ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

নির্বাচনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১১:০৯:৪৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ জুন ২০১৮
  • / ৩২৬ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ ডেস্ক: দেশের সর্বত্রই এখন নির্বাচনী আবহ। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রুপসা থেকে পাথুরিয়া সবখানেই একই চিত্র। প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে চলছে ভোটের প্রচারণা-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় সংসদে ‘নির্বাচনী বাজেট’ ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের বরেণ্য ব্যক্তিরা থেকে শুরু করে জাতিসংঘ, দাতাদেশ-সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক মহল ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ নিয়ে সোচ্চার। ‘নির্বাচনকালীণ সরকার’ ইস্যুর সুরহা না হলেও তৃর্ণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বামপন্থী, মধ্যবাম, ইসলামী দলসহ সব মত-পথের দলের নেতারা নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীরা আসন ভিত্তিক প্রচারণাও শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের মধ্যে দলীয় নমিনেশনের জন্য দৌঁড়ঝাপও শুরু হয়ে গেছে। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই বছর ২৯ জানুয়ারি সংসদের প্রথম অধিবেশনে বসে। সংবিধান অনুযায়ী চলতি বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে হবে। তাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শুরু হয়ে গেছে সর্বাত্মক প্রস্তুতি। নির্বাচন কমিশন এক বছর আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ৬ মাস আগেই বার্তা দিয়েছেন অক্টোবরে তফসিল ঘোষণা এবং ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সরকারের চার বছর পূর্তি উপলক্ষে গত ১২ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষ দিকে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কীভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তা সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। সেই সরকার সর্বতোভাবে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনায় সহায়তা দিয়ে যাবে।’ কয়েক মাস আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ঘোষণা দেন অক্টোবরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, ‘অক্টোবরে ছোট্ট আকারে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে’। ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ নিয়ে বিতর্কের সুরাহা না হলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যেই ‘জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি’ গঠন করেছে। ভোটের আগাম প্রস্তুতি এবং নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে দলটি। অন্যদিকে বিএনপি ভোটের আগে ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ বিষয়ে এখনো আপত্তি থাকলেও দলীয় চেয়ারপার্সনের মুক্তি নিয়ে ব্যাতিব্যস্ত। তবে ভিতরে ভিতরে দলটি নির্বাচনের অংশ গ্রহণের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃর্ণমূল পর্যায়ে দলটি এবং ২০ দলীয় শরীক দলের নেতাকর্মীরা হামলা-মামলা মোকাবিলার মধ্যেই নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল সজাগ দৃষ্টি রাখছে। প্রভাবশালী দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো চায় বাংলাদেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকুক। ৫ জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচনের পর থেকে তারা এ বিষয়ে নানা ফোরাম-পর্যায়ে দেন দরবার করছে; উপদেশ-পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের আগে জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সাবেক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মহাসচিবদের সঙ্গে বৈঠক করে সমঝোতার চেষ্টা করেন। এবার ৩০ জুন ঢাকায় আসছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখতে এলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির নেতাদের সঙ্গে পৃথক পৃথক ভাবে বৈঠকে মিলিত হবেন। আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ বিষয়ে তার ভূমিকাও থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অনেক আগ থেকেই নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছে। দলের জাতীয় কাউন্সিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের ৫ জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচনের প্রসঙ্গ উল্লেখ না করেই দলীয় নেতাকর্মীদের বার্তা দেন ‘এবার হবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’। তারপর থেকেই শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যেখানে সরকারি সফরে গেছেন মানুষের কাছে নৌকা মার্কায় ভোট প্রার্থনা করেছেন। নির্বাচনে বিএনপি আসবে কি না সে নিয়ে সংশয় থাকায় নির্বাচনী কৌশল চূড়ান্ত করেনি। গৃহপালিত বিরোধী দল এরশাদের জাতীয় পার্টিকে ‘নির্বাচনী মাঠের কোন সাইটে খেলাবেন’ তা এখনো ঝুলন্ত রাখলেও ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ‘জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি’ গঠন করেছে। ওই কমিটির কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এইচটি ইমামকে। সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সদস্য সচিব এবং নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য করা হয়েছে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও লীগের সহযোগী সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকবৃন্দকে। এই কমিটি সারাদেশের দলের বর্তমান এমপি, প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন। দলের প্রার্থী হবেন সে ব্যাপারে এই কমিটি প্রস্তাবনা দেবেন। তবে বিভিন্ন সংস্থা ও কয়েকটি গ্রুপের জরীপের ফলাফল যাচাই বাছাই করে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। শরীক দলগুলো একশ আসন দাবী করায় কয়েকদিন আগে ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, আলোচনা করে ১৪ দলীয় জোটের শরীকদের মনোনয়ন দেয়া হবে। ১৪ দলীয় জোটের মূখপত্র মোঃ নাসিম জানান, ১৪ দলের যে নেতা যে আসনে জনপ্রিয় সেখানে তাকেই নৌকা মার্কার প্রার্থী করা হবে। নির্বাচনী প্রস্তুতির নির্দেশনা পাওয়ার পর তৃর্ণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নির্বাচনী প্রচারণায় কার্যত নেমে পড়েছেন।
ভারতে কংগ্রেসের ভরাডুবি এবং বিজেপি ক্ষমতায় আসায় দিল্লী নির্ভরতা কমে যাওয়ার পরও এবার হ্যাটট্রিক জয়ের লক্ষ্যে ছক কষে দেশব্যাপী প্রচারণায় নেমেছে দলটি। জানা গেছে সারাদেশে কেন্দ্র ভিত্তিক ১২ লাখ পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। তিনশ আসনে এ, বি, সি ক্যাটাগরিতে প্রার্থী বাছাই করা হয়েছে। দলের প্রার্থী বাছাই, প্রচার-প্রচারণা, নির্বাচনী ইশেতহার তৈরিসহ নির্বাচনভিত্তিক সার্বিক কর্মকা- চলছে। দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে মাঠে উন্নয়ন ফিরিস্তি তুলে ধরে প্রচারণার কাজ করছেন সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় এখন নিয়মিত যাতায়াত করছেন। শত শত নেতা এবার নির্বাচনী এলাকায় ঈদ করেছেন। তারা স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন ৩০ জানুয়ারি সিলেটের জনসভায় নৌকা মার্কায় ভোট চাওয়ার মধ্য দিয়ে। এরপর ৮ ফেব্রুয়ারি বরিশাল এবং সর্বশেষ ২২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী, ৩ মার্চ খুলনায় এবং ৭ মার্চ রাজধানীতে জনসভা করে নৌকা মার্কায় ভোট চান। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের অধীনেই নির্বাচন হবে। তিনি গতকাল বলেছেন, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্যে নির্বাচনকালীন সরকার অক্টোবরে গঠিত হতে পারে। এই সরকারের আকার ছোট হবে; তবে বিষয়টি পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। তিনিই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
অন্যদিকে দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিকে প্রাধান্য দিলেও নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছে বিএনপি। দলটির কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃর্ণমূল পর্যায়ের নেতারা কেউ আওয়ামী লীগকে ৫ জানুয়ারীর মতো ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার সুযোগ দিতে নাজী নন। তারা কেন্দ্রীয় নের্তৃত্বকে নিজেদের মত জানিয়েছেন। সেই বার্তা নিয়ে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ল-ন যান এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জানান। তিনি নেতাকর্মীদের বার্তা পেয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। সুত্রের দাবি, বিএনপি মনে করছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেই বেগম জিয়াকে কারাগারে রাখা হয়েছে। ভোটের আগে তাকে মুক্তি দেয়া হবে না। এই বাস্তবতা মেনেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। তারেক রহমান নির্দেশনা দেন বেগম জিয়ার মুক্তির দাবির পাশাপাশি নির্বাচনী প্রচারণা ও মাঠে থাকতে হবে। এছাড়া দাতাদেশ, সংস্থা, ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকসহ আন্তর্জাতিক মহলও পরামর্শ দিয়েছেন বিএনপি যেনো নির্বাচনের মাঠ থেকে এবার দূরে না থাকে। বিশেষ করে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ তিন নেতা দিল্লী গেলে সেখান থেকে নির্বাচনে অংশ দেওয়া পরামর্শই দেয়া হয়েছে বলে এক নেতা জানান। বিএনপির দাবি ছিল ‘দিল্লী যেন ৫ জানুয়ারীর মতো অনৈতিক আচরণ না করে। জনগণের ভোটে যেন বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা হয়। এতে ভারতই লাভবান হবে’। জবাবে বিএনপিকে দিল্লী নিশ্চিত করেছে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেকার সম্পর্ক পিপলস টু পিপলস। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর মতো (কংগ্রেস শাসনামলে পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এর ভূমিকা) অবস্থানে তারা নেই। ভারতের নতুন পররাষ্ট্র সচিব ঢাকা সফর করে সে বার্তা দিয়ে গেছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ সম্প্রতি মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের বলেছেন, তারা অবশ্যই এবার নির্বাচনে অংশ নেবে। জানা গেছে, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছে গত দুই বারে ক্ষমতায় থাকার কারণে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তাদের জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনগুলোকে ‘নির্বাচনের রিহ্যাসসেল’ মনে করছে দলটি। আওয়ামী লীগের জুলুম-নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে জনগণ ধানের শীর্ষে ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। বিএনপি মাঠে থাকলেই ব্যাপক ভোট পাবে। তাছাড়া খালেদা জিয়ার কারাবন্দীত্ব নির্বাচনে ইতিবাচক ভুমিকা রাখবে বলে মনে করছে বিএনপির হাইকমান্ড। এরসঙ্গে রয়েছে আন্তর্জাতিক চাপ। কূটনৈতিক মহল চাইছে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিক। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করা বিএনপির পালে যে নির্বাচনী হাওয়া লেগেছে সেটা বেশ পরিস্কার।
এদিকে এরশাদের জাতীয় পার্টিসহ অপরাপর দলগুলোও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরশাদের জাতীয় পার্টি দেশের রাজনীতিতে কার্যত ‘নাচের পুতুল’ হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা যেভাবে ভোটের বাজারে নাচার নির্দেশনা দেবেন এরশাদ সেভাবেই নাচবেন। তিনি নানান স্ববিরোধী কথাবার্তা বললেও চাতক পাখির মতো তাকিয়ে রয়েছে শেখ হাসিনার নির্দেশনার অপেক্ষায়। বি চৌধুরী, ড. কামাল হোসেন, কাদের সিদ্দিকী, আসম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছেন নির্বাচনে অংশ নিতেই। সিপিবি-বাসদসহ ইসলামী ধারা ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে, ৫ জানুয়ারীর মতো ভোট নয়; এবার নির্বাচনের মাঠে জমবে ‘খেলা’।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

নির্বাচনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি

আপলোড টাইম : ১১:০৯:৪৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ জুন ২০১৮

সমীকরণ ডেস্ক: দেশের সর্বত্রই এখন নির্বাচনী আবহ। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রুপসা থেকে পাথুরিয়া সবখানেই একই চিত্র। প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে চলছে ভোটের প্রচারণা-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় সংসদে ‘নির্বাচনী বাজেট’ ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের বরেণ্য ব্যক্তিরা থেকে শুরু করে জাতিসংঘ, দাতাদেশ-সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক মহল ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ নিয়ে সোচ্চার। ‘নির্বাচনকালীণ সরকার’ ইস্যুর সুরহা না হলেও তৃর্ণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বামপন্থী, মধ্যবাম, ইসলামী দলসহ সব মত-পথের দলের নেতারা নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীরা আসন ভিত্তিক প্রচারণাও শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের মধ্যে দলীয় নমিনেশনের জন্য দৌঁড়ঝাপও শুরু হয়ে গেছে। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই বছর ২৯ জানুয়ারি সংসদের প্রথম অধিবেশনে বসে। সংবিধান অনুযায়ী চলতি বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে হবে। তাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শুরু হয়ে গেছে সর্বাত্মক প্রস্তুতি। নির্বাচন কমিশন এক বছর আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ৬ মাস আগেই বার্তা দিয়েছেন অক্টোবরে তফসিল ঘোষণা এবং ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সরকারের চার বছর পূর্তি উপলক্ষে গত ১২ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষ দিকে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কীভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তা সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। সেই সরকার সর্বতোভাবে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনায় সহায়তা দিয়ে যাবে।’ কয়েক মাস আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ঘোষণা দেন অক্টোবরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, ‘অক্টোবরে ছোট্ট আকারে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে’। ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ নিয়ে বিতর্কের সুরাহা না হলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যেই ‘জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি’ গঠন করেছে। ভোটের আগাম প্রস্তুতি এবং নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে দলটি। অন্যদিকে বিএনপি ভোটের আগে ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ বিষয়ে এখনো আপত্তি থাকলেও দলীয় চেয়ারপার্সনের মুক্তি নিয়ে ব্যাতিব্যস্ত। তবে ভিতরে ভিতরে দলটি নির্বাচনের অংশ গ্রহণের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃর্ণমূল পর্যায়ে দলটি এবং ২০ দলীয় শরীক দলের নেতাকর্মীরা হামলা-মামলা মোকাবিলার মধ্যেই নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল সজাগ দৃষ্টি রাখছে। প্রভাবশালী দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো চায় বাংলাদেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকুক। ৫ জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচনের পর থেকে তারা এ বিষয়ে নানা ফোরাম-পর্যায়ে দেন দরবার করছে; উপদেশ-পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের আগে জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সাবেক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মহাসচিবদের সঙ্গে বৈঠক করে সমঝোতার চেষ্টা করেন। এবার ৩০ জুন ঢাকায় আসছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখতে এলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির নেতাদের সঙ্গে পৃথক পৃথক ভাবে বৈঠকে মিলিত হবেন। আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ বিষয়ে তার ভূমিকাও থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অনেক আগ থেকেই নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছে। দলের জাতীয় কাউন্সিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের ৫ জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচনের প্রসঙ্গ উল্লেখ না করেই দলীয় নেতাকর্মীদের বার্তা দেন ‘এবার হবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’। তারপর থেকেই শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যেখানে সরকারি সফরে গেছেন মানুষের কাছে নৌকা মার্কায় ভোট প্রার্থনা করেছেন। নির্বাচনে বিএনপি আসবে কি না সে নিয়ে সংশয় থাকায় নির্বাচনী কৌশল চূড়ান্ত করেনি। গৃহপালিত বিরোধী দল এরশাদের জাতীয় পার্টিকে ‘নির্বাচনী মাঠের কোন সাইটে খেলাবেন’ তা এখনো ঝুলন্ত রাখলেও ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ‘জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি’ গঠন করেছে। ওই কমিটির কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এইচটি ইমামকে। সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সদস্য সচিব এবং নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য করা হয়েছে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও লীগের সহযোগী সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকবৃন্দকে। এই কমিটি সারাদেশের দলের বর্তমান এমপি, প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন। দলের প্রার্থী হবেন সে ব্যাপারে এই কমিটি প্রস্তাবনা দেবেন। তবে বিভিন্ন সংস্থা ও কয়েকটি গ্রুপের জরীপের ফলাফল যাচাই বাছাই করে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। শরীক দলগুলো একশ আসন দাবী করায় কয়েকদিন আগে ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, আলোচনা করে ১৪ দলীয় জোটের শরীকদের মনোনয়ন দেয়া হবে। ১৪ দলীয় জোটের মূখপত্র মোঃ নাসিম জানান, ১৪ দলের যে নেতা যে আসনে জনপ্রিয় সেখানে তাকেই নৌকা মার্কার প্রার্থী করা হবে। নির্বাচনী প্রস্তুতির নির্দেশনা পাওয়ার পর তৃর্ণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নির্বাচনী প্রচারণায় কার্যত নেমে পড়েছেন।
ভারতে কংগ্রেসের ভরাডুবি এবং বিজেপি ক্ষমতায় আসায় দিল্লী নির্ভরতা কমে যাওয়ার পরও এবার হ্যাটট্রিক জয়ের লক্ষ্যে ছক কষে দেশব্যাপী প্রচারণায় নেমেছে দলটি। জানা গেছে সারাদেশে কেন্দ্র ভিত্তিক ১২ লাখ পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। তিনশ আসনে এ, বি, সি ক্যাটাগরিতে প্রার্থী বাছাই করা হয়েছে। দলের প্রার্থী বাছাই, প্রচার-প্রচারণা, নির্বাচনী ইশেতহার তৈরিসহ নির্বাচনভিত্তিক সার্বিক কর্মকা- চলছে। দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে মাঠে উন্নয়ন ফিরিস্তি তুলে ধরে প্রচারণার কাজ করছেন সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় এখন নিয়মিত যাতায়াত করছেন। শত শত নেতা এবার নির্বাচনী এলাকায় ঈদ করেছেন। তারা স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন ৩০ জানুয়ারি সিলেটের জনসভায় নৌকা মার্কায় ভোট চাওয়ার মধ্য দিয়ে। এরপর ৮ ফেব্রুয়ারি বরিশাল এবং সর্বশেষ ২২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী, ৩ মার্চ খুলনায় এবং ৭ মার্চ রাজধানীতে জনসভা করে নৌকা মার্কায় ভোট চান। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের অধীনেই নির্বাচন হবে। তিনি গতকাল বলেছেন, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্যে নির্বাচনকালীন সরকার অক্টোবরে গঠিত হতে পারে। এই সরকারের আকার ছোট হবে; তবে বিষয়টি পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। তিনিই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
অন্যদিকে দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিকে প্রাধান্য দিলেও নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছে বিএনপি। দলটির কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃর্ণমূল পর্যায়ের নেতারা কেউ আওয়ামী লীগকে ৫ জানুয়ারীর মতো ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার সুযোগ দিতে নাজী নন। তারা কেন্দ্রীয় নের্তৃত্বকে নিজেদের মত জানিয়েছেন। সেই বার্তা নিয়ে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ল-ন যান এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জানান। তিনি নেতাকর্মীদের বার্তা পেয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। সুত্রের দাবি, বিএনপি মনে করছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেই বেগম জিয়াকে কারাগারে রাখা হয়েছে। ভোটের আগে তাকে মুক্তি দেয়া হবে না। এই বাস্তবতা মেনেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। তারেক রহমান নির্দেশনা দেন বেগম জিয়ার মুক্তির দাবির পাশাপাশি নির্বাচনী প্রচারণা ও মাঠে থাকতে হবে। এছাড়া দাতাদেশ, সংস্থা, ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকসহ আন্তর্জাতিক মহলও পরামর্শ দিয়েছেন বিএনপি যেনো নির্বাচনের মাঠ থেকে এবার দূরে না থাকে। বিশেষ করে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ তিন নেতা দিল্লী গেলে সেখান থেকে নির্বাচনে অংশ দেওয়া পরামর্শই দেয়া হয়েছে বলে এক নেতা জানান। বিএনপির দাবি ছিল ‘দিল্লী যেন ৫ জানুয়ারীর মতো অনৈতিক আচরণ না করে। জনগণের ভোটে যেন বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা হয়। এতে ভারতই লাভবান হবে’। জবাবে বিএনপিকে দিল্লী নিশ্চিত করেছে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেকার সম্পর্ক পিপলস টু পিপলস। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর মতো (কংগ্রেস শাসনামলে পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এর ভূমিকা) অবস্থানে তারা নেই। ভারতের নতুন পররাষ্ট্র সচিব ঢাকা সফর করে সে বার্তা দিয়ে গেছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ সম্প্রতি মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের বলেছেন, তারা অবশ্যই এবার নির্বাচনে অংশ নেবে। জানা গেছে, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছে গত দুই বারে ক্ষমতায় থাকার কারণে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তাদের জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনগুলোকে ‘নির্বাচনের রিহ্যাসসেল’ মনে করছে দলটি। আওয়ামী লীগের জুলুম-নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে জনগণ ধানের শীর্ষে ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। বিএনপি মাঠে থাকলেই ব্যাপক ভোট পাবে। তাছাড়া খালেদা জিয়ার কারাবন্দীত্ব নির্বাচনে ইতিবাচক ভুমিকা রাখবে বলে মনে করছে বিএনপির হাইকমান্ড। এরসঙ্গে রয়েছে আন্তর্জাতিক চাপ। কূটনৈতিক মহল চাইছে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিক। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করা বিএনপির পালে যে নির্বাচনী হাওয়া লেগেছে সেটা বেশ পরিস্কার।
এদিকে এরশাদের জাতীয় পার্টিসহ অপরাপর দলগুলোও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরশাদের জাতীয় পার্টি দেশের রাজনীতিতে কার্যত ‘নাচের পুতুল’ হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা যেভাবে ভোটের বাজারে নাচার নির্দেশনা দেবেন এরশাদ সেভাবেই নাচবেন। তিনি নানান স্ববিরোধী কথাবার্তা বললেও চাতক পাখির মতো তাকিয়ে রয়েছে শেখ হাসিনার নির্দেশনার অপেক্ষায়। বি চৌধুরী, ড. কামাল হোসেন, কাদের সিদ্দিকী, আসম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছেন নির্বাচনে অংশ নিতেই। সিপিবি-বাসদসহ ইসলামী ধারা ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে, ৫ জানুয়ারীর মতো ভোট নয়; এবার নির্বাচনের মাঠে জমবে ‘খেলা’।