বিদ্যুতের দাম ফের বাড়ছে
- আপলোড টাইম : ০৩:৩৯:৪৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৩
- / ১৩ বার পড়া হয়েছে
সমীকরণ প্রতিবেদন: বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও এলএনজির মূল্যবৃদ্ধিতে আর্থিক ঘাটতি সমন্বয়ে ভোক্তা পর্যায়ে লোডশেডিং করা হচ্ছে। আগের বছরের তুলনায় ৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর কথা থাকলেও এখন উৎপাদন আগের তুলনায় কম হচ্ছে। অথচ ফের বাড়তে যাচ্ছে বিদ্যুতের দাম। এ ব্যাপারে প্রস্তুতি চলছে। চলতি মাসে ঘোষণা না আসলে আগামী মাসের ১ সেপ্টেম্বর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রস্তাবিত পাইকারি দাম ৬৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাবনার বিপরীতে অন্তত ৫০ থেকে ৬৫ শতাংশ দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিইআরসি গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর গণশুনানিতে পাইকারি পর্যায়ে গড়ে প্রায় ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল। সেক্ষেত্রে ভোক্তা পর্যায়ে দাম না বাড়ালে পাইকারি মূল্যহার কার্যকর করা সম্ভব হবে না। গণশুনানিতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বিদ্যুতের দাম ইফনিটপ্রতি পাইকারি ৩ টাকা ৩৯ পয়সা বাড়িয়ে ৮ টাকা ৫৬ পয়সা করার প্রস্তাব করে। সরকার এতোদিন ৩ টাকা ৩৯ পয়সা ভর্তুকি দিয়ে আসছিল। আর গ্যাসের তখনকার দর বিবেচনায় বিপিডিবির ওই প্রস্তাব ছিল। আগামী ১ সেপ্টেম্বর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, জ্বালানি তেলের রেকর্ড পরিমাণ দাম বাড়ানোর পর ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। এ কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে কিছুটা সময় নিচ্ছে সরকার। সরকারি ভর্তুকির পরিমাণ জানা গেলে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিইআরসির এক কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, শুনানির পর ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে দামের বিষয়ে আদেশ ঘোষণার আইনি বাধ্যবাধকতা আছে। ইতিমধ্যে তিন মাস পেরিয়ে গেছে। তাই ভর্তুকির পরিমাণ জানতে তাগাদা দিয়ে গত দ্বিতীয় দফায় চিঠি দেওয়া হয়েছে।
মানুষ যখন তীব্র মূল্যস্ফীতির সঙ্গে টিকে থাকার সংগ্রাম করছে, ঠিক তখনই জ্বালানি তেলের দাম আরেক দফা বাড়িয়ে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি করেছে। পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণে বাজারে নিত্যপণ্যের দামও হু হু করে বেড়ে গেছে। করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যেমন থমকে গিয়েছিল, একইভাবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আয়ের ওপরও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন, অনেকের ব্যবসাও বন্ধ হয়েছে। ফলে আয় কমে এসেছে দেশের একটি বড় অংশের মানুষের। যদি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম আবার বাড়ানো হয় তাহলে সাধারণ মানুষের ওপর বিপর্যয় নেমে আসবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, সবার সম্মিলতি প্রচেষ্টা অনেকখানি জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ সাশ্রয় করবে। তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটে পৃথিবীজুড়ে সরকারগুলো জ্বালানি সাশ্রয়ের উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও দিনের আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে কর্মঘণ্টা বদলে দিয়েছে। একইসঙ্গে সরকারি, বেসরকারি সব অফিসে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে। সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অফিসগুলোতে কম আলো জ্বেলে এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহারে সাশ্রয়ী হয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার কমাচ্ছে।
গত ১৮ মে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর বিষয়ে শুনানি হয়। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর দিকেই এগোচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। পাইকারিভাবে বিদ্যুতের দাম ৩ টাকা ৩৯ পয়সা বাড়িয়ে ৮ টাকা ৫৬ পয়সা করার প্রস্তাব করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এতদিন সরকার ৩ টাকা ৩৯ পয়সা ভর্তুকি দিয়ে আসছিল। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রস্তাব গ্রহণ করলে সরকারের আর ভর্তুকি দেয়ার প্রয়োজন পড়বে না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাবের উপদেষ্টা শামসুল আলম জানতে চান, সরকার ভর্তুকি দিতে চায় কিনা। শুনানিতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বলেন, বিদ্যুতের পাইকারি দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা প্রমাণের দায়িত্ব বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের। সর্বোচ্চ নিরপেক্ষ ও ন্যায় সঙ্গতভাবে আদেশ দেয়া হবে।
বিইআরসির দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, পিডিবির প্রস্তাব যাচাই-বাছাই চলছে। বিদ্যুৎ বেচে বছরে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে পিডিবির। এর মধ্যে সরকারি ভর্তুকি থেকে বড় অংশ পাওয়ার কথা। বাকিটা দাম বাড়িয়ে সমন্বয় করা হবে। একই সঙ্গে লোডশেডিংয়ের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমায় পিডিবির খরচ কমছে। আবার তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচ বেড়েছে। পাইকারিতে মূল্যবৃদ্ধির পর ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়াতে কমিশনে আবেদন করবে বিতরণকারী সংস্থাগুলো। তাদের প্রস্তাব নিয়ে শুনানির পর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়বে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের উপর গণশুনানিকালে বিইআরসি’র টেকনিক্যাল কমিটি পাইকারি বিদ্যুতে ২ দশমিক ৯৯ টাকা বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল। অর্থাৎ প্রায় ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে ওই কমিটি। ওই কমিটির সুপারিশকেই গুরুত্ব দিয়ে চূড়ান্ত করা হচ্ছে বিদ্যুতের নয়া দাম। এমনিই ইঙ্গিত দিয়েছেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)-এর একজন সদস্য। বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে গণশুনানি হলেও খুচরা কোম্পানিগুলোও দাম বাড়ানোর প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে।
এবিষয়ে বিইআরসি’র সদস্য (বিদ্যুৎ) মোহাম্মদ বজলুর রহমান বলেন, নিয়ম অনুযায়ী শুনানির পরবর্তী তিন মাসের মধ্যেই দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। চলতি মাসেই বিদ্যুতের নতুন দাম ঘোষণা করতে পারবো। দাম কতো টাকা বাড়বে জানতে চাইলে এই সদস্য জানান, গণশুনানিতে বিইআরসি’র টেকনিক্যাল কমিটির একটি সুপারিশ মানুষ জেনেছে।
শুনানিতে কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ খাতে সরকার ভোক্তাদের ভর্তুকি দিতে চায় কিনা। বিদ্যুৎ খাতে সরকারের বিদ্যমান ভর্তুকি রয়েছে, সরকার তা অব্যাহত রাখতে চায় কিনা, তা জানা দরকার।
জানা গেছে, গত এক যুগে ৯ বার বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। এ সময়ে পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে ৯০ শতাংশ দাম বেড়েছে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দাম বাড়ানো হয়। ওই সময় সরকারি ভর্তুকি ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ধরে পাইকারি পর্যায়ে ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। একই সময়ে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। গত জুনে গ্যাসের দাম গড়ে ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ৬ আগস্ট লোডশেডিংয়ের মধ্যে বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। ডিজেলে সাড়ে ৪২ ও পেট্রল-অকটেনে ৫১ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে পরিবহন, নিত্যপণ্যের বাজার, সব রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদনসহ নানা খাতে। বিদ্যুতের দাম বাড়লে জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। গত বছরের জুন থেকে ফার্নেস অয়েলে আমদানি শুল্ক চালু হয়েছে। এতে খরচ বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। গত বছরের জুলাইয়ে কয়লার ওপর ৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর আরোপ করা হয়েছে। বিশ্ববাজারে কয়লার দামও বেড়েছে। দেশে গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের পাইকারি দাম গড়ে ৫ টাকা ১৭ পয়সা। পিডিবির খরচ হচ্ছে ৯ টাকার বেশি। ফলে ২০২১-২২ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। পাইকারি দাম ঘোষণা হলে খুচরার ওপর প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) বর্তমান দর ইউনিট প্রতি ৫.১৭ টাকা থেকে ৬৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৮.৫৮ টাকা করার প্রস্তাব করেছে। বিপিডিবি’র এই প্রস্তাব গ্যাসের বর্তমান দর বিবেচনায়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি হলে ৯.১৪ টাকা এবং ১২৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেলে ৯.২৭ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
অন্যদিকে বিইআরসি টেকনিক্যাল কমিটি ২ দশমিক ৯৯ টাকা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। অর্থাৎ প্রায় ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। বিইআরসি সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যুতের পাইকারি দর ইউনিট প্রতি ৫.১৭ টাকা নির্ধারণ করে। বিদ্যুতের একক পাইকারি বিক্রেতা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। বিপিডিবি’র পাইকারি দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, চাহিদা মতো গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে খরচ বেড়ে গেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুতে গড় উৎপাদন খরচ ছিল ২.১৩ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.১৬ টাকায়। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, কয়লার মূসক বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সালে ইউনিট প্রতি উৎপাদন খরচ দাঁড়াবে ৪.২৪ টাকায়। পাইকারি দাম না বাড়লে ২০২২ সালে ৩০ হাজার ২৫১ কোটি ৮০ লাখ টাকা লোকসান হবে বিপিডিবি’র।