক সুশাসন ও নিরাপত্তা না থাকায় উদ্বেগজনকভাবে নারী ও শিশুদের ধর্ষণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং সমাজবিজ্ঞানীরা। এছাড়া ধর্ষণের মামলার বিচারিক কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা, কঠোর শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া ধর্ষণের ঘটনা উৎসাহিত করছে বিকৃত যৌনরুচির পুরুষদের।
পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত ৪ মাসেই ধর্ষণের ১৫৩৮টি ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। পরিসংখ্যানে জানা যায়; ২০১৮ সালে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে ৩৯৪৯টি, ২০১৭ সালে ৩৯৯৫টি, ২০১৬ সালে ৩৭২৮টি, ২০১৫ সালে ৩৯৩০টি এবং ২০১৪ সালে ৩৬৯৫টি। সবমিলিয়ে গত ৫ বছরে (২০১৪- ২০১৮) ১৯২৯৭টি মামলা হয়েছে। এছাড়া ২০১৬ সালে বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্র থেকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সংগ্রহীত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৮ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪ হাজার ৩০৪ জনের মধ্যে ৭৪০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৮ সালে ধর্ষণের শিকার ৩০৭ জনের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১১৪ জনকে। ২০০৯ সালে ধর্ষণের শিকার ৩৯৩ জনের মধ্যে ১৩০ জন, ২০১০ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৯৩ জনের মধ্যে ৬৬ জন, ২০১১ সালে ধর্ষণের শিকার ৬৩৫ জনের মধ্যে ৯৬ জন, ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার ৫০৮ জনের মধ্যে ১০৬ জন, ২০১৩ সালে ধর্ষণের শিকার ৫১৬ জনের মধ্যে ৬৪ জন, ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৪৪ জনের মধ্যে ৭৮ জন এবং ২০১৫ সালে ধর্ষণের শিকার ৮০৮ জনের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৮৫ জনকে।
জানা গেছে, গত ১০ বছরে ধর্ষণের যতগুলো মামলা হয়েছে সেগুলোর তদন্তের অগ্রগতি, আসামি গ্রেফতার, বিচারিক কার্যক্রম, আসামিদের সাজা রীতিমতো হতাশাজনক। সঠিক তদন্ত না হওয়া, প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ, বিচারিক কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা এবং ধর্ষকদের উপযুক্ত সাজা না হওয়ার কারণে সমাজে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করা হয়। এছাড়া কোন ধর্ষিতা বিচার চাইতে গিয়ে তাকে এবং পরিবারকে সামাজিকভাবে পদে পদে নাজেহাল হতে হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে আদালত এমনকি ধর্ষকদের প্রভাবশালী আত্মীয়স্বজন, রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে চরম অসহযোগিতা পান মামলার বাদীরা। এমনকি প্রাণনাশের হুমকি, প্রাণে মেরে ফেলার ঘটনাও ঘটে। ধর্ষণ করে কঠোর শাস্তি হয়েছে এমন নজির কম থাকায় ধর্ষক শ্রেণী সমাজে ধর্ষণের মতো জগণ্য ও ঘৃণ্য কাজে মেতে উঠেছে বলে মনে করছেন সমাজ সচেতন ব্যক্তিরা।
পুলিশের অতিরিক্ত জিআইজি (ইন্টেলিজেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাল অ্যাপেয়ার্স) মো. মনিরুজ্জামান মনির বলেন, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, মাদকের আসক্তি বেড়ে যাওয়া, সামাজিক বিচার ব্যবস্থাপনা উঠে যাওয়া, অপসংস্কৃতির লালনসহ বিভিন্ন কারণে সমাজে ধর্ষণের মতো জঘণ্য অপরাধগুলো ঘটছে। আগে সমাজে কঠোর সামাজিক অনুশাসন ছিল বলে ধর্ষণ বা ইভটিজিংয়ের ঘটনা প্রতিরোধ রোধ করা সম্ভব হতো। এখন সামাজিকভাবে কোন বিচার ব্যবস্থা নেই। এছাড়া অবাধে পর্ণমুভি দেখার প্রবণতা, আকাশ সংস্কৃতির কারণে আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে বিকৃত যৌনরুচি তৈরি হয়েছে। ফলে ধর্ষণের মতো অপরাধগুলো বেশি ঘটছে। এছাড়া অতিমাত্রায় মাদকাসক্তির কারণে মানুষের মধ্যে বিচার বিবেচনা বোধ কমে গেছে। ফলে সে নিজের কাছের আত্মীয়কেও ধর্ষণ করতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। এসব প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনা, সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা নিনা গোস্বামী বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণের মতো জঘণ্য অপরাধ বাড়ছে। পুলিশ, আইনজীবী, জনপ্রতিনিধি- কোথাও জবাবদিহিতা নেই। সমাজে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও অধিকাংশ ঘটনা থেকে যায় অন্তরালে। খুব কম ঘটনায় মামলা হয়। আবার মামলা হলেও নারীবান্ধব পরিবেশের অভাবে ভিকটিম বিচার পাওয়ার পরিবর্তে উল্টো নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। নানা হয়রানির কারণে ধর্ষণের শিকার নারীরা মামলা করতে চান না। আবার কেউ কেউ মামলা করলেও পদে পদে নানা হয়রানির কারণে বিচার পান না। নি¤œ আদালতে সাজা হলে উচ্চ আদালতে আদেশে সাজা স্থগিত হয়, আবার কখনো কখনো বিচার কার্যক্রমও স্থগিত হয়। বর্তমানে যে আইনে ধর্ষণের বিচার হয় সেখানে সাক্ষ্য আইন বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা। সাক্ষ্য আইন পরিবর্তন না হলে বিচার পাবে না ধর্ষিতারা।
পুলিশ সদর দফতরের এক পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছে, সম্প্রতি ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা সভায় কথা উঠেছে। ধর্ষণ প্রতিরোধে মামলাগুলো দ্রুত তদন্ত করে চার্জশিট দেয়া, দোষী ব্যক্তির কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে গুরুত্ব দিয়ে মামলার তদন্ত করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এছাড়া পুরনো মামলাগুলো পর্যালোচনা করে যেসব মামলা এখনও আদালতে চার্জশিট দেয়া সম্ভব হয়নি সেগুলো দ্রুত তদন্ত শেষ করা এবং কোন মামলায় আসামি পলাতক থাকলে তাদের গ্রেফতারের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা পুলিশকে উদ্যোগ নেয়ার নির্দেশনা দেয়া। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ধর্ষণ বন্ধ করতে হলে সামাজিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা মজবুত করতে হবে। অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশ চালু করতে হবে। স্কুল কলেজ থেকে শুরু করে সমাজের প্রত্যেক স্তরে ধর্ষণের মতো জঘণ্য অপরাধ প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
আইনজীবী ফারজানা মনি এক লেখায় বলেছেন ধর্ষণের মতোন অপরাধ হলে লোকলজ্জার ভয়ে ভিকটিম বা তার পরিবার আইনের আশ্রয় নেয় না বা নিলেও কিছু ভুলের জন্য তারা ন্যায়বিচার পেতে ব্যর্থ হন। যেসব আইনে ধর্ষণজনিত বিধিবিধান রয়েছে সেগুলো হলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ ( সংশোধনী ২০০৩) দন্ডবিধি, ১৮৬০ সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২, ৪. ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৬০। দন্ডবিধির ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী পাঁচটি অবস্থায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলা যায়, সেগুলো হলোঃ নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে, নারীর সম্মতি ছাড়া, মৃত্যু বা জখমের ভয় দেখিয়ে, নারীর সম্মতি নিয়েই, কিন্তু পুরুষটি জানে যে সে ওই নারীর স্বামী নয় এবং পুরুষটি তাও জানে, নারীটি তাকে এমন একজন পুরুষ বলে ভুল করেছে যে পুরুষটির সঙ্গে তার আইনসঙ্গতভাবে বিয়ে হয়েছে বা বিবাহিত বলে সে বিশ্বাস করে। নারীর সম্মতিসহ কিংবা সম্মতি ছাড়া যদি সে নারীর বয়স ১৬ বছরের কম হয়। অর্থাৎ ১৬ বছরের চেয়ে কম বয়সী মেয়ের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে।
ওই আইনজীবি বলেন, আমাদের দেশে ধর্ষণের ঘটনা যত ঘটে, তার বেশির ভাগই আইনের আওতায় আসে না। থানায় যাওয়া, মেডিকেল পরীক্ষা, আদালতে এসে সাক্ষী দেয়া এবং ধর্ষিতার প্রতি সবার বিরূপ মনোভাব- এগুলো নারীর জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার মানসিক শক্তি সবার থাকে না। নারী ও শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত সব অপরাধের বিচারকাজ পরিচালনার জন্য সরকার প্রত্যেক জেলা সদরে একটি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নামে বিশেষ আদালত গঠন করেছে। ধর্ষণের বিচারও এই ট্রাইব্যুনালে হবে। আমরা সবসময় দেখি, মামলা শেষ হতে অনেক দিন সময় নেয়। কিন্তু এই আইনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘মামলা প্রাপ্তির তারিখ হতে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।’ [নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ধারা ২০(৩)] ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইন অনুসারে ধর্ষণ-সংক্রান্ত মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ নেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু এ আইনের কয়েকটি ধারা নারীর বিপক্ষে যায়। যেমন এখানে বলা হয়েছে, ‘ধর্ষিত নারীর চারিত্রিক সমস্যা আছে।’ (নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ধারা ১৫৫(৪)। আইনটি ভারতেও একসময় প্রচলিত ছিল। কিন্তু তারা তা অনেক আগেই বাতিল করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে তা এখনো প্রচলিত। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩) অত্যন্ত কঠোর একটি আইন। ফলে এ আইনকে ব্যবহার করে হয়রানি করার জন্য মিথ্যা মামলা দায়ের যেমন হচ্ছে, তেমনি এ আইনের অধীন শাস্তি পাওয়ার হারও খুবই কম।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

বেপরোয়া ধর্ষণ : চার মাসে ১৫৩৮টি মামলা

আপলোড টাইম : ১১:০২:০৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০১৯

তদন্তের অগ্রগতি গ্রেফতার বিচার কার্যক্রম সাজা হতাশাজনক
সমীকরণ প্রতিবেদন:
গত ৪ মাসে (চলতি বছরের জানুয়ারি-এপ্রিল) ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে ১৫৩৮টি। আর গত সাড়ে ৫ বছরে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে ২৮৩৫টি। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়, দেশে নারী ও শিশু ধর্ষণ অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। ধর্ষকের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী ও কর্মজীবী নারীরাও। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং ধর্ষণ করে নৃশংসভাবে হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে যাত্রীবাহী বাসেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। মাদকে আসক্তি, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, অপসংস্কৃতি সর্বোপরি সামাজিক সুশাসন ও নিরাপত্তা না থাকায় উদ্বেগজনকভাবে নারী ও শিশুদের ধর্ষণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং সমাজবিজ্ঞানীরা। এছাড়া ধর্ষণের মামলার বিচারিক কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা, কঠোর শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া ধর্ষণের ঘটনা উৎসাহিত করছে বিকৃত যৌনরুচির পুরুষদের।
পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত ৪ মাসেই ধর্ষণের ১৫৩৮টি ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। পরিসংখ্যানে জানা যায়; ২০১৮ সালে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে ৩৯৪৯টি, ২০১৭ সালে ৩৯৯৫টি, ২০১৬ সালে ৩৭২৮টি, ২০১৫ সালে ৩৯৩০টি এবং ২০১৪ সালে ৩৬৯৫টি। সবমিলিয়ে গত ৫ বছরে (২০১৪- ২০১৮) ১৯২৯৭টি মামলা হয়েছে। এছাড়া ২০১৬ সালে বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্র থেকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সংগ্রহীত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৮ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪ হাজার ৩০৪ জনের মধ্যে ৭৪০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৮ সালে ধর্ষণের শিকার ৩০৭ জনের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১১৪ জনকে। ২০০৯ সালে ধর্ষণের শিকার ৩৯৩ জনের মধ্যে ১৩০ জন, ২০১০ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৯৩ জনের মধ্যে ৬৬ জন, ২০১১ সালে ধর্ষণের শিকার ৬৩৫ জনের মধ্যে ৯৬ জন, ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার ৫০৮ জনের মধ্যে ১০৬ জন, ২০১৩ সালে ধর্ষণের শিকার ৫১৬ জনের মধ্যে ৬৪ জন, ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৪৪ জনের মধ্যে ৭৮ জন এবং ২০১৫ সালে ধর্ষণের শিকার ৮০৮ জনের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৮৫ জনকে।
জানা গেছে, গত ১০ বছরে ধর্ষণের যতগুলো মামলা হয়েছে সেগুলোর তদন্তের অগ্রগতি, আসামি গ্রেফতার, বিচারিক কার্যক্রম, আসামিদের সাজা রীতিমতো হতাশাজনক। সঠিক তদন্ত না হওয়া, প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ, বিচারিক কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা এবং ধর্ষকদের উপযুক্ত সাজা না হওয়ার কারণে সমাজে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করা হয়। এছাড়া কোন ধর্ষিতা বিচার চাইতে গিয়ে তাকে এবং পরিবারকে সামাজিকভাবে পদে পদে নাজেহাল হতে হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে আদালত এমনকি ধর্ষকদের প্রভাবশালী আত্মীয়স্বজন, রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে চরম অসহযোগিতা পান মামলার বাদীরা। এমনকি প্রাণনাশের হুমকি, প্রাণে মেরে ফেলার ঘটনাও ঘটে। ধর্ষণ করে কঠোর শাস্তি হয়েছে এমন নজির কম থাকায় ধর্ষক শ্রেণী সমাজে ধর্ষণের মতো জগণ্য ও ঘৃণ্য কাজে মেতে উঠেছে বলে মনে করছেন সমাজ সচেতন ব্যক্তিরা।
পুলিশের অতিরিক্ত জিআইজি (ইন্টেলিজেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাল অ্যাপেয়ার্স) মো. মনিরুজ্জামান মনির বলেন, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, মাদকের আসক্তি বেড়ে যাওয়া, সামাজিক বিচার ব্যবস্থাপনা উঠে যাওয়া, অপসংস্কৃতির লালনসহ বিভিন্ন কারণে সমাজে ধর্ষণের মতো জঘণ্য অপরাধগুলো ঘটছে। আগে সমাজে কঠোর সামাজিক অনুশাসন ছিল বলে ধর্ষণ বা ইভটিজিংয়ের ঘটনা প্রতিরোধ রোধ করা সম্ভব হতো। এখন সামাজিকভাবে কোন বিচার ব্যবস্থা নেই। এছাড়া অবাধে পর্ণমুভি দেখার প্রবণতা, আকাশ সংস্কৃতির কারণে আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে বিকৃত যৌনরুচি তৈরি হয়েছে। ফলে ধর্ষণের মতো অপরাধগুলো বেশি ঘটছে। এছাড়া অতিমাত্রায় মাদকাসক্তির কারণে মানুষের মধ্যে বিচার বিবেচনা বোধ কমে গেছে। ফলে সে নিজের কাছের আত্মীয়কেও ধর্ষণ করতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। এসব প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনা, সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা নিনা গোস্বামী বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণের মতো জঘণ্য অপরাধ বাড়ছে। পুলিশ, আইনজীবী, জনপ্রতিনিধি- কোথাও জবাবদিহিতা নেই। সমাজে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও অধিকাংশ ঘটনা থেকে যায় অন্তরালে। খুব কম ঘটনায় মামলা হয়। আবার মামলা হলেও নারীবান্ধব পরিবেশের অভাবে ভিকটিম বিচার পাওয়ার পরিবর্তে উল্টো নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। নানা হয়রানির কারণে ধর্ষণের শিকার নারীরা মামলা করতে চান না। আবার কেউ কেউ মামলা করলেও পদে পদে নানা হয়রানির কারণে বিচার পান না। নি¤œ আদালতে সাজা হলে উচ্চ আদালতে আদেশে সাজা স্থগিত হয়, আবার কখনো কখনো বিচার কার্যক্রমও স্থগিত হয়। বর্তমানে যে আইনে ধর্ষণের বিচার হয় সেখানে সাক্ষ্য আইন বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা। সাক্ষ্য আইন পরিবর্তন না হলে বিচার পাবে না ধর্ষিতারা।
পুলিশ সদর দফতরের এক পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছে, সম্প্রতি ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা সভায় কথা উঠেছে। ধর্ষণ প্রতিরোধে মামলাগুলো দ্রুত তদন্ত করে চার্জশিট দেয়া, দোষী ব্যক্তির কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে গুরুত্ব দিয়ে মামলার তদন্ত করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এছাড়া পুরনো মামলাগুলো পর্যালোচনা করে যেসব মামলা এখনও আদালতে চার্জশিট দেয়া সম্ভব হয়নি সেগুলো দ্রুত তদন্ত শেষ করা এবং কোন মামলায় আসামি পলাতক থাকলে তাদের গ্রেফতারের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা পুলিশকে উদ্যোগ নেয়ার নির্দেশনা দেয়া। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ধর্ষণ বন্ধ করতে হলে সামাজিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা মজবুত করতে হবে। অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশ চালু করতে হবে। স্কুল কলেজ থেকে শুরু করে সমাজের প্রত্যেক স্তরে ধর্ষণের মতো জঘণ্য অপরাধ প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
আইনজীবী ফারজানা মনি এক লেখায় বলেছেন ধর্ষণের মতোন অপরাধ হলে লোকলজ্জার ভয়ে ভিকটিম বা তার পরিবার আইনের আশ্রয় নেয় না বা নিলেও কিছু ভুলের জন্য তারা ন্যায়বিচার পেতে ব্যর্থ হন। যেসব আইনে ধর্ষণজনিত বিধিবিধান রয়েছে সেগুলো হলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ ( সংশোধনী ২০০৩) দন্ডবিধি, ১৮৬০ সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২, ৪. ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৬০। দন্ডবিধির ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী পাঁচটি অবস্থায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলা যায়, সেগুলো হলোঃ নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে, নারীর সম্মতি ছাড়া, মৃত্যু বা জখমের ভয় দেখিয়ে, নারীর সম্মতি নিয়েই, কিন্তু পুরুষটি জানে যে সে ওই নারীর স্বামী নয় এবং পুরুষটি তাও জানে, নারীটি তাকে এমন একজন পুরুষ বলে ভুল করেছে যে পুরুষটির সঙ্গে তার আইনসঙ্গতভাবে বিয়ে হয়েছে বা বিবাহিত বলে সে বিশ্বাস করে। নারীর সম্মতিসহ কিংবা সম্মতি ছাড়া যদি সে নারীর বয়স ১৬ বছরের কম হয়। অর্থাৎ ১৬ বছরের চেয়ে কম বয়সী মেয়ের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে।
ওই আইনজীবি বলেন, আমাদের দেশে ধর্ষণের ঘটনা যত ঘটে, তার বেশির ভাগই আইনের আওতায় আসে না। থানায় যাওয়া, মেডিকেল পরীক্ষা, আদালতে এসে সাক্ষী দেয়া এবং ধর্ষিতার প্রতি সবার বিরূপ মনোভাব- এগুলো নারীর জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার মানসিক শক্তি সবার থাকে না। নারী ও শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত সব অপরাধের বিচারকাজ পরিচালনার জন্য সরকার প্রত্যেক জেলা সদরে একটি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নামে বিশেষ আদালত গঠন করেছে। ধর্ষণের বিচারও এই ট্রাইব্যুনালে হবে। আমরা সবসময় দেখি, মামলা শেষ হতে অনেক দিন সময় নেয়। কিন্তু এই আইনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘মামলা প্রাপ্তির তারিখ হতে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।’ [নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ধারা ২০(৩)] ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইন অনুসারে ধর্ষণ-সংক্রান্ত মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ নেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু এ আইনের কয়েকটি ধারা নারীর বিপক্ষে যায়। যেমন এখানে বলা হয়েছে, ‘ধর্ষিত নারীর চারিত্রিক সমস্যা আছে।’ (নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ধারা ১৫৫(৪)। আইনটি ভারতেও একসময় প্রচলিত ছিল। কিন্তু তারা তা অনেক আগেই বাতিল করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে তা এখনো প্রচলিত। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩) অত্যন্ত কঠোর একটি আইন। ফলে এ আইনকে ব্যবহার করে হয়রানি করার জন্য মিথ্যা মামলা দায়ের যেমন হচ্ছে, তেমনি এ আইনের অধীন শাস্তি পাওয়ার হারও খুবই কম।