ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

নিজের মৃত্যুর ভবিষ্যৎ বাণীর ৩৯ বছর পরেও বেঁচে আছেন সিরাজ ফকির

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:০১:৪৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৯ জুন ২০২১
  • / ৯৫ বার পড়া হয়েছে

আরিফ হাসান, হিজলগাড়ী: ৩৯ বছর পূর্বে নিজের মৃত্যুর দিনক্ষণ জানিয়ে ব্যাপক আলোচিত হওয়া চুয়াডাঙ্গার নেহালপুর গ্রামের সিরাজ ফকির মৃত্যুর ওপর অপেক্ষায় ছাড়া এখনও বেঁেচ আছেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে পড়ে গেছে মুখের দাঁত, সাদা হয়ে পড়েছে মাথার চুল, সেই সাথে শরীরের চামড়ায় পড়েছে ভাজ। ৩৯ বছর আগে কেন, কী কারণে এলাকাবাসীকে নিজেই নিজের মৃত্যুর দিন-তারিখ-মাস আর সময় জানিয়েছিলেন, আর কেনই বা মৃত্যু হলো না, প্রশ্নের উত্তরে ৩৯ বছর যাবত নীরব থাকায় সিরাজ ফকিরকে ঘিরে জানার আগ্রহের কমতি নেই এলাকাবাসীর। বাইরের এলাকায় গেলে এখনও নেহালপুর গ্রামবাসীকে সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়, তাহলো সিরাজ ফকির কি এখনও বেঁচে আছে?। ইন্টারনেট ফেসবুকবিহীন সময়েও দুই বাংলায় ভাইরাল সিরাজ ফকিরের সাথে নানা বিষয় কথার সময় ৩৯ বছর আগের ৭ আষাঢ় কী হয়েছিল কী হয়েছিল তা জানালেন অকপটে।
জানা যায়, ১৯৮২ সালের প্রথম দিকে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নেহালপুর গ্রামের পান্তাপাড়ার মৃত আকালে মণ্ডলের ছেলে সিরাজ হঠাৎ করেই ঘোষণা দেন ৭ আষাঢ় রোববার দ্বিপ্রহরে তিনি মৃত্যুবরণ করবেন। ৪১ দিন আগে নিজের মৃত্যুর দিনক্ষণ গ্রামে প্রচার করলে সেই খবর পুরো জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। নিজের মৃত্যুর সংবাদ নিজেই জানিয়ে দেওয়ায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। মোবাইল, ফেসবুক কিংবা ইন্টারনেট না থাকলেও এক-কান দু-কান করে সেই কথা ছড়িয়ে পড়ে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়াসহ অনেক জেলাতে। এমনকি দেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়ায় সিরাজের এই মৃত্যুর দিনক্ষণের খবর। বহু দূরান্ত থেকে মানুষ সিরাজকে দেখতে আসে। কয়েক দিনের মধ্যেই পীরের আস্তানায় পরিণত হয় তাঁর বাড়ি। অন্যদিকে নির্ধারিত দিন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে নেহালপুর গ্রামের বাসিন্দাদের বাড়িতেও আত্মীয়-স্বজন আসার ধুম পড়ে যায়। দলে দলে মানুষ ছুটে আসতে থাকে সিরাজকে দেখার জন্য। যে-যার সামর্থ্য অনুযায়ী খাবার নিয়ে আসে সিরাজকে খাওয়ানোর জন্য।
মৃত্যুর ঘোষণা দেওয়ার পর সিরাজ তাঁর নিজস্ব ভক্তদের মাঝে তাঁর মৃত্যুর পর কে, কী দায়িত্ব পালন করবেন, কোথায় দাফন করা হবে লাশ, সব কিছু বুঝিয়ে দেন। রোববার সকাল থেকে গরু-মহিষের গাড়ী, বাসে করে কিংবা পায়ে হেটে নেহালপুর গ্রামে সিরাজ ফকিরের মৃত্যুর দৃশ্য দেখার জন্য ছুটে আসতে থাকে দলে দলে মানুষ। দুপুরের আগেই নেহালপুর স্কুলমাঠসহ পুরো এলাকা জনস্রোতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সীমান্ত পেরিয়ে পাশ্ববর্তী দেশ ভারত থেকেও মানুষ আসে মৃত্যুর দৃশ্য দেখার জন্য। জনতার ঢল সামলাতে আসে কয়েক গাড়ি পুলিশও। সিরাজ নিজেই তাঁর মৃত্যুর স্থান নির্ধারণ করে দেন নেহালপুর স্কুলমাঠের ঠিক মাঝখানে। সেখানে বাঁশ দিয়ে মঞ্চ তৈরি করে চৌকি পেতে সিরাজ ফকির মৃত্যুর জন্য শুয়ে পড়েন। প্রায় একঘণ্টা শুয়ে থাকেন তিনি। দীর্ঘ সময় মৃত্যু না হওয়ায় উপস্থিতি জনতা উত্তেজিত হতে শুরু করে। এরই একপয়ার্যে সিরাজ শোয়া থেকে উঠে চিৎকার দিয়ে বলেন এই মাত্র আল্লাহ আমার হায়াত আরও ১শ বছর বৃদ্ধি করে দিলেন। বলেই ভৌ-দৌঁড় দিয়ে পালিয়ে নেহালপুর গ্রামের সোনা মণ্ডলের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এসময় উত্তেজিত জনতা সিরাজকে গণপিটুনী দিতে উদ্যত হলে পুলিশ জনরোষ থেকে সিরাজকে প্রাণে রক্ষা করে আটক করে। আটককের পর সিরাজকে ১৫৪ ধারায় মামলাপূর্বক ৫০ টাকা জরিমানা করে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়। সেই মামলায় ২৭ দিন ৫০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও একদিন মোট ২৮ দিন হাজতবাস করে বাড়ি ফেরেন সিরাজ।
সেই সময়ে ঘটনার প্রত্যাক্ষদর্শী নেহালপুর গ্রামের হাফেজ লোকমান হোসেন বলেন, সিরাজ ফকির তখন নতুন ফকির (সাধু) হওয়ার জন্য কথিত এক পীরের কাছে মুরিদ হয়েছিলেন। মুরিদ হওয়ার পরই তিনি বিভিন্ন ধরনের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন। লোকমুখে শোনা যায়, ঘটনার ৪১ মাস আগে সিরাজ তাঁর আস্তানায় বসে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নিজেই মৃত্যুর দিনক্ষণ জানান। যেহেতু সেই সময় গ্রামাঞ্চলের মানুষ এখনকার মতো সচেতন ছিল না, সে কারণে সিরাজের কথাটা যাচাই-বাছাই না করেই মানুষ তা বিশ্বাস করে। এবং সিরাজের মৃত্যুর দৃশ্য দেখার জন্য ভীড় করেন। তিনি আরও বলেন, একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না কখন কোন অবস্থায় কার মৃত্যু হবে। মৃত্যুর সংবাদ ভাইরাল হয়ে গেলে সিরাজের কদর বেড়ে যায়।
একই গ্রামের আলামিন হোসেন নামের এক যুবক বলেন, ‘সিরাজ মরতে চেয়েছিল আমাদের জন্মেরও আগে। কিন্ত এখনও বাইরে গিয়ে যদি নিজ গ্রামের নাম বলি তবে বয়স্ক মানুষরা জানতে চাই, সিরাজ কী এখনও বেঁচে আছে?’ সিরাজ ফকিরের এক প্রতিবেশী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আসলে তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজের মৃত্যুর নাটক সাজিয়ে ফায়দা লুটে নেওয়া। কী ধরনের ফায়দার কথা বলছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, পীর-মুরিদ করে টাকা ইনকাম করায় মূল উদ্দেশ্য ছিল।
ফারুখ জোয়ার্দ্দার নামে হিজলগাড়ী বাজারের এক জুতা ব্যবসায়ী বলেন, ‘বাপ-দাদাদের কাছ থেকে শুনেছি, সিরাজ মৃত্যুর ঘোষণা দেওয়ার পর নেহালপুর গ্রামে প্রতিটি বাড়িতে এত পরিমাণ আত্মীয়-স্বজন আসে, তাদের খেতে দিতে গিয়ে অনেক বাড়ির গোলার ধান, মুড়ি, চিড়া গাছের ফলফলাদি ফুরিয়ে যায়।’
জনরোষ থেকে বাঁচতে সিরাজ যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই সোনাই মন্ডলের বড় ছেলে দাউদ আলী বলেন, ‘সিরাজ নিজের মৃত্যুর দিন তারিখ জানিয়ে নির্ধারিত দিনের আগেই গ্রাম থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু ঘোষণা দেওয়ার পরদিন থেকেই নেহালপুর গ্রামসহ আশেপাশের কয়েক গ্রামের মানুষের প্রতিনিয়ত ভিড় লেগে থাকত সিরাজের বাড়িতে। কোনোভাবেই মানুষের চোখের আড়াল হতে পারেনি সে। এছাড়া লোকমুখে শোনা যায়, সিরাজ বিকল্প পন্থায়ও মৃত্যুর চেষ্টা করতে চেয়েছিল। নির্ধারিত দিনের আগে থেকেই বিপুল সংখ্যাক মানুষের উপস্থিতি ও নির্ধারিত দিনে জনতার ভিড় আর বিপুল সংখ্যা পুলিশের উপস্থিতিতে সিরাজ নিজেও হতবম্ব হয়ে পড়ে।’
কেন, কী কারণে নিজেই নিজের মৃত্যুর দিনক্ষণ জানিয়েছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাব সবসময়ই নীরব থেকেছেন ৩৯ বছর পূর্বের ভাইরাল সিরাজ। সময়ের সমীকরণ-এর করা প্রশ্নে ৩৯ বছর পর মুখ খোলেন সিরাজ। তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে বিভিন্নজন বিভিন্ন ধরনের কথা বললেও আসলে আমি স্বপ্নের মাধ্যমে জানতে পারি ৮ আষাঢ় আমার জীবনে বড় একটা বিপদ আসছে, সেই বিপদে আমি মারা যেতে পারি। সেই বিপদের কথা ভক্ত অনুসারীদের জানালে তারা তা অতিরঞ্জিত করে প্রচার করে। লক্ষ মানুষের উপস্থিতি দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে যায়। নির্ধারিত দিনে এত মানুষের চাপে বাধ্য হয়ে স্কুলমাঠে হাজার হাজার মানুষের মাঝে তৈরি করা ছাউনীর নিচে পাতা চৌকিতে গিয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল।’ পৃথিবী ছেড়ে কেউ কোনো দিন মরতে চাই? এমন পাল্টা প্রশ্ন করে সিরাজ আরও বলেন, ‘সেদিন মানুষ আমার মৃত্যুর দৃশ্য দেখার জন্য যেভাবে নেহালপুর স্কুলমাঠে ভিড় করেছিল, সচোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। একজন মানুষ মারা যাবে, আর সেই দৃশ্য দেখার জন্য মানুষের উল্লাস দেখে সেদিন সত্যি সত্যিই মরে যেতে ইচ্ছা করছিল, কিন্ত মরণ তো আর মুখের কথা নয়।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

নিজের মৃত্যুর ভবিষ্যৎ বাণীর ৩৯ বছর পরেও বেঁচে আছেন সিরাজ ফকির

আপলোড টাইম : ১০:০১:৪৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৯ জুন ২০২১

আরিফ হাসান, হিজলগাড়ী: ৩৯ বছর পূর্বে নিজের মৃত্যুর দিনক্ষণ জানিয়ে ব্যাপক আলোচিত হওয়া চুয়াডাঙ্গার নেহালপুর গ্রামের সিরাজ ফকির মৃত্যুর ওপর অপেক্ষায় ছাড়া এখনও বেঁেচ আছেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে পড়ে গেছে মুখের দাঁত, সাদা হয়ে পড়েছে মাথার চুল, সেই সাথে শরীরের চামড়ায় পড়েছে ভাজ। ৩৯ বছর আগে কেন, কী কারণে এলাকাবাসীকে নিজেই নিজের মৃত্যুর দিন-তারিখ-মাস আর সময় জানিয়েছিলেন, আর কেনই বা মৃত্যু হলো না, প্রশ্নের উত্তরে ৩৯ বছর যাবত নীরব থাকায় সিরাজ ফকিরকে ঘিরে জানার আগ্রহের কমতি নেই এলাকাবাসীর। বাইরের এলাকায় গেলে এখনও নেহালপুর গ্রামবাসীকে সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়, তাহলো সিরাজ ফকির কি এখনও বেঁচে আছে?। ইন্টারনেট ফেসবুকবিহীন সময়েও দুই বাংলায় ভাইরাল সিরাজ ফকিরের সাথে নানা বিষয় কথার সময় ৩৯ বছর আগের ৭ আষাঢ় কী হয়েছিল কী হয়েছিল তা জানালেন অকপটে।
জানা যায়, ১৯৮২ সালের প্রথম দিকে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নেহালপুর গ্রামের পান্তাপাড়ার মৃত আকালে মণ্ডলের ছেলে সিরাজ হঠাৎ করেই ঘোষণা দেন ৭ আষাঢ় রোববার দ্বিপ্রহরে তিনি মৃত্যুবরণ করবেন। ৪১ দিন আগে নিজের মৃত্যুর দিনক্ষণ গ্রামে প্রচার করলে সেই খবর পুরো জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। নিজের মৃত্যুর সংবাদ নিজেই জানিয়ে দেওয়ায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। মোবাইল, ফেসবুক কিংবা ইন্টারনেট না থাকলেও এক-কান দু-কান করে সেই কথা ছড়িয়ে পড়ে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়াসহ অনেক জেলাতে। এমনকি দেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়ায় সিরাজের এই মৃত্যুর দিনক্ষণের খবর। বহু দূরান্ত থেকে মানুষ সিরাজকে দেখতে আসে। কয়েক দিনের মধ্যেই পীরের আস্তানায় পরিণত হয় তাঁর বাড়ি। অন্যদিকে নির্ধারিত দিন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে নেহালপুর গ্রামের বাসিন্দাদের বাড়িতেও আত্মীয়-স্বজন আসার ধুম পড়ে যায়। দলে দলে মানুষ ছুটে আসতে থাকে সিরাজকে দেখার জন্য। যে-যার সামর্থ্য অনুযায়ী খাবার নিয়ে আসে সিরাজকে খাওয়ানোর জন্য।
মৃত্যুর ঘোষণা দেওয়ার পর সিরাজ তাঁর নিজস্ব ভক্তদের মাঝে তাঁর মৃত্যুর পর কে, কী দায়িত্ব পালন করবেন, কোথায় দাফন করা হবে লাশ, সব কিছু বুঝিয়ে দেন। রোববার সকাল থেকে গরু-মহিষের গাড়ী, বাসে করে কিংবা পায়ে হেটে নেহালপুর গ্রামে সিরাজ ফকিরের মৃত্যুর দৃশ্য দেখার জন্য ছুটে আসতে থাকে দলে দলে মানুষ। দুপুরের আগেই নেহালপুর স্কুলমাঠসহ পুরো এলাকা জনস্রোতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সীমান্ত পেরিয়ে পাশ্ববর্তী দেশ ভারত থেকেও মানুষ আসে মৃত্যুর দৃশ্য দেখার জন্য। জনতার ঢল সামলাতে আসে কয়েক গাড়ি পুলিশও। সিরাজ নিজেই তাঁর মৃত্যুর স্থান নির্ধারণ করে দেন নেহালপুর স্কুলমাঠের ঠিক মাঝখানে। সেখানে বাঁশ দিয়ে মঞ্চ তৈরি করে চৌকি পেতে সিরাজ ফকির মৃত্যুর জন্য শুয়ে পড়েন। প্রায় একঘণ্টা শুয়ে থাকেন তিনি। দীর্ঘ সময় মৃত্যু না হওয়ায় উপস্থিতি জনতা উত্তেজিত হতে শুরু করে। এরই একপয়ার্যে সিরাজ শোয়া থেকে উঠে চিৎকার দিয়ে বলেন এই মাত্র আল্লাহ আমার হায়াত আরও ১শ বছর বৃদ্ধি করে দিলেন। বলেই ভৌ-দৌঁড় দিয়ে পালিয়ে নেহালপুর গ্রামের সোনা মণ্ডলের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এসময় উত্তেজিত জনতা সিরাজকে গণপিটুনী দিতে উদ্যত হলে পুলিশ জনরোষ থেকে সিরাজকে প্রাণে রক্ষা করে আটক করে। আটককের পর সিরাজকে ১৫৪ ধারায় মামলাপূর্বক ৫০ টাকা জরিমানা করে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়। সেই মামলায় ২৭ দিন ৫০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও একদিন মোট ২৮ দিন হাজতবাস করে বাড়ি ফেরেন সিরাজ।
সেই সময়ে ঘটনার প্রত্যাক্ষদর্শী নেহালপুর গ্রামের হাফেজ লোকমান হোসেন বলেন, সিরাজ ফকির তখন নতুন ফকির (সাধু) হওয়ার জন্য কথিত এক পীরের কাছে মুরিদ হয়েছিলেন। মুরিদ হওয়ার পরই তিনি বিভিন্ন ধরনের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন। লোকমুখে শোনা যায়, ঘটনার ৪১ মাস আগে সিরাজ তাঁর আস্তানায় বসে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নিজেই মৃত্যুর দিনক্ষণ জানান। যেহেতু সেই সময় গ্রামাঞ্চলের মানুষ এখনকার মতো সচেতন ছিল না, সে কারণে সিরাজের কথাটা যাচাই-বাছাই না করেই মানুষ তা বিশ্বাস করে। এবং সিরাজের মৃত্যুর দৃশ্য দেখার জন্য ভীড় করেন। তিনি আরও বলেন, একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না কখন কোন অবস্থায় কার মৃত্যু হবে। মৃত্যুর সংবাদ ভাইরাল হয়ে গেলে সিরাজের কদর বেড়ে যায়।
একই গ্রামের আলামিন হোসেন নামের এক যুবক বলেন, ‘সিরাজ মরতে চেয়েছিল আমাদের জন্মেরও আগে। কিন্ত এখনও বাইরে গিয়ে যদি নিজ গ্রামের নাম বলি তবে বয়স্ক মানুষরা জানতে চাই, সিরাজ কী এখনও বেঁচে আছে?’ সিরাজ ফকিরের এক প্রতিবেশী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আসলে তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজের মৃত্যুর নাটক সাজিয়ে ফায়দা লুটে নেওয়া। কী ধরনের ফায়দার কথা বলছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, পীর-মুরিদ করে টাকা ইনকাম করায় মূল উদ্দেশ্য ছিল।
ফারুখ জোয়ার্দ্দার নামে হিজলগাড়ী বাজারের এক জুতা ব্যবসায়ী বলেন, ‘বাপ-দাদাদের কাছ থেকে শুনেছি, সিরাজ মৃত্যুর ঘোষণা দেওয়ার পর নেহালপুর গ্রামে প্রতিটি বাড়িতে এত পরিমাণ আত্মীয়-স্বজন আসে, তাদের খেতে দিতে গিয়ে অনেক বাড়ির গোলার ধান, মুড়ি, চিড়া গাছের ফলফলাদি ফুরিয়ে যায়।’
জনরোষ থেকে বাঁচতে সিরাজ যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই সোনাই মন্ডলের বড় ছেলে দাউদ আলী বলেন, ‘সিরাজ নিজের মৃত্যুর দিন তারিখ জানিয়ে নির্ধারিত দিনের আগেই গ্রাম থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু ঘোষণা দেওয়ার পরদিন থেকেই নেহালপুর গ্রামসহ আশেপাশের কয়েক গ্রামের মানুষের প্রতিনিয়ত ভিড় লেগে থাকত সিরাজের বাড়িতে। কোনোভাবেই মানুষের চোখের আড়াল হতে পারেনি সে। এছাড়া লোকমুখে শোনা যায়, সিরাজ বিকল্প পন্থায়ও মৃত্যুর চেষ্টা করতে চেয়েছিল। নির্ধারিত দিনের আগে থেকেই বিপুল সংখ্যাক মানুষের উপস্থিতি ও নির্ধারিত দিনে জনতার ভিড় আর বিপুল সংখ্যা পুলিশের উপস্থিতিতে সিরাজ নিজেও হতবম্ব হয়ে পড়ে।’
কেন, কী কারণে নিজেই নিজের মৃত্যুর দিনক্ষণ জানিয়েছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাব সবসময়ই নীরব থেকেছেন ৩৯ বছর পূর্বের ভাইরাল সিরাজ। সময়ের সমীকরণ-এর করা প্রশ্নে ৩৯ বছর পর মুখ খোলেন সিরাজ। তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে বিভিন্নজন বিভিন্ন ধরনের কথা বললেও আসলে আমি স্বপ্নের মাধ্যমে জানতে পারি ৮ আষাঢ় আমার জীবনে বড় একটা বিপদ আসছে, সেই বিপদে আমি মারা যেতে পারি। সেই বিপদের কথা ভক্ত অনুসারীদের জানালে তারা তা অতিরঞ্জিত করে প্রচার করে। লক্ষ মানুষের উপস্থিতি দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে যায়। নির্ধারিত দিনে এত মানুষের চাপে বাধ্য হয়ে স্কুলমাঠে হাজার হাজার মানুষের মাঝে তৈরি করা ছাউনীর নিচে পাতা চৌকিতে গিয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল।’ পৃথিবী ছেড়ে কেউ কোনো দিন মরতে চাই? এমন পাল্টা প্রশ্ন করে সিরাজ আরও বলেন, ‘সেদিন মানুষ আমার মৃত্যুর দৃশ্য দেখার জন্য যেভাবে নেহালপুর স্কুলমাঠে ভিড় করেছিল, সচোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। একজন মানুষ মারা যাবে, আর সেই দৃশ্য দেখার জন্য মানুষের উল্লাস দেখে সেদিন সত্যি সত্যিই মরে যেতে ইচ্ছা করছিল, কিন্ত মরণ তো আর মুখের কথা নয়।