ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

জেঁকে বসেছে শীত : চুয়াডাঙ্গায় টানা দুদিন দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্র রেকর্ড, জনজীবনে স্থবিরতা

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১১:১৮:৩১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৮ জানুয়ারী ২০২৩
  • / ১০ বার পড়া হয়েছে

বেড়েছে শীতবাহিত রোগের প্রার্দুভাব, শৈত্যপ্রবাহ কয়েকদিন অব্যাহত থাকার পূর্বাভাস

সমীকরণ প্রতিবেদন:
উত্তরের হিমেল হাওয়া ও কনকনে শীতের ঠান্ডায় কাঁপছে চুয়াডাঙ্গা। টানা দুদিন এ জেলায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে। এছাড়া এ মৌসুমে এর আগে টানা তিনদিন দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রাও এ জেলায় রেকর্ড হয়। কুয়াশা ও হিমেল হাওয়ায় বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। শীতে কষ্টে আছেন খেটে খাওয়া ছিন্নমূল মানুষ। সময় মতো কাজে যেতে পারছেন না তারা। খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করতে দেখা গেছে এসব মানুষকে। শীতের কাপড় জড়িয়ে সাইকেলে চেপে কাজের সন্ধানে শ্রমজীবী মানুষকে বেরোতে দেখা গেছে। আর তীব্র ঠান্ডায় দেখা দিচ্ছে শীতজনিত নানা রোগ। হাসপাতালে বাড়ছে শিশু ও বয়স্ক রোগীর সংখ্যা।

চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রকিবুল হাসান জানান, গতকাল শনিবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় এ জেলায়। এছাড়া গত শুক্রবারও এ জেলায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল। তাই টানা দুদিন এ জেলায় জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হচ্ছে। আরও এক-দুদিন এ তাপমাত্রা ও তীব্র শীত অব্যাহত থাকতে পারে।’
এদিকে, পৌষের শেষদিকে কনকনে শীত আর ঠান্ডা বাতাসে নেমে এসেছে স্থবিরতা। যার কারণে এ জেলার ছিন্নমূল মানুষের রাত কাটে এখন অসহনীয় দুর্ভোগে। শীতের একেকটি রাত যেন তাদের কাছে দুঃস্বপ্ন। প্রাকৃতিক এই বৈরিতা থেকে বাঁচতে সমাজের বিত্তবানদের প্রতি সাহায্যের আবেদন অসহায় মুখগুলোর। চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার শান্তিপাড়ার বাসিন্দা শুকুর আলী বলেন, ‘ঠান্ডার কারণে দুদিন রিকশা নিয়ে বের হয়নি। জমানো তেমন টাকাও নেই, তাই আজ নিরুপায় হয়ে কাজে বের হয়েছি।’ চুয়াডাঙ্গা সদরের সরিষাডাঙ্গা গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ্ব জবেদা খাতুন কম্বল না পাওয়ার আক্ষেপ জানিয়ে বলেন, ‘এরাম শীতেও কম্বল পাইনি। জাড়ে (ঠান্ডা) মরে যাওয়ার মতো অবস্থা। কেউ যদি এ্যাকটা কম্বল দিতো, খুব ভালো হইতো।’
জেলা শহরের কোর্ট মোড় এলাকার একটি স্থানীয় পত্রিকা অফিসে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করা হাসি খাতুন বলেন, ‘সকালে এসে ঘর মুছতে যেয়ে খুব জাড় লাগচে। কিন্তু কাজ না করলি খাবো কী। তাই কাজে এসেছি।’ রমজান আলী নামের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী জানালেন, ‘কিছু তো দেখি না, তবে খুব শীত লাগছে। সোয়েটার দুটো গায়ে দিয়েছি।’ চুয়াডাঙ্গা শহরের শহীদ হাসান চত্বরের শ্রমবিক্রি করতে আসা কয়েকজনের সাথে কথা হয়। স্থানীয়ভাবে যাদের ‘জোন’ বলা হয়। তাঁদের নাম জিজ্ঞেস করতেই তাঁরা কৌতুহলবশত এগিয়ে এসে বলেন, ‘বাপজি, নাম জিজ্ঞেস কইর..লে কম্বল দিবানাকি গো।’ সাংবাদিক পরিচয় দিতেই হাতের বিড়ি ফেলে সিরাজ মিয়া নামের একজন বলেন, ‘এই শীতে সেই ভোরে কাজে আসা লাগে, প্রতিদিনই আসি। কিন্তু বেশ কয়েকদিন কাজ না পেয়ে ফিরে যাচ্ছি। আবার খুব জাড় লাগে, কেউ কম্বল দেয়নি।’

চুয়াডাঙ্গা শহরের ফল বিক্রেতা সেলিমের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, বিক্রি একেবারে নেই। এই শীতে শুধু দোকান খুলে বসে থাকা আর কি। জিনিসপত্রের যে দাম, সংসার চালাতে এই তীব্র শীতকে উপেক্ষা করতে হচ্ছে। একজন নারী ভিক্ষুক জানান, ‘স্টেশনের প্লাটফর্মে ঘুমাই। পুরনো একটি কাথায় গা মুড়িয়ে শীত নিবারণের ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতেই প্রতিদিনের রাত কাটে। কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাইনি।’ চুয়াডাঙ্গা শহরের শহীদ হাসান চত্বরে কথা হয় ভ্যানচালক লিয়াকতের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আজ খুব সকালে বাড়ি থেকে শীতের কারণে বের হতে পারিনি। একটু দেরি করে বের হলাম, কিন্তু ভাড়া নেই। রিকশা বসে বসে শীতে কাপছি।’ এদিকে, বেসরকারি চাকরিজীবী শারমিন মালিক বলেন, ‘চুয়াডাঙ্গা থেকে মেহেরপুরের উদ্দেশ্যে বের হয়েছি। কিন্ত এই শীত অফিসে টাইমের মধ্যে পৌছাতে পারব না। কারণ প্রচণ্ড শীতে আমি যে বাসে যায়, সেই ফার্স্ট টিপের বাস এখনো ছাড়েনি।’ আলমডাঙ্গার ভালাইপুর এলাকার কৃষক বাবু মিয়া বলেন, ভোরে কৃষি কাজের জন্য মাঠে এসেছি। ঠান্ডায় হাত চলছে না। রোদ হলে কাজ করতে কোনো অসুবিধা হতো না।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা এ যাবত ২৪ হাজারের বেশি কম্বল বিতরণ করেছি। আরো ৩২ হাজার কম্বল বিতরণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়া আমি জেলার বিত্তবানদের নিজে অনুরোধ করেছি শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে। ইতঃমধ্যে অনেকে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন বলে জেনেছি। তাছাড়া জেলার সব সামাজিক সংগঠনের সাথে আমি বসেছি এবং তাদেরকেও শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে অনুরোধ জানিয়েছি। তারাও ১০ হাজারের বেশি কম্বল বিতরণ করেছে। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে শীতবস্ত্র ও আর্থিক অনুদান সাধ্যমতো দিচ্ছি।’

এদিকে, তীব্র শীত আর একটানা কুয়াশার কারণে চরম দুর্ভোগে পড়েছে শিশু ও বৃদ্ধারা। প্রতিনিয়তই ঠান্ডাজনিত সর্দি, কাঁশি, নিউমোনিয়া ও হাপানিজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। এছাড়াও শৈত্যপ্রবাহ ও মৃদু বাতাসে গ্রামীণ জনপদের মানুষেরাও বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে।
শিশু ওয়ার্ডে ২২ মাস বয়সী কন্যাসন্তানকে ভর্তি করেছেন রিক্তা খাতুন। নিজেরও এই শীতে ঠান্ডা লেগেছে জানিয়ে রিক্তা জানালেন, এক সপ্তাহ ধরে তাঁর বাঁচ্চার জ্বর, সর্দি। স্থানীয়ভাবে গ্রাম্য ডাক্তার দেখিয়ে বাঁচ্চা সুস্থ না হওয়ায় হাসপাতালে গত দুদিন ভর্তি করিয়েছেন। কিন্ত তীব্র শীতে বাঁচ্চা নিয়ে হাসপাতালে এসে তিনি নিজেই ঠান্ডাজনিত রোগে পড়ছেন বলে জানান।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আসাদুর রহমান মালিক খোকন জানান, তীব্র শীতে শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়াসহ শীতজনিত বিভিন্ন রোগে হাসপাতালের আউটডোরে রোগীর চাপ বেড়েছ। প্রতিদিন তিনশ সাড়ে তিনশ শিশু শুধু আউটডোরেই চিকিৎসা নিচ্ছে। এছাড়া ভর্তি আছে হাসপাতালে বরাদ্দকৃত বেডের তিনগুণ ও শীতজনিত কারণে নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আওলিয়ার রহমান জানান, ঠান্ডায় শিশু ও বৃদ্ধদের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। এই শীতে আসলে সবাইকে একটু সতর্কভাবে চললে শীতজনিত রোগ-বালাই থেকে দূরে থাকা সম্ভব হবে। জেলা সদরের হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্সগুলোতে এই কয়দিনে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগী বেড়েছে। তবে আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে তখন রোগীর এই চাপ থাকবে না।

জীবননগর:
চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলাতে শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। তীব্র শীতে কাপছে এই উপজেলাবাসী। গত কয়েকদিনের ন্যায় গতকাল শনিবার ঘন কুয়াশায় আচ্ছাদিত না থাকলেও হাড় কাঁপানো শীত অনুভূত হয়েছে এই উপজেলায়। তীব্র শীতে অসহায় হয়ে পড়েছে ছিন্নমূল ও নিম্ন আয়ের মানুষ। গতকাল দুপুরের পরে সুর্যের দেখা মিললেও ছিল না রোদের তেজ।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, গতকাল শনিবার চুয়াডাঙ্গা জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। পুরো জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। আগামী আরও দুইদিন এই শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে। ফলে শীত আরও বারতে বলে ধারণা করছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

এদিকে, তীব্র শীতে জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বেড়েছে ডায়রিয়া, আমাশা, শ্বাসকষ্টসহ ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন রোগীর সংখ্যা। বয়স্কদের তুলনায় শিশুরা বেশি ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘শীতের সময় ঠান্ডজনিত সব বয়সী মানুষই ঠাণ্ডাজনিত রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। এসময় হাসপাতালে ঠান্ডাজনিত রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। বয়স্কদেও তুলনায় শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।’

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

জেঁকে বসেছে শীত : চুয়াডাঙ্গায় টানা দুদিন দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্র রেকর্ড, জনজীবনে স্থবিরতা

আপলোড টাইম : ১১:১৮:৩১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৮ জানুয়ারী ২০২৩

বেড়েছে শীতবাহিত রোগের প্রার্দুভাব, শৈত্যপ্রবাহ কয়েকদিন অব্যাহত থাকার পূর্বাভাস

সমীকরণ প্রতিবেদন:
উত্তরের হিমেল হাওয়া ও কনকনে শীতের ঠান্ডায় কাঁপছে চুয়াডাঙ্গা। টানা দুদিন এ জেলায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে। এছাড়া এ মৌসুমে এর আগে টানা তিনদিন দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রাও এ জেলায় রেকর্ড হয়। কুয়াশা ও হিমেল হাওয়ায় বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। শীতে কষ্টে আছেন খেটে খাওয়া ছিন্নমূল মানুষ। সময় মতো কাজে যেতে পারছেন না তারা। খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করতে দেখা গেছে এসব মানুষকে। শীতের কাপড় জড়িয়ে সাইকেলে চেপে কাজের সন্ধানে শ্রমজীবী মানুষকে বেরোতে দেখা গেছে। আর তীব্র ঠান্ডায় দেখা দিচ্ছে শীতজনিত নানা রোগ। হাসপাতালে বাড়ছে শিশু ও বয়স্ক রোগীর সংখ্যা।

চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রকিবুল হাসান জানান, গতকাল শনিবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় এ জেলায়। এছাড়া গত শুক্রবারও এ জেলায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল। তাই টানা দুদিন এ জেলায় জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হচ্ছে। আরও এক-দুদিন এ তাপমাত্রা ও তীব্র শীত অব্যাহত থাকতে পারে।’
এদিকে, পৌষের শেষদিকে কনকনে শীত আর ঠান্ডা বাতাসে নেমে এসেছে স্থবিরতা। যার কারণে এ জেলার ছিন্নমূল মানুষের রাত কাটে এখন অসহনীয় দুর্ভোগে। শীতের একেকটি রাত যেন তাদের কাছে দুঃস্বপ্ন। প্রাকৃতিক এই বৈরিতা থেকে বাঁচতে সমাজের বিত্তবানদের প্রতি সাহায্যের আবেদন অসহায় মুখগুলোর। চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার শান্তিপাড়ার বাসিন্দা শুকুর আলী বলেন, ‘ঠান্ডার কারণে দুদিন রিকশা নিয়ে বের হয়নি। জমানো তেমন টাকাও নেই, তাই আজ নিরুপায় হয়ে কাজে বের হয়েছি।’ চুয়াডাঙ্গা সদরের সরিষাডাঙ্গা গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ্ব জবেদা খাতুন কম্বল না পাওয়ার আক্ষেপ জানিয়ে বলেন, ‘এরাম শীতেও কম্বল পাইনি। জাড়ে (ঠান্ডা) মরে যাওয়ার মতো অবস্থা। কেউ যদি এ্যাকটা কম্বল দিতো, খুব ভালো হইতো।’
জেলা শহরের কোর্ট মোড় এলাকার একটি স্থানীয় পত্রিকা অফিসে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করা হাসি খাতুন বলেন, ‘সকালে এসে ঘর মুছতে যেয়ে খুব জাড় লাগচে। কিন্তু কাজ না করলি খাবো কী। তাই কাজে এসেছি।’ রমজান আলী নামের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী জানালেন, ‘কিছু তো দেখি না, তবে খুব শীত লাগছে। সোয়েটার দুটো গায়ে দিয়েছি।’ চুয়াডাঙ্গা শহরের শহীদ হাসান চত্বরের শ্রমবিক্রি করতে আসা কয়েকজনের সাথে কথা হয়। স্থানীয়ভাবে যাদের ‘জোন’ বলা হয়। তাঁদের নাম জিজ্ঞেস করতেই তাঁরা কৌতুহলবশত এগিয়ে এসে বলেন, ‘বাপজি, নাম জিজ্ঞেস কইর..লে কম্বল দিবানাকি গো।’ সাংবাদিক পরিচয় দিতেই হাতের বিড়ি ফেলে সিরাজ মিয়া নামের একজন বলেন, ‘এই শীতে সেই ভোরে কাজে আসা লাগে, প্রতিদিনই আসি। কিন্তু বেশ কয়েকদিন কাজ না পেয়ে ফিরে যাচ্ছি। আবার খুব জাড় লাগে, কেউ কম্বল দেয়নি।’

চুয়াডাঙ্গা শহরের ফল বিক্রেতা সেলিমের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, বিক্রি একেবারে নেই। এই শীতে শুধু দোকান খুলে বসে থাকা আর কি। জিনিসপত্রের যে দাম, সংসার চালাতে এই তীব্র শীতকে উপেক্ষা করতে হচ্ছে। একজন নারী ভিক্ষুক জানান, ‘স্টেশনের প্লাটফর্মে ঘুমাই। পুরনো একটি কাথায় গা মুড়িয়ে শীত নিবারণের ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতেই প্রতিদিনের রাত কাটে। কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাইনি।’ চুয়াডাঙ্গা শহরের শহীদ হাসান চত্বরে কথা হয় ভ্যানচালক লিয়াকতের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আজ খুব সকালে বাড়ি থেকে শীতের কারণে বের হতে পারিনি। একটু দেরি করে বের হলাম, কিন্তু ভাড়া নেই। রিকশা বসে বসে শীতে কাপছি।’ এদিকে, বেসরকারি চাকরিজীবী শারমিন মালিক বলেন, ‘চুয়াডাঙ্গা থেকে মেহেরপুরের উদ্দেশ্যে বের হয়েছি। কিন্ত এই শীত অফিসে টাইমের মধ্যে পৌছাতে পারব না। কারণ প্রচণ্ড শীতে আমি যে বাসে যায়, সেই ফার্স্ট টিপের বাস এখনো ছাড়েনি।’ আলমডাঙ্গার ভালাইপুর এলাকার কৃষক বাবু মিয়া বলেন, ভোরে কৃষি কাজের জন্য মাঠে এসেছি। ঠান্ডায় হাত চলছে না। রোদ হলে কাজ করতে কোনো অসুবিধা হতো না।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা এ যাবত ২৪ হাজারের বেশি কম্বল বিতরণ করেছি। আরো ৩২ হাজার কম্বল বিতরণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়া আমি জেলার বিত্তবানদের নিজে অনুরোধ করেছি শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে। ইতঃমধ্যে অনেকে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন বলে জেনেছি। তাছাড়া জেলার সব সামাজিক সংগঠনের সাথে আমি বসেছি এবং তাদেরকেও শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে অনুরোধ জানিয়েছি। তারাও ১০ হাজারের বেশি কম্বল বিতরণ করেছে। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে শীতবস্ত্র ও আর্থিক অনুদান সাধ্যমতো দিচ্ছি।’

এদিকে, তীব্র শীত আর একটানা কুয়াশার কারণে চরম দুর্ভোগে পড়েছে শিশু ও বৃদ্ধারা। প্রতিনিয়তই ঠান্ডাজনিত সর্দি, কাঁশি, নিউমোনিয়া ও হাপানিজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। এছাড়াও শৈত্যপ্রবাহ ও মৃদু বাতাসে গ্রামীণ জনপদের মানুষেরাও বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে।
শিশু ওয়ার্ডে ২২ মাস বয়সী কন্যাসন্তানকে ভর্তি করেছেন রিক্তা খাতুন। নিজেরও এই শীতে ঠান্ডা লেগেছে জানিয়ে রিক্তা জানালেন, এক সপ্তাহ ধরে তাঁর বাঁচ্চার জ্বর, সর্দি। স্থানীয়ভাবে গ্রাম্য ডাক্তার দেখিয়ে বাঁচ্চা সুস্থ না হওয়ায় হাসপাতালে গত দুদিন ভর্তি করিয়েছেন। কিন্ত তীব্র শীতে বাঁচ্চা নিয়ে হাসপাতালে এসে তিনি নিজেই ঠান্ডাজনিত রোগে পড়ছেন বলে জানান।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আসাদুর রহমান মালিক খোকন জানান, তীব্র শীতে শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়াসহ শীতজনিত বিভিন্ন রোগে হাসপাতালের আউটডোরে রোগীর চাপ বেড়েছ। প্রতিদিন তিনশ সাড়ে তিনশ শিশু শুধু আউটডোরেই চিকিৎসা নিচ্ছে। এছাড়া ভর্তি আছে হাসপাতালে বরাদ্দকৃত বেডের তিনগুণ ও শীতজনিত কারণে নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আওলিয়ার রহমান জানান, ঠান্ডায় শিশু ও বৃদ্ধদের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। এই শীতে আসলে সবাইকে একটু সতর্কভাবে চললে শীতজনিত রোগ-বালাই থেকে দূরে থাকা সম্ভব হবে। জেলা সদরের হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্সগুলোতে এই কয়দিনে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগী বেড়েছে। তবে আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে তখন রোগীর এই চাপ থাকবে না।

জীবননগর:
চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলাতে শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। তীব্র শীতে কাপছে এই উপজেলাবাসী। গত কয়েকদিনের ন্যায় গতকাল শনিবার ঘন কুয়াশায় আচ্ছাদিত না থাকলেও হাড় কাঁপানো শীত অনুভূত হয়েছে এই উপজেলায়। তীব্র শীতে অসহায় হয়ে পড়েছে ছিন্নমূল ও নিম্ন আয়ের মানুষ। গতকাল দুপুরের পরে সুর্যের দেখা মিললেও ছিল না রোদের তেজ।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, গতকাল শনিবার চুয়াডাঙ্গা জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। পুরো জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। আগামী আরও দুইদিন এই শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে। ফলে শীত আরও বারতে বলে ধারণা করছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

এদিকে, তীব্র শীতে জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বেড়েছে ডায়রিয়া, আমাশা, শ্বাসকষ্টসহ ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন রোগীর সংখ্যা। বয়স্কদের তুলনায় শিশুরা বেশি ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘শীতের সময় ঠান্ডজনিত সব বয়সী মানুষই ঠাণ্ডাজনিত রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। এসময় হাসপাতালে ঠান্ডাজনিত রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। বয়স্কদেও তুলনায় শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।’