ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

চুয়াডাঙ্গায় আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে করোনা শনাক্তের হার!

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:৪০:০৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুন ২০২১
  • / ৯১ বার পড়া হয়েছে

স্বাস্থ্যবিধি অগ্রাহ্য ও সচেতনতার অভাবে কোভিডে গোষ্ঠী সংক্রমণের ঝুঁকি

সারা দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৪০ জনের মৃত্যু, ছড়িয়ে পড়ছে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট

সমীকরণ প্রতিবেদক: সারা দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা সংক্রমণ শনাক্ত রোগীর সংখ্যা, শনাক্তের হার ও মৃত্যু সবই বেড়েছে। গতকাল গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ২ হাজার ৫৭৬ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ সময় মৃত্যু হয়েছে ৪০ জনের। গতকাল বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। গত বুধবার দেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫৩৭ জন। টানা ৪১ দিন পর এদিন শনাক্ত রোগী আড়াই হাজার ছাড়ায়। ওই সময় করোনায় মৃত্যু হয় ৩৬ জনের। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন শনাক্তদের নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত করোনাভাইরাস শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মোট ৮ লাখ ২০ হাজার ৩৯৫। মোট মৃত্যু হয়েছে ১২ হাজার ৯৮৯ জনের। সুস্থ হয়েছেন ৭ লাখ ৫৯ হাজার ৬৩০ জন। শেষ ২৪ ঘণ্টায় ১৯ হাজার ৪৪৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। গত বুধবার এই হার ছিল ১২ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো দেশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে কি না, তা বোঝার একটি নির্দেশক হলো রোগী শনাক্তের হার। কোনো দেশে টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়।
গত ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে, ১২ জনের। এরপর ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগে ৮ জন করে, খুলনা বিভাগে ৬ জন, রংপুরে ৪ জন ও সিলেটে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে রাজশাহী বিভাগে ৮১৫ জন। এরপর খুলনা বিভাগে ৫৭৮, ঢাকা বিভাগে ৫১৩, চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৩৭, রংপুর বিভাগে ১৩০, ময়মনসিংহ বিভাগে ১১৯, সিলেট বিভাগে ৯২ এবং বরিশাল বিভাগে ৪৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা:
চুয়াডাঙ্গায় আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে করোনা শনাক্তের হার। নমুনা পরীক্ষার তুলনায় জেলায় প্রতিদিন এই হার ২০ শতাংশের আশে পাশে থাকলেও গত ৯ জুন জেলায় করোনা শনাক্তের হান বেড়ে দাড়ায় ৪৬ দশমিক ২৫ শতাংশে। করোনা শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন বেড়ে চললেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনীহা দেখা যাচ্ছে জেলাবাসীর মধ্যে। রাস্তা-ঘাটে, হাটে-বাজারে কোথওই সাস্থবিধি মেনে চলার প্রবণতা খুব একটা চোখে পড়ছে না।
জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, কুষ্টিয়া পিসিআর ল্যাব হতে প্রাপ্ত নমুনা পরীক্ষার ফলাপল অনুযায়ী গত ৪ জুন পর্যন্ত জেলায় করোনা শনাক্তের হার অনেকটাই সহনীয় ছিল। ওইদিন পিসিআর ল্যাব থেকে প্রাপ্ত ৫০ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৭ জনের নমুনায় করোনা শনাক্ত হয়। অর্থাৎ শনাক্তের হার ছিল ১৪ শতাংশ। অথচ এর পরদিন থেকেই পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। গত ১ জুন জেলায় ১১৫টি নমুনা পরীক্ষায় ১৫ জনের করোনা ফলাফল পজেটিভ আসে, পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ৮.৩৯ শতাংশ। ২ জুন ৭৫টি নমুনা পরীক্ষায় ১ জনের করোনা ফলাফল পজেটিভ আসে, শনাক্তের হার ১.৩৩ শতাংশ। ৩ জুন ১৮৮টি নমুনা পরীক্ষায় ৫১ জনের করোনা ফলাফল পজেটিভ আসে, শনাক্তের হার ২৭.১৩ শতাংশ। ৪ জুন ৫০টি নমুনা পরীক্ষায় ৭ জনের করোনা ফলাফল পজেটিভ আসে, শনাক্তের হার ১৪ শতাংশ। ৫ জুন ১১টি নমুনা পরীক্ষায় ৪ জনের করোনা ফলাফল পজেটিভ আসে, শনাক্তের হার৩৬.৩৬ শতাংশ। ৬ জুন জেলায় ২৪টি নমুনা পরীক্ষায় ৮ জনের করোনা ফলাফল পজেটিভ আসে, শনাক্তের হার ৩৩.৩৩ শতাংশ।
৭ জুন ৬১টি নমুনা পরীক্ষায় ২৮ জনের করোনা ফলাফল পজেটিভ আসে, শনাক্তের হার ৪৫.৯০ শতাংশ, ৮ জুন ৬২টি নমুনা পরীক্ষায় ১৯ জনের করোনা ফলাফল পজেটিভ আসে, শনাক্তের হার ৩০.৩৫ শতাংশ। ৯ জুন ৮০টি নমুনা পরীক্ষায় ৩৭ জনের করোনা ফলাফল পজেটিভ আসে, শনাক্তের হার ৪৬.২৫ শতাংশ ও গতকাল ৬২টি নমুনা পরীক্ষায় ২১ জনের করোনা ফলাফল পজেটিভ এসেছে, শনাক্তের হার ৩৭.৫০ শতাংশ।
স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, পবিত্র ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে ‘লকডাউন’ ঢিলেঢালা হয়ে পড়ে। ঈদকেন্দ্রিক কেনাকাটা ও যাতায়াতে বিপুল লোকসমাগম দেখে জনস্বাস্থ্যবিদেরা এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আশঙ্কা করেছিল, ঈদের পর সংক্রমণ আবার বেড়ে যাবে। সেই আশঙ্কায় বাস্তবে রুপ নিয়েছে। গত মে মাসে করোনা শনাক্তের গড় হার ২০ শতাংশের কাছাকাছি থাকলেও জুন মাসে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। বিশেষ করে ৫ জুনের পর থেকে করোনা শনাক্তের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ার পরও মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিয়ে অবজ্ঞা-অবহেলা ও সচেতনতার অভাবে করোনা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. এ এস এম মারুফ হাসান করোনা শনাক্তের এই হারকে স্বাভাবিক বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, মাঝে মাঝে পরীক্ষায় করোনা শনাক্তের হার কিছুটা বেশি হলেও তা এ যাবৎ গড় হিসেবে ২০ শতাংশের কাছাকাছি। জেলায় ১৯৫ শয্যার করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল শুরু থেকেই প্রস্তুত রাখা হয়েছে। করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ৩০ জন চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয়সংখ্যক নার্স এবং পর্যাপ্ত ওষুধ রয়েছে। অক্সিজেনেরও কোনো সংকট নেই। আইসিইউ চালুর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘জেলায় করোনা সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণরোধে প্রশাসন তৎপর রয়েছে। করোনা আক্রান্ত হয়ে যারা হোম আইসোলেশনে আছেন, সে সকল বাড়িতে লাল পতাকা টাঙানোসহ লকডাউন করা হচ্ছে। চারটি উপজেলার মধ্যে সম্প্রতি দামুড়হুার সীমান্ত এলাকায় করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুহার সব থেকে বেড়েছে। এজন্য উপজেলার ডুগডুগি ও নাটুদহ পশুহাটগুলো বন্ধ করা হয়েছে। একই সাথে দামুড়হুা উপজেলার সকল পর্যটনকেন্দ্রও বন্ধ রাখা হয়েছে। সংক্রমিত এলাকার চায়ের দোকান পুরোপুরিভাবে বন্ধ রাখার জন্যও নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এছাড়া সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আংশিক লকডাউনের আওতায় নেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রাম। পুলিশ, গ্রাম পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতায় ওইসব গ্রামের প্রবেশমুখে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। এছাড়া চুল কারাখানাগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। একইসাথে সীমান্ত এলাকা বিজিবি টহল জোরদার করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত ১৭ মে থেকে ভারতে আটকে পড়া বাংলাদেশীরা দর্শনা জয়নগর সীমান্ত দিয়ে দেশে আসতে শুরু করেন। তাঁদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিতে চুয়াডাঙ্গা জেলাসহ আশপাশের জেলায় তাদের ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। গত কয়েকদিন ধরে বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশিদের আগমন। নতুন করে এনওসি প্রদান না করায় আটকে পড়ারা আসতে পারছে না। তবে আজ (গতকাল ১০ জুন) থেকে আবারও নতুন করে তাদের এনওসি দেওয়া শুরু হয়েছে। সে হিসেবে আগামীকাল (আজ শুক্রবার) আবারও জয়নগর চেকপোস্ট দিয়ে দেশে আসবে বাংলাদেশিরা। এজন্য তাদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিতে জেলার সকল কোয়ারেন্টিন সেন্টার প্রস্তুত করা হয়েছে।’
গতকাল জেলায় নতুন করে আরও ২১ জনের নমুনায় করোনা শনাক্ত হয়েছে। নতুন ২১ জনসহ জেলায় মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৭৫ জনে। বর্তমানে জেলায় করোনা আক্রান্ত হয়ে আইসোলেশনে থাকা রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪৬ জনে। গতকাল বুধবার রাত ৯টায় জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ এ তথ্য নিশ্চিত করে। গতকাল জেলায় নতুন ১৬ জন সুস্থ হয়েছে। এ নিয়ে জেলায় মোট সুস্থ হয়েছে ১ হাজার ৮৫৯ জন।
জানা যায়, গত বুধবার জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ করোনা পরীক্ষার জন্য ৮১টি নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য প্রেরণ করে। গতকাল পূর্বের পেন্ডিং নমুনাসহ ৫৬টি নমুনার ফলাফল সিভিল সার্জন অফিসে এসে পৌঁছায়। এর মধ্যে ২১ জনের নমুনায় করোনা শনাক্ত হয়েছে। বাকি ৩৫টি নমুনার ফলাফল নেগেটিভ আসে। গতকাল নতুন আক্রান্ত ২১ জনের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার পোস্ট অফিসপাড়ার ১ জন, হকপাড়ার ১ জন ও দক্ষিণ হাসপাতালপাড়ার ১ জনসহ সদর উপজেলার ৫ জন করোনা আক্রান্ত হয়েছে। আলমডাঙ্গা উপজেলায় ৩ জন, দামুড়হুদায় ৯ জন ও জীবননগের ৪ জন। জেলায় মোট শনাক্তদের মধ্যে সদর উপজেলার ১ হাজার ৮৪ জন, আলমডাঙ্গায় ৩৮১ জন, দামুড়হুদায় ৪৭২ জন ও জীবননগরে ২৩৮ জন।
এদিকে, গতকাল জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ করোনা পরীক্ষার জন্য আরও ১৩৫টি নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষর জন্য প্রেরণ করেছে। এ নিয়ে জেলায় মোট নমুনা সংগ্রহের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৮৬৫ জনে। জেলায় এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছে ১ হাজার ৮৫৯ জন। এর মধ্যে সদর উপজেলার ৯৯১ জন, আলমডাঙ্গার ৩৪০ জন, দামুড়হুদায় ৩৩১ জন ও দামুড়হুদায় ১৯৭ জন সুস্থ হয়েছেন।
চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন অফিসের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী জেলা থেকে এ পর্যন্ত মোট নমুনা সংগ্রহ ১০ হাজার ৮৬৫টি, প্রাপ্ত ফলাফল ১০ হাজার ৪৩৬টি, পজিটিভ ২ হাজার ১৭৫ জন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত চুয়াডায় ২৪৬ জন করোনাক্রান্ত রোগী চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন। এর মধ্যে সদর উপজেলায় অবস্থানকালে আক্রান্ত হয়েছেন ৬৪ জন, আলমডাঙ্গায় ২১ জন, দামুড়হুদায় ১২৫ জন ও জীবননগরে ৩৬ জন। আক্রান্তদের মধ্যে বর্তমানে ২০৭ জন হোম আইসোলেশনে আছেন। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৫০ জন, আলমডাঙ্গায় ১৬ জন, দামুড়হুদায় ১০৬ জন ও জীবননগরে ৩৫ জন। প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে আছেন সদর উপজেলার ১৩ জন, আলমডাঙ্গার ৪ জন, দামুড়হুদার ১৮ জন ও জীবননগরের ১ জন জনসহ মোট ৩৬ জন। চুয়াডাঙ্গায় করোনা আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত মোট মৃত্যু হয়েছে ৭০ জনের। এরমধ্যে সদর উপজেলার ২৫ জন, আলমডাঙ্গায় ১৭ জন, দামুড়হুদায় ১৮ জন ও জীবননগরে ৪ জন। চুয়াডাঙ্গায় আক্রান্ত অন্য ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে এ জেলার বাইরে। উন্নত চিকিৎসার জন্য জেলার বাইরে চিকিৎসাধীন রয়েছে অন্য ৩ জন।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

চুয়াডাঙ্গায় আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে করোনা শনাক্তের হার!

আপলোড টাইম : ১০:৪০:০৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুন ২০২১

স্বাস্থ্যবিধি অগ্রাহ্য ও সচেতনতার অভাবে কোভিডে গোষ্ঠী সংক্রমণের ঝুঁকি

সারা দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৪০ জনের মৃত্যু, ছড়িয়ে পড়ছে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট

সমীকরণ প্রতিবেদক: সারা দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা সংক্রমণ শনাক্ত রোগীর সংখ্যা, শনাক্তের হার ও মৃত্যু সবই বেড়েছে। গতকাল গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ২ হাজার ৫৭৬ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ সময় মৃত্যু হয়েছে ৪০ জনের। গতকাল বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। গত বুধবার দেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫৩৭ জন। টানা ৪১ দিন পর এদিন শনাক্ত রোগী আড়াই হাজার ছাড়ায়। ওই সময় করোনায় মৃত্যু হয় ৩৬ জনের। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন শনাক্তদের নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত করোনাভাইরাস শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মোট ৮ লাখ ২০ হাজার ৩৯৫। মোট মৃত্যু হয়েছে ১২ হাজার ৯৮৯ জনের। সুস্থ হয়েছেন ৭ লাখ ৫৯ হাজার ৬৩০ জন। শেষ ২৪ ঘণ্টায় ১৯ হাজার ৪৪৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। গত বুধবার এই হার ছিল ১২ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো দেশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে কি না, তা বোঝার একটি নির্দেশক হলো রোগী শনাক্তের হার। কোনো দেশে টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়।
গত ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে, ১২ জনের। এরপর ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগে ৮ জন করে, খুলনা বিভাগে ৬ জন, রংপুরে ৪ জন ও সিলেটে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে রাজশাহী বিভাগে ৮১৫ জন। এরপর খুলনা বিভাগে ৫৭৮, ঢাকা বিভাগে ৫১৩, চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৩৭, রংপুর বিভাগে ১৩০, ময়মনসিংহ বিভাগে ১১৯, সিলেট বিভাগে ৯২ এবং বরিশাল বিভাগে ৪৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা:
চুয়াডাঙ্গায় আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে করোনা শনাক্তের হার। নমুনা পরীক্ষার তুলনায় জেলায় প্রতিদিন এই হার ২০ শতাংশের আশে পাশে থাকলেও গত ৯ জুন জেলায় করোনা শনাক্তের হান বেড়ে দাড়ায় ৪৬ দশমিক ২৫ শতাংশে। করোনা শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন বেড়ে চললেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনীহা দেখা যাচ্ছে জেলাবাসীর মধ্যে। রাস্তা-ঘাটে, হাটে-বাজারে কোথওই সাস্থবিধি মেনে চলার প্রবণতা খুব একটা চোখে পড়ছে না।
জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, কুষ্টিয়া পিসিআর ল্যাব হতে প্রাপ্ত নমুনা পরীক্ষার ফলাপল অনুযায়ী গত ৪ জুন পর্যন্ত জেলায় করোনা শনাক্তের হার অনেকটাই সহনীয় ছিল। ওইদিন পিসিআর ল্যাব থেকে প্রাপ্ত ৫০ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৭ জনের নমুনায় করোনা শনাক্ত হয়। অর্থাৎ শনাক্তের হার ছিল ১৪ শতাংশ। অথচ এর পরদিন থেকেই পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। গত ১ জুন জেলায় ১১৫টি নমুনা পরীক্ষায় ১৫ জনের করোনা ফলাফল পজেটিভ আসে, পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ৮.৩৯ শতাংশ। ২ জুন ৭৫টি নমুনা পরীক্ষায় ১ জনের করোনা ফলাফল পজেটিভ আসে, শনাক্তের হার ১.৩৩ শতাংশ। ৩ জুন ১৮৮টি নমুনা পরীক্ষায় ৫১ জনের করোনা ফলাফল পজেটিভ আসে, শনাক্তের হার ২৭.১৩ শতাংশ। ৪ জুন ৫০টি নমুনা পরীক্ষায় ৭ জনের করোনা ফলাফল পজেটিভ আসে, শনাক্তের হার ১৪ শতাংশ। ৫ জুন ১১টি নমুনা পরীক্ষায় ৪ জনের করোনা ফলাফল পজেটিভ আসে, শনাক্তের হার৩৬.৩৬ শতাংশ। ৬ জুন জেলায় ২৪টি নমুনা পরীক্ষায় ৮ জনের করোনা ফলাফল পজেটিভ আসে, শনাক্তের হার ৩৩.৩৩ শতাংশ।
৭ জুন ৬১টি নমুনা পরীক্ষায় ২৮ জনের করোনা ফলাফল পজেটিভ আসে, শনাক্তের হার ৪৫.৯০ শতাংশ, ৮ জুন ৬২টি নমুনা পরীক্ষায় ১৯ জনের করোনা ফলাফল পজেটিভ আসে, শনাক্তের হার ৩০.৩৫ শতাংশ। ৯ জুন ৮০টি নমুনা পরীক্ষায় ৩৭ জনের করোনা ফলাফল পজেটিভ আসে, শনাক্তের হার ৪৬.২৫ শতাংশ ও গতকাল ৬২টি নমুনা পরীক্ষায় ২১ জনের করোনা ফলাফল পজেটিভ এসেছে, শনাক্তের হার ৩৭.৫০ শতাংশ।
স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, পবিত্র ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে ‘লকডাউন’ ঢিলেঢালা হয়ে পড়ে। ঈদকেন্দ্রিক কেনাকাটা ও যাতায়াতে বিপুল লোকসমাগম দেখে জনস্বাস্থ্যবিদেরা এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আশঙ্কা করেছিল, ঈদের পর সংক্রমণ আবার বেড়ে যাবে। সেই আশঙ্কায় বাস্তবে রুপ নিয়েছে। গত মে মাসে করোনা শনাক্তের গড় হার ২০ শতাংশের কাছাকাছি থাকলেও জুন মাসে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। বিশেষ করে ৫ জুনের পর থেকে করোনা শনাক্তের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ার পরও মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিয়ে অবজ্ঞা-অবহেলা ও সচেতনতার অভাবে করোনা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. এ এস এম মারুফ হাসান করোনা শনাক্তের এই হারকে স্বাভাবিক বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, মাঝে মাঝে পরীক্ষায় করোনা শনাক্তের হার কিছুটা বেশি হলেও তা এ যাবৎ গড় হিসেবে ২০ শতাংশের কাছাকাছি। জেলায় ১৯৫ শয্যার করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল শুরু থেকেই প্রস্তুত রাখা হয়েছে। করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ৩০ জন চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয়সংখ্যক নার্স এবং পর্যাপ্ত ওষুধ রয়েছে। অক্সিজেনেরও কোনো সংকট নেই। আইসিইউ চালুর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘জেলায় করোনা সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণরোধে প্রশাসন তৎপর রয়েছে। করোনা আক্রান্ত হয়ে যারা হোম আইসোলেশনে আছেন, সে সকল বাড়িতে লাল পতাকা টাঙানোসহ লকডাউন করা হচ্ছে। চারটি উপজেলার মধ্যে সম্প্রতি দামুড়হুার সীমান্ত এলাকায় করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুহার সব থেকে বেড়েছে। এজন্য উপজেলার ডুগডুগি ও নাটুদহ পশুহাটগুলো বন্ধ করা হয়েছে। একই সাথে দামুড়হুা উপজেলার সকল পর্যটনকেন্দ্রও বন্ধ রাখা হয়েছে। সংক্রমিত এলাকার চায়ের দোকান পুরোপুরিভাবে বন্ধ রাখার জন্যও নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এছাড়া সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আংশিক লকডাউনের আওতায় নেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রাম। পুলিশ, গ্রাম পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতায় ওইসব গ্রামের প্রবেশমুখে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। এছাড়া চুল কারাখানাগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। একইসাথে সীমান্ত এলাকা বিজিবি টহল জোরদার করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত ১৭ মে থেকে ভারতে আটকে পড়া বাংলাদেশীরা দর্শনা জয়নগর সীমান্ত দিয়ে দেশে আসতে শুরু করেন। তাঁদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিতে চুয়াডাঙ্গা জেলাসহ আশপাশের জেলায় তাদের ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। গত কয়েকদিন ধরে বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশিদের আগমন। নতুন করে এনওসি প্রদান না করায় আটকে পড়ারা আসতে পারছে না। তবে আজ (গতকাল ১০ জুন) থেকে আবারও নতুন করে তাদের এনওসি দেওয়া শুরু হয়েছে। সে হিসেবে আগামীকাল (আজ শুক্রবার) আবারও জয়নগর চেকপোস্ট দিয়ে দেশে আসবে বাংলাদেশিরা। এজন্য তাদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিতে জেলার সকল কোয়ারেন্টিন সেন্টার প্রস্তুত করা হয়েছে।’
গতকাল জেলায় নতুন করে আরও ২১ জনের নমুনায় করোনা শনাক্ত হয়েছে। নতুন ২১ জনসহ জেলায় মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৭৫ জনে। বর্তমানে জেলায় করোনা আক্রান্ত হয়ে আইসোলেশনে থাকা রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪৬ জনে। গতকাল বুধবার রাত ৯টায় জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ এ তথ্য নিশ্চিত করে। গতকাল জেলায় নতুন ১৬ জন সুস্থ হয়েছে। এ নিয়ে জেলায় মোট সুস্থ হয়েছে ১ হাজার ৮৫৯ জন।
জানা যায়, গত বুধবার জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ করোনা পরীক্ষার জন্য ৮১টি নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য প্রেরণ করে। গতকাল পূর্বের পেন্ডিং নমুনাসহ ৫৬টি নমুনার ফলাফল সিভিল সার্জন অফিসে এসে পৌঁছায়। এর মধ্যে ২১ জনের নমুনায় করোনা শনাক্ত হয়েছে। বাকি ৩৫টি নমুনার ফলাফল নেগেটিভ আসে। গতকাল নতুন আক্রান্ত ২১ জনের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার পোস্ট অফিসপাড়ার ১ জন, হকপাড়ার ১ জন ও দক্ষিণ হাসপাতালপাড়ার ১ জনসহ সদর উপজেলার ৫ জন করোনা আক্রান্ত হয়েছে। আলমডাঙ্গা উপজেলায় ৩ জন, দামুড়হুদায় ৯ জন ও জীবননগের ৪ জন। জেলায় মোট শনাক্তদের মধ্যে সদর উপজেলার ১ হাজার ৮৪ জন, আলমডাঙ্গায় ৩৮১ জন, দামুড়হুদায় ৪৭২ জন ও জীবননগরে ২৩৮ জন।
এদিকে, গতকাল জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ করোনা পরীক্ষার জন্য আরও ১৩৫টি নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষর জন্য প্রেরণ করেছে। এ নিয়ে জেলায় মোট নমুনা সংগ্রহের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৮৬৫ জনে। জেলায় এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছে ১ হাজার ৮৫৯ জন। এর মধ্যে সদর উপজেলার ৯৯১ জন, আলমডাঙ্গার ৩৪০ জন, দামুড়হুদায় ৩৩১ জন ও দামুড়হুদায় ১৯৭ জন সুস্থ হয়েছেন।
চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন অফিসের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী জেলা থেকে এ পর্যন্ত মোট নমুনা সংগ্রহ ১০ হাজার ৮৬৫টি, প্রাপ্ত ফলাফল ১০ হাজার ৪৩৬টি, পজিটিভ ২ হাজার ১৭৫ জন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত চুয়াডায় ২৪৬ জন করোনাক্রান্ত রোগী চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন। এর মধ্যে সদর উপজেলায় অবস্থানকালে আক্রান্ত হয়েছেন ৬৪ জন, আলমডাঙ্গায় ২১ জন, দামুড়হুদায় ১২৫ জন ও জীবননগরে ৩৬ জন। আক্রান্তদের মধ্যে বর্তমানে ২০৭ জন হোম আইসোলেশনে আছেন। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৫০ জন, আলমডাঙ্গায় ১৬ জন, দামুড়হুদায় ১০৬ জন ও জীবননগরে ৩৫ জন। প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে আছেন সদর উপজেলার ১৩ জন, আলমডাঙ্গার ৪ জন, দামুড়হুদার ১৮ জন ও জীবননগরের ১ জন জনসহ মোট ৩৬ জন। চুয়াডাঙ্গায় করোনা আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত মোট মৃত্যু হয়েছে ৭০ জনের। এরমধ্যে সদর উপজেলার ২৫ জন, আলমডাঙ্গায় ১৭ জন, দামুড়হুদায় ১৮ জন ও জীবননগরে ৪ জন। চুয়াডাঙ্গায় আক্রান্ত অন্য ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে এ জেলার বাইরে। উন্নত চিকিৎসার জন্য জেলার বাইরে চিকিৎসাধীন রয়েছে অন্য ৩ জন।