ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বিপদসীমা ওপরে ১৯ নদ-নদীর পানি

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:১৯:১৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জুলাই ২০২০
  • / ২৪৩ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ প্রতিবেদন:
ভারি বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে নতুন করে বিপৎসীমার ওপরে চলে গেছে আরও দুটি নদীর পানি প্রবাহ। এ নিয়ে ১৯টি নদ-নদীর পানি ৩০টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের অনেক এলাকা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, আজকের মধ্যে তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে ও বালু নদীর পানি ডেমরা পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এ ছাড়া দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র, ঢাকা জেলার আশপাশের নদীসমূহ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ-নদীর পানি সমতল। ফলে আজকের মধ্যে অনেক জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে, গতকাল সকাল নাগাদ ১০১টি পর্যবেক্ষণাধীন পানি সমতল স্টেশনের ৭২টি পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। অব্যাহত পানি বৃদ্ধিতে আজকের মধ্যে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিলেট, সুমানগঞ্জ এবং নেত্রকোনা জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। স্থিতিশীল থাকতে পারে বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, নাটোর, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও ঢাকা জেলার নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি।
এদিকে টানা বন্যায় দেশের ২২ লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ এখনো পানিবন্দী। নদী ভাঙনে বিলীন হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। সরকার বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রাখলেও তা অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধি ও বানভাসিরা। ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়া বাসস্থান, খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে রয়েছে বানভাসিরা। নানারকম পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। পশুখাদ্যের অভাবে গবাদি পশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন খামারি ও গেরস্থরা। বন্যাদুর্গত অনেক এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ভেঙে গেছে রাস্তা, বাঁধ, ব্রিজ, কালভার্ট। তার ওপরে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সংকট ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। আমাদের বিভিন্ন জেলার সংবাদকর্মীরা জানিয়েছেন সেখানকার বন্যা পরিস্থিতি ও মানুষের ভোগান্তির কথা-সিরাজগঞ্জ : যমুনাসহ অভ্যন্তরীণ ফুলজোড়, করতোয়া ও চলনবিলের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় সিরাজগঞ্জে এখনো সাড়ে তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। পানিবন্দী এসব মানুষ গবাদি পশু নিয়ে চরম বিপাকে আছে। দেখা দিয়েছে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধের তীব্র সংকট। সরকারিভাবে বিতরণ করা চাল ও শুকনো খাবার প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সরকারি হিসাবে জেলার ছয়টি উপজেলার ৪৫টি ইউনিয়নের প্রায় ৫৮ হাজার পরিবার পানিবন্দী। ৫৩ কিলোমিটার কাঁচা-পাকা সড়ক ও বাঁধ নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৫ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে।
জামালপুর : চার দিন টানা পানি কমার পর গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি ফের ১২ সেন্টিমিটার বেড়ে বুধবার বিকালে বাহাদুরাবাদঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৮৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এতে জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলার সাত উপজেলার ৬৮ ইউনিয়নের মধ্যে ৫৯টি ইউনিয়নের প্রায় ১০ লাখ মানুষ এখন পানিবন্দী। এদিকে গত মঙ্গলবার রাতে সরিষাবাড়ী উপজেলার শুয়াকৈর এলাকায় ঝিনাই নদীর ওপর ২০০ মিটার ব্রিজের পিলারসহ গার্ডার ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এতে কামরাবাদ ইউনিয়নের চরাঞ্চলের ১৫ গ্রামের সঙ্গে জামালপুর সদরের যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে গেছে। টানা ২৫ দিন ধরে পানিবন্দী থাকায় দুর্গতদের মাঝে পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে, অনেকেরই হাতে-পায়ে ঘা ও ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া বিশুদ্ধ পানি, খাবার, শিশু খাদ্য ও গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। অপরদিকে গতকাল সরিষাবাড়ী উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে স্নেহা আক্তার নামে দুই বছর বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
শরীয়তপুর :ঢাকা আঞ্চলিক মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে পানি ওঠায় চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে এ রুটে চলাচলকারী যাত্রীদের। যে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে গণপরিবহন। শরীয়তপুরের সুরেশ্বর পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপৎসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বন্যাকবলিত অনেকে রান্নাবান্না করতে না পেরে মানবতার জীবনযাপন করছেন। এক বেলা খেতে পারলে ও আরেক বেলা খেতে পারছে না। জেলার ছয় উপজেলার মধ্যে চার উপজেলার ২৩ ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভার ৩০ হাজার পরিবার পানিবন্দী। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি, ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট।
মানিকগঞ্জ : নদীর পানি কমতে শুরু করলেও বিপৎসীমার ওপরে থাকায় এখনো জেলার নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। মানিকগঞ্জ পৌরসভার বেশিরভাগ এলাকায় পানি ঢুকে পড়েছে। করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যে বন্যা যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে। আবার থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় কর্মজীবী মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড হতে উঁচুটিয়া নবনির্মিত রাস্তাটির বিভিন্ন জায়গায় ভাঙন দেখা দেওয়ায় এ এলাকার লোকজন রয়েছে আতঙ্কে।
লালমনিরহাট : আবারও তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলার নিম্নাঞ্চলগুলো আবারও নতুন করে প্লাবিত হয়ে পড়েছে। অপরদিকে ধরলার পানি শিমুলবাড়ী পয়েন্টে গতকাল বিকাল ৩টায় বিপৎসীমার ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানিবৃদ্ধির ফলে সদর উপজেলার মোগলহাট, কুলাঘাট, তিস্তা, গোকুন্ডা, খুনিয়াগাছ, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচাসহ তিস্তাপাড়ের লোকজন আবারও বন্যার আশংকায় চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
কুড়িগ্রাম: জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সবকটি নদ-নদীর পানি আবারও বাড়তে শুরু করেছে। গতকাল পাউবো জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারীতে ৫৩ সেন্টিমিটার এবং দুধকুমার নদীর নুনখাওয়া পয়েন্টে ৪২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নতুন করে নিম্নাঞ্চলসমূহ আবারও তলিয়ে গিয়ে দুর্ভোগ বেড়েছে। উজানের কয়েকটি জায়গায় দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন। জেলার রাজারহাটে তিস্তা নদীর প্রবল ঘূর্ণিস্রোতে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ বুড়িরহাট স্পারটির ৫০ মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এতে উজান ও ভাটিতে কয়েক গ্রামের হাজার হাজার মানুষ ভাঙন আতঙ্কে রয়েছেন।
নাটোর: জেলার সিংড়ায় আত্রাই নদীর পানি গতকাল বিপৎসীমার ৭৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ১০ সেন্টিমিটার। নতুন করে অনেক বাড়ি ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। সিংড়া-কলম সড়কের বলিয়াবাড়ী এলাকার রাস্তা যে কোনো সময় পানির চাপে ধসে যাওয়ার শঙ্কায় রয়েছে। বিলদহর জেলেপাড়ার সব বাড়িতেই ঢুকে পড়েছে পানি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া : এ জেলার নদ-নদীর পানি দ্রুত বাড়ছে। ইতিমধ্যেই তিতাস নদীর পানি বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদী, মৌলভী বাজারের মনু ও হবিগঞ্জের খোয়াই নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং টানা বৃষ্টির পাশাপাশি উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীর পানি চারটি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তবে এখনো বাড়ি-ঘরে পানি প্রবেশ করেনি বলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
গাইবান্ধা : ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, তিস্তা ও করতোয়াসহ সবগুলো নদ-নদীর পানি কিছুটা কমে গতকাল থেকে আবার বাড়তে শুরু করেছে। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি ৭ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৭১ সেন্টিমিটার এবং ঘাঘট নদীর পানি ১০ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৫১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। আর করতোয়া নদীর পানি বিপৎসীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তায় পানি বাড়লেও এখনো তা বিপৎসীমার নিচে রয়েছে। সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সদর উপজেলার বন্যা উপদ্রুত এলাকার বসতবাড়ি টানা দীর্ঘদিন পানিতে নিমজ্জিত থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে বানভাসিরা। কাঁচা ঘরবাড়িগুলো বন্যার পানিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে।
সুনামগঞ্জ : ২০ দিনের ব্যবধানে সুনামগঞ্জে তৃতীয় দফা বন্যা দেখা দিয়েছে। বিপৎসীমার ওপরে রয়েছে সুরমা, যাদুকাটা, পুরানত সুরমাসহ জেলার সবগুলো নদ-নদীর পানি। বন্যার কারণে জেলায় লাখো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। পরিবার-পরিজন ও গবাদি পশু নিয়ে চরম বিপাকে আছেন বানভাসিরা।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

বিপদসীমা ওপরে ১৯ নদ-নদীর পানি

আপলোড টাইম : ০৯:১৯:১৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জুলাই ২০২০

সমীকরণ প্রতিবেদন:
ভারি বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে নতুন করে বিপৎসীমার ওপরে চলে গেছে আরও দুটি নদীর পানি প্রবাহ। এ নিয়ে ১৯টি নদ-নদীর পানি ৩০টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের অনেক এলাকা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, আজকের মধ্যে তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে ও বালু নদীর পানি ডেমরা পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এ ছাড়া দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র, ঢাকা জেলার আশপাশের নদীসমূহ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ-নদীর পানি সমতল। ফলে আজকের মধ্যে অনেক জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে, গতকাল সকাল নাগাদ ১০১টি পর্যবেক্ষণাধীন পানি সমতল স্টেশনের ৭২টি পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। অব্যাহত পানি বৃদ্ধিতে আজকের মধ্যে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিলেট, সুমানগঞ্জ এবং নেত্রকোনা জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। স্থিতিশীল থাকতে পারে বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, নাটোর, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও ঢাকা জেলার নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি।
এদিকে টানা বন্যায় দেশের ২২ লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ এখনো পানিবন্দী। নদী ভাঙনে বিলীন হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। সরকার বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রাখলেও তা অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধি ও বানভাসিরা। ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়া বাসস্থান, খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে রয়েছে বানভাসিরা। নানারকম পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। পশুখাদ্যের অভাবে গবাদি পশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন খামারি ও গেরস্থরা। বন্যাদুর্গত অনেক এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ভেঙে গেছে রাস্তা, বাঁধ, ব্রিজ, কালভার্ট। তার ওপরে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সংকট ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। আমাদের বিভিন্ন জেলার সংবাদকর্মীরা জানিয়েছেন সেখানকার বন্যা পরিস্থিতি ও মানুষের ভোগান্তির কথা-সিরাজগঞ্জ : যমুনাসহ অভ্যন্তরীণ ফুলজোড়, করতোয়া ও চলনবিলের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় সিরাজগঞ্জে এখনো সাড়ে তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। পানিবন্দী এসব মানুষ গবাদি পশু নিয়ে চরম বিপাকে আছে। দেখা দিয়েছে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধের তীব্র সংকট। সরকারিভাবে বিতরণ করা চাল ও শুকনো খাবার প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সরকারি হিসাবে জেলার ছয়টি উপজেলার ৪৫টি ইউনিয়নের প্রায় ৫৮ হাজার পরিবার পানিবন্দী। ৫৩ কিলোমিটার কাঁচা-পাকা সড়ক ও বাঁধ নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৫ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে।
জামালপুর : চার দিন টানা পানি কমার পর গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি ফের ১২ সেন্টিমিটার বেড়ে বুধবার বিকালে বাহাদুরাবাদঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৮৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এতে জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলার সাত উপজেলার ৬৮ ইউনিয়নের মধ্যে ৫৯টি ইউনিয়নের প্রায় ১০ লাখ মানুষ এখন পানিবন্দী। এদিকে গত মঙ্গলবার রাতে সরিষাবাড়ী উপজেলার শুয়াকৈর এলাকায় ঝিনাই নদীর ওপর ২০০ মিটার ব্রিজের পিলারসহ গার্ডার ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এতে কামরাবাদ ইউনিয়নের চরাঞ্চলের ১৫ গ্রামের সঙ্গে জামালপুর সদরের যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে গেছে। টানা ২৫ দিন ধরে পানিবন্দী থাকায় দুর্গতদের মাঝে পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে, অনেকেরই হাতে-পায়ে ঘা ও ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া বিশুদ্ধ পানি, খাবার, শিশু খাদ্য ও গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। অপরদিকে গতকাল সরিষাবাড়ী উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে স্নেহা আক্তার নামে দুই বছর বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
শরীয়তপুর :ঢাকা আঞ্চলিক মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে পানি ওঠায় চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে এ রুটে চলাচলকারী যাত্রীদের। যে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে গণপরিবহন। শরীয়তপুরের সুরেশ্বর পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপৎসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বন্যাকবলিত অনেকে রান্নাবান্না করতে না পেরে মানবতার জীবনযাপন করছেন। এক বেলা খেতে পারলে ও আরেক বেলা খেতে পারছে না। জেলার ছয় উপজেলার মধ্যে চার উপজেলার ২৩ ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভার ৩০ হাজার পরিবার পানিবন্দী। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি, ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট।
মানিকগঞ্জ : নদীর পানি কমতে শুরু করলেও বিপৎসীমার ওপরে থাকায় এখনো জেলার নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। মানিকগঞ্জ পৌরসভার বেশিরভাগ এলাকায় পানি ঢুকে পড়েছে। করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যে বন্যা যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে। আবার থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় কর্মজীবী মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড হতে উঁচুটিয়া নবনির্মিত রাস্তাটির বিভিন্ন জায়গায় ভাঙন দেখা দেওয়ায় এ এলাকার লোকজন রয়েছে আতঙ্কে।
লালমনিরহাট : আবারও তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলার নিম্নাঞ্চলগুলো আবারও নতুন করে প্লাবিত হয়ে পড়েছে। অপরদিকে ধরলার পানি শিমুলবাড়ী পয়েন্টে গতকাল বিকাল ৩টায় বিপৎসীমার ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানিবৃদ্ধির ফলে সদর উপজেলার মোগলহাট, কুলাঘাট, তিস্তা, গোকুন্ডা, খুনিয়াগাছ, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচাসহ তিস্তাপাড়ের লোকজন আবারও বন্যার আশংকায় চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
কুড়িগ্রাম: জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সবকটি নদ-নদীর পানি আবারও বাড়তে শুরু করেছে। গতকাল পাউবো জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারীতে ৫৩ সেন্টিমিটার এবং দুধকুমার নদীর নুনখাওয়া পয়েন্টে ৪২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নতুন করে নিম্নাঞ্চলসমূহ আবারও তলিয়ে গিয়ে দুর্ভোগ বেড়েছে। উজানের কয়েকটি জায়গায় দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন। জেলার রাজারহাটে তিস্তা নদীর প্রবল ঘূর্ণিস্রোতে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ বুড়িরহাট স্পারটির ৫০ মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এতে উজান ও ভাটিতে কয়েক গ্রামের হাজার হাজার মানুষ ভাঙন আতঙ্কে রয়েছেন।
নাটোর: জেলার সিংড়ায় আত্রাই নদীর পানি গতকাল বিপৎসীমার ৭৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ১০ সেন্টিমিটার। নতুন করে অনেক বাড়ি ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। সিংড়া-কলম সড়কের বলিয়াবাড়ী এলাকার রাস্তা যে কোনো সময় পানির চাপে ধসে যাওয়ার শঙ্কায় রয়েছে। বিলদহর জেলেপাড়ার সব বাড়িতেই ঢুকে পড়েছে পানি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া : এ জেলার নদ-নদীর পানি দ্রুত বাড়ছে। ইতিমধ্যেই তিতাস নদীর পানি বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদী, মৌলভী বাজারের মনু ও হবিগঞ্জের খোয়াই নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং টানা বৃষ্টির পাশাপাশি উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীর পানি চারটি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তবে এখনো বাড়ি-ঘরে পানি প্রবেশ করেনি বলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
গাইবান্ধা : ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, তিস্তা ও করতোয়াসহ সবগুলো নদ-নদীর পানি কিছুটা কমে গতকাল থেকে আবার বাড়তে শুরু করেছে। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি ৭ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৭১ সেন্টিমিটার এবং ঘাঘট নদীর পানি ১০ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৫১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। আর করতোয়া নদীর পানি বিপৎসীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তায় পানি বাড়লেও এখনো তা বিপৎসীমার নিচে রয়েছে। সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সদর উপজেলার বন্যা উপদ্রুত এলাকার বসতবাড়ি টানা দীর্ঘদিন পানিতে নিমজ্জিত থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে বানভাসিরা। কাঁচা ঘরবাড়িগুলো বন্যার পানিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে।
সুনামগঞ্জ : ২০ দিনের ব্যবধানে সুনামগঞ্জে তৃতীয় দফা বন্যা দেখা দিয়েছে। বিপৎসীমার ওপরে রয়েছে সুরমা, যাদুকাটা, পুরানত সুরমাসহ জেলার সবগুলো নদ-নদীর পানি। বন্যার কারণে জেলায় লাখো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। পরিবার-পরিজন ও গবাদি পশু নিয়ে চরম বিপাকে আছেন বানভাসিরা।