ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

দুর্বৃত্তদের হানায় স্বপ্ন ভাঙছে কৃষকের

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:২৬:০৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০
  • / ১০৯ বার পড়া হয়েছে

কালীগঞ্জে বেড়েই চলেছে ফসলি খেত বিনষ্টের ঘটনা
রিয়াজ মোল্যা:
ঝিনাইদহ কালীগঞ্জে সম্প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে ফসলি খেত বিনষ্টের ঘটনা। দুবৃর্ত্তরা রাতের আধারে একের পর এক নৃশংসভাবে ধরন্ত-ফলন্ত খেত নষ্ট করছে। কৃষকেরা ধার-দেনার মাধ্যমে ফসল চাষ করার পর ভরা খেত নষ্ট হওয়ায় তারা একেবারে পথে বসে যাচ্ছেন। রাতের আধারে কে বা কারা লোক চক্ষুর আড়ালে এমন জঘন্যতম কাজটি করছে। যে কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা নির্দিষ্টভাবে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগও দায়ের করতে পারছেন না। ফলে এমন ক্ষতিকর কাজ করেও মনুষ্যত্বহীন দুর্বৃত্তরা থাকছে ধরা-ছোয়ার বাইরে। এদিকে প্রায়ই খেত নষ্টের ঘটনা ঘটায় সবজি খেতের মালিকেরা রয়েছেন অচেনা এক আতঙ্কে। প্রশাসন বলছে, ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, গোষ্ঠীগত বিরোধের জেরে এমনটি হয়ে থাকে। তবে এটাকে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা হতে পারে এমনটিও উড়িয়ে দিচ্ছে না প্রশাসন।
ভুক্তভোগী কৃষকদের সূত্রে জানা গেছে, বিগত কয়েক মাস ধরে শত্রুতা করে মানুষের অগোচরে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের কৃষকের সবজি খেত কেটে সাবাড় করছে। পুকুরে কখনও কীটনাশক দিয়ে আবার গ্যাস বড়ি ব্যবহারের মাধ্যমে মাছ নিধন করছে। কৃষকেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উৎপাদন করলেও সমাজের গুটি কয়েক দুষ্ট প্রকৃতির মানুষ দ্বারা স্বপ্ন ভাঙছে তাদের। তাঁরা বলছেন, শত্রুতার মাধ্যমে কৃষকের ভরা খেত নষ্ট হচ্ছে। এটা মনুষ্যত্বহীনতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২০ জুন বাবরা গ্রামের আলী বকসের ২ ছেলে কৃষক টিপু সুলতান ও শহিদুল ইসলামের দুই ভায়ের ১৫ কাঠা জমির কাঁদিওয়ালা কলাগাছ কেটে দেয় দুর্বৃত্তরা। একইভাবে ৩ জুলাই মল্লিকপুর গ্রামের মল্লিক মণ্ডলের ছেলে সবজি চাষি মাজেদুল মণ্ডলের বেথুলী মাঠের আড়াই বিঘা জমির ৩ শতাধিক ধরন্ত পেপে গাছ কেটে দেয়। এর ঠিক ৪ দিন পরে ৭ জুলাই পৌর এলাকার ফয়লা গ্রামের তাকের হোসেনের ছেলে আবু সাঈদের ১৫ শতক জমির ধরন্ত করলা খেত কেটে দেয়। ১৩ জুলাই বারোবাজারের ঘোপ গ্রামের মাহতাব মুন্সির ছেলে আব্দুর রশিদের দেড় বিঘা জমির সিমগাছে কীটনাশক স্প্রে করে পুড়িয়ে দেয়। ৯ আগস্ট তিল্লা গ্রামের সতীশ বিশ্বাসের ছেলে কৃষক বিকাশ বিশ্বাসের ১৫ শতক ধরন্ত করলা খেত কেটে দেয় দুর্বৃত্তরা। ২৮ আগস্ট সাইটবাড়িয়া গ্রামের মাছচাষি ইউপি সদস্য কবিরুল ইসলাম নান্নুর পুকুরে গ্যাস বড়ি দিয়ে প্রায় দেড় লক্ষাধিক টাকার মাছ নিধন করে। এর ৩ দিন পর ৩১ আগস্ট একই ইউনিয়নের রাড়িপাড়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত বিজিবি সদস্যের ৪৮ শতক মূল্যবান দার্জিলিং লেবু ও থাই পেয়ারার কলম কেটে দেয় দুর্বৃত্তরা। এর আগে ২৫ আগস্ট বলরামপুর গ্রামের মাছচাষি মমরেজ আলীর পুকুরে একইভাবে বিষ দিয়ে প্রায় ২ লক্ষাধিক টাকার মাছ মেরে দেয়। ৬ সেপ্টেম্বর সাইটবাড়িয়া গ্রামের আনছার আলী মোল্যার ছেলে হতদরিদ্র কৃষক বাপ্পি মোল্যার ৯ শতক ধরন্ত বেগুন খেত কেটে দিয়ে সর্বশান্ত করে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর পৌর এলাকার খয়েরতলা গ্রামের রফি বিশ্বাসের পুকুরে গ্যাস বড়ি প্রয়োগ করে লক্ষাধিক টাকার মাছ নিধন করে দুর্বৃত্তরা। সর্বশেষ ২২ সেপ্টেম্বর পৌর এলাকার চাপালী গ্রামে মৃত লুৎফর রহমানের ছেলে আতিয়ার রহমানের প্রায় ১ বিঘা জমির লাউ গাছ কেটে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।


ক্ষতিগ্রস্ত মাছচাষি সাইটবাড়িয়া গ্রামের কবিরুল ইসলাম নান্নু জানান, ধার-দেনার মাধ্যমে মাছ চাষ করেছিলাম। পুকুরের মাছও বেশ বড় হয়েছিল। কিন্তু রাতের আধারে কে বা কারা পুকুরে গ্যাস বড়ি দিয়ে লক্ষাধিক টাকার মাছ মেরে দিয়েছে। সকালে পুকুর থেকে মরা মাছ তোলার সময় গ্যাস বড়ি পেয়েছিলাম। তিনি বলেন, ‘আমি কারও শত্রু হতে পারি। অথবা আমার কোনো অপরাধ থাকতে পারে, কিন্তু পুকুরের মাছগুলো কী অপরাধ করেছে?। তা ছাড়াও একজনের ক্ষতি করে তাদেরই বা কী লাভ? এখন কোনোভাবেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারছি না। নান্নু আরও জানান, ‘রাতের আধারে কে বা কারা মাছ নিধন করেছে। আমি কাউকে দেখিনি ফলে শুধু থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছি।’
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আব্দুর রশিদ জানান, ‘আমি একজন সবজি চাষি। মাঠে অন্য ফসলের সঙ্গে দেড় বিঘা জমিতে সিমের চাষ করেছিলাম। সতেজ গাছগুলো বানে উঠে লতিয়ে ফুল ধরা শুরু হয়েছিল। কিছুদিন পরেই সিম তোলা যেত। কিন্তু শত্রুতা করে কে বা কারা রাতের আধারে গাছ বিনাশ করা কীটনাশক স্প্রে করে আমার খেতের সব সিমগাছ পুড়িয়ে দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমার জানা মতে আমি কারও ক্ষতি করিনি। সারা দিন চাষকাজে ব্যস্ত থাকি। সে কারণে মনে করি আমার কোনো শত্রু নেই। খেত নষ্ট করার পর এলাকাবাসীর সঙ্গে আমার নিজেকেও হতবাক করেছে। আমরা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। যে কারণে ঝামেলা এড়াতে আমি থানা পুলিশ করিনি।’
সাইটবাড়িয়া গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত আরেক কৃষক বাপ্পি মোল্যা জানান, ‘মাঠের ৯ শতক জমিই আমার একমাত্র সম্বল। সারা বছর পরের খেতে কামলার কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে বিকেলে নিজের ওই জমিটাতে বেগুন লাগিয়ে প্রতিনিয়ত পরিশ্রম করি। খেতের বেগুন গাছগুলোতে বেগুন ধরা শুরু হয়েছিল। কিন্তু আমার ধরন্ত বেগুন খেত ধারাল কিছু দিয়ে মাটি সমান করে কেটে সাবাড় করে দিয়েছে। না দেখে অনুমান নির্ভর হয়ে কাউকে দোষারোপও করতে পারছি না। খেত নষ্ট হওয়ার ফলে আমি আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। যে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমার বেশ সময় পার করতে হবে।’ তিনি বলেন, যারা কৃষকের ভরাখেত নষ্ট করতে পারে, সমাজের দুষ্টু প্রকৃতির এ মানুষগুলো সব ধরনের অপরাধমূলক কাজ করতে পারে। এমন জঘন্য কাজ করা শুধুমাত্র জঘন্য মানসিকতার মানুষদের পক্ষেই সম্ভব।
এ ব্যাপারে কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহা. মাহাফুজুর রহমান মিয়া জানান, কৃষকের ভরা খেত কেটে দেওয়ার মতো ক্ষতি পুশিয়ে ওঠার নয়। সম্প্রতি এমন ঘটনার কথা শুনছি। কিন্তু দুষ্টু প্রকৃতির এ মানুষগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তরা সন্দেহ করলেও তা অনুমান নির্ভর হওয়ায় কেউ অভিযোগ দিতে চাচ্ছেন না। বিগত ৩-৪ মাসে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ফসলহানী ঘটলেও মাত্র ৩ জন থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন। তারাও বলতে পারছেন না কারা এমন জঘন্য কাজ করছে। ফলে এক ধরনের জটিলতা থেকেই যাচ্ছে। তারপরও পুলিশ সামাজিক ও গোষ্ঠীগত বিরোধ, সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক কলহের জের ধরে এটা হতে পারে বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে। তবে এটা সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য কোনো বিশেষ মহল করছে কি না, সেটাও উড়িয়ে না দিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম আশরাফ জানান, কৃষকদের পরিশ্রমের ফসল যারা রাতের আধারে বিনষ্ট করছে, তারা মনুষ্যত্বহীন পশুর মতো। ভরাখেত নষ্ট হওয়ায় প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা পথে বসে যাচ্ছেন। যে বিরোধের জের ধরেই হোক না কেন কৃষকের ক্ষতি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
স্থানীয় সাংসদ আনোয়ারুল আজিম আনার বলেন, একজন কৃষকের ভরা খেত নষ্ট হলে তার পাজর ভেঙে যায়। যারা খেত নষ্ট করছে তাদের কোনো লাভ হচ্ছে না। তবে যাদের খেত নষ্ট হচ্ছে তারা নিঃস্ব হচ্ছে। রাতের আধারে কৃষকের ভরাখেত নষ্ট করাটা এক ধরনের বর্বরতা, নৃশংসতা, যা কোনো মানুষের পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সম্প্রতি বিষয়টি সবাই ভাবিয়ে তুলেছে। কারা এমন অমানবিক কাজ করছে, তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে যোগ করেন এই সাংসদ।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

দুর্বৃত্তদের হানায় স্বপ্ন ভাঙছে কৃষকের

আপলোড টাইম : ০৯:২৬:০৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

কালীগঞ্জে বেড়েই চলেছে ফসলি খেত বিনষ্টের ঘটনা
রিয়াজ মোল্যা:
ঝিনাইদহ কালীগঞ্জে সম্প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে ফসলি খেত বিনষ্টের ঘটনা। দুবৃর্ত্তরা রাতের আধারে একের পর এক নৃশংসভাবে ধরন্ত-ফলন্ত খেত নষ্ট করছে। কৃষকেরা ধার-দেনার মাধ্যমে ফসল চাষ করার পর ভরা খেত নষ্ট হওয়ায় তারা একেবারে পথে বসে যাচ্ছেন। রাতের আধারে কে বা কারা লোক চক্ষুর আড়ালে এমন জঘন্যতম কাজটি করছে। যে কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা নির্দিষ্টভাবে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগও দায়ের করতে পারছেন না। ফলে এমন ক্ষতিকর কাজ করেও মনুষ্যত্বহীন দুর্বৃত্তরা থাকছে ধরা-ছোয়ার বাইরে। এদিকে প্রায়ই খেত নষ্টের ঘটনা ঘটায় সবজি খেতের মালিকেরা রয়েছেন অচেনা এক আতঙ্কে। প্রশাসন বলছে, ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, গোষ্ঠীগত বিরোধের জেরে এমনটি হয়ে থাকে। তবে এটাকে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা হতে পারে এমনটিও উড়িয়ে দিচ্ছে না প্রশাসন।
ভুক্তভোগী কৃষকদের সূত্রে জানা গেছে, বিগত কয়েক মাস ধরে শত্রুতা করে মানুষের অগোচরে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের কৃষকের সবজি খেত কেটে সাবাড় করছে। পুকুরে কখনও কীটনাশক দিয়ে আবার গ্যাস বড়ি ব্যবহারের মাধ্যমে মাছ নিধন করছে। কৃষকেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উৎপাদন করলেও সমাজের গুটি কয়েক দুষ্ট প্রকৃতির মানুষ দ্বারা স্বপ্ন ভাঙছে তাদের। তাঁরা বলছেন, শত্রুতার মাধ্যমে কৃষকের ভরা খেত নষ্ট হচ্ছে। এটা মনুষ্যত্বহীনতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২০ জুন বাবরা গ্রামের আলী বকসের ২ ছেলে কৃষক টিপু সুলতান ও শহিদুল ইসলামের দুই ভায়ের ১৫ কাঠা জমির কাঁদিওয়ালা কলাগাছ কেটে দেয় দুর্বৃত্তরা। একইভাবে ৩ জুলাই মল্লিকপুর গ্রামের মল্লিক মণ্ডলের ছেলে সবজি চাষি মাজেদুল মণ্ডলের বেথুলী মাঠের আড়াই বিঘা জমির ৩ শতাধিক ধরন্ত পেপে গাছ কেটে দেয়। এর ঠিক ৪ দিন পরে ৭ জুলাই পৌর এলাকার ফয়লা গ্রামের তাকের হোসেনের ছেলে আবু সাঈদের ১৫ শতক জমির ধরন্ত করলা খেত কেটে দেয়। ১৩ জুলাই বারোবাজারের ঘোপ গ্রামের মাহতাব মুন্সির ছেলে আব্দুর রশিদের দেড় বিঘা জমির সিমগাছে কীটনাশক স্প্রে করে পুড়িয়ে দেয়। ৯ আগস্ট তিল্লা গ্রামের সতীশ বিশ্বাসের ছেলে কৃষক বিকাশ বিশ্বাসের ১৫ শতক ধরন্ত করলা খেত কেটে দেয় দুর্বৃত্তরা। ২৮ আগস্ট সাইটবাড়িয়া গ্রামের মাছচাষি ইউপি সদস্য কবিরুল ইসলাম নান্নুর পুকুরে গ্যাস বড়ি দিয়ে প্রায় দেড় লক্ষাধিক টাকার মাছ নিধন করে। এর ৩ দিন পর ৩১ আগস্ট একই ইউনিয়নের রাড়িপাড়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত বিজিবি সদস্যের ৪৮ শতক মূল্যবান দার্জিলিং লেবু ও থাই পেয়ারার কলম কেটে দেয় দুর্বৃত্তরা। এর আগে ২৫ আগস্ট বলরামপুর গ্রামের মাছচাষি মমরেজ আলীর পুকুরে একইভাবে বিষ দিয়ে প্রায় ২ লক্ষাধিক টাকার মাছ মেরে দেয়। ৬ সেপ্টেম্বর সাইটবাড়িয়া গ্রামের আনছার আলী মোল্যার ছেলে হতদরিদ্র কৃষক বাপ্পি মোল্যার ৯ শতক ধরন্ত বেগুন খেত কেটে দিয়ে সর্বশান্ত করে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর পৌর এলাকার খয়েরতলা গ্রামের রফি বিশ্বাসের পুকুরে গ্যাস বড়ি প্রয়োগ করে লক্ষাধিক টাকার মাছ নিধন করে দুর্বৃত্তরা। সর্বশেষ ২২ সেপ্টেম্বর পৌর এলাকার চাপালী গ্রামে মৃত লুৎফর রহমানের ছেলে আতিয়ার রহমানের প্রায় ১ বিঘা জমির লাউ গাছ কেটে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।


ক্ষতিগ্রস্ত মাছচাষি সাইটবাড়িয়া গ্রামের কবিরুল ইসলাম নান্নু জানান, ধার-দেনার মাধ্যমে মাছ চাষ করেছিলাম। পুকুরের মাছও বেশ বড় হয়েছিল। কিন্তু রাতের আধারে কে বা কারা পুকুরে গ্যাস বড়ি দিয়ে লক্ষাধিক টাকার মাছ মেরে দিয়েছে। সকালে পুকুর থেকে মরা মাছ তোলার সময় গ্যাস বড়ি পেয়েছিলাম। তিনি বলেন, ‘আমি কারও শত্রু হতে পারি। অথবা আমার কোনো অপরাধ থাকতে পারে, কিন্তু পুকুরের মাছগুলো কী অপরাধ করেছে?। তা ছাড়াও একজনের ক্ষতি করে তাদেরই বা কী লাভ? এখন কোনোভাবেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারছি না। নান্নু আরও জানান, ‘রাতের আধারে কে বা কারা মাছ নিধন করেছে। আমি কাউকে দেখিনি ফলে শুধু থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছি।’
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আব্দুর রশিদ জানান, ‘আমি একজন সবজি চাষি। মাঠে অন্য ফসলের সঙ্গে দেড় বিঘা জমিতে সিমের চাষ করেছিলাম। সতেজ গাছগুলো বানে উঠে লতিয়ে ফুল ধরা শুরু হয়েছিল। কিছুদিন পরেই সিম তোলা যেত। কিন্তু শত্রুতা করে কে বা কারা রাতের আধারে গাছ বিনাশ করা কীটনাশক স্প্রে করে আমার খেতের সব সিমগাছ পুড়িয়ে দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমার জানা মতে আমি কারও ক্ষতি করিনি। সারা দিন চাষকাজে ব্যস্ত থাকি। সে কারণে মনে করি আমার কোনো শত্রু নেই। খেত নষ্ট করার পর এলাকাবাসীর সঙ্গে আমার নিজেকেও হতবাক করেছে। আমরা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। যে কারণে ঝামেলা এড়াতে আমি থানা পুলিশ করিনি।’
সাইটবাড়িয়া গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত আরেক কৃষক বাপ্পি মোল্যা জানান, ‘মাঠের ৯ শতক জমিই আমার একমাত্র সম্বল। সারা বছর পরের খেতে কামলার কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে বিকেলে নিজের ওই জমিটাতে বেগুন লাগিয়ে প্রতিনিয়ত পরিশ্রম করি। খেতের বেগুন গাছগুলোতে বেগুন ধরা শুরু হয়েছিল। কিন্তু আমার ধরন্ত বেগুন খেত ধারাল কিছু দিয়ে মাটি সমান করে কেটে সাবাড় করে দিয়েছে। না দেখে অনুমান নির্ভর হয়ে কাউকে দোষারোপও করতে পারছি না। খেত নষ্ট হওয়ার ফলে আমি আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। যে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমার বেশ সময় পার করতে হবে।’ তিনি বলেন, যারা কৃষকের ভরাখেত নষ্ট করতে পারে, সমাজের দুষ্টু প্রকৃতির এ মানুষগুলো সব ধরনের অপরাধমূলক কাজ করতে পারে। এমন জঘন্য কাজ করা শুধুমাত্র জঘন্য মানসিকতার মানুষদের পক্ষেই সম্ভব।
এ ব্যাপারে কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহা. মাহাফুজুর রহমান মিয়া জানান, কৃষকের ভরা খেত কেটে দেওয়ার মতো ক্ষতি পুশিয়ে ওঠার নয়। সম্প্রতি এমন ঘটনার কথা শুনছি। কিন্তু দুষ্টু প্রকৃতির এ মানুষগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তরা সন্দেহ করলেও তা অনুমান নির্ভর হওয়ায় কেউ অভিযোগ দিতে চাচ্ছেন না। বিগত ৩-৪ মাসে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ফসলহানী ঘটলেও মাত্র ৩ জন থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন। তারাও বলতে পারছেন না কারা এমন জঘন্য কাজ করছে। ফলে এক ধরনের জটিলতা থেকেই যাচ্ছে। তারপরও পুলিশ সামাজিক ও গোষ্ঠীগত বিরোধ, সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক কলহের জের ধরে এটা হতে পারে বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে। তবে এটা সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য কোনো বিশেষ মহল করছে কি না, সেটাও উড়িয়ে না দিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম আশরাফ জানান, কৃষকদের পরিশ্রমের ফসল যারা রাতের আধারে বিনষ্ট করছে, তারা মনুষ্যত্বহীন পশুর মতো। ভরাখেত নষ্ট হওয়ায় প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা পথে বসে যাচ্ছেন। যে বিরোধের জের ধরেই হোক না কেন কৃষকের ক্ষতি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
স্থানীয় সাংসদ আনোয়ারুল আজিম আনার বলেন, একজন কৃষকের ভরা খেত নষ্ট হলে তার পাজর ভেঙে যায়। যারা খেত নষ্ট করছে তাদের কোনো লাভ হচ্ছে না। তবে যাদের খেত নষ্ট হচ্ছে তারা নিঃস্ব হচ্ছে। রাতের আধারে কৃষকের ভরাখেত নষ্ট করাটা এক ধরনের বর্বরতা, নৃশংসতা, যা কোনো মানুষের পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সম্প্রতি বিষয়টি সবাই ভাবিয়ে তুলেছে। কারা এমন অমানবিক কাজ করছে, তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে যোগ করেন এই সাংসদ।