ইপেপার । আজমঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

তিন দশকে মুমূর্ষ চুয়াডাঙ্গার গ্রামীণ লোকজ সাংস্কৃতি

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৮:০৪:২২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১১ অক্টোবর ২০২১
  • / ১০ বার পড়া হয়েছে

আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে বিলুপ্ত বিনোদনের প্রধান অনুযঙ্গ যাত্রাপালা
আরিফ হাসান:
‘হৈ হৈ কাণ্ড, রৈ রৈ ব্যাপার। এপার বাংলা আর ওপার বাংলার জনপ্রিয় যাত্রাদলের অদ্য রজনীর বিশেষ আকর্ষণ…. রিক্সা ভ্যানে মাইক নিয়ে বাবুল আক্তারের ভরাট কণ্ঠে যাত্রার বিজ্ঞাপন এখন আর শোনা যায় না। হ্যাজাং-এর আলোয় জরির পোশাকে শরীর জড়িয়ে, কাঠের তরবারী উচিয়ে আদেশ করুন জাহাপানা বলে চিৎকার করে না সিরাজুল। সুঠাম দেহের অধিকারী কালো বর্ণের হিজলগাড়ীর যাত্রাশিল্পী সিরাজুল গত হয়েছে বেশ কয়েক বছর পূর্বে। বলদিয়ার বাবুল আক্তার এখন পুরোদস্ত বেকার। যাত্রার আলোক উজ্জল রঙ্গ মঞ্চের দৃশ্যের মতোই দীর্ঘদিন অসুস্থ থেকে পরপারে চলে গেছে বড়শলুয়ার রবজেল। রাজমিস্ত্রীর কাজ করে সংসার চালাতে হচ্ছে হিজলগাড়ীর কালাম মাস্টারের। রঙিন মঞ্চের তারকা নায়ক বড়শলুয়ার দেলেয়ার ডাক্তার এখন আকাশের তারকা। ছোটশলুয়া গ্রামে আলী হোসেন মাস্টারের কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে খুব সহজেই অনুমান করা যায় তিনি এক সময় নায়ক ছিলেন। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, হাতের মুঠোয় বিনোদনের সহজলভ্যতা, যাত্রার নামে অশ্লীলতা, মেলার নামে জুয়ার আবর্তে পড়ে চুয়াডাঙ্গা জেলা থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এক কালের বিনোদনের প্রধান অনুযঙ্গ যাত্রাপালা। ৯০ দশকের শেষ দিক পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা জেলাতে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল গ্রামীণ লোকজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালা। যার মধ্যে ছিল যাত্রাপালা, জারি, সারি পালাগান অন্যতম। যাত্রাশিল্প বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি এই শিল্পীর সাথে জড়িত শিল্পী, কলাকুশলীরা পেশা বদল করেছে।
৭০ দশকের দিকে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ছোটশলুয়া গ্রামের খাইরুল মেম্বার ছিল এই এলাকার যাত্রাদলের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। পরে ৮০’র দশকের দিকে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বলদিয়া গ্রামের মরহুম আ. লতিফ মেম্বারের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে নবরত্ন অপেরা। সেই সময় বৃহত্তর বেগমপুর, তিতুদহ ইউনিয়নে আরও বেশ কয়েকটি যাত্রাদলের আর্বিভাব হয়। এই দুই ইউনিয়নের প্রায় শতাধিক মানুষ যাত্রা দলের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। তিতুদহ ইউনিয়নের তিতুদহ গ্রাম, বড়শলুয়া, ছোটশলুয়া ও বলদিয়া এবং বেগমপুর ইউনিয়নের বেগমপুর, ফুরশেদপুর, কোটালী, হিজলগাড়ী, নেহালপুর, বোয়ালিয়া, শৈলমারী, আকন্দবাড়ীয়াসহ কয়েকটি গ্রামে সেই সময়ের তরুণ যুবকরা মিলে গড়ে তোলে একাধিক যাত্রাদল।
মূলত তারাই দুই দশক এই এলাকার সাংস্কৃতিক অঙ্গন মাতিয়ে রাখে। সেই সময় এই এলাকায় গড়ে ওঠা যাত্রাশিল্পীদের অনেকেই দেশব্যাপী সুমান অর্জন করেন। যার মধ্য বড়শলুয়া গ্রামের মরহুম রবজেল হোসেন, দেয়োয়ার ডাক্তার, ছোটশলুয়া গ্রামের আলী হোসেন মাস্টার, বলদিয়ার বাবুল আক্তার, ওসমান আলী, ইমদাদুল হক, আক্কাস আলী, ছোটশলুয়া মরহুম বিল্লাল হোসেন, মুরাদ আলী, হিজলগাড়ী গ্রামের মরহুম সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ।
বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী- বর্তমানে সারা দেশে কুশলী ও কর্মীসহ যাত্রাশিল্পীর সংখ্যা ২০ হাজার ৩ শ। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল প্রায় ৫ লাখ। ৯০’র পর থেকে অশ্লীলতা, নিরাপত্তা সমস্যাসহ নানা অজুহাতে যাত্রাশিল্পকে আবদ্ধ করা হয় নিয়ন্ত্রণের বেড়াজালে। ১৯৯১-৯৬’র মধ্যে ৬ বার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় যাত্রানুষ্ঠান বন্ধের জন্য। সে সময় ১০১৪ দিন সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে যাত্রানুষ্ঠান। তারপর থেকে এখনো অনেক জায়গায় যাত্রার নাম শুনলে অনুমোদন দেওয়া হয় না। সারা দেশে যাত্রাপালার অনুমোদন অঘোষিতভাবে বন্ধ রয়েছে। যাত্রাপালা আয়োজনে জেলা প্রশাসনের অনুমোদন দরকার হয়। কিন্তু যাত্রার কথা শুনলেই প্রশাসন আর অনুমোদন দিচ্ছে না। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। দেশে যেখানে ৩০০-এর বেশি যাত্রা দল ছিল, এখন ৩০টি দলও সংগঠিত হচ্ছে না। প্রায় দুই বছর ধরে যাত্রাপালা বন্ধ। সর্বশেষ করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকে অদ্যবর্তি দেশের কোথাও একটিও যাত্রা অনুষ্ঠান হয়নি।
একসময় চুয়াডাঙ্গা জেলাতে আষাঢ় মাসের গড়াইটুপি অম্রবতি মেলার মাঠে যাত্রাগানের আসর দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ আসতো। শীতের রাত জেগে যাত্রা অনুষ্ঠান দেখা সেই সময় নেশায় পরিণত হয়েছিল সকল বয়সী নারী-পুরুষদের। বড়শলুয়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম বলেন, গড়াইটুপি মেলায় যাত্রা দেখার জন্য গ্রাম থেকে দল বেঁধে মেলায় যেতাম। সাঁতপাকে বাধা, মায়ের চোখে জল, হাসির হাটে কান্না সমাজ, অশ্রু দিয়ে লেখা নামে দেখা যাত্রাপালাগুলো এখনও চোখের সামনে ভেঁসে বেড়ায়।
সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়নের ছোটশলুয়া গ্রামে ছিল নছিমন যাত্রাপালার পুরো শিল্পী কলাকৌশলী টিম। এই যাত্রাদলের প্রধান ছিল মরহুম মুরাদ আলী। সামাজিক যাত্রাপালার নায়ক একাধিকবার পুরস্কারপ্রাপ্ত ছোটশলুয়া গ্রামের স্কুলশিক্ষক আলী হোসেন আপেক্ষের সুরে তিনি বলেন, আকাশ সাংস্কৃতির প্রভাব আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ও আবহমান বাংলার সংস্কৃতির অংশ যাত্রা শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। এই শিল্পকে রক্ষা করার জন্য তিনি সরকারের কাছে দাবি জানান।
বড়শলুয়া নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজের সমাজ বিজ্ঞানের প্রভাষক মুকিত জোয়ার্দ্দার বলেন, যাত্রাদলের অতি মুনাফালোভী মালিকদের খপ্পরে পড়ে গত তিন দশকে মুমূর্ষু হয়ে পড়েছে এই শিল্প। দুই দশক আগেও সারাদেশে তিন শতাধিক যাত্রাদল ছিল। কমতে কমতে এখন সর্বোচ্চ টিকে আছে মাত্রা ৩০ টি। যাত্রার এই করুণ দশার কারণে বেকার হয়ে পড়েছেন এই শিল্পের মানুষগুলো। বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাবে তাদের অনেকে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সরকার যাত্রা শিল্পের জন্য নীতিমালা ও নিবন্ধনের ব্যবস্থা করলেও এই শিল্পের মরণদশা কাটছে না। সারাদেশে অঘোষিতভাবে বন্ধ রয়েছে যাত্রাপালার অনুমোদন। কোন কোন জায়গায় ডিসি এবং এসপি’রা অনুমোদন দিলেও যাত্রা-পুতুল নাচের নামে অশ¬ীল-নোংরা নৃত্য, জুয়া-হাউজির আসর বসানোর কারণে তা বন্ধ করে দেয়া হয়। যাত্রা শিল্প ধ্বংসের জন্য তিনি অশ্লীলতাকেও দায়ি করেন।
হিজলগাড়ী, নেহালপুর ও ছোটশলুয়া গ্রামের বেশ কয়েকজন যাত্রা শিল্পী ও সংগঠনরা বলে বলেন, যাত্রা শিল্পের অবক্ষয় এবং বিলুপ্তির পথে ধাবিত হওয়ার মূল কারণ অসাধু যাত্রাপালা ব্যবসায়ীদের ‘প্রিন্সেস’ আমদানি আর জুয়া-হাউজি চালু । তারা বলেন, এই শব্দগুলো আগে যাত্রা দলে ছিল না। ১৯৯৫ সালের পর এই অশ¬ীলতার সূচনা হয়েছিল মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। তাদের কাছেই চিরায়ত যাত্রাপালার মৃত্যু ঘটে। প্রিন্সেস বলতে তারা অশ্লীল নৃত্যশিল্পীদের বোঝিয়েছেন। ২০০০ সালের শুরুর দিকে যাত্রাপালার নামে যাত্রামঞ্চে প্রিন্সেসদের দাপট চলে। এ কারণে শুরু হয় যাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা। নিষেধাজ্ঞা তারপর আবার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সাপ নেউলের খেলায় শেষতক এই শিল্পের পতন ঘটে।
জানা যায়, যাত্রাপালার ঐতিহ্য অত্যন্ত প্রাচীন। যাত্রা’র সূচনা হয় খ্রিস্টপূর্ব কয়েক হাজার বছর আগে। তখন মানুষ দেব-দেবীদের বন্দনা করতো। তখন দল বেঁধে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ‘যাত্রা’ করার থেকে এর নাম ’যাত্রা’। ১৫০৯ সালে যাত্রার সাথে শ্রী চৈতন্য দেবের সময়ে যাত্রায় অভিনয় যুক্ত হয়। ‘রুক্ষ্মীনি হরন’ প্রথম যাত্রা পালা। অষ্টম ও নবম শতকেও এদেশে পালাগান ও পালার অভিনয় প্রচলিত ছিল। শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের আগেও রাঢ়, বঙ্গ, সমতট, গৌড়, প্লু, চন্দ্রদ্বীপ, হরিকেল, শ্রীহট্টসহ সমগ্র ভূখন্ডে পালাগান ও কাহিনিকাব্যের অভিনয় প্রচলিত ছিল। ধর্মীয় বা কোনো উৎসবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার যে রীতি সেখান থেকেই যাত্রা শব্দটি এসেছে। এদেশে শিবের গাজন, রামযাত্রা, কেষ্টযাত্রা, সীতার বারোমাসী, রাধার বারোমাসী প্রচলিত ছিল। অষ্টাদশ শতকে যাত্রা বাংলা ভূখন্ডের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় শিশুরাম, পরমানন্দ অধিকারী, সুবল দাস ছিলেন যাত্রার জগতে প্রসিদ্ধ। উনবিংশ শতকে পৌরাণিক কাহিনিভিত্তিক যাত্রা খুব জনপ্রিয়তা পায়। উনবিংশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে যাত্রায় দেশপ্রেমমূলক কাহিনির অভিনয় শুরু হয়। বিখ্যাত সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেনও পালা লিখেছেন। তিনি বেহুলা নিয়ে যাত্রাপালা লেখেন। সে সময় গ্রামেগঞ্জে বিষাদ সিন্ধুর কাহিনি নিয়েও যাত্রা অভিনয় হতো। কারবালার কাহিনি নিয়ে যাত্রা পালা লেখা হতো।
যাত্রাপালা সংশি¬ষ্টরা জানান, এখন টিকে আছে এমন নামকরা যাত্রাদলগুলো হলো: যশোরের আনন্দ অপেরা, চ্যালেঞ্জার অপেরা, অগ্রগামী নাট্টসংস্থা, মাগুরার চৈতালি অপেরা, নারায়ণগঞ্জের ভোলানাথ যাত্রা সমপ্রদায়, কোহিনূর অপেরা, গাজীপুরের দিশারী অপেরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস যাত্রা ইউনিট, খুলনার স্বদেশ অপেরা, রাজমহল অপেরা, রঙমহল অপেরা,দেশ অপেরা, নাটোরের পদ্মযাত্রা ইউনিট, বাগেরহাটের সুন্দরবন অপেরা, লক্ষ্মীপুরের কেয়া যাত্রা ইউনিট ইত্যাদি।
উলে¬খযোগ্য যাত্রা পালার মধ্যে রয়েছে: রূপবান-রহিম বাদশাহ, মালকা বানু, সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল, গুনাইবিবি, দুর্গামনি, কমলা রানীর বনবাস, কাজল রেখা, মলুয়া, ভেলুয়া সুন্দরী, সোনাভান, বীরাঙ্গনা সখিনা, গাজী কালু চম্পাবতী, বনবিবি ইত্যাদি। জনপ্রিয়তা পায়: মাইকেল মধুসূদন, দেবদাস, রক্তাক্ত বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বিজয় এনেছি, মা মাটি মানুষ, সোনার বাংলা, সোজন বাদিয়ার ঘাট, লালন ফকির, ঈশাঁখা, রক্তাত্ত প্রান্তর, একযে ছিলেন মহারানী, দাতা হাতেম তাই, এই দেশ এই মাটি, বিদ্রোহী বুড়িগঙ্গা, বর্গী এলো দেশে, বাংলার মহানায়ক ইত্যাদি পালা। চুয়াডাঙ্গা জেলাতে যাত্রা শিল্পের সুদিন হয়তো পূর্বে মত ফিরে আসবে না তবে সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা বলে বিল্পুপ্তির হাত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে। যাত্রা শিল্পকে বাচিঁয়ে সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি কামনা করেছে এই শিল্পের সাথে জড়িতরা।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

তিন দশকে মুমূর্ষ চুয়াডাঙ্গার গ্রামীণ লোকজ সাংস্কৃতি

আপলোড টাইম : ০৮:০৪:২২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১১ অক্টোবর ২০২১

আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে বিলুপ্ত বিনোদনের প্রধান অনুযঙ্গ যাত্রাপালা
আরিফ হাসান:
‘হৈ হৈ কাণ্ড, রৈ রৈ ব্যাপার। এপার বাংলা আর ওপার বাংলার জনপ্রিয় যাত্রাদলের অদ্য রজনীর বিশেষ আকর্ষণ…. রিক্সা ভ্যানে মাইক নিয়ে বাবুল আক্তারের ভরাট কণ্ঠে যাত্রার বিজ্ঞাপন এখন আর শোনা যায় না। হ্যাজাং-এর আলোয় জরির পোশাকে শরীর জড়িয়ে, কাঠের তরবারী উচিয়ে আদেশ করুন জাহাপানা বলে চিৎকার করে না সিরাজুল। সুঠাম দেহের অধিকারী কালো বর্ণের হিজলগাড়ীর যাত্রাশিল্পী সিরাজুল গত হয়েছে বেশ কয়েক বছর পূর্বে। বলদিয়ার বাবুল আক্তার এখন পুরোদস্ত বেকার। যাত্রার আলোক উজ্জল রঙ্গ মঞ্চের দৃশ্যের মতোই দীর্ঘদিন অসুস্থ থেকে পরপারে চলে গেছে বড়শলুয়ার রবজেল। রাজমিস্ত্রীর কাজ করে সংসার চালাতে হচ্ছে হিজলগাড়ীর কালাম মাস্টারের। রঙিন মঞ্চের তারকা নায়ক বড়শলুয়ার দেলেয়ার ডাক্তার এখন আকাশের তারকা। ছোটশলুয়া গ্রামে আলী হোসেন মাস্টারের কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে খুব সহজেই অনুমান করা যায় তিনি এক সময় নায়ক ছিলেন। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, হাতের মুঠোয় বিনোদনের সহজলভ্যতা, যাত্রার নামে অশ্লীলতা, মেলার নামে জুয়ার আবর্তে পড়ে চুয়াডাঙ্গা জেলা থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এক কালের বিনোদনের প্রধান অনুযঙ্গ যাত্রাপালা। ৯০ দশকের শেষ দিক পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা জেলাতে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল গ্রামীণ লোকজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালা। যার মধ্যে ছিল যাত্রাপালা, জারি, সারি পালাগান অন্যতম। যাত্রাশিল্প বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি এই শিল্পীর সাথে জড়িত শিল্পী, কলাকুশলীরা পেশা বদল করেছে।
৭০ দশকের দিকে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ছোটশলুয়া গ্রামের খাইরুল মেম্বার ছিল এই এলাকার যাত্রাদলের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। পরে ৮০’র দশকের দিকে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বলদিয়া গ্রামের মরহুম আ. লতিফ মেম্বারের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে নবরত্ন অপেরা। সেই সময় বৃহত্তর বেগমপুর, তিতুদহ ইউনিয়নে আরও বেশ কয়েকটি যাত্রাদলের আর্বিভাব হয়। এই দুই ইউনিয়নের প্রায় শতাধিক মানুষ যাত্রা দলের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। তিতুদহ ইউনিয়নের তিতুদহ গ্রাম, বড়শলুয়া, ছোটশলুয়া ও বলদিয়া এবং বেগমপুর ইউনিয়নের বেগমপুর, ফুরশেদপুর, কোটালী, হিজলগাড়ী, নেহালপুর, বোয়ালিয়া, শৈলমারী, আকন্দবাড়ীয়াসহ কয়েকটি গ্রামে সেই সময়ের তরুণ যুবকরা মিলে গড়ে তোলে একাধিক যাত্রাদল।
মূলত তারাই দুই দশক এই এলাকার সাংস্কৃতিক অঙ্গন মাতিয়ে রাখে। সেই সময় এই এলাকায় গড়ে ওঠা যাত্রাশিল্পীদের অনেকেই দেশব্যাপী সুমান অর্জন করেন। যার মধ্য বড়শলুয়া গ্রামের মরহুম রবজেল হোসেন, দেয়োয়ার ডাক্তার, ছোটশলুয়া গ্রামের আলী হোসেন মাস্টার, বলদিয়ার বাবুল আক্তার, ওসমান আলী, ইমদাদুল হক, আক্কাস আলী, ছোটশলুয়া মরহুম বিল্লাল হোসেন, মুরাদ আলী, হিজলগাড়ী গ্রামের মরহুম সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ।
বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী- বর্তমানে সারা দেশে কুশলী ও কর্মীসহ যাত্রাশিল্পীর সংখ্যা ২০ হাজার ৩ শ। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল প্রায় ৫ লাখ। ৯০’র পর থেকে অশ্লীলতা, নিরাপত্তা সমস্যাসহ নানা অজুহাতে যাত্রাশিল্পকে আবদ্ধ করা হয় নিয়ন্ত্রণের বেড়াজালে। ১৯৯১-৯৬’র মধ্যে ৬ বার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় যাত্রানুষ্ঠান বন্ধের জন্য। সে সময় ১০১৪ দিন সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে যাত্রানুষ্ঠান। তারপর থেকে এখনো অনেক জায়গায় যাত্রার নাম শুনলে অনুমোদন দেওয়া হয় না। সারা দেশে যাত্রাপালার অনুমোদন অঘোষিতভাবে বন্ধ রয়েছে। যাত্রাপালা আয়োজনে জেলা প্রশাসনের অনুমোদন দরকার হয়। কিন্তু যাত্রার কথা শুনলেই প্রশাসন আর অনুমোদন দিচ্ছে না। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। দেশে যেখানে ৩০০-এর বেশি যাত্রা দল ছিল, এখন ৩০টি দলও সংগঠিত হচ্ছে না। প্রায় দুই বছর ধরে যাত্রাপালা বন্ধ। সর্বশেষ করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকে অদ্যবর্তি দেশের কোথাও একটিও যাত্রা অনুষ্ঠান হয়নি।
একসময় চুয়াডাঙ্গা জেলাতে আষাঢ় মাসের গড়াইটুপি অম্রবতি মেলার মাঠে যাত্রাগানের আসর দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ আসতো। শীতের রাত জেগে যাত্রা অনুষ্ঠান দেখা সেই সময় নেশায় পরিণত হয়েছিল সকল বয়সী নারী-পুরুষদের। বড়শলুয়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম বলেন, গড়াইটুপি মেলায় যাত্রা দেখার জন্য গ্রাম থেকে দল বেঁধে মেলায় যেতাম। সাঁতপাকে বাধা, মায়ের চোখে জল, হাসির হাটে কান্না সমাজ, অশ্রু দিয়ে লেখা নামে দেখা যাত্রাপালাগুলো এখনও চোখের সামনে ভেঁসে বেড়ায়।
সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়নের ছোটশলুয়া গ্রামে ছিল নছিমন যাত্রাপালার পুরো শিল্পী কলাকৌশলী টিম। এই যাত্রাদলের প্রধান ছিল মরহুম মুরাদ আলী। সামাজিক যাত্রাপালার নায়ক একাধিকবার পুরস্কারপ্রাপ্ত ছোটশলুয়া গ্রামের স্কুলশিক্ষক আলী হোসেন আপেক্ষের সুরে তিনি বলেন, আকাশ সাংস্কৃতির প্রভাব আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ও আবহমান বাংলার সংস্কৃতির অংশ যাত্রা শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। এই শিল্পকে রক্ষা করার জন্য তিনি সরকারের কাছে দাবি জানান।
বড়শলুয়া নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজের সমাজ বিজ্ঞানের প্রভাষক মুকিত জোয়ার্দ্দার বলেন, যাত্রাদলের অতি মুনাফালোভী মালিকদের খপ্পরে পড়ে গত তিন দশকে মুমূর্ষু হয়ে পড়েছে এই শিল্প। দুই দশক আগেও সারাদেশে তিন শতাধিক যাত্রাদল ছিল। কমতে কমতে এখন সর্বোচ্চ টিকে আছে মাত্রা ৩০ টি। যাত্রার এই করুণ দশার কারণে বেকার হয়ে পড়েছেন এই শিল্পের মানুষগুলো। বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাবে তাদের অনেকে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সরকার যাত্রা শিল্পের জন্য নীতিমালা ও নিবন্ধনের ব্যবস্থা করলেও এই শিল্পের মরণদশা কাটছে না। সারাদেশে অঘোষিতভাবে বন্ধ রয়েছে যাত্রাপালার অনুমোদন। কোন কোন জায়গায় ডিসি এবং এসপি’রা অনুমোদন দিলেও যাত্রা-পুতুল নাচের নামে অশ¬ীল-নোংরা নৃত্য, জুয়া-হাউজির আসর বসানোর কারণে তা বন্ধ করে দেয়া হয়। যাত্রা শিল্প ধ্বংসের জন্য তিনি অশ্লীলতাকেও দায়ি করেন।
হিজলগাড়ী, নেহালপুর ও ছোটশলুয়া গ্রামের বেশ কয়েকজন যাত্রা শিল্পী ও সংগঠনরা বলে বলেন, যাত্রা শিল্পের অবক্ষয় এবং বিলুপ্তির পথে ধাবিত হওয়ার মূল কারণ অসাধু যাত্রাপালা ব্যবসায়ীদের ‘প্রিন্সেস’ আমদানি আর জুয়া-হাউজি চালু । তারা বলেন, এই শব্দগুলো আগে যাত্রা দলে ছিল না। ১৯৯৫ সালের পর এই অশ¬ীলতার সূচনা হয়েছিল মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। তাদের কাছেই চিরায়ত যাত্রাপালার মৃত্যু ঘটে। প্রিন্সেস বলতে তারা অশ্লীল নৃত্যশিল্পীদের বোঝিয়েছেন। ২০০০ সালের শুরুর দিকে যাত্রাপালার নামে যাত্রামঞ্চে প্রিন্সেসদের দাপট চলে। এ কারণে শুরু হয় যাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা। নিষেধাজ্ঞা তারপর আবার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সাপ নেউলের খেলায় শেষতক এই শিল্পের পতন ঘটে।
জানা যায়, যাত্রাপালার ঐতিহ্য অত্যন্ত প্রাচীন। যাত্রা’র সূচনা হয় খ্রিস্টপূর্ব কয়েক হাজার বছর আগে। তখন মানুষ দেব-দেবীদের বন্দনা করতো। তখন দল বেঁধে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ‘যাত্রা’ করার থেকে এর নাম ’যাত্রা’। ১৫০৯ সালে যাত্রার সাথে শ্রী চৈতন্য দেবের সময়ে যাত্রায় অভিনয় যুক্ত হয়। ‘রুক্ষ্মীনি হরন’ প্রথম যাত্রা পালা। অষ্টম ও নবম শতকেও এদেশে পালাগান ও পালার অভিনয় প্রচলিত ছিল। শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের আগেও রাঢ়, বঙ্গ, সমতট, গৌড়, প্লু, চন্দ্রদ্বীপ, হরিকেল, শ্রীহট্টসহ সমগ্র ভূখন্ডে পালাগান ও কাহিনিকাব্যের অভিনয় প্রচলিত ছিল। ধর্মীয় বা কোনো উৎসবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার যে রীতি সেখান থেকেই যাত্রা শব্দটি এসেছে। এদেশে শিবের গাজন, রামযাত্রা, কেষ্টযাত্রা, সীতার বারোমাসী, রাধার বারোমাসী প্রচলিত ছিল। অষ্টাদশ শতকে যাত্রা বাংলা ভূখন্ডের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় শিশুরাম, পরমানন্দ অধিকারী, সুবল দাস ছিলেন যাত্রার জগতে প্রসিদ্ধ। উনবিংশ শতকে পৌরাণিক কাহিনিভিত্তিক যাত্রা খুব জনপ্রিয়তা পায়। উনবিংশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে যাত্রায় দেশপ্রেমমূলক কাহিনির অভিনয় শুরু হয়। বিখ্যাত সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেনও পালা লিখেছেন। তিনি বেহুলা নিয়ে যাত্রাপালা লেখেন। সে সময় গ্রামেগঞ্জে বিষাদ সিন্ধুর কাহিনি নিয়েও যাত্রা অভিনয় হতো। কারবালার কাহিনি নিয়ে যাত্রা পালা লেখা হতো।
যাত্রাপালা সংশি¬ষ্টরা জানান, এখন টিকে আছে এমন নামকরা যাত্রাদলগুলো হলো: যশোরের আনন্দ অপেরা, চ্যালেঞ্জার অপেরা, অগ্রগামী নাট্টসংস্থা, মাগুরার চৈতালি অপেরা, নারায়ণগঞ্জের ভোলানাথ যাত্রা সমপ্রদায়, কোহিনূর অপেরা, গাজীপুরের দিশারী অপেরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস যাত্রা ইউনিট, খুলনার স্বদেশ অপেরা, রাজমহল অপেরা, রঙমহল অপেরা,দেশ অপেরা, নাটোরের পদ্মযাত্রা ইউনিট, বাগেরহাটের সুন্দরবন অপেরা, লক্ষ্মীপুরের কেয়া যাত্রা ইউনিট ইত্যাদি।
উলে¬খযোগ্য যাত্রা পালার মধ্যে রয়েছে: রূপবান-রহিম বাদশাহ, মালকা বানু, সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল, গুনাইবিবি, দুর্গামনি, কমলা রানীর বনবাস, কাজল রেখা, মলুয়া, ভেলুয়া সুন্দরী, সোনাভান, বীরাঙ্গনা সখিনা, গাজী কালু চম্পাবতী, বনবিবি ইত্যাদি। জনপ্রিয়তা পায়: মাইকেল মধুসূদন, দেবদাস, রক্তাক্ত বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বিজয় এনেছি, মা মাটি মানুষ, সোনার বাংলা, সোজন বাদিয়ার ঘাট, লালন ফকির, ঈশাঁখা, রক্তাত্ত প্রান্তর, একযে ছিলেন মহারানী, দাতা হাতেম তাই, এই দেশ এই মাটি, বিদ্রোহী বুড়িগঙ্গা, বর্গী এলো দেশে, বাংলার মহানায়ক ইত্যাদি পালা। চুয়াডাঙ্গা জেলাতে যাত্রা শিল্পের সুদিন হয়তো পূর্বে মত ফিরে আসবে না তবে সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা বলে বিল্পুপ্তির হাত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে। যাত্রা শিল্পকে বাচিঁয়ে সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি কামনা করেছে এই শিল্পের সাথে জড়িতরা।