ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ঢাকায় ৩৮ টুকরো হওয়া ঝিনাইদহের গৃহবধূর দুই সন্তানের সামনে ঘোর অন্ধকার

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:২০:২৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭
  • / ৩২১ বার পড়া হয়েছে

কাজল চৌধূরী: উর্মি আর তামিমের চোখে এখন হতাশা। মাকে ৩৮ টুকরো করে হত্যা করা হয়েছে। আর পিতা? মাকে হত্যার দায়ে ফেরারী। সামনে তাদের ঘোর অনামিশা আর এক রাশ প্রশ্ন। কি ভাবে মানুষ হবে। কে তাদের লালন পালন করবে। শেষ বারের মতো মৃত মায়ের মুখটি দেখতে তারা এখন ব্যকুল। জামা-কাপড় পরে বসে ছিল ঘরের বারান্দায়। মাকে একনজর দেখার আশা নিয়ে রওনা দিয়েছে। মা তাসলিমা আক্তারকে ৩৮ টুকরো করে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এই বিভৎস টুকরো টুকরো মাংশ পিন্ডির মধ্যে কি ভাবে মায়ের মুখটি দেখবে তারা? উর্মি আর তামিমের সঙ্গে গেছেন পরিবারের অন্য দুই সদস্য। শিশু দু’টির প্রশ্ন ‘আমরা কি আমাদের মাকে দেখতে পারবো, শুনেছি তাকে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছে। সাংবাদিক শুনেই প্রশ্ন করে বসে ‘আপনারা দেখেছেন আমাদের মায়ের মুখটা ঠিক আছে কি’। সপ্তম শ্রেণীতে পড়–য়া মেয়ে উর্মি কান্নার ফাঁকে ফাঁকে আরো বলে, এই মা-ই তাদের বড় করতে পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন। তাদের দু’জনকে নানা বাড়িতে রেখে ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। তার পাঠানো টাকায় পড়ালেখা চলতো, চলতো তাদের খাওয়া-পরা। এখন তাদের দু’জনের কি হবে ? নিহত তাসলিমা আক্তারের পিতা তক্কেল আলী মন্ডলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় হতবাক হয়ে বসে আছে শিশু দুইটি। পরনে জামা-কাপড়। ভ্যানের অপেক্ষায় বসে আছে তারা ঢাকায় যাবে। সঙ্গে আছেন নানী রাবেয়া খাতুন ও মামা হাফিজুর রহমান।
ঢাকার জামগড়া এলাকায় খুন হয়েছেন তাদের মা তাসলিমা আক্তার। শুনেছেন তার দেখে চেনার উপায় নেই, কেটে ৩৮ টুকরো করা হয়েছে। তারপরও একনজর দেখার আশা নিয়ে তারা যাচ্ছেন। ভালো থাকলে লাশও নিয়ে আসবেন বলে জানান বাবা তক্কেল আলী মন্ডল। উল্লেখ্য ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নৈহাটি গ্রামের তক্কেল আলীর একমাত্র কন্যা তাসলিমা আক্তার (৩২)। আনমানিক ১০ বছর তিনি ঢাকায় চলে যান। সাভার, আশুলিয়া, জামগড়া এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন আর পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। ঈদের দুইদিন আগে তাসলিমাকে খুন করা হয়েছে। জামগড়া এলাকার একটি বাসায় প্লাস্টিকের ড্রামে তার অর্ধগলিত লাশ পাওয়া গেছে। ৩৮ টুকরো করে ড্রামে ভরে রাখা ছিল ওই লাশটি।
নিহত তাসলিমা আক্তারের মা রাবেয়া খাতুন জানান, প্রায় ১৪ বছর আগে খাজুরা গ্রামের বাবুল হোসেনের সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে হয়। বিয়ের পর উর্মির জন্ম। কিন্তু বাবুল নেশাগ্রস্থ হওয়ায় তারা সংসার করতে পারেনি। অল্প দিনেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এরপর তাসলিমা ঢাকায় কাজ করতে চলে যায়। সেখানে পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। সেখানে সাহেব আলী নামের এক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের পর জন্ম হয় ছেলে তামিম। কিন্তু বাড়িতে থাকা মেয়েকে নিয়ে তাদের বিরোধ সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে তাসলিমাকে তাড়িয়ে দেন পুলিশ সদস্য। রাবেয়া খাতুন আরো জানান, এই ঘটনার পর তাসলিমা তাকে বলেছিল সে আর কখনও সংসার করবে না। কাজ করে বাচ্চা দুইটি মানুষ করবে। ছেলে-মেয়ে দু’টিকে তার হাতে তুলে দিয়ে আবারো চলে যায় ঢাকায়। সেখানে কাজ করতে থাকে। তিনি জানান, আনুমানিক এক বছর পূর্বে তাদের পাশ^বর্তী বাগডাঙ্গা গ্রামের মজিবর রহমানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। মজিবর রহমানও ওই কারখানায় কাজ করতো। মজিবর তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেন। এতে তাসলিমা রাজী না থাকলেও একই এলাকার মানুষ হওয়ায় মাঝে মধ্যে কথা হতো। একটি সময় তার মেয়ের মজিবরের কথায় রাজি হন। ৭ মাস হয়েছে তারা দু’জন বিয়ে করেছে।
রাবেয়া খাতুন জানান, বিয়ের পর তারা প্রায়ই গোলমাল করতো। একটি সময় তারা গ্রামে চলে আসে। স্বামী মজিবর রহমান তাকে বাড়িতে না রেখে নানা স্থানে লুকিয়ে রাখতেন। এই অবস্থায় তিনি যোগাযোগ করে মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। তাসলিমা কিছুদিন বাড়িতে থেকে আবারো ঢাকায় চলে যায়। সেখানে আশুলিয়া এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ নেন। আর মজিবর তার পিছু নিতে ওই এলাকার একটি দর্জির দোকানে কাজ নেন। দু’জন দুই জায়গায় বসবাস করতেন। তাসলিমা আক্তারের ফুফু শিউলী খাতুন জানান, মজিবর মাঝে মধ্যেই মোবাইল ফোনে তাসলিমাকে উত্যক্ত করতো। নতুন করে সংসার করার প্রস্তাব দেন। ৩০ আগষ্ট তাসলিমাকে নিয়ে নতুন বাসায় চলে যান। যাবার সময় বলে যায় তার মোবাইল বন্ধ থাকবে। বেশি যোগাযোগ করার প্রয়োজন নেই। এরপর তিনি ঈদের ছুটিতে বাড়িতে চলে আসেন। আসার সময় চেষ্টা করেও তাসলিমার সন্ধান পাননি। তারা নতুন যে বাসা নিয়েছিল সেটাও চিনতে পারেন নি। এখন তারা জানতে পারছেন তাসলিমাকে খুন করা হয়েছে। খুন করার পরিকল্পনা নিয়েই নতুন বাসায় নেওয়া হয়েছে বলে শিউলী খাতুন জানান। আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল আউয়াল প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ঘটনার পর তারা বিভিন্ন তথ্যের ভিক্তিতে ঝিনাইদহের বাগডাঙ্গা গ্রাম থেকে মুকুল নামের একজনকে আটক করেছে। তার মাধ্যমে তারা তাসলিমাকে সনাক্ত করতে পেরেছেন। তার স্বামী মজিবর রহমান পলাতক রয়েছেন। ধারণা করা যাচ্ছে, পারিবারিক কলহের কারনে তাসলিমাকে হত্যার পর টুকরো টুকরো করে ড্রামে ভরে রাখা হয়েছিল।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

ঢাকায় ৩৮ টুকরো হওয়া ঝিনাইদহের গৃহবধূর দুই সন্তানের সামনে ঘোর অন্ধকার

আপলোড টাইম : ১০:২০:২৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

কাজল চৌধূরী: উর্মি আর তামিমের চোখে এখন হতাশা। মাকে ৩৮ টুকরো করে হত্যা করা হয়েছে। আর পিতা? মাকে হত্যার দায়ে ফেরারী। সামনে তাদের ঘোর অনামিশা আর এক রাশ প্রশ্ন। কি ভাবে মানুষ হবে। কে তাদের লালন পালন করবে। শেষ বারের মতো মৃত মায়ের মুখটি দেখতে তারা এখন ব্যকুল। জামা-কাপড় পরে বসে ছিল ঘরের বারান্দায়। মাকে একনজর দেখার আশা নিয়ে রওনা দিয়েছে। মা তাসলিমা আক্তারকে ৩৮ টুকরো করে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এই বিভৎস টুকরো টুকরো মাংশ পিন্ডির মধ্যে কি ভাবে মায়ের মুখটি দেখবে তারা? উর্মি আর তামিমের সঙ্গে গেছেন পরিবারের অন্য দুই সদস্য। শিশু দু’টির প্রশ্ন ‘আমরা কি আমাদের মাকে দেখতে পারবো, শুনেছি তাকে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছে। সাংবাদিক শুনেই প্রশ্ন করে বসে ‘আপনারা দেখেছেন আমাদের মায়ের মুখটা ঠিক আছে কি’। সপ্তম শ্রেণীতে পড়–য়া মেয়ে উর্মি কান্নার ফাঁকে ফাঁকে আরো বলে, এই মা-ই তাদের বড় করতে পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন। তাদের দু’জনকে নানা বাড়িতে রেখে ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। তার পাঠানো টাকায় পড়ালেখা চলতো, চলতো তাদের খাওয়া-পরা। এখন তাদের দু’জনের কি হবে ? নিহত তাসলিমা আক্তারের পিতা তক্কেল আলী মন্ডলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় হতবাক হয়ে বসে আছে শিশু দুইটি। পরনে জামা-কাপড়। ভ্যানের অপেক্ষায় বসে আছে তারা ঢাকায় যাবে। সঙ্গে আছেন নানী রাবেয়া খাতুন ও মামা হাফিজুর রহমান।
ঢাকার জামগড়া এলাকায় খুন হয়েছেন তাদের মা তাসলিমা আক্তার। শুনেছেন তার দেখে চেনার উপায় নেই, কেটে ৩৮ টুকরো করা হয়েছে। তারপরও একনজর দেখার আশা নিয়ে তারা যাচ্ছেন। ভালো থাকলে লাশও নিয়ে আসবেন বলে জানান বাবা তক্কেল আলী মন্ডল। উল্লেখ্য ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নৈহাটি গ্রামের তক্কেল আলীর একমাত্র কন্যা তাসলিমা আক্তার (৩২)। আনমানিক ১০ বছর তিনি ঢাকায় চলে যান। সাভার, আশুলিয়া, জামগড়া এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন আর পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। ঈদের দুইদিন আগে তাসলিমাকে খুন করা হয়েছে। জামগড়া এলাকার একটি বাসায় প্লাস্টিকের ড্রামে তার অর্ধগলিত লাশ পাওয়া গেছে। ৩৮ টুকরো করে ড্রামে ভরে রাখা ছিল ওই লাশটি।
নিহত তাসলিমা আক্তারের মা রাবেয়া খাতুন জানান, প্রায় ১৪ বছর আগে খাজুরা গ্রামের বাবুল হোসেনের সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে হয়। বিয়ের পর উর্মির জন্ম। কিন্তু বাবুল নেশাগ্রস্থ হওয়ায় তারা সংসার করতে পারেনি। অল্প দিনেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এরপর তাসলিমা ঢাকায় কাজ করতে চলে যায়। সেখানে পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। সেখানে সাহেব আলী নামের এক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের পর জন্ম হয় ছেলে তামিম। কিন্তু বাড়িতে থাকা মেয়েকে নিয়ে তাদের বিরোধ সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে তাসলিমাকে তাড়িয়ে দেন পুলিশ সদস্য। রাবেয়া খাতুন আরো জানান, এই ঘটনার পর তাসলিমা তাকে বলেছিল সে আর কখনও সংসার করবে না। কাজ করে বাচ্চা দুইটি মানুষ করবে। ছেলে-মেয়ে দু’টিকে তার হাতে তুলে দিয়ে আবারো চলে যায় ঢাকায়। সেখানে কাজ করতে থাকে। তিনি জানান, আনুমানিক এক বছর পূর্বে তাদের পাশ^বর্তী বাগডাঙ্গা গ্রামের মজিবর রহমানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। মজিবর রহমানও ওই কারখানায় কাজ করতো। মজিবর তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেন। এতে তাসলিমা রাজী না থাকলেও একই এলাকার মানুষ হওয়ায় মাঝে মধ্যে কথা হতো। একটি সময় তার মেয়ের মজিবরের কথায় রাজি হন। ৭ মাস হয়েছে তারা দু’জন বিয়ে করেছে।
রাবেয়া খাতুন জানান, বিয়ের পর তারা প্রায়ই গোলমাল করতো। একটি সময় তারা গ্রামে চলে আসে। স্বামী মজিবর রহমান তাকে বাড়িতে না রেখে নানা স্থানে লুকিয়ে রাখতেন। এই অবস্থায় তিনি যোগাযোগ করে মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। তাসলিমা কিছুদিন বাড়িতে থেকে আবারো ঢাকায় চলে যায়। সেখানে আশুলিয়া এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ নেন। আর মজিবর তার পিছু নিতে ওই এলাকার একটি দর্জির দোকানে কাজ নেন। দু’জন দুই জায়গায় বসবাস করতেন। তাসলিমা আক্তারের ফুফু শিউলী খাতুন জানান, মজিবর মাঝে মধ্যেই মোবাইল ফোনে তাসলিমাকে উত্যক্ত করতো। নতুন করে সংসার করার প্রস্তাব দেন। ৩০ আগষ্ট তাসলিমাকে নিয়ে নতুন বাসায় চলে যান। যাবার সময় বলে যায় তার মোবাইল বন্ধ থাকবে। বেশি যোগাযোগ করার প্রয়োজন নেই। এরপর তিনি ঈদের ছুটিতে বাড়িতে চলে আসেন। আসার সময় চেষ্টা করেও তাসলিমার সন্ধান পাননি। তারা নতুন যে বাসা নিয়েছিল সেটাও চিনতে পারেন নি। এখন তারা জানতে পারছেন তাসলিমাকে খুন করা হয়েছে। খুন করার পরিকল্পনা নিয়েই নতুন বাসায় নেওয়া হয়েছে বলে শিউলী খাতুন জানান। আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল আউয়াল প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ঘটনার পর তারা বিভিন্ন তথ্যের ভিক্তিতে ঝিনাইদহের বাগডাঙ্গা গ্রাম থেকে মুকুল নামের একজনকে আটক করেছে। তার মাধ্যমে তারা তাসলিমাকে সনাক্ত করতে পেরেছেন। তার স্বামী মজিবর রহমান পলাতক রয়েছেন। ধারণা করা যাচ্ছে, পারিবারিক কলহের কারনে তাসলিমাকে হত্যার পর টুকরো টুকরো করে ড্রামে ভরে রাখা হয়েছিল।