ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশকে বহুল প্রতীক্ষিত ঋণ ‘অনুমোদন দিলো’ আইএমএফ

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৮:১৬:২৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
  • / ৫ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ প্রতিবেদন:
বিশ্ব আর্থিক খাতের অন্যতম প্রধান মোড়ল খ্যাত ইন্টারন্যাশনাল মনিটরিং ফান্ডের (আইএমএফ) কাছ থেকে বাংলাদেশ যে পরিমাণ ঋণ চেয়েছিল সংস্থাটি তার চেয়েও বেশি ঋণ অনুমোদন করেছে। বৈশ্বিক কারণে অর্থনীতিতে চাপ সামলানো এবং দেশে বিরাজমান ডলার সঙ্কটের সুরাহায় বাংলাদেশ ৪৫০ কোটি (৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন) ডলার চেয়েছিল। আইএমএফ তার চেয়ে ২০ কোটি ডলার বেশি অর্থ্যাৎ ৪৭০ কোটি (৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন) ডলার দেবে। যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশ গত কয়েক মাসে দফায় দফায় আলোচনা করেও ঋণের অর্থ ছাড় করাতে পারেনি। সামনেও দেশগুলোর ভাগ্যে আইএমএফ’র ঋণ মিলবে কিনা তাও অনিশ্চিত। সেখানে বাংলাদেশ যা চেয়েছে তার চেয়েও বেশি ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক বলে মনে করছেন আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা। অনেকেই এ জন্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়োচিত পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন। তাদের মতে, আইএমএফ থেকে এই ঋণের বড় অঙ্কের ডলার আসার সুযোগে শ্রীলঙ্কা কিংবা পাকিস্তান হওয়ার আশঙ্কা নেই বাংলাদেশের সামনে। নানামুখী বৈশ্বিক সঙ্কটের কারণে দেশে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা ডলার নিয়ে যখন তীব্র হাহাকার চলছে; ঠিক সেই সময়ে আইএমএফ’র বড় অঙ্কের ঋণে বাংলাদেশের রিজার্ভ আরো শক্তিশালী হবে মনে করছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাংলাদেশের চলমান অর্থনেতিক সঙ্কট মোকাবেলায় বেশকিছু শর্তদিয়ে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)। ঋণের বাকি কিস্তি পেতে শর্ত পরিপালনের কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা। চলতি ফেব্রয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে সংস্থাটির কাছ থেকে প্রথম কিস্তি হিসেবে বাংলাদেশ পাবে ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। বাকি ঋণ আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে ৬ কিস্তিতে পরিশোধ করবে আইএমএফ। ২ দশমিক ২ শতাংশ সুদে নেয়া হচ্ছে এই ঋণ। সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে জোর দিয়েছে আইএমএফও।

আইএমএফ’র এই ঋণ কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্তর্জাতিক অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীরাও বাংলাদেশের অবকাঠামোখাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছে বলে জানিয়েছে অর্থমন্ত্রণালয়। গত সোমবার দিবাগত গভীর রাতে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে আইএমএফ’র নির্বাহী বোর্ডের সভায় বাংলাদেশের ঋণ পাওয়ার বিষয়টি অনুমোদন দেয়া হয়। ওই বোর্ড মিটিংয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ঋণ ফেরত প্রদানের সক্ষমতা এবং আইএমএফ থেকে শর্তপরিপালনের বিষয়গুলো তুলে ধরেন সংস্থাটির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) এ্যান্তোইনেত মনসিও সায়েহ। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশও সফর করে গেছেন। এর পরই বোর্ড মিটিংয়ে অন্যান্য সদস্যরা বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং বাংলাদেশের পক্ষে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রস্তাবের অনুমোদন দেন।
এদিকে, আইএমএফের ঋণ মঞ্জুরির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতার প্রকাশ ঘটেছে বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সঙ্কটকালে বাংলাদেশের বহু প্রত্যাশিত ঋণের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে আইএমএফ’র নির্বাহী পরিষদ। ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের এই ঋণের সুবাদে দুর্বল হয়ে পড়া রিজার্ভের বিপরীতে বিদেশি মুদ্রার একটি ‘বাফার’ তৈরির সুযোগ পাবে বাংলাদেশ। অর্থমন্ত্রী বলেন, এ ঋণ অনুমোদনের মাধ্যমে এটাও প্রমাণিত হল, আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক এলাকাসমূহ শক্ত ভিতের উপরে দাড়িয়ে আছে এবং অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় ভালো। আইএমএফের এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) এবং এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ) থেকে ৩৩০ কোটি ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ। এর অংশ হিসেবে প্রথম কিস্তির ৪৭৬ মিলিয়ন ডলার তাৎক্ষণিকভাবে ছাড় করা হবে বলে জানিয়েছে জানিয়েছে আইএমএফ। এছাড়া আইএমএফ এর নবগঠিত রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় বাংলাদেশ পাবে ১৪০ কোটি ডলার। বাংলাদেশই প্রথম এশীয় দেশ, এই তহবিল থেকে ঋণ পাচ্ছে। এদিকে, বাংলাদেশ সময় গতকাল মঙ্গলবার সকালে আইএমএফের ডিএমডি’র বরাত একটি প্রেসবিজ্ঞপ্তিতেও জানানো হয়, এই ঋণ দেশটির সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা অক্ষুন্ন রাখা, দুর্বলতাকে সুরক্ষিত করা এবং অন্তভূর্ক্তিমূলক ও পরিবেশ সম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবে। তবে এসবক্ষেত্রে সাফল্য আনতে হলে উচ্চাভিলাষী সংস্কার কার্যক্রমের গতি বাড়াতে হবে। ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হতে গেলে মানবসম্পদ ও অবকাঠামো খাতে আরও বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশ সফরকালেও সংস্থাটির ডিএমডি এ্যান্তোইনেত মনসিও সায়েহ জানিয়েছিলেন, এই ঋণ বাংলাদেশের রিজার্ভ বাড়বে।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফ’র সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, আইএমএফ’র একটি ঋণ প্যাকেজের অনুমোদন বাংলাদেশের বাজারকে স্থিতিশীল করবে। এতে আমরা কিছু তহবিল পাবো, যা আমাদের রিজার্ভ বাড়াবে। এটিই এ মুহূর্তের সেরা কৌশল হওয়া উচিত। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমেদ বলেন, আইএমএফ’র কাছ থেকে ঋণ পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হবে রিজার্ভ। রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক সঙ্কটের কারণে ডলার সঙ্কট বাড়ছে। এ অবস্থায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তবে আগামী কিস্তিগুলো পেতে আইএমএফ’র দেয়া সংষ্কার প্রস্তাবগুলো কার্যকর করতে হবে। অন্যথায় তারা ঋণ দিবে না। তিনি বলেন, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি কমাতে হবে এবং মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি যাতে না কমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, সংস্থাটির এই ঋণ দেয়ার ফলে চাপে থাকা অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, আইএমএফ’র ঋণ ছাড় শুরু হলে বৈশ্বিক কারনে দেশে বিদ্যমান ডলারের সঙ্কট কিছুটা হলেও বাড়বে। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন থেকে পাশাপাশি দেশের রিজার্ভকেও শক্তিশালী করবে। ইউএনডিপি’র কান্ট্রি ইকোনমিষ্ট ড. নাজনীন আহমেদও বলেছেন, আইএমএফ’এর ঋণ এলে দেশে ডলারের সাপ্লাই কিছুটা বাড়বে। আর্থিকখাতে গতি বাড়বে। সূত্র মতে, আইএমএফ’র কাছ থেকে ঋণ পেতে গত বছরের জুলাই মাস থেকে চেষ্টা করছিল সরকার। পবে ঋণ সংক্রান্ত আবেদনের প্রেক্ষিতে সংস্থাটির উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে আইএমএফের একটি দল ঋণ কর্মসূচির বিশদ বিবরণ বের করতে গত বছরের ২৬ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর ঢাকা সফর করেছেন। এরপর আইএমএফ’র ডিএমডি এ্যান্তোয়নেত মনসিও সায়েহ ১৪ থকে ১৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ সফর করেন। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, আমরা যেভাবে চেয়েছিলাম ঠিক সেভাবে ঋণ পাচ্ছি। বাংলাদেশের জন্য মোট ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়া হবে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭টি কিস্তিতে এই অর্থ বিতরণ করা হবে। ঋণের প্রথম কিস্তি ৪৪৭ দশমিক ৭০ মিলিয়ন ডলারের চলতি মাসেই দেয়া হবে। অবশিষ্ট পরিমাণ ৬৫৯ দশমিক ১৮ মিলিয়ন ডলার ৬টি সমান কিস্তিতে দেয়া হবে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় সহায়তা করবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার যে সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তা বাস্তবায়নেও সহায়তা করবে এই ঋণ। আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) এ্যান্তোইনেত মনসিও সায়েহ সংস্থাটির প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যেও সরকারকে তার উচ্চাভিলাষী সংস্কার কার্যক্রমের গতি বাড়াতে হবে। মানবসম্পদ ও অবকাঠামো খাতে আরও বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনেও তা জরুরি। তারা বলেছে, বাংলাদেশ সরকার এসব চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও বাংলাদেশ অবগত। এছাড়া রাজস্ব খাতে সংস্কার করলে বাংলাদেশ সামাজিক খাত, উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ব্যয় বৃদ্ধি করতে পারবে। তবে সে জন্য কর নীতি ও রাজস্ব প্রশাসন উভয় খাতেই হাত দিতে হবে। রাজস্ব সংস্কার হলে সরকারি অর্থায়ন, বিনিয়োগ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা উন্নত হবে। এতে সরকারের ব্যয় সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা বাড়বে এবং শাসনব্যবস্থা উন্নত হবে।

আইএমএফ’র ডিএমডি বলেন, আর্থিক খাতের দুর্বলতা কমলে, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা উন্নত করা হলে ও পুঁজিবাজারের উন্নতি করা গেলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করা সম্ভব হবে। এদিকে, ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ পেতে ও চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার কয়েক মাস ধরেই সংস্কার কর্মসূচি পরিচালনা করছে। চলতি জানুয়ারিতে যখন আইএমএফ’র ডিএমডি বাংলাদেশ সফরে আসেন, তখন এসব সংস্কারে সন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি। মৌলিক এসব সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রাখার প্রতিও আইএমএফ’র ডিএমডি গুরুত্বারোপ করেন তখন। ইতোমধ্যে ভর্তুকি কমাতে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। এরপর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়। রিজার্ভের গণনাপদ্ধতি আইএমএফ’র চাওয়া অনুযায়ী করা হচ্ছে এবং জ্বালানি তেলের দাম মাসে মাসে সমন্বয় করার ঘোষণাও দিয়েছে সরকার।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

বাংলাদেশকে বহুল প্রতীক্ষিত ঋণ ‘অনুমোদন দিলো’ আইএমএফ

আপলোড টাইম : ০৮:১৬:২৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

সমীকরণ প্রতিবেদন:
বিশ্ব আর্থিক খাতের অন্যতম প্রধান মোড়ল খ্যাত ইন্টারন্যাশনাল মনিটরিং ফান্ডের (আইএমএফ) কাছ থেকে বাংলাদেশ যে পরিমাণ ঋণ চেয়েছিল সংস্থাটি তার চেয়েও বেশি ঋণ অনুমোদন করেছে। বৈশ্বিক কারণে অর্থনীতিতে চাপ সামলানো এবং দেশে বিরাজমান ডলার সঙ্কটের সুরাহায় বাংলাদেশ ৪৫০ কোটি (৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন) ডলার চেয়েছিল। আইএমএফ তার চেয়ে ২০ কোটি ডলার বেশি অর্থ্যাৎ ৪৭০ কোটি (৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন) ডলার দেবে। যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশ গত কয়েক মাসে দফায় দফায় আলোচনা করেও ঋণের অর্থ ছাড় করাতে পারেনি। সামনেও দেশগুলোর ভাগ্যে আইএমএফ’র ঋণ মিলবে কিনা তাও অনিশ্চিত। সেখানে বাংলাদেশ যা চেয়েছে তার চেয়েও বেশি ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক বলে মনে করছেন আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা। অনেকেই এ জন্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়োচিত পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন। তাদের মতে, আইএমএফ থেকে এই ঋণের বড় অঙ্কের ডলার আসার সুযোগে শ্রীলঙ্কা কিংবা পাকিস্তান হওয়ার আশঙ্কা নেই বাংলাদেশের সামনে। নানামুখী বৈশ্বিক সঙ্কটের কারণে দেশে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা ডলার নিয়ে যখন তীব্র হাহাকার চলছে; ঠিক সেই সময়ে আইএমএফ’র বড় অঙ্কের ঋণে বাংলাদেশের রিজার্ভ আরো শক্তিশালী হবে মনে করছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাংলাদেশের চলমান অর্থনেতিক সঙ্কট মোকাবেলায় বেশকিছু শর্তদিয়ে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)। ঋণের বাকি কিস্তি পেতে শর্ত পরিপালনের কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা। চলতি ফেব্রয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে সংস্থাটির কাছ থেকে প্রথম কিস্তি হিসেবে বাংলাদেশ পাবে ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। বাকি ঋণ আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে ৬ কিস্তিতে পরিশোধ করবে আইএমএফ। ২ দশমিক ২ শতাংশ সুদে নেয়া হচ্ছে এই ঋণ। সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে জোর দিয়েছে আইএমএফও।

আইএমএফ’র এই ঋণ কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্তর্জাতিক অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীরাও বাংলাদেশের অবকাঠামোখাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছে বলে জানিয়েছে অর্থমন্ত্রণালয়। গত সোমবার দিবাগত গভীর রাতে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে আইএমএফ’র নির্বাহী বোর্ডের সভায় বাংলাদেশের ঋণ পাওয়ার বিষয়টি অনুমোদন দেয়া হয়। ওই বোর্ড মিটিংয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ঋণ ফেরত প্রদানের সক্ষমতা এবং আইএমএফ থেকে শর্তপরিপালনের বিষয়গুলো তুলে ধরেন সংস্থাটির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) এ্যান্তোইনেত মনসিও সায়েহ। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশও সফর করে গেছেন। এর পরই বোর্ড মিটিংয়ে অন্যান্য সদস্যরা বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং বাংলাদেশের পক্ষে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রস্তাবের অনুমোদন দেন।
এদিকে, আইএমএফের ঋণ মঞ্জুরির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতার প্রকাশ ঘটেছে বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সঙ্কটকালে বাংলাদেশের বহু প্রত্যাশিত ঋণের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে আইএমএফ’র নির্বাহী পরিষদ। ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের এই ঋণের সুবাদে দুর্বল হয়ে পড়া রিজার্ভের বিপরীতে বিদেশি মুদ্রার একটি ‘বাফার’ তৈরির সুযোগ পাবে বাংলাদেশ। অর্থমন্ত্রী বলেন, এ ঋণ অনুমোদনের মাধ্যমে এটাও প্রমাণিত হল, আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক এলাকাসমূহ শক্ত ভিতের উপরে দাড়িয়ে আছে এবং অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় ভালো। আইএমএফের এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) এবং এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ) থেকে ৩৩০ কোটি ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ। এর অংশ হিসেবে প্রথম কিস্তির ৪৭৬ মিলিয়ন ডলার তাৎক্ষণিকভাবে ছাড় করা হবে বলে জানিয়েছে জানিয়েছে আইএমএফ। এছাড়া আইএমএফ এর নবগঠিত রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় বাংলাদেশ পাবে ১৪০ কোটি ডলার। বাংলাদেশই প্রথম এশীয় দেশ, এই তহবিল থেকে ঋণ পাচ্ছে। এদিকে, বাংলাদেশ সময় গতকাল মঙ্গলবার সকালে আইএমএফের ডিএমডি’র বরাত একটি প্রেসবিজ্ঞপ্তিতেও জানানো হয়, এই ঋণ দেশটির সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা অক্ষুন্ন রাখা, দুর্বলতাকে সুরক্ষিত করা এবং অন্তভূর্ক্তিমূলক ও পরিবেশ সম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবে। তবে এসবক্ষেত্রে সাফল্য আনতে হলে উচ্চাভিলাষী সংস্কার কার্যক্রমের গতি বাড়াতে হবে। ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হতে গেলে মানবসম্পদ ও অবকাঠামো খাতে আরও বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশ সফরকালেও সংস্থাটির ডিএমডি এ্যান্তোইনেত মনসিও সায়েহ জানিয়েছিলেন, এই ঋণ বাংলাদেশের রিজার্ভ বাড়বে।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফ’র সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, আইএমএফ’র একটি ঋণ প্যাকেজের অনুমোদন বাংলাদেশের বাজারকে স্থিতিশীল করবে। এতে আমরা কিছু তহবিল পাবো, যা আমাদের রিজার্ভ বাড়াবে। এটিই এ মুহূর্তের সেরা কৌশল হওয়া উচিত। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমেদ বলেন, আইএমএফ’র কাছ থেকে ঋণ পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হবে রিজার্ভ। রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক সঙ্কটের কারণে ডলার সঙ্কট বাড়ছে। এ অবস্থায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তবে আগামী কিস্তিগুলো পেতে আইএমএফ’র দেয়া সংষ্কার প্রস্তাবগুলো কার্যকর করতে হবে। অন্যথায় তারা ঋণ দিবে না। তিনি বলেন, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি কমাতে হবে এবং মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি যাতে না কমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, সংস্থাটির এই ঋণ দেয়ার ফলে চাপে থাকা অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, আইএমএফ’র ঋণ ছাড় শুরু হলে বৈশ্বিক কারনে দেশে বিদ্যমান ডলারের সঙ্কট কিছুটা হলেও বাড়বে। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন থেকে পাশাপাশি দেশের রিজার্ভকেও শক্তিশালী করবে। ইউএনডিপি’র কান্ট্রি ইকোনমিষ্ট ড. নাজনীন আহমেদও বলেছেন, আইএমএফ’এর ঋণ এলে দেশে ডলারের সাপ্লাই কিছুটা বাড়বে। আর্থিকখাতে গতি বাড়বে। সূত্র মতে, আইএমএফ’র কাছ থেকে ঋণ পেতে গত বছরের জুলাই মাস থেকে চেষ্টা করছিল সরকার। পবে ঋণ সংক্রান্ত আবেদনের প্রেক্ষিতে সংস্থাটির উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে আইএমএফের একটি দল ঋণ কর্মসূচির বিশদ বিবরণ বের করতে গত বছরের ২৬ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর ঢাকা সফর করেছেন। এরপর আইএমএফ’র ডিএমডি এ্যান্তোয়নেত মনসিও সায়েহ ১৪ থকে ১৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ সফর করেন। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, আমরা যেভাবে চেয়েছিলাম ঠিক সেভাবে ঋণ পাচ্ছি। বাংলাদেশের জন্য মোট ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়া হবে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭টি কিস্তিতে এই অর্থ বিতরণ করা হবে। ঋণের প্রথম কিস্তি ৪৪৭ দশমিক ৭০ মিলিয়ন ডলারের চলতি মাসেই দেয়া হবে। অবশিষ্ট পরিমাণ ৬৫৯ দশমিক ১৮ মিলিয়ন ডলার ৬টি সমান কিস্তিতে দেয়া হবে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় সহায়তা করবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার যে সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তা বাস্তবায়নেও সহায়তা করবে এই ঋণ। আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) এ্যান্তোইনেত মনসিও সায়েহ সংস্থাটির প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যেও সরকারকে তার উচ্চাভিলাষী সংস্কার কার্যক্রমের গতি বাড়াতে হবে। মানবসম্পদ ও অবকাঠামো খাতে আরও বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনেও তা জরুরি। তারা বলেছে, বাংলাদেশ সরকার এসব চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও বাংলাদেশ অবগত। এছাড়া রাজস্ব খাতে সংস্কার করলে বাংলাদেশ সামাজিক খাত, উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ব্যয় বৃদ্ধি করতে পারবে। তবে সে জন্য কর নীতি ও রাজস্ব প্রশাসন উভয় খাতেই হাত দিতে হবে। রাজস্ব সংস্কার হলে সরকারি অর্থায়ন, বিনিয়োগ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা উন্নত হবে। এতে সরকারের ব্যয় সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা বাড়বে এবং শাসনব্যবস্থা উন্নত হবে।

আইএমএফ’র ডিএমডি বলেন, আর্থিক খাতের দুর্বলতা কমলে, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা উন্নত করা হলে ও পুঁজিবাজারের উন্নতি করা গেলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করা সম্ভব হবে। এদিকে, ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ পেতে ও চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার কয়েক মাস ধরেই সংস্কার কর্মসূচি পরিচালনা করছে। চলতি জানুয়ারিতে যখন আইএমএফ’র ডিএমডি বাংলাদেশ সফরে আসেন, তখন এসব সংস্কারে সন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি। মৌলিক এসব সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রাখার প্রতিও আইএমএফ’র ডিএমডি গুরুত্বারোপ করেন তখন। ইতোমধ্যে ভর্তুকি কমাতে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। এরপর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়। রিজার্ভের গণনাপদ্ধতি আইএমএফ’র চাওয়া অনুযায়ী করা হচ্ছে এবং জ্বালানি তেলের দাম মাসে মাসে সমন্বয় করার ঘোষণাও দিয়েছে সরকার।