ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

থমথমে ওয়াশিংটন ডিসি, কারফিউ শেষে জরুরি অবস্থা

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১১:১৭:০৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৯ জানুয়ারী ২০২১
  • / ৯১ বার পড়া হয়েছে

ছয় রাজ্য থেকে ন্যাশনাল গার্ড তলব; রাজপথ শান্ত, উত্তপ্ত রাজনীতি
সমীকরণ প্রতিবেদন:
যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের ন্যক্কারজনক হামলার পর থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে। আগে যেখানে ছিল মানুষের শোরগোল আর আনাগোনা, সেখানে এখন শুধুই নীরবতা। কারফিউ শেষে এখন চলছে জরুরি অবস্থা। ওয়াশিংটন ডিসির রাজপথ এখন শান্ত। পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতিতে চলছে কড়া তল্লাশি। প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছেন না মার্কিনিরা। আশপাশের ছয়টি রাজ্য থেকে ন্যাশনাল গার্ড তলব করা হয়েছে। প্রতি সাত ফুট পরপর ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যরা ক্যাপিটল হিলের স্থাপনা ঘিরে রেখেছেন। রাজপথ শান্ত হলেও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ট্রাম্পকে অভিশংসন দাবি উঠছে বিভিন্ন দিক থেকে। সমালোচনার তীর আসে বিশ্বের নানান প্রান্ত থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, ক্যাপিটল ভবনে হামলা ও ভাঙচুরের সময় আহত এক পুলিশ কর্মকর্তা গতকাল মারা গেছেন। তার নাম ব্রায়ান ডি সিকনিক। তিনি ২০০৮ সালে ক্যাপিটল পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন। পুলিশের বিবৃতিতে বলা হয়, সিকনিক বুধবার দাঙ্গার সময় দায়িত্ব পালন করছিলেন এবং নিরাপত্তাকর্মীদের ওপর বিক্ষোভকারীদের হামলার সময় মারামারিতে আহত হন। সেখান থেকে বিভাগীয় কার্যালয়ে ফেরার পর অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যান এবং তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায়। সিকনিকের মৃত্যুতে বুধবার ক্যাপিটল ভবনে দাঙ্গায় নিহতের সংখ্যা ৫-এ দাঁড়াল। বাকি চারজনের মধ্যে ট্রাম্পপন্থি একজন বিক্ষোভকারী ভবনের ভিতর পুলিশের গুলিতে নিহত হন। অন্য তিনজনকে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত্যু হয়। হামলায় সৃষ্ট দাঙ্গায় পুলিশের গুলিতে নিহত নারী দেশটির বিমানবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা। নিহত অ্যাশলি বাবিট (৩৫) বিমানবাহিনীর হয়ে দুবার আফগানিস্তান ও ইরাকে দায়িত্ব পালন করেন। সেখান থেকে ফেরার পর কুয়েত ও কাতারে ‘ন্যাশনাল গার্ড’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়াগোর বাসিন্দা বাবিট সম্প্রতি বিয়ে করেন এবং তার স্বামী অ্যারন বাবিটের সঙ্গে একটি পুল সার্ভিস কোম্পানিতে চাকরি করতেন। বাবিট প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একজন ঘোর সমর্থক। বাবিট নিয়মিতই ট্রাম্পের নানা সমাবেশে যোগ দিতেন। মৃত্যুর আগের দিনও এক পোস্টে তিনি ট্রাম্প সমর্থকদের বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিতে ওয়াশিংটন ডিসিতে যাওয়ার কথা জানান।
তিনি লেখেন, ‘আমাদের কেউ থামাতে পারবে না। তারা চেষ্টা করতে পারে, চেষ্টা করতে পারে এবং চেষ্টা করে যেতেই পারে। কিন্তু এখানে যে ঝড় উঠেছে তা ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ডিসিতে আঘাত হানতে যাচ্ছে।’ বুধবার ক্যাপিটল ভবনে সহিংসতার সময় পুলিশের বাধা ডিঙিয়ে ভবনের ভিতরে ঢুকে যান বাবিট। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি দরজার পাশের একটি তাক বেয়ে ওপরে উঠছেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গুলির শব্দ শোনা যায় এবং তাকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখা যায়। ক্যাপিটল পুলিশের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, বিক্ষোভকারীরা জোর করে হাউস চেম্বারে ঢুকে পড়ার সময় ইউনাইটেড স্টেটস ক্যাপিটল পুলিশের একজন কর্মী তার সার্ভিস আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি চালান। কারণ ওই সময় কংগ্রেস সদস্যরা হাউস চেম্বারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। গুলিবিদ্ধ বাবিটকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে বুধবার সন্ধ্যায় তিনি মারা যান। পুলিশ জানায়, যে কর্মকর্তা গুলি করেছিলেন তাকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। তবে তার পরিচয় জানানো হয়নি। বুধবারের দাঙ্গায় নিহত অন্যরা হলেন- পেনসিলভেনিয়ার বেনজামিন ফিলিপস (৫০), আলাবামার কেভিন গ্রিসন (৫৫) ও জর্জিয়ার রোজানি বয়ল্যান্ড (৩৪)। দাঙ্গায় আরও অন্তত ১৪ পুলিশ কর্মকর্তা আহত হন।
এদিকে, মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি গতকাল মার্কিন ক্যাপিটলে এক সংবাদ সম্মেলনে অভিশংসনের আহ্বান জানিয়েছেন। পেলাসি ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্পের সশস্ত্র সমর্থকদের হামলার ঘটনাকে আমেরিকার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে দাঁড় করেছেন। তিনি হামলাকে শুধু আইনসভায় নয়, জাতির ওপর নারকীয় আঘাত বলে মন্তব্য করেন। রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান অ্যাডাম কিনজিনগার সংবিধানের ২৫তম সংশোধনী অনুযায়ী ট্রাম্পকে ক্ষমতাহীন ঘোষণা করতে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। রিপাবলিকান এই আইনপ্রণেতা বলেছেন, ট্রাম্পই এসব ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য দায়ী। ট্রাম্পকে দায়িত্ব পালনের জন্য অযোগ্য উল্লেখ করে তাঁকে সব নির্বাহী দায়িত্ব থেকে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সরে দাঁড়াতে হবে। একই দিন মিনেসোটা অঙ্গরাজ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম নারী কংগ্রেস সদস্য ইলহান ওমরও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে অভিশংসনের প্রস্তাব তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের যত দ্রুত সম্ভব তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে। এটা পরিষ্কার যে তিনি আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য হুমকি।’
টয়লেটে পাঁচ ঘণ্টা আটকা :
ডোনাল্ড ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকদের তান্ডবে টানা পাঁচ ঘণ্টা মার্কিন ক্যাপিটল ভবনের টয়লেটে আটকে থাকতে হয়েছে কংগ্রেসওমেন গ্রেম মিংকেকে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, টয়লেটে আটকে পড়া প্রসঙ্গে গ্রেম মিংকে বলেন, ‘দরজার বাইরে বিদ্রোহীরা ইউএস, ইউএস বলে চিৎকার করছিল। তাদের তান্ডবে আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল কারও হাতে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে আমি এখন নিরাপদে আছি, ধন্যবাদ সবাইকে পাশে থাকার জন্য।’ একই সময়ে কংগ্রেস ভবনে উপস্থিত রাজনৈতিক কলামিস্ট জেমি স্টাইমও আটকে ছিলেন ভবনের ভিতরে। জেমি স্টাইম বলেন, ‘ক্যাপিটল ভবনের বাইরে ট্রাম্পের কিছু বেপরোয়া সমর্থকের মুখোমুখি হই আমরা। তাদের সবাই পতাকা ওড়াচ্ছিল ও ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছিল। আমি প্রতিনিধি পরিষদের প্রেস গ্যালারিতে ঢুকে যাই। অধিবেশন দ্বিতীয় ঘণ্টায় গড়ালে হঠাৎ আমরা কাচ ভাঙার আওয়াজ শুনতে পেলাম। বাতাস ধোঁয়াচ্ছন্ন হতে শুরু করল। ক্যাপিটল ভবনের পুলিশের পক্ষ থেকে ঘোষণা এলো, এক ব্যক্তি ভবনে ঢুকে পড়েছে। এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছিল।’ তিনি আরও বলেন, পুলিশ ভবনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, যে কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। একটি গুলি চলেছিল। চেম্বারের ভিতরে তখন বিক্ষোভকারী আর পুলিশের মুখোমুখি অবস্থান। দরজায় পাঁচজন লোক বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে। ভয়ানক একটা অবস্থা। এটি ছিল জনগণের মতামতকে ছোট করা। এ কারণেই স্পিকার অধিবেশন চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন :
সহিংস ঘটনার পর ক্যাপিটল ভবন ঘিরে নিরাপত্তাব্যবস্থার সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, ভিড় দেখে পুলিশ দ্রুত লাইন ভেঙে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। দাঙ্গাকারীদের অনেকে বর্ম পরে ছিলেন। কারও কারও হাতে দেশি অস্ত্র, কারও হাতে রাসায়নিক স্প্রে ছিল। তারা ভবনের ভিতর ঢুকে কয়েক ঘণ্টা ধরে তান্ডব চালায়। তার পরও পুলিশকে তাদের ঘিরে ধরে ভবন থেকে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করতে দেখা যায়। গ্রেফতারের পরিবর্তে পুলিশ তাদের কাউকে কাউকে পথ দেখিয়ে ভবনের বাইরে নিয়ে যায়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে ও দরজা খুলতে সাহায্য করে। ভাইরাল হওয়া একটি ছবিতে ক্যাপিটল ভবনে ভাঙচুরের সময় এক পুলিশকে এক ব্যক্তির সঙ্গে ‘সেলফি’ তোলার জন্য পোজ দিতে দেখা যায়। ওইদিন দাঙ্গায় অংশ নেওয়া একজন যুক্তরাষ্ট্রের চরম ডানপন্থি দল ‘প্রাউড বয়েজ’এর খুব চেনা সদস্য নিক ওচস। তিনি ক্যাপিটল ভবনের ভিতর সেলফি তুলে নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টে পোস্ট দেন। পরে সিএনএনকে বলেন, ‘যেখানে হাজার হাজার মানুষ ছিল… পরিস্থিতির ওপর তাদের (নিরাপত্তা বাহিনীর) কোনো নিয়ন্ত্রণই ছিল না। আমাকে ভবনের ভিতরে যেতে কেউ থামায়নি বা প্রশ্ন করেনি।’ ভাইরাল হওয়া আরেক ছবিতে এক বিক্ষোভকারীকে সগর্বে হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলসির ডেস্কে এক পা তুলে তার চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায়। ছবিতে তাকে স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে। পেলসির ডেস্ক থেকে একটি চিঠিও চুরি করেন তিনি। তার পরও এ ঘটনায় কেন আটকের সংখ্যা এত কম তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নবনির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘এ দেশ বিচারের দুটি ধরনের সাক্ষী হলো। তার একটি গতকাল ইউএস ক্যাপিটলে চরমপন্থিদের তান্ডব এবং অন্যটি গত সামারে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে (ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার) পুলিশের টিয়ার গ্যাসের শেল ছোড়া। যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।’ অন্যদিকে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স বলেছেন, যারা বুধবারের দাঙ্গায় জড়িত ছিল তাদের আইন অনুযায়ী বিচারের আওতায় আনা হবে। ওই ঘটনার যত ছবি ও ভিডিও অনলাইনে ঘুরছে তাতে ? দাঙ্গাকারীদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে প্রমাণ দেওয়া খুব বেশি কঠিন কাজ হবে না। যদিও ফেসবুক কর্তৃপক্ষ দাঙ্গার ছবি ও ভিডিও মুছে দিয়েছেন। তবে তদন্ত কর্মকর্তারা জনগণের কাছে দাঙ্গায় অংশগ্রহণকারীদের ছবি, ভিডিও এবং অন্যান্য প্রমাণ সংগ্রহ করার আহ্বান জানিয়েছেন। ভাইরাল হওয়া দাঙ্গার বেশ কয়েকটি ছবির মুখও বেশ পরিচিত। তারা বিভিন্ন চরম ডানপন্থি দলের সদস্য। ক্যাপিটল পুলিশের পক্ষ থেকেও আসল অপরাধীদের খুঁজে বের করতে তদন্ত শুরুর কথা জানানো হয়েছে। আইনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের বিরল ও গুরুতর অভিযোগ আনা হতে পারে। আর দোষী সাব্যস্ত হলে ২০ বছরের কারাদন্ড হবে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

থমথমে ওয়াশিংটন ডিসি, কারফিউ শেষে জরুরি অবস্থা

আপলোড টাইম : ১১:১৭:০৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৯ জানুয়ারী ২০২১

ছয় রাজ্য থেকে ন্যাশনাল গার্ড তলব; রাজপথ শান্ত, উত্তপ্ত রাজনীতি
সমীকরণ প্রতিবেদন:
যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের ন্যক্কারজনক হামলার পর থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে। আগে যেখানে ছিল মানুষের শোরগোল আর আনাগোনা, সেখানে এখন শুধুই নীরবতা। কারফিউ শেষে এখন চলছে জরুরি অবস্থা। ওয়াশিংটন ডিসির রাজপথ এখন শান্ত। পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতিতে চলছে কড়া তল্লাশি। প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছেন না মার্কিনিরা। আশপাশের ছয়টি রাজ্য থেকে ন্যাশনাল গার্ড তলব করা হয়েছে। প্রতি সাত ফুট পরপর ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যরা ক্যাপিটল হিলের স্থাপনা ঘিরে রেখেছেন। রাজপথ শান্ত হলেও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ট্রাম্পকে অভিশংসন দাবি উঠছে বিভিন্ন দিক থেকে। সমালোচনার তীর আসে বিশ্বের নানান প্রান্ত থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, ক্যাপিটল ভবনে হামলা ও ভাঙচুরের সময় আহত এক পুলিশ কর্মকর্তা গতকাল মারা গেছেন। তার নাম ব্রায়ান ডি সিকনিক। তিনি ২০০৮ সালে ক্যাপিটল পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন। পুলিশের বিবৃতিতে বলা হয়, সিকনিক বুধবার দাঙ্গার সময় দায়িত্ব পালন করছিলেন এবং নিরাপত্তাকর্মীদের ওপর বিক্ষোভকারীদের হামলার সময় মারামারিতে আহত হন। সেখান থেকে বিভাগীয় কার্যালয়ে ফেরার পর অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যান এবং তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায়। সিকনিকের মৃত্যুতে বুধবার ক্যাপিটল ভবনে দাঙ্গায় নিহতের সংখ্যা ৫-এ দাঁড়াল। বাকি চারজনের মধ্যে ট্রাম্পপন্থি একজন বিক্ষোভকারী ভবনের ভিতর পুলিশের গুলিতে নিহত হন। অন্য তিনজনকে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত্যু হয়। হামলায় সৃষ্ট দাঙ্গায় পুলিশের গুলিতে নিহত নারী দেশটির বিমানবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা। নিহত অ্যাশলি বাবিট (৩৫) বিমানবাহিনীর হয়ে দুবার আফগানিস্তান ও ইরাকে দায়িত্ব পালন করেন। সেখান থেকে ফেরার পর কুয়েত ও কাতারে ‘ন্যাশনাল গার্ড’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়াগোর বাসিন্দা বাবিট সম্প্রতি বিয়ে করেন এবং তার স্বামী অ্যারন বাবিটের সঙ্গে একটি পুল সার্ভিস কোম্পানিতে চাকরি করতেন। বাবিট প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একজন ঘোর সমর্থক। বাবিট নিয়মিতই ট্রাম্পের নানা সমাবেশে যোগ দিতেন। মৃত্যুর আগের দিনও এক পোস্টে তিনি ট্রাম্প সমর্থকদের বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিতে ওয়াশিংটন ডিসিতে যাওয়ার কথা জানান।
তিনি লেখেন, ‘আমাদের কেউ থামাতে পারবে না। তারা চেষ্টা করতে পারে, চেষ্টা করতে পারে এবং চেষ্টা করে যেতেই পারে। কিন্তু এখানে যে ঝড় উঠেছে তা ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ডিসিতে আঘাত হানতে যাচ্ছে।’ বুধবার ক্যাপিটল ভবনে সহিংসতার সময় পুলিশের বাধা ডিঙিয়ে ভবনের ভিতরে ঢুকে যান বাবিট। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি দরজার পাশের একটি তাক বেয়ে ওপরে উঠছেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গুলির শব্দ শোনা যায় এবং তাকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখা যায়। ক্যাপিটল পুলিশের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, বিক্ষোভকারীরা জোর করে হাউস চেম্বারে ঢুকে পড়ার সময় ইউনাইটেড স্টেটস ক্যাপিটল পুলিশের একজন কর্মী তার সার্ভিস আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি চালান। কারণ ওই সময় কংগ্রেস সদস্যরা হাউস চেম্বারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। গুলিবিদ্ধ বাবিটকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে বুধবার সন্ধ্যায় তিনি মারা যান। পুলিশ জানায়, যে কর্মকর্তা গুলি করেছিলেন তাকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। তবে তার পরিচয় জানানো হয়নি। বুধবারের দাঙ্গায় নিহত অন্যরা হলেন- পেনসিলভেনিয়ার বেনজামিন ফিলিপস (৫০), আলাবামার কেভিন গ্রিসন (৫৫) ও জর্জিয়ার রোজানি বয়ল্যান্ড (৩৪)। দাঙ্গায় আরও অন্তত ১৪ পুলিশ কর্মকর্তা আহত হন।
এদিকে, মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি গতকাল মার্কিন ক্যাপিটলে এক সংবাদ সম্মেলনে অভিশংসনের আহ্বান জানিয়েছেন। পেলাসি ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্পের সশস্ত্র সমর্থকদের হামলার ঘটনাকে আমেরিকার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে দাঁড় করেছেন। তিনি হামলাকে শুধু আইনসভায় নয়, জাতির ওপর নারকীয় আঘাত বলে মন্তব্য করেন। রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান অ্যাডাম কিনজিনগার সংবিধানের ২৫তম সংশোধনী অনুযায়ী ট্রাম্পকে ক্ষমতাহীন ঘোষণা করতে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। রিপাবলিকান এই আইনপ্রণেতা বলেছেন, ট্রাম্পই এসব ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য দায়ী। ট্রাম্পকে দায়িত্ব পালনের জন্য অযোগ্য উল্লেখ করে তাঁকে সব নির্বাহী দায়িত্ব থেকে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সরে দাঁড়াতে হবে। একই দিন মিনেসোটা অঙ্গরাজ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম নারী কংগ্রেস সদস্য ইলহান ওমরও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে অভিশংসনের প্রস্তাব তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের যত দ্রুত সম্ভব তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে। এটা পরিষ্কার যে তিনি আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য হুমকি।’
টয়লেটে পাঁচ ঘণ্টা আটকা :
ডোনাল্ড ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকদের তান্ডবে টানা পাঁচ ঘণ্টা মার্কিন ক্যাপিটল ভবনের টয়লেটে আটকে থাকতে হয়েছে কংগ্রেসওমেন গ্রেম মিংকেকে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, টয়লেটে আটকে পড়া প্রসঙ্গে গ্রেম মিংকে বলেন, ‘দরজার বাইরে বিদ্রোহীরা ইউএস, ইউএস বলে চিৎকার করছিল। তাদের তান্ডবে আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল কারও হাতে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে আমি এখন নিরাপদে আছি, ধন্যবাদ সবাইকে পাশে থাকার জন্য।’ একই সময়ে কংগ্রেস ভবনে উপস্থিত রাজনৈতিক কলামিস্ট জেমি স্টাইমও আটকে ছিলেন ভবনের ভিতরে। জেমি স্টাইম বলেন, ‘ক্যাপিটল ভবনের বাইরে ট্রাম্পের কিছু বেপরোয়া সমর্থকের মুখোমুখি হই আমরা। তাদের সবাই পতাকা ওড়াচ্ছিল ও ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছিল। আমি প্রতিনিধি পরিষদের প্রেস গ্যালারিতে ঢুকে যাই। অধিবেশন দ্বিতীয় ঘণ্টায় গড়ালে হঠাৎ আমরা কাচ ভাঙার আওয়াজ শুনতে পেলাম। বাতাস ধোঁয়াচ্ছন্ন হতে শুরু করল। ক্যাপিটল ভবনের পুলিশের পক্ষ থেকে ঘোষণা এলো, এক ব্যক্তি ভবনে ঢুকে পড়েছে। এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছিল।’ তিনি আরও বলেন, পুলিশ ভবনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, যে কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। একটি গুলি চলেছিল। চেম্বারের ভিতরে তখন বিক্ষোভকারী আর পুলিশের মুখোমুখি অবস্থান। দরজায় পাঁচজন লোক বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে। ভয়ানক একটা অবস্থা। এটি ছিল জনগণের মতামতকে ছোট করা। এ কারণেই স্পিকার অধিবেশন চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন :
সহিংস ঘটনার পর ক্যাপিটল ভবন ঘিরে নিরাপত্তাব্যবস্থার সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, ভিড় দেখে পুলিশ দ্রুত লাইন ভেঙে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। দাঙ্গাকারীদের অনেকে বর্ম পরে ছিলেন। কারও কারও হাতে দেশি অস্ত্র, কারও হাতে রাসায়নিক স্প্রে ছিল। তারা ভবনের ভিতর ঢুকে কয়েক ঘণ্টা ধরে তান্ডব চালায়। তার পরও পুলিশকে তাদের ঘিরে ধরে ভবন থেকে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করতে দেখা যায়। গ্রেফতারের পরিবর্তে পুলিশ তাদের কাউকে কাউকে পথ দেখিয়ে ভবনের বাইরে নিয়ে যায়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে ও দরজা খুলতে সাহায্য করে। ভাইরাল হওয়া একটি ছবিতে ক্যাপিটল ভবনে ভাঙচুরের সময় এক পুলিশকে এক ব্যক্তির সঙ্গে ‘সেলফি’ তোলার জন্য পোজ দিতে দেখা যায়। ওইদিন দাঙ্গায় অংশ নেওয়া একজন যুক্তরাষ্ট্রের চরম ডানপন্থি দল ‘প্রাউড বয়েজ’এর খুব চেনা সদস্য নিক ওচস। তিনি ক্যাপিটল ভবনের ভিতর সেলফি তুলে নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টে পোস্ট দেন। পরে সিএনএনকে বলেন, ‘যেখানে হাজার হাজার মানুষ ছিল… পরিস্থিতির ওপর তাদের (নিরাপত্তা বাহিনীর) কোনো নিয়ন্ত্রণই ছিল না। আমাকে ভবনের ভিতরে যেতে কেউ থামায়নি বা প্রশ্ন করেনি।’ ভাইরাল হওয়া আরেক ছবিতে এক বিক্ষোভকারীকে সগর্বে হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলসির ডেস্কে এক পা তুলে তার চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায়। ছবিতে তাকে স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে। পেলসির ডেস্ক থেকে একটি চিঠিও চুরি করেন তিনি। তার পরও এ ঘটনায় কেন আটকের সংখ্যা এত কম তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নবনির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘এ দেশ বিচারের দুটি ধরনের সাক্ষী হলো। তার একটি গতকাল ইউএস ক্যাপিটলে চরমপন্থিদের তান্ডব এবং অন্যটি গত সামারে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে (ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার) পুলিশের টিয়ার গ্যাসের শেল ছোড়া। যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।’ অন্যদিকে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স বলেছেন, যারা বুধবারের দাঙ্গায় জড়িত ছিল তাদের আইন অনুযায়ী বিচারের আওতায় আনা হবে। ওই ঘটনার যত ছবি ও ভিডিও অনলাইনে ঘুরছে তাতে ? দাঙ্গাকারীদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে প্রমাণ দেওয়া খুব বেশি কঠিন কাজ হবে না। যদিও ফেসবুক কর্তৃপক্ষ দাঙ্গার ছবি ও ভিডিও মুছে দিয়েছেন। তবে তদন্ত কর্মকর্তারা জনগণের কাছে দাঙ্গায় অংশগ্রহণকারীদের ছবি, ভিডিও এবং অন্যান্য প্রমাণ সংগ্রহ করার আহ্বান জানিয়েছেন। ভাইরাল হওয়া দাঙ্গার বেশ কয়েকটি ছবির মুখও বেশ পরিচিত। তারা বিভিন্ন চরম ডানপন্থি দলের সদস্য। ক্যাপিটল পুলিশের পক্ষ থেকেও আসল অপরাধীদের খুঁজে বের করতে তদন্ত শুরুর কথা জানানো হয়েছে। আইনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের বিরল ও গুরুতর অভিযোগ আনা হতে পারে। আর দোষী সাব্যস্ত হলে ২০ বছরের কারাদন্ড হবে।