ইপেপার । আজমঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

নতুন শঙ্কায় পোশাক খাত

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১২:১৯:৩৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ মে ২০২৩
  • / ২২ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ প্রতিবেদন:
দেশের তৈরি পোশাক খাতে নতুন করে দেখা দিয়েছে শঙ্কার মেঘ। যদিও কয়েক মাস ধরেই খাতটির উদ্যোক্তারা রপ্তানি আয় কমে যাওয়া নিয়ে চাপের মধ্যে ছিলেন। তারা বলছেন, রপ্তানির প্রধান প্রধান অঞ্চলগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকায় আগামীতে ওইসব অঞ্চলে রপ্তানি ব্যাপক হারে কমে গেছে। ইতোমধ্যে তার প্রভাবও স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ক্রয়াদেশ কমেছে অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। অর্ডার না থাকায় এবং আর্থিক সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছোট অনেক কারখানা। বেকার হয়ে পড়ছেন শ্রমিকরা। অর্ডার কমে যাওয়ায় কমেছে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যও তার প্রমাণ দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভিসা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হুঁশিয়ারি নতুন করে শঙ্কার ছায়া ফেলেছে বলে মনে করেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব ও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতায় এমনিতেই ধুঁকছে দেশের তৈরি পোশাক খাত। তবে সংকটের মধ্যেও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ছিলেন এই শিল্পের মালিকরা। কিন্তু কিছুতেই যেন সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছে না দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখা এ খাতটি। কমেই চলেছে ক্রয়াদেশ। পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় এ বছর ক্রয়াদেশ কমেছে অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। অর্ডার না থাকায় এবং আর্থিক সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছোট অনেক কারখানা। পথে বসছেন ছোট উদ্যোক্তা, বেকার হয়ে পড়ছে শ্রমিকরা। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবেই নতুন কার্যাদেশ কমছে বলে দাবি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর। বলা হচ্ছে, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তৈরি পোশাকশিল্প ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে নতুন করে সংকটে পড়েছে খাতটি। এর মধ্যেই এলো যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিয়ে হুঁশিয়ারি। বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে যারা বাধা দেবেন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে যারা অন্তরায় হবেন তাদের ভিসা দেবে না বলে এক ঘোষণায় জানিয়েছে দেশটি। গত বুধবার দেয়া মার্কিন নতুন এ নীতি আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে প্রভাব ফেলবে কিনা তা নিয়ে নানা আলোচনা চলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী- চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে দেশের তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানি যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ইউরোপের বাজারে বেড়েছে। তবে কমেছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। ইপিবির ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিলের তথ্যমতে, প্রথম ১০ মাসের তৈরি পোশাক রপ্তানি আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ০৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধিসহ ৩৮ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত ১০ মাসে যুক্তরাজ্যের বাজারে তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ১০ দশমিক ৮৮ শতাংশ, কানাডার বাজারে বেড়েছে ১৬ দশমিক ০৯ শতাংশ এবং ইউরোপের বাজারে বেড়েছে ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কমেছে ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ পণ্য।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রপ্তানি বেশি এবং আমদানি কম হওয়ায় আমাদের বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত থাকে। যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সহায়তা করে। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে এখন সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসছে। বাংলাদেশ ২০২১-২২ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১ হাজার ৪২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। বিপরীতে আমদানি করেছে মাত্র ২৮৩ কোটি ডলারের পণ্য। প্রবাসী আয়ে বরাবরই শীর্ষে থাকত সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। তবে সবশেষ দুই অর্থবছরে আরব আমিরাতকে হটিয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্র থেকে সর্বোচ্চ ৩০৪ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। সৌদি আরব থেকে এসেছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩০৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার।
জানতে চাইলে পোশাক খাতের উদ্যোক্তা ক্ল্যাসিক ফ্যাশন কনসেপ্টের এমডি ও তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদউল্লাহ আজিম ভোরের কাগজকে বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে যে বৈশ্বিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে- তার পাশাপাাশি অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির ফলে বিদ্যুৎ জ¦ালানি নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ সবকিছুর কারণেই মূলত ক্রয়াদেশ কমেছে। পোশাক খাত জটিল অবস্থার মধ্যে রয়েছে। গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩০-৩৫ শতাংশ ক্রয়াদেশ কমে গেছে। এ অবস্থায় পোশাক খাত সংকটের মুখে পড়েছে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনো শ্রমিক অসন্তোষ নেই। তিনি বলেন, ইউরোপ-আমেরিকা থেকে অর্ডার কম আসায় আমরা নতুন বাজার ধরার চেষ্টা করছি। কোরিয়া, জাপান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে বিকল্প বাজার খুঁজছি। সেটাও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু পোশাক খাত এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। এর মধ্যে নতুন করে ভিসা নিয়ে ঘোষণায় আমরাও শঙ্কিত। তিনি বলেন, আমরা আমেরিকায় রপ্তানি করি বেশি, আমদানি করি কম। তিনি বলেন, আমরা প্রায় ৮০ শতাংশ পণ্য রপ্তানি করি সেখানে। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মেলা বা সামিটে অংশ নিতে বা রপ্তানির কাজে নিয়মিত আমাদের সে দেশে যেতে হয়। তাই তারা যদি ভিসা নিয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্তে যায়; তাহলে আমরা সমস্যায় পড়ে যাব। যদিও এখনো কোনো জটিলতা সৃষ্টি হয়নি বলে জানান তিনি। তবে অদূর ভবিষ্যতে পড়বে না- এমন কোনো কারণ নেই।
এ ব্যবসায়ী নেতা আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে এটা পলিটিক্যাল বিষয়, ব্যবসায়ীরা সবাই এ পলিটিক্সের সঙ্গে জড়িত নয়। তাই আমরা আশা করি, এটা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য তেমন নেতিবাচক কিছু হবে না। তবে দীর্ঘমেয়াদি কিছু সমস্যা তৈরি হতে পারে। যেমন এখনই আমেরিকার ভিসা পেতে অনেকের এক বছর লেগে যায়। আগামীতে এ ধরনের জটিলতা আরো বাড়তে থাকবে। তারা যদি যাচাই-বাছাই করে ভিসা দিতে দেরি করে- তাহলে অনেক ক্রেতার সঙ্গে নির্ধারিত সময়ে মিটিং করা যাবে না। সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
যদিও বাণিজ্যে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, আমরা যেসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি করি তা বৈশ্বিক বিবেচনায় সবচেয়ে ভালো পণ্য। বিশ্বমানের এ পোশাক আমরা তাদের যে দামে দেই, তাদের এ প্রয়োজনীয় পণ্য তা অন্য কোনো দেশ দিতে পারবে না। তাই আমাদের কাছ থেকে নেয়। এজন্য আলাদা কোনো সুবিধা আমাদের দেয় না। তাই নতুন যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছে এরফলে ব্যবসা-বাণিজ্য বা আমদানি-রপ্তানিতে কোনো ধরনের প্রভাব পড়বে না।
ব্যবসায়ীদের দাবি, চলতি বছর প্রায় ৩৭০ কারখানা বন্ধ হয়েছে। চাকরি হারিয়েছেন ২৫ থেকে ৩০ হাজার শ্রমিক। বন্ধের পথে আরো বেশ কয়েকটি কারখানা। বাংলাদেশ শিল্প পুলিশের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ অর্থাৎ প্রথম তিন মাসে দেশের মোট ৯৭টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এগুলো বন্ধ হওয়ার কারণে ২০ হাজার ২৭৬ শ্রমিক চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত ১৭টি কারখানায় ছয় হাজার ৬৪৭ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। বিকেএমইএর সদস্যভুক্ত সাত কারখানায় এক হাজার ৪৮৬ জন, বিটিএমইএর সদস্যভুক্ত তিন কারখানায় দুই হাজার ৮৭ জন, বেপজার দুই কারখানায় দুই হাজার ৪৫ জন শ্রমিক বেকার হয়েছেন। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে গত বছরও সারাদেশে ৫১০টি শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে আশুলিয়া এলাকায় ৯৬টি, গাজীপুরে ১৫৭টি, চট্টগ্রামে ৮০টি, নারায়ণগঞ্জে ২০টি, ময়মনসিংহে ছয়টি এবং খুলনায় বন্ধ হয় ১৫১টি কারখানা। ক্রয়াদেশ না পাওয়া ছাড়াও শ্রমিক অসন্তোষের কারণেও অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রোজার ঈদের আগে ও পরে সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কারখানায় বেতন না পাওয়ায় আন্দোলনও করে শ্রমিকরা।
পোশাক খাত বর্তমানে নানা চাপের কারণে নাজুক অবস্থা দাবি করে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, এ অবস্থায় পোশাক শিল্পের ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সরকারের অব্যাহত সহায়তার কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, আমাদের পোশাক শিল্প নানা কারণে চাপে আছে। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, সে তুলনায় পণ্যের দাম বাড়েনি। করোনায় সরকার বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়েছিল। রপ্তানির ক্ষেত্রে যেসব প্রণোদনা আছে, তা আরো বাড়ানো দরকার।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

নতুন শঙ্কায় পোশাক খাত

আপলোড টাইম : ১২:১৯:৩৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ মে ২০২৩

সমীকরণ প্রতিবেদন:
দেশের তৈরি পোশাক খাতে নতুন করে দেখা দিয়েছে শঙ্কার মেঘ। যদিও কয়েক মাস ধরেই খাতটির উদ্যোক্তারা রপ্তানি আয় কমে যাওয়া নিয়ে চাপের মধ্যে ছিলেন। তারা বলছেন, রপ্তানির প্রধান প্রধান অঞ্চলগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকায় আগামীতে ওইসব অঞ্চলে রপ্তানি ব্যাপক হারে কমে গেছে। ইতোমধ্যে তার প্রভাবও স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ক্রয়াদেশ কমেছে অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। অর্ডার না থাকায় এবং আর্থিক সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছোট অনেক কারখানা। বেকার হয়ে পড়ছেন শ্রমিকরা। অর্ডার কমে যাওয়ায় কমেছে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যও তার প্রমাণ দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভিসা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হুঁশিয়ারি নতুন করে শঙ্কার ছায়া ফেলেছে বলে মনে করেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব ও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতায় এমনিতেই ধুঁকছে দেশের তৈরি পোশাক খাত। তবে সংকটের মধ্যেও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ছিলেন এই শিল্পের মালিকরা। কিন্তু কিছুতেই যেন সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছে না দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখা এ খাতটি। কমেই চলেছে ক্রয়াদেশ। পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় এ বছর ক্রয়াদেশ কমেছে অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। অর্ডার না থাকায় এবং আর্থিক সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছোট অনেক কারখানা। পথে বসছেন ছোট উদ্যোক্তা, বেকার হয়ে পড়ছে শ্রমিকরা। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবেই নতুন কার্যাদেশ কমছে বলে দাবি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর। বলা হচ্ছে, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তৈরি পোশাকশিল্প ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে নতুন করে সংকটে পড়েছে খাতটি। এর মধ্যেই এলো যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিয়ে হুঁশিয়ারি। বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে যারা বাধা দেবেন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে যারা অন্তরায় হবেন তাদের ভিসা দেবে না বলে এক ঘোষণায় জানিয়েছে দেশটি। গত বুধবার দেয়া মার্কিন নতুন এ নীতি আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে প্রভাব ফেলবে কিনা তা নিয়ে নানা আলোচনা চলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী- চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে দেশের তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানি যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ইউরোপের বাজারে বেড়েছে। তবে কমেছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। ইপিবির ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিলের তথ্যমতে, প্রথম ১০ মাসের তৈরি পোশাক রপ্তানি আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ০৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধিসহ ৩৮ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত ১০ মাসে যুক্তরাজ্যের বাজারে তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ১০ দশমিক ৮৮ শতাংশ, কানাডার বাজারে বেড়েছে ১৬ দশমিক ০৯ শতাংশ এবং ইউরোপের বাজারে বেড়েছে ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কমেছে ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ পণ্য।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রপ্তানি বেশি এবং আমদানি কম হওয়ায় আমাদের বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত থাকে। যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সহায়তা করে। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে এখন সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসছে। বাংলাদেশ ২০২১-২২ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১ হাজার ৪২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। বিপরীতে আমদানি করেছে মাত্র ২৮৩ কোটি ডলারের পণ্য। প্রবাসী আয়ে বরাবরই শীর্ষে থাকত সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। তবে সবশেষ দুই অর্থবছরে আরব আমিরাতকে হটিয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্র থেকে সর্বোচ্চ ৩০৪ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। সৌদি আরব থেকে এসেছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩০৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার।
জানতে চাইলে পোশাক খাতের উদ্যোক্তা ক্ল্যাসিক ফ্যাশন কনসেপ্টের এমডি ও তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদউল্লাহ আজিম ভোরের কাগজকে বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে যে বৈশ্বিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে- তার পাশাপাাশি অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির ফলে বিদ্যুৎ জ¦ালানি নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ সবকিছুর কারণেই মূলত ক্রয়াদেশ কমেছে। পোশাক খাত জটিল অবস্থার মধ্যে রয়েছে। গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩০-৩৫ শতাংশ ক্রয়াদেশ কমে গেছে। এ অবস্থায় পোশাক খাত সংকটের মুখে পড়েছে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনো শ্রমিক অসন্তোষ নেই। তিনি বলেন, ইউরোপ-আমেরিকা থেকে অর্ডার কম আসায় আমরা নতুন বাজার ধরার চেষ্টা করছি। কোরিয়া, জাপান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে বিকল্প বাজার খুঁজছি। সেটাও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু পোশাক খাত এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। এর মধ্যে নতুন করে ভিসা নিয়ে ঘোষণায় আমরাও শঙ্কিত। তিনি বলেন, আমরা আমেরিকায় রপ্তানি করি বেশি, আমদানি করি কম। তিনি বলেন, আমরা প্রায় ৮০ শতাংশ পণ্য রপ্তানি করি সেখানে। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মেলা বা সামিটে অংশ নিতে বা রপ্তানির কাজে নিয়মিত আমাদের সে দেশে যেতে হয়। তাই তারা যদি ভিসা নিয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্তে যায়; তাহলে আমরা সমস্যায় পড়ে যাব। যদিও এখনো কোনো জটিলতা সৃষ্টি হয়নি বলে জানান তিনি। তবে অদূর ভবিষ্যতে পড়বে না- এমন কোনো কারণ নেই।
এ ব্যবসায়ী নেতা আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে এটা পলিটিক্যাল বিষয়, ব্যবসায়ীরা সবাই এ পলিটিক্সের সঙ্গে জড়িত নয়। তাই আমরা আশা করি, এটা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য তেমন নেতিবাচক কিছু হবে না। তবে দীর্ঘমেয়াদি কিছু সমস্যা তৈরি হতে পারে। যেমন এখনই আমেরিকার ভিসা পেতে অনেকের এক বছর লেগে যায়। আগামীতে এ ধরনের জটিলতা আরো বাড়তে থাকবে। তারা যদি যাচাই-বাছাই করে ভিসা দিতে দেরি করে- তাহলে অনেক ক্রেতার সঙ্গে নির্ধারিত সময়ে মিটিং করা যাবে না। সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
যদিও বাণিজ্যে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, আমরা যেসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি করি তা বৈশ্বিক বিবেচনায় সবচেয়ে ভালো পণ্য। বিশ্বমানের এ পোশাক আমরা তাদের যে দামে দেই, তাদের এ প্রয়োজনীয় পণ্য তা অন্য কোনো দেশ দিতে পারবে না। তাই আমাদের কাছ থেকে নেয়। এজন্য আলাদা কোনো সুবিধা আমাদের দেয় না। তাই নতুন যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছে এরফলে ব্যবসা-বাণিজ্য বা আমদানি-রপ্তানিতে কোনো ধরনের প্রভাব পড়বে না।
ব্যবসায়ীদের দাবি, চলতি বছর প্রায় ৩৭০ কারখানা বন্ধ হয়েছে। চাকরি হারিয়েছেন ২৫ থেকে ৩০ হাজার শ্রমিক। বন্ধের পথে আরো বেশ কয়েকটি কারখানা। বাংলাদেশ শিল্প পুলিশের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ অর্থাৎ প্রথম তিন মাসে দেশের মোট ৯৭টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এগুলো বন্ধ হওয়ার কারণে ২০ হাজার ২৭৬ শ্রমিক চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত ১৭টি কারখানায় ছয় হাজার ৬৪৭ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। বিকেএমইএর সদস্যভুক্ত সাত কারখানায় এক হাজার ৪৮৬ জন, বিটিএমইএর সদস্যভুক্ত তিন কারখানায় দুই হাজার ৮৭ জন, বেপজার দুই কারখানায় দুই হাজার ৪৫ জন শ্রমিক বেকার হয়েছেন। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে গত বছরও সারাদেশে ৫১০টি শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে আশুলিয়া এলাকায় ৯৬টি, গাজীপুরে ১৫৭টি, চট্টগ্রামে ৮০টি, নারায়ণগঞ্জে ২০টি, ময়মনসিংহে ছয়টি এবং খুলনায় বন্ধ হয় ১৫১টি কারখানা। ক্রয়াদেশ না পাওয়া ছাড়াও শ্রমিক অসন্তোষের কারণেও অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রোজার ঈদের আগে ও পরে সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কারখানায় বেতন না পাওয়ায় আন্দোলনও করে শ্রমিকরা।
পোশাক খাত বর্তমানে নানা চাপের কারণে নাজুক অবস্থা দাবি করে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, এ অবস্থায় পোশাক শিল্পের ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সরকারের অব্যাহত সহায়তার কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, আমাদের পোশাক শিল্প নানা কারণে চাপে আছে। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, সে তুলনায় পণ্যের দাম বাড়েনি। করোনায় সরকার বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়েছিল। রপ্তানির ক্ষেত্রে যেসব প্রণোদনা আছে, তা আরো বাড়ানো দরকার।