ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

নাগরিক শ্রদ্ধায় বিদায় আজ

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:৩৫:২১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০১৯
  • / ২১০ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ প্রতিবেদন:
বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও ইমেরিটাস চেয়ার স্যার ফজলে হাসান আবেদের মৃত্যুতে প্রতিষ্ঠানটিতে কোনো ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হবে না বলে মন্তব্য করেছেন ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। বলেন, কোনো ধরনের অনিশ্চয়তা নয় বরং স্যার ফজলে হাসান আবেদের দর্শন ও স্বপ্ন দিয়ে এগিয়ে যাবে ব্র্যাক। গতকাল শনিবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) কার্যালয়ে এসব কথা বলেন ব্র্যাকের বর্তমান চেয়ারপারসন ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারে এই উপদেষ্টা। গত শুক্রবার রাত ৮টা ২৮ মিনিটে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তিনি স্ত্রী, এক মেয়ে, এক ছেলে এবং তিন নাতি-নাতনি রেখে গেছেন।
সূত্র জানায়, ১৯৭০ সালে চট্টগ্রামে স্যার ফজলে হাসান আবেদ বহুজাতিক তেল কোম্পানি শেলের অর্থ বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে বিপন্ন মানুষের সেবায় ত্রাণ দিতে গিয়েছিলেন দক্ষিণের দ্বীপ মনপুরায়। সে পদক্ষেপটিই হয়ে উঠল বৃহত্তর এক অভিযাত্রার প্রথম ধাপ। স্বাধীন দেশের ছিন্নমূল মানুষকে সহায়তা দিতে ব্র্যাক নামের যে বেসরকারি সংস্থাটি গড়ে তুলেছিলেন ৪৮ বছর আগে, সেটিই হয়ে উঠল বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংস্থা। আর যুক্তরাজ্য থেকে নাইট উপাধি পেয়ে তার নামের আগে বসল ‘স্যার’। তিনি যে চিরকাল থাকবেন না, সে উপলব্ধি থেকে গুছিয়ে দিয়ে গেছেন প্রতিষ্ঠানটিকে, ঠিক করে গেছেন উত্তরাধিকার। ব্র্যাকের সঙ্গে তাই স্যার ফজলে হাসান আবেদও বেঁচে থাকবেন এসব কাজের মধ্য দিয়ে।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, স্যার ফজলে হাসান আবেদ, বিভিন্নভাবে আমাদের মেসেজ দিয়ে গেছেন। সেই মেসেজ হলো, তার দর্শনকে আশ্রয় করে ব্র্যাককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমরা তার সেই দর্শনের দিকে নজর দিয়ে ব্র্যাককে এগিয়ে নিয়ে যাব। প্রথমত, তার দর্শনটা ছিল খুবই সুস্পষ্ট। সেটা হচ্ছে পৃথিবীতে অসংখ্য ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষ রয়েছে। এই মানুষগুলোর জন্য কাজ করাটাই হচ্ছে সবচেয়ে মহত্তর কাজ। দ্বিতীয়ত, এসব ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষের নিজেদের পরিবর্তনের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সম্ভাবনাকে শ্রদ্ধা করতে হবে, চিহ্নিত করতে হবে। তৃতীয়ত হচ্ছে, এই সম্ভাবনাগুলোকে ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষগুলো কাজে লাগাতে পারছে না। তার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে প্রতিষ্ঠানিক, সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক কারণ। সেই প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার জন্য আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। এসব করার জন্য আবেদ দর্শনকে ধরে কাজ করতে হবে, সেজন্য একটা প্রতিষ্ঠান লাগবে। সেই প্রতিষ্ঠানকে নিয়ম, দক্ষতা, স্বচ্ছতার ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে। যেটা উনি ব্র্যাকের মাধ্যমে করে গেছেন বলে জানান হোসেন জিল্লুর।
ভবিষ্যতে কী করতে হবে তার জন্য ফজলে হাসান আবেদ অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন বলেও মন্তব্য করেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারপারসান। তার দেয়া দর্শন, চ্যালেঞ্জ আর অনুপ্রেরণাই ব্র্যাককে ভবিষ্যতে পথ চলতে সহায়তা করবে। তিনি বলেন, সফল হবো কী হবো না, এটা বলার বিষয় না। দেখার বিষয়। চেষ্টা যদি করি দর্শন যদি ঠিক থাকে পরিশ্রম করে লেগে থাকা যায় তাহলে সফলতা আসবেই। ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, স্যার ফজলে হাসান আবেদ জানতেন তিনি চলে যাওয়ার পর ব্র্যাকের কী হবে সেই প্রশ্ন উঠবে। সে কারণেই তিনি এসব প্রশ্নের সুষ্ঠু সমাধান আর সুরাহা নিজেই দিয়ে গেছেন। সজ্ঞানে পূর্ণাঙ্গভাবে করে গেছেন সব সমাধান।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ব্র্যাকের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনে স্যার ফজলে হাসান আবেদ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাধারণত এমন উদাহরণ দেখা যায় না। এটি মানুষের কাছে নিঃসন্দেহে অনুকরণীয় একটি বিষয় হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদের ভাবনায় বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন স্যার। এরই ধারাবাহিকতায় গত আগস্ট মাসের বোর্ড মিটিংয়ে ব্র্যাকের চেয়ারপারসন পদ পরিবর্তন করা হয়েছে, স্যার ফজলে হাসান আবেদ চেয়ার অ্যামেরিটাস হয়েছিলেন। ব্র্যাক বাংলাদেশের চেয়ারপারসন হিসাবে আমাকে (ড. হোসেন জিল্লুর রহমান) নির্বাচিত করা হলো। আর ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের দায়িত্ব পেলেন আমিরা হক। তিনি জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি ছিলেন। বাংলাদেশি নারী। তিনি নিউইয়র্কে থাকেন। ‘ব্র্যাক ব্যাংক’র চেয়ারম্যান করা হয়েছে আহসান হাবিব মুনসুরকে। তিনি অর্থনীতিবিদ। পরবর্তীতে স্যার ফজলে হাসানের উদ্যোগেই আরেকটা নতুন স্তর তৈরি হলো। সেটা হলো ব্র্যাক গ্লোবাল বোর্ড। এটা হলো ব্র্যাকের বৈশ্বিক আকাঙ্ক্ষা।
হোসেন জিল্লুর আরো বলেন, ফজলে হাসান আবেদ যখন দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হলেন, চিকিৎসকরা যখন তাকে বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন তখন তিনি নিজের কথা ভাবেননি, ভেবেছেন ব্র্যাকের সমস্যার কীভাবে সমাধান করা যায়। স্যার ফজলে হাসান অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে সক্ষমতা ও সজ্ঞানেই ব্র্যাকে পরিবর্তনের বিষয়টা সম্পন্ন করেছেন। একইসঙ্গে যাদের দায়িত্ব দিলেন তাদের কি করা উচিত, সেটারও চ্যালেঞ্জ দিয়ে গেছেন স্যার। এমন না যে উনি কোনো ফর্মুলা দিয়ে গেছেন। কিন্তু সব মিলিয়ে ব্র্যাকের পরিবর্তনের বিষয়টা নিশ্চিত করে গেছেন। তার নিজ হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক যেন কোনো অনিশ্চয়তার মধ্যে একেবারেই না পড়ে সেই ব্যবস্থা করে গেছেন।
কেমন ছিলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, তিনি খুবই বিনয়ী ছিলেন। তার অনেক অর্জন ছিল, কিন্তু তা নিয়ে কখনো কোনো দিন বাহাদুরি করেন নি। মানুষ বুঝেছে তিনি মানুষের জন্য কতটা করেছেন। দুইটি জিনিস স্যার ফজলে হাসান আবেদকে নাড়া দিয়েছিল বলে উল্লেখ করেন ব্র্যাকের চেয়ারপারসন। তিনি বলেন, স্যার আবেদের ছিল সচ্ছল জীবন। তিনি ইংল্যান্ডে ছিলেন। সেখান থেকে বাংলাদেশে ফিরেছেন। ১৯৭০ সালের বন্যায় অসংখ্য মানুষের মৃত্যু আর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। এদুটিই তাকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল। এসবের কারণেই তিনি ভেবেছিলেন, এই দেশে পুনর্গঠনের কাজ করতে হবে। সেই থেকে কাজে লেগে যান তিনি। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, একটা নিশ্চিত সচ্ছল জীবন ফেলে এসে সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন ফজলে হাসান আবেদ। অথচ সেই পথের গন্তব্য তার জানা ছিল না। কিন্তু তিনি লেগে থেকেছেন। এটাকে সৌখিনতা হিসেবে নেননি। তার প্রতিদানও তিনি পেয়েছেন। আজ তাই অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা নিয়েই শেষ শয্যার দিকে চলেছেন। ‘ব্র্যাক বাংলাদেশ’-র চেয়ারপারসন বলেন, প্রথমত, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে সব ধরনের কর্মকাণ্ডে সুযোগ দেয়া। দ্বিতীয়ত, গরিব মানুষের মধ্য নানা ধরনের সম্ভাবনা আছে এবং সেই সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করা।
গত ২৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় শারীরিকভাবে অসুস্থ বোধ করায় ফজলে হাসান আবেদকে অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর থেকে সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। ফজলে হাসান আবেদের জন্ম ১৯৩৬ সালে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তিনি বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩৬ বছর। ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় তার বয়স ৬৫ হয়ে গেলে তিনি নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। এরপর তাকে চেয়ারপারসন নির্বাচিত করেন ব্র্যাকের তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ। পরবর্তীতে তিনি ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের তত্ত্বাবধায়ক পর্ষদেরও চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
সরজমিন ব্র্যাক সেন্টারে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানানোর জন্য মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার ইন-এর ভেতর-বাহির পরিস্কার-পরিছন্নতার কাজ করা হচ্ছে। ভবনের ভেতরে যেখানে লাশ রাখা হবে সেই জায়গাটিও প্রস্তুত করা হচ্ছে। ভবনের বাইরে শোক জানিয়ে বিশাল একটি ব্যানার টাঙ্গাানো হবে বলে জানান ব্যানার তৈরিতে ব্যস্ত শ্রমিকরা। শ্রমিকদের একজন নাসির জানান, এটি প্রায় ৩০ ফুটের মতো লম্বা ও চওড়া হবে। এখানে আবেদ স্যারের ডিজিটাল ছবি সম্বিলিত একটি ব্যানার লাগানো হবে। ব্র্যাকের অ্যাডভকেসি, টেকনোলজি অ্যান্ড পাটনারশিপ ডিরেক্টর কেএএম মোরশেদ জানান, আজ (শনিবার) আমাদের এই সেন্টারে কোনো ধরনের কর্মসূচি রাখা হয়নি। তবে আগামীকাল (রোববার) ব্র্যাকের সব ধরনের কর্মকর্তাদের জন্য বিশেষ সাধারণ ছুটি ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটিতে অর্ধযুগ ধরে কাজ করছেন সমির আহমেদ বলেন, আবেদ স্যারের মৃত্যুতে আমরা ভীষণ মর্মহত হলেও তিনি কিন্তু সেই শিক্ষা আমাদের দেন নি। স্যার ফজলে হাসান আবেদ ছিলেন গ্রামবাংলার পালাবদলের স্বপ্নদ্রষ্টা। গ্রামীণ দরিদ্র মানুষদের জীবনমান উন্নয়ন ও অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী করার পথ দেখিয়েছেন। দরিদ্র নারীদের ক্ষমতায়নের পথপ্রদর্শক ছিলেন। তার সবচেয়ে বড় উদ্যোগটি ছিলো, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে অতি দারিদ্র্য দূরীকরণ। তার সেই স্বপ্ন সার্থক হয়েছে বলে আমরা মনে করি। আরেক কর্মকর্তা সোহেল জানান, স্যার ফজলে হাসান আবেদের অবর্তমানে ব্র্যাকের কার্যক্রমে কোন সমস্যা হবে না। কারণ মৃত্যুর আগেই তার গড়া সংস্থাকে সেভাবেই গুছিয়ে গেছেন। ক্ষণজন্মা এই মানুষটির মৃত্যুতে শুন্যতা নেমে আসলেও তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান চলবে তারই নীতি ও আদর্শে।
দাফন:
আজ রোববার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ রাখা হবে ঢাকা আর্মি স্টেডিয়ামে। সেখানেই দুপুর সাড়ে ১২টায় নামাজে জানাজার পর দাফন করা হবে বনানী কবরস্থানে।
বিজিএমইএ’র শোক প্রকাশ:
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের আকষ্মিক মৃত্যুতে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক এবং পরিচালনা পর্ষদ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। বিজিএমইএ সভাপতি ও পরিচালনা পর্ষদ মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি এক বিজ্ঞপ্তিতির মাধ্যমে গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেছে বিজিএমইএ।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

নাগরিক শ্রদ্ধায় বিদায় আজ

আপলোড টাইম : ১০:৩৫:২১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০১৯

সমীকরণ প্রতিবেদন:
বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও ইমেরিটাস চেয়ার স্যার ফজলে হাসান আবেদের মৃত্যুতে প্রতিষ্ঠানটিতে কোনো ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হবে না বলে মন্তব্য করেছেন ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। বলেন, কোনো ধরনের অনিশ্চয়তা নয় বরং স্যার ফজলে হাসান আবেদের দর্শন ও স্বপ্ন দিয়ে এগিয়ে যাবে ব্র্যাক। গতকাল শনিবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) কার্যালয়ে এসব কথা বলেন ব্র্যাকের বর্তমান চেয়ারপারসন ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারে এই উপদেষ্টা। গত শুক্রবার রাত ৮টা ২৮ মিনিটে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তিনি স্ত্রী, এক মেয়ে, এক ছেলে এবং তিন নাতি-নাতনি রেখে গেছেন।
সূত্র জানায়, ১৯৭০ সালে চট্টগ্রামে স্যার ফজলে হাসান আবেদ বহুজাতিক তেল কোম্পানি শেলের অর্থ বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে বিপন্ন মানুষের সেবায় ত্রাণ দিতে গিয়েছিলেন দক্ষিণের দ্বীপ মনপুরায়। সে পদক্ষেপটিই হয়ে উঠল বৃহত্তর এক অভিযাত্রার প্রথম ধাপ। স্বাধীন দেশের ছিন্নমূল মানুষকে সহায়তা দিতে ব্র্যাক নামের যে বেসরকারি সংস্থাটি গড়ে তুলেছিলেন ৪৮ বছর আগে, সেটিই হয়ে উঠল বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংস্থা। আর যুক্তরাজ্য থেকে নাইট উপাধি পেয়ে তার নামের আগে বসল ‘স্যার’। তিনি যে চিরকাল থাকবেন না, সে উপলব্ধি থেকে গুছিয়ে দিয়ে গেছেন প্রতিষ্ঠানটিকে, ঠিক করে গেছেন উত্তরাধিকার। ব্র্যাকের সঙ্গে তাই স্যার ফজলে হাসান আবেদও বেঁচে থাকবেন এসব কাজের মধ্য দিয়ে।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, স্যার ফজলে হাসান আবেদ, বিভিন্নভাবে আমাদের মেসেজ দিয়ে গেছেন। সেই মেসেজ হলো, তার দর্শনকে আশ্রয় করে ব্র্যাককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমরা তার সেই দর্শনের দিকে নজর দিয়ে ব্র্যাককে এগিয়ে নিয়ে যাব। প্রথমত, তার দর্শনটা ছিল খুবই সুস্পষ্ট। সেটা হচ্ছে পৃথিবীতে অসংখ্য ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষ রয়েছে। এই মানুষগুলোর জন্য কাজ করাটাই হচ্ছে সবচেয়ে মহত্তর কাজ। দ্বিতীয়ত, এসব ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষের নিজেদের পরিবর্তনের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সম্ভাবনাকে শ্রদ্ধা করতে হবে, চিহ্নিত করতে হবে। তৃতীয়ত হচ্ছে, এই সম্ভাবনাগুলোকে ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষগুলো কাজে লাগাতে পারছে না। তার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে প্রতিষ্ঠানিক, সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক কারণ। সেই প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার জন্য আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। এসব করার জন্য আবেদ দর্শনকে ধরে কাজ করতে হবে, সেজন্য একটা প্রতিষ্ঠান লাগবে। সেই প্রতিষ্ঠানকে নিয়ম, দক্ষতা, স্বচ্ছতার ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে। যেটা উনি ব্র্যাকের মাধ্যমে করে গেছেন বলে জানান হোসেন জিল্লুর।
ভবিষ্যতে কী করতে হবে তার জন্য ফজলে হাসান আবেদ অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন বলেও মন্তব্য করেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারপারসান। তার দেয়া দর্শন, চ্যালেঞ্জ আর অনুপ্রেরণাই ব্র্যাককে ভবিষ্যতে পথ চলতে সহায়তা করবে। তিনি বলেন, সফল হবো কী হবো না, এটা বলার বিষয় না। দেখার বিষয়। চেষ্টা যদি করি দর্শন যদি ঠিক থাকে পরিশ্রম করে লেগে থাকা যায় তাহলে সফলতা আসবেই। ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, স্যার ফজলে হাসান আবেদ জানতেন তিনি চলে যাওয়ার পর ব্র্যাকের কী হবে সেই প্রশ্ন উঠবে। সে কারণেই তিনি এসব প্রশ্নের সুষ্ঠু সমাধান আর সুরাহা নিজেই দিয়ে গেছেন। সজ্ঞানে পূর্ণাঙ্গভাবে করে গেছেন সব সমাধান।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ব্র্যাকের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনে স্যার ফজলে হাসান আবেদ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাধারণত এমন উদাহরণ দেখা যায় না। এটি মানুষের কাছে নিঃসন্দেহে অনুকরণীয় একটি বিষয় হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদের ভাবনায় বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন স্যার। এরই ধারাবাহিকতায় গত আগস্ট মাসের বোর্ড মিটিংয়ে ব্র্যাকের চেয়ারপারসন পদ পরিবর্তন করা হয়েছে, স্যার ফজলে হাসান আবেদ চেয়ার অ্যামেরিটাস হয়েছিলেন। ব্র্যাক বাংলাদেশের চেয়ারপারসন হিসাবে আমাকে (ড. হোসেন জিল্লুর রহমান) নির্বাচিত করা হলো। আর ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের দায়িত্ব পেলেন আমিরা হক। তিনি জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি ছিলেন। বাংলাদেশি নারী। তিনি নিউইয়র্কে থাকেন। ‘ব্র্যাক ব্যাংক’র চেয়ারম্যান করা হয়েছে আহসান হাবিব মুনসুরকে। তিনি অর্থনীতিবিদ। পরবর্তীতে স্যার ফজলে হাসানের উদ্যোগেই আরেকটা নতুন স্তর তৈরি হলো। সেটা হলো ব্র্যাক গ্লোবাল বোর্ড। এটা হলো ব্র্যাকের বৈশ্বিক আকাঙ্ক্ষা।
হোসেন জিল্লুর আরো বলেন, ফজলে হাসান আবেদ যখন দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হলেন, চিকিৎসকরা যখন তাকে বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন তখন তিনি নিজের কথা ভাবেননি, ভেবেছেন ব্র্যাকের সমস্যার কীভাবে সমাধান করা যায়। স্যার ফজলে হাসান অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে সক্ষমতা ও সজ্ঞানেই ব্র্যাকে পরিবর্তনের বিষয়টা সম্পন্ন করেছেন। একইসঙ্গে যাদের দায়িত্ব দিলেন তাদের কি করা উচিত, সেটারও চ্যালেঞ্জ দিয়ে গেছেন স্যার। এমন না যে উনি কোনো ফর্মুলা দিয়ে গেছেন। কিন্তু সব মিলিয়ে ব্র্যাকের পরিবর্তনের বিষয়টা নিশ্চিত করে গেছেন। তার নিজ হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক যেন কোনো অনিশ্চয়তার মধ্যে একেবারেই না পড়ে সেই ব্যবস্থা করে গেছেন।
কেমন ছিলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, তিনি খুবই বিনয়ী ছিলেন। তার অনেক অর্জন ছিল, কিন্তু তা নিয়ে কখনো কোনো দিন বাহাদুরি করেন নি। মানুষ বুঝেছে তিনি মানুষের জন্য কতটা করেছেন। দুইটি জিনিস স্যার ফজলে হাসান আবেদকে নাড়া দিয়েছিল বলে উল্লেখ করেন ব্র্যাকের চেয়ারপারসন। তিনি বলেন, স্যার আবেদের ছিল সচ্ছল জীবন। তিনি ইংল্যান্ডে ছিলেন। সেখান থেকে বাংলাদেশে ফিরেছেন। ১৯৭০ সালের বন্যায় অসংখ্য মানুষের মৃত্যু আর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। এদুটিই তাকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল। এসবের কারণেই তিনি ভেবেছিলেন, এই দেশে পুনর্গঠনের কাজ করতে হবে। সেই থেকে কাজে লেগে যান তিনি। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, একটা নিশ্চিত সচ্ছল জীবন ফেলে এসে সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন ফজলে হাসান আবেদ। অথচ সেই পথের গন্তব্য তার জানা ছিল না। কিন্তু তিনি লেগে থেকেছেন। এটাকে সৌখিনতা হিসেবে নেননি। তার প্রতিদানও তিনি পেয়েছেন। আজ তাই অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা নিয়েই শেষ শয্যার দিকে চলেছেন। ‘ব্র্যাক বাংলাদেশ’-র চেয়ারপারসন বলেন, প্রথমত, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে সব ধরনের কর্মকাণ্ডে সুযোগ দেয়া। দ্বিতীয়ত, গরিব মানুষের মধ্য নানা ধরনের সম্ভাবনা আছে এবং সেই সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করা।
গত ২৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় শারীরিকভাবে অসুস্থ বোধ করায় ফজলে হাসান আবেদকে অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর থেকে সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। ফজলে হাসান আবেদের জন্ম ১৯৩৬ সালে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তিনি বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩৬ বছর। ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় তার বয়স ৬৫ হয়ে গেলে তিনি নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। এরপর তাকে চেয়ারপারসন নির্বাচিত করেন ব্র্যাকের তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ। পরবর্তীতে তিনি ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের তত্ত্বাবধায়ক পর্ষদেরও চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
সরজমিন ব্র্যাক সেন্টারে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানানোর জন্য মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার ইন-এর ভেতর-বাহির পরিস্কার-পরিছন্নতার কাজ করা হচ্ছে। ভবনের ভেতরে যেখানে লাশ রাখা হবে সেই জায়গাটিও প্রস্তুত করা হচ্ছে। ভবনের বাইরে শোক জানিয়ে বিশাল একটি ব্যানার টাঙ্গাানো হবে বলে জানান ব্যানার তৈরিতে ব্যস্ত শ্রমিকরা। শ্রমিকদের একজন নাসির জানান, এটি প্রায় ৩০ ফুটের মতো লম্বা ও চওড়া হবে। এখানে আবেদ স্যারের ডিজিটাল ছবি সম্বিলিত একটি ব্যানার লাগানো হবে। ব্র্যাকের অ্যাডভকেসি, টেকনোলজি অ্যান্ড পাটনারশিপ ডিরেক্টর কেএএম মোরশেদ জানান, আজ (শনিবার) আমাদের এই সেন্টারে কোনো ধরনের কর্মসূচি রাখা হয়নি। তবে আগামীকাল (রোববার) ব্র্যাকের সব ধরনের কর্মকর্তাদের জন্য বিশেষ সাধারণ ছুটি ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটিতে অর্ধযুগ ধরে কাজ করছেন সমির আহমেদ বলেন, আবেদ স্যারের মৃত্যুতে আমরা ভীষণ মর্মহত হলেও তিনি কিন্তু সেই শিক্ষা আমাদের দেন নি। স্যার ফজলে হাসান আবেদ ছিলেন গ্রামবাংলার পালাবদলের স্বপ্নদ্রষ্টা। গ্রামীণ দরিদ্র মানুষদের জীবনমান উন্নয়ন ও অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী করার পথ দেখিয়েছেন। দরিদ্র নারীদের ক্ষমতায়নের পথপ্রদর্শক ছিলেন। তার সবচেয়ে বড় উদ্যোগটি ছিলো, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে অতি দারিদ্র্য দূরীকরণ। তার সেই স্বপ্ন সার্থক হয়েছে বলে আমরা মনে করি। আরেক কর্মকর্তা সোহেল জানান, স্যার ফজলে হাসান আবেদের অবর্তমানে ব্র্যাকের কার্যক্রমে কোন সমস্যা হবে না। কারণ মৃত্যুর আগেই তার গড়া সংস্থাকে সেভাবেই গুছিয়ে গেছেন। ক্ষণজন্মা এই মানুষটির মৃত্যুতে শুন্যতা নেমে আসলেও তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান চলবে তারই নীতি ও আদর্শে।
দাফন:
আজ রোববার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ রাখা হবে ঢাকা আর্মি স্টেডিয়ামে। সেখানেই দুপুর সাড়ে ১২টায় নামাজে জানাজার পর দাফন করা হবে বনানী কবরস্থানে।
বিজিএমইএ’র শোক প্রকাশ:
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের আকষ্মিক মৃত্যুতে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক এবং পরিচালনা পর্ষদ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। বিজিএমইএ সভাপতি ও পরিচালনা পর্ষদ মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি এক বিজ্ঞপ্তিতির মাধ্যমে গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেছে বিজিএমইএ।