ইপেপার । আজবৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

জরুরি অবস্থার আহ্বান জাতিসংঘের

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:২৫:৩০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২০
  • / ১০১ বার পড়া হয়েছে

জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ভাবতে হবে
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ‘জলবায়ু জরুরি অবস্থা’ জারির আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশের প্রতি। তাগিদ দিয়েছেন বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে সবুজায়ন অব্যাহত রাখার। প্যারিস জলবায়ু চুক্তির পাঁচ বছর পূর্তিতে এক ভার্চুয়াল সম্মেলনে গত শনিবার এ আহ্বান জানান তিনি।
গুতেরেস চান কার্বন নিরপেক্ষতা অর্থাৎ কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ এতটাই কমিয়ে আনা, যাতে তা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণ না হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি পথ পরিবর্তন না করি তাহলে এ শতাব্দীতে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা বৃদ্ধির ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যেতে পারি।’ পাঁচ বছর আগে প্যারিস সম্মেলনে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ২ ডিগ্রিতে সীমিত রাখার চুক্তি হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু রাষ্ট্রের অসহযোগিতার কারণে সেই চুক্তি কার্যকর করা যায়নি। গত শুক্রবার যুক্তরাজ্য বলেছে, দেশটি এখন থেকে আর দেশের বাইরের কোনো জীবাশ্ম জ্বালানি প্রকল্পে সরাসরি সরকারি সহযোগিতা দেবে না। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন রোধে এটি এক নতুন ও সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি।
জলাবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশ সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় রয়েছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণারত বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। জলবায়ু ও বন্যা বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটেছে। আর এরই প্রভাবে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, নদীভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। তা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন, দীর্ঘমেয়াদি, রেকর্ড ভঙ্গকারী আর ভয়াবহ বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস আসছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের চলমান প্রবণতার প্রেক্ষাপটে উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত সে বিষয়ে দেশের একটি বেসরকারি সংস্থার সাথে একযোগে গবেষণা করছে কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টার। তারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত উন্নয়নের ওপরও জোর দেয়। গবেষণায় বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে জলবায়ুর পরিবর্তন বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে উপকূলীয় অঞ্চলগুলো। তাই এসব অঞ্চলের সমস্যা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে।
গবেষকরা প্রথম যে সমাধানটি দিয়েছেন তা হচ্ছেÑ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের সংরক্ষণ। উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সংরক্ষণের পাশাপাশি নতুন করে বৃক্ষরোপণের কথা বলা হয়েছে, যেটি পরিবেশকে কার্বনমুক্ত করার পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবেও কাজ করবে। এ ছাড়াও ম্যানগ্রোভ ক্রমবর্ধমান জীববৈচিত্র্য, মাছের আবাসস্থল ও ইকো-ট্যুরিজমসহ কিছু অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করে।
উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য গবেষকদের দ্বিতীয় সুপারিশ হলোÑ আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা তৈরি করা এবং আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৫৩০টি এমন ধরনের আশ্রয়কেন্দ্রের প্রয়োজন, যেখানে মানুষ আশ্রয় নিতে এবং তাদের গবাদিপশু ও অন্যান্য মূল্যবান প্রাণিসম্পদ রাখার ব্যবস্থা করতে পারে। তৃতীয় সম্ভাব্য সমাধানটি হলোÑ নিচু জমির চার পাশে বাঁধ দেয়া, যা বন্যা থেকে কৃষিজমি, বাড়িঘর ও অবকাঠামো রক্ষা করবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে দেশে খুব পরিকল্পিত কোনো কর্মসূচি নেয়া হয়েছে এমন নয়। বরং এ বিষয়ে কথা উঠলে সরকারি নেতা-কর্মকর্তাদের মুখে একটি প্রসঙ্গই মুখ্য হয়ে ওঠে। সেটি হলোÑ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য উন্নত বিশ্বের দেয়া ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুত তহবিল থেকে অর্থলাভের বিষয়টি। নিঃসন্দেহে বৈশ্বিক উষ্ণায়নে উন্নত দেশগুলো দায়ী এবং তাদের উচিত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে তহবিল জোগানো। সেই প্রতিশ্রুতি তারা দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা এখনো কার্যকর হয়নি। আমাদের সেই তহবিল পেতে হবে। তবে নিজেদেরও কিছু করার আছে। সিডর, আইলা, আমফানে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় বেড়িবাঁধ পুরোপুরি মেরামত হয়নি গত এক দশকেরও বেশি সময়ে। সাগরের জোয়ার-ভাটায় অনেক এলাকা সকাল-বিকেল প্লাবিত হচ্ছে। লোনা পানিতে ভাসছে মানুষের ঘরবাড়ি, ফসলের ক্ষেত, ধানিজমি। কিন্তু সরকার ও প্রশাসনের সে দিকে মনোযোগ নেই। তারা নগরকেন্দ্রিক উন্নয়ন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। এ অবস্থা বছরের পর বছর চলতে পারে না। আমাদের সারা দেশের মানুষের কথা ভাবতে হবে। তাদের কল্যাণে কাজ করতে হবে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের আহ্বান অনুযায়ী কার্বন নিঃসরণের বিষয়ে আমাদের তেমন কিছু করার হয়তো নেই, কিন্তু ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের জন্য ক্ষতিকর প্রকল্পগুলো এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার যদি বন্ধ করতে পারি সেটিও খুব ছোট অর্জন হবে না।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

জরুরি অবস্থার আহ্বান জাতিসংঘের

আপলোড টাইম : ১০:২৫:৩০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২০

জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ভাবতে হবে
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ‘জলবায়ু জরুরি অবস্থা’ জারির আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশের প্রতি। তাগিদ দিয়েছেন বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে সবুজায়ন অব্যাহত রাখার। প্যারিস জলবায়ু চুক্তির পাঁচ বছর পূর্তিতে এক ভার্চুয়াল সম্মেলনে গত শনিবার এ আহ্বান জানান তিনি।
গুতেরেস চান কার্বন নিরপেক্ষতা অর্থাৎ কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ এতটাই কমিয়ে আনা, যাতে তা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণ না হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি পথ পরিবর্তন না করি তাহলে এ শতাব্দীতে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা বৃদ্ধির ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যেতে পারি।’ পাঁচ বছর আগে প্যারিস সম্মেলনে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ২ ডিগ্রিতে সীমিত রাখার চুক্তি হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু রাষ্ট্রের অসহযোগিতার কারণে সেই চুক্তি কার্যকর করা যায়নি। গত শুক্রবার যুক্তরাজ্য বলেছে, দেশটি এখন থেকে আর দেশের বাইরের কোনো জীবাশ্ম জ্বালানি প্রকল্পে সরাসরি সরকারি সহযোগিতা দেবে না। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন রোধে এটি এক নতুন ও সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি।
জলাবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশ সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় রয়েছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণারত বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। জলবায়ু ও বন্যা বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটেছে। আর এরই প্রভাবে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, নদীভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। তা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন, দীর্ঘমেয়াদি, রেকর্ড ভঙ্গকারী আর ভয়াবহ বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস আসছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের চলমান প্রবণতার প্রেক্ষাপটে উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত সে বিষয়ে দেশের একটি বেসরকারি সংস্থার সাথে একযোগে গবেষণা করছে কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টার। তারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত উন্নয়নের ওপরও জোর দেয়। গবেষণায় বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে জলবায়ুর পরিবর্তন বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে উপকূলীয় অঞ্চলগুলো। তাই এসব অঞ্চলের সমস্যা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে।
গবেষকরা প্রথম যে সমাধানটি দিয়েছেন তা হচ্ছেÑ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের সংরক্ষণ। উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সংরক্ষণের পাশাপাশি নতুন করে বৃক্ষরোপণের কথা বলা হয়েছে, যেটি পরিবেশকে কার্বনমুক্ত করার পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবেও কাজ করবে। এ ছাড়াও ম্যানগ্রোভ ক্রমবর্ধমান জীববৈচিত্র্য, মাছের আবাসস্থল ও ইকো-ট্যুরিজমসহ কিছু অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করে।
উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য গবেষকদের দ্বিতীয় সুপারিশ হলোÑ আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা তৈরি করা এবং আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৫৩০টি এমন ধরনের আশ্রয়কেন্দ্রের প্রয়োজন, যেখানে মানুষ আশ্রয় নিতে এবং তাদের গবাদিপশু ও অন্যান্য মূল্যবান প্রাণিসম্পদ রাখার ব্যবস্থা করতে পারে। তৃতীয় সম্ভাব্য সমাধানটি হলোÑ নিচু জমির চার পাশে বাঁধ দেয়া, যা বন্যা থেকে কৃষিজমি, বাড়িঘর ও অবকাঠামো রক্ষা করবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে দেশে খুব পরিকল্পিত কোনো কর্মসূচি নেয়া হয়েছে এমন নয়। বরং এ বিষয়ে কথা উঠলে সরকারি নেতা-কর্মকর্তাদের মুখে একটি প্রসঙ্গই মুখ্য হয়ে ওঠে। সেটি হলোÑ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য উন্নত বিশ্বের দেয়া ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুত তহবিল থেকে অর্থলাভের বিষয়টি। নিঃসন্দেহে বৈশ্বিক উষ্ণায়নে উন্নত দেশগুলো দায়ী এবং তাদের উচিত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে তহবিল জোগানো। সেই প্রতিশ্রুতি তারা দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা এখনো কার্যকর হয়নি। আমাদের সেই তহবিল পেতে হবে। তবে নিজেদেরও কিছু করার আছে। সিডর, আইলা, আমফানে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় বেড়িবাঁধ পুরোপুরি মেরামত হয়নি গত এক দশকেরও বেশি সময়ে। সাগরের জোয়ার-ভাটায় অনেক এলাকা সকাল-বিকেল প্লাবিত হচ্ছে। লোনা পানিতে ভাসছে মানুষের ঘরবাড়ি, ফসলের ক্ষেত, ধানিজমি। কিন্তু সরকার ও প্রশাসনের সে দিকে মনোযোগ নেই। তারা নগরকেন্দ্রিক উন্নয়ন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। এ অবস্থা বছরের পর বছর চলতে পারে না। আমাদের সারা দেশের মানুষের কথা ভাবতে হবে। তাদের কল্যাণে কাজ করতে হবে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের আহ্বান অনুযায়ী কার্বন নিঃসরণের বিষয়ে আমাদের তেমন কিছু করার হয়তো নেই, কিন্তু ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের জন্য ক্ষতিকর প্রকল্পগুলো এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার যদি বন্ধ করতে পারি সেটিও খুব ছোট অর্জন হবে না।