ইপেপার । আজবৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

পেশা নয়, মানুষের প্রয়োজনে তাঁরা আজ সবজি-মাছ ব্যবসায়ী

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:৪৬:০৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২০ এপ্রিল ২০২০
  • / ১৭৮ বার পড়া হয়েছে

প্রতিবেদক, কালীগঞ্জ:
হারুন অর রশিদ, রুমন, সামিউল, টিটু, নির্ঝর ও বিল্লাল সবাই গ্রামের শিক্ষিত যুবক। এদের মধ্যে বিল্লাল ছাড়া আর সবাই বেশ সচ্ছল পরিবারের সন্তান। লেখাপড়া আর কর্মক্ষেত্র তাঁদের ভিন্ন স্থানে হলেও লকডাউনে এখন তাঁরা গ্রামে। তাঁদের পেশা নয়, তবে গ্রামের মানুষের প্রয়োজনে তাঁরা বর্তমান পরিস্থিতিতে আজ সবাই সবজি ও মাছ ব্যবসায়ী। লকডাউন চলাকালীন সময়ে পরিবারের জন্য বেশি প্রয়োজনীয় সবজি ও মাছ। আর এগুলো কিনতে ও বিক্রি করতে গ্রামের কাউকে যেন বাজারে যেতে না হয়, সে জন্য গ্রামের মধ্যের একটি লিচু বাগানে তাঁরা দোকান দিয়েছেন। যেখানে অত্যন্ত কম লাভে বিক্রি করা হচ্ছে সবজি ও মাছ। এখানে ক্রেতা ও বিক্রেতা শুধু ওই গ্রামের মানুষ। লকডাউনের মধ্যে গ্রামের বেশিরভাগ সবজি চাষি তাঁদের উৎপাদিত সবজিও বিক্রি করতে পেরে বেশ উপকৃত হচ্ছেন। অপর দিকে, তাঁরা এগুলো বিক্রি করে লাভের টাকায় ত্রাণ হিসেবে গ্রামের হতদরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর মধ্যে সবজি ও মাছ পর্যায়ক্রমে বিতরণ করছেন। এভাবে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের ফুলবাড়ি গ্রামের সাত যুবক তাঁদের গ্রামের মানুষকে করোনা সংক্রমন থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।
সরেজমিনে উপজেলার সীমান্তবর্তী ফুলবাড়িয়া গ্রামে ঢুকে দেখা যায়, শিক্ষক ফিরোজ মাহমুদের একটি লিচু বাগানের মধ্যে বসানো হয়েছে এক পাশে সবজি আর অন্য পাশে মাছের দোকান। যেখানে বসে সবজি ও মাছ বিক্রি করছেন ওই গ্রামের চকচকে পোশাক পরিহিত কয়েক যুবক। আর নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলছে বেচাকেনা। মানুষ কেনাকাটা করেই তাঁদের অনুরোধে স্থান ত্যাগ করছেন। মহৎ এ কাজের প্রধান উদ্যোক্তা হারুন অর রশিদ জানান, ‘আমি সিলেটের শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে এখন একটি সফ্টওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করছি। দেশে করোনার থাবা পড়লেই আমি গ্রামে চলে আসি। এরপরই শুরু হয় লকডাউন পরিস্থিতি। সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়, প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে যাওয়া যাবে না। কিন্ত গ্রামের মানুষের খেয়ে বেঁচে থাকতে হলে বেশি প্রয়োজন সবজি ও মাছ। আর চাল তো ত্রাণ হিসেবে পাচ্ছেন। গ্রাম সুরক্ষায় গ্রামের ৭ যুবক মিলে শুরু করি সারা গ্রামের মধ্যকার সড়কে জীবাণুনাশক স্প্রে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে বাজারে না যেতে সচেতন করতে থাকি। কিন্ত এরপরও গ্রামের বাজারে যেতে চাচ্ছিলেন মানুষ। কারণ হিসেবে দেখলাম, মাছ ও সবজি কিনতে আবার কেউ কেউ সবজি বিক্রি করতে বাজারে যেতে চাচ্ছেন। তখন আমরা চিন্তা করে দেখলাম, গ্রামের মধ্যেই সবজি ও মাছের দোকান দিলে হয়ত মানুষের বাজারে যাওয়া বন্ধ করা সম্ভব হবে। এছাড়াও যখন কম দামে সবজি ও মাছ পাবে, তখন তাঁরা আর বাজারে যাওয়ার কথা ভাববেন না। কথা মোতাবেক কাজ। পরের দিন নিজেরা গাঁটের থেকে মোট ১৪ হাজার টাকা দিয়ে কাঁচা-শুকনা মরিচ, আদা, পেঁয়াজ, রসুন, আলু ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সবজি কিনে আনি। সকালে গ্রামের মধ্যের একটি লিচু বাগানের ফাঁকা ছায়াযুক্ত জায়গাতে দোকান দিয়ে আজ ১৩ দিন চালাচ্ছি। এখন সবজি চাষি, ক্রেতা উভয়ই উপকৃত হচ্ছেন। আবার লভ্যাংশ থেকে হতদরিদ্র মধ্যবিত্তদের পরিবারে পর্যায়ক্রমে সবজি গোপনে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এতে গ্রামের মানুষ সবদিক দিয়ে উপকৃত হচ্ছেন। আবার বাজারের ভিড়ে আসাটাও কমে গেছে।’
বিল্লাল হোসেন নামের যুবকদের একজন জানান, ‘আমি এ কাজের জন্য টাকা দিতে পারিনি, তবে পরিশ্রম করে পুশিয়ে দিচ্ছি।’ নির্ঝর জানান, ‘আমার বাবার বড় ব্যবসা রয়েছে। আমি সেখানে বসতাম। কিন্ত এখন ব্যবসা বন্ধ থাকায় গ্রামের মধ্যে দোকান দিয়ে সবজি বিক্রি করছি।’ তিনি জানান, ‘সবজি চাষিরাও সবজি বিক্রি করতে পারছিলেন না। আবার সাংসারিক প্রয়োজনে অন্যদেরকেও সবজি ও মাছ কিনতে বাজারে যেতে হচ্ছিল। এখন আমরা এ দুটি মাথায় নিয়ে কাজ করছি। তা ছাড়াও বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীদের চেয়ে কম দামে সবজি ও মাছ দিতে পারায় গ্রামের মানুষ আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। ব্যবসায় যতটুকু লাভ হচ্ছে, তার কিছু অংশ রেখে দিয়ে বাকিটা পরিমাণ মতো সবজি প্রতিদিন হতদরিদ্রদের বাড়িতে আমাদের মায়েদের দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
ওই গ্রামের বাসিন্দা ইউপি সদস্য মাহাফুজুর রহমান লাকী জানান, ‘গ্রামের যুবকদের এমন উদ্যোগের ফলে আমাদের গ্রামের মানুষের বাজারে যাওয়া একেবারেই কমে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের লাভের টাকা হতে হতদরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে খুব গোপনে বিনা মূল্যে সবজি পাঠিয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের এমন কাজে এখন বড়রাও বেশ সাহায্য করছেন। সব মিলিয়ে যুবকদের এমন মহৎ উদ্যোগকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়।’

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

পেশা নয়, মানুষের প্রয়োজনে তাঁরা আজ সবজি-মাছ ব্যবসায়ী

আপলোড টাইম : ১০:৪৬:০৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২০ এপ্রিল ২০২০

প্রতিবেদক, কালীগঞ্জ:
হারুন অর রশিদ, রুমন, সামিউল, টিটু, নির্ঝর ও বিল্লাল সবাই গ্রামের শিক্ষিত যুবক। এদের মধ্যে বিল্লাল ছাড়া আর সবাই বেশ সচ্ছল পরিবারের সন্তান। লেখাপড়া আর কর্মক্ষেত্র তাঁদের ভিন্ন স্থানে হলেও লকডাউনে এখন তাঁরা গ্রামে। তাঁদের পেশা নয়, তবে গ্রামের মানুষের প্রয়োজনে তাঁরা বর্তমান পরিস্থিতিতে আজ সবাই সবজি ও মাছ ব্যবসায়ী। লকডাউন চলাকালীন সময়ে পরিবারের জন্য বেশি প্রয়োজনীয় সবজি ও মাছ। আর এগুলো কিনতে ও বিক্রি করতে গ্রামের কাউকে যেন বাজারে যেতে না হয়, সে জন্য গ্রামের মধ্যের একটি লিচু বাগানে তাঁরা দোকান দিয়েছেন। যেখানে অত্যন্ত কম লাভে বিক্রি করা হচ্ছে সবজি ও মাছ। এখানে ক্রেতা ও বিক্রেতা শুধু ওই গ্রামের মানুষ। লকডাউনের মধ্যে গ্রামের বেশিরভাগ সবজি চাষি তাঁদের উৎপাদিত সবজিও বিক্রি করতে পেরে বেশ উপকৃত হচ্ছেন। অপর দিকে, তাঁরা এগুলো বিক্রি করে লাভের টাকায় ত্রাণ হিসেবে গ্রামের হতদরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর মধ্যে সবজি ও মাছ পর্যায়ক্রমে বিতরণ করছেন। এভাবে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের ফুলবাড়ি গ্রামের সাত যুবক তাঁদের গ্রামের মানুষকে করোনা সংক্রমন থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।
সরেজমিনে উপজেলার সীমান্তবর্তী ফুলবাড়িয়া গ্রামে ঢুকে দেখা যায়, শিক্ষক ফিরোজ মাহমুদের একটি লিচু বাগানের মধ্যে বসানো হয়েছে এক পাশে সবজি আর অন্য পাশে মাছের দোকান। যেখানে বসে সবজি ও মাছ বিক্রি করছেন ওই গ্রামের চকচকে পোশাক পরিহিত কয়েক যুবক। আর নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলছে বেচাকেনা। মানুষ কেনাকাটা করেই তাঁদের অনুরোধে স্থান ত্যাগ করছেন। মহৎ এ কাজের প্রধান উদ্যোক্তা হারুন অর রশিদ জানান, ‘আমি সিলেটের শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে এখন একটি সফ্টওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করছি। দেশে করোনার থাবা পড়লেই আমি গ্রামে চলে আসি। এরপরই শুরু হয় লকডাউন পরিস্থিতি। সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়, প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে যাওয়া যাবে না। কিন্ত গ্রামের মানুষের খেয়ে বেঁচে থাকতে হলে বেশি প্রয়োজন সবজি ও মাছ। আর চাল তো ত্রাণ হিসেবে পাচ্ছেন। গ্রাম সুরক্ষায় গ্রামের ৭ যুবক মিলে শুরু করি সারা গ্রামের মধ্যকার সড়কে জীবাণুনাশক স্প্রে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে বাজারে না যেতে সচেতন করতে থাকি। কিন্ত এরপরও গ্রামের বাজারে যেতে চাচ্ছিলেন মানুষ। কারণ হিসেবে দেখলাম, মাছ ও সবজি কিনতে আবার কেউ কেউ সবজি বিক্রি করতে বাজারে যেতে চাচ্ছেন। তখন আমরা চিন্তা করে দেখলাম, গ্রামের মধ্যেই সবজি ও মাছের দোকান দিলে হয়ত মানুষের বাজারে যাওয়া বন্ধ করা সম্ভব হবে। এছাড়াও যখন কম দামে সবজি ও মাছ পাবে, তখন তাঁরা আর বাজারে যাওয়ার কথা ভাববেন না। কথা মোতাবেক কাজ। পরের দিন নিজেরা গাঁটের থেকে মোট ১৪ হাজার টাকা দিয়ে কাঁচা-শুকনা মরিচ, আদা, পেঁয়াজ, রসুন, আলু ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সবজি কিনে আনি। সকালে গ্রামের মধ্যের একটি লিচু বাগানের ফাঁকা ছায়াযুক্ত জায়গাতে দোকান দিয়ে আজ ১৩ দিন চালাচ্ছি। এখন সবজি চাষি, ক্রেতা উভয়ই উপকৃত হচ্ছেন। আবার লভ্যাংশ থেকে হতদরিদ্র মধ্যবিত্তদের পরিবারে পর্যায়ক্রমে সবজি গোপনে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এতে গ্রামের মানুষ সবদিক দিয়ে উপকৃত হচ্ছেন। আবার বাজারের ভিড়ে আসাটাও কমে গেছে।’
বিল্লাল হোসেন নামের যুবকদের একজন জানান, ‘আমি এ কাজের জন্য টাকা দিতে পারিনি, তবে পরিশ্রম করে পুশিয়ে দিচ্ছি।’ নির্ঝর জানান, ‘আমার বাবার বড় ব্যবসা রয়েছে। আমি সেখানে বসতাম। কিন্ত এখন ব্যবসা বন্ধ থাকায় গ্রামের মধ্যে দোকান দিয়ে সবজি বিক্রি করছি।’ তিনি জানান, ‘সবজি চাষিরাও সবজি বিক্রি করতে পারছিলেন না। আবার সাংসারিক প্রয়োজনে অন্যদেরকেও সবজি ও মাছ কিনতে বাজারে যেতে হচ্ছিল। এখন আমরা এ দুটি মাথায় নিয়ে কাজ করছি। তা ছাড়াও বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীদের চেয়ে কম দামে সবজি ও মাছ দিতে পারায় গ্রামের মানুষ আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। ব্যবসায় যতটুকু লাভ হচ্ছে, তার কিছু অংশ রেখে দিয়ে বাকিটা পরিমাণ মতো সবজি প্রতিদিন হতদরিদ্রদের বাড়িতে আমাদের মায়েদের দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
ওই গ্রামের বাসিন্দা ইউপি সদস্য মাহাফুজুর রহমান লাকী জানান, ‘গ্রামের যুবকদের এমন উদ্যোগের ফলে আমাদের গ্রামের মানুষের বাজারে যাওয়া একেবারেই কমে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের লাভের টাকা হতে হতদরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে খুব গোপনে বিনা মূল্যে সবজি পাঠিয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের এমন কাজে এখন বড়রাও বেশ সাহায্য করছেন। সব মিলিয়ে যুবকদের এমন মহৎ উদ্যোগকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়।’