ইপেপার । আজবৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

গুম দিবসের প্রত্যাশা

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৮:২৯:৩২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ অগাস্ট ২০২১
  • / ৩৪ বার পড়া হয়েছে

ফেরত আসবে হারিয়ে যাওয়া মানুষ
একজন মানুষ যদি বিচারের পর দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাগারে থাকেন, স্বজনরা এর বাস্তবতা বোঝেন। এর একটি যৌক্তিক হিসাব-নিকাশ তারা করতে পারেন। নির্ধারিত মেয়াদের সাজা ভোগের পর আপনজন নিজেদের মধ্যে ফিরে আসবেন সবার সেই প্রত্যাশা থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ‘অনন্তকাল’ অপেক্ষার অনিশ্চয়তা থাকে না। একজন ব্যক্তির গুম হয়ে যাওয়া মানে, একটি পরিবার ও তার স্বজনদের জন্য সীমাহীন দুঃখ ও দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে থাকা। এমন একটা ব্যাপার বাংলাদেশের বহু মানুষকে কুরে কুরে খাচ্ছে; কিন্তু কোনো ধরনের প্রতিকার মিলছে না। বাংলাদেশে বছরের পর বছর গুমের ঘটনা ঘটে চলেছে। সরকার এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীনতা দেখাচ্ছে। তাই এর সঠিক সংখ্যাও জানা যাচ্ছে না। তবে ভুক্তভোগীদের হিসাবে এর আনুমানিক সংখ্যা ছয় শতাধিক। এ ধরনের ৩৪ ব্যক্তি সম্পর্কে জাতিসঙ্ঘ বাংলাদেশ সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে।
‘মায়ের ডাক’ নামের একটি সংগঠনও গুমের শিকার ব্যক্তিদের খোঁজ জানতে চায়। এতে সাধারণত সেসব মায়েরা সংযুক্ত যারা নিজেদের সন্তান হারিয়েছেন। রয়েছেন তাদের স্বজনরাও। তারা বছরের নির্ধারিত দিনগুলোতে হারিয়ে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চোখের পানি ফেলে দুঃখ ও শোক প্রকাশ করে সান্ত্বনা নিতে চান। এর বাইরে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উচ্চহারে গুম নিয়ে কোনো পক্ষ থেকে কোনো ধরনের জোরালো আওয়াজ তোলা হয়নি। বাংলাদেশে বহু মানবাধিকার সংগঠন রয়েছে। তারাও এ নিয়ে খুব একটা সক্রিয়তা দেখায় না। এ দেশে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বেশির ভাগের কার্যক্রম মোটা দাগে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রয়েছে। এসব সংগঠনের বেশির ভাগই মানবাধিকার প্রশ্নে নিজেদের ‘নির্বাচিত প্রতিক্রিয়া’ দেখায়। কখনো তারা পান থেকে চুন খসলে শোরগোল তুলে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে। আবার কখনো সরাসরি মানুষ হত্যা করা হলেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। আমেরিকার নেতৃত্বে মানবাধিকারের পৃষ্ঠপোষকদের আচরণও পক্ষপাতিত্ব ও নানা ধরনের রহস্যে ঘেরা। পশ্চিমারা মানবাধিকার প্রসঙ্গটি দিয়ে তাদের অপছন্দের শাসকদের যতটুকু ঘায়েল করতে চায় সাধারণ মানুষের প্রকৃত মানবাধিকার রক্ষায় সেটি তারা করে না একই মাত্রায়। মানবাধিকার রক্ষার নামে তাদের কাছে থাকা অস্ত্রগুলোর প্রয়োগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ জন্য পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়ছে। তারা ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের নামে আমাদের মতো দেশগুলোতে খুব একটা প্রভাব খাটাতে যে পারবে না তার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
এ দেশে গুমের অনেক ঘটনা প্রকাশ্যে ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে নাগরিকদের। এর পর থেকে তাদের আর খবর পাওয়া যায়নি। অনেক ক্ষেত্রে মানুষের কাছে তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, সরকার এসব তথ্যপ্রমাণ গুম হওয়া ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষায় ব্যবহার করতে চায় না। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সম্প্রদায় গুমের ব্যাপারে কিছু অনুসন্ধান করতে চাইলেও সরকারের সহযোগিতার অভাবে সেটি বেশিদূর এগোতে পারেনি। ২০১৩ সাল থেকে গুমবিষয়ক জাতিসঙ্ঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশে সফরের অনুমতি চায়। এ পর্যন্ত সরকার তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে ওঠা অভিযোগ সরকার শুধু অস্বীকার করেই তার ‘দায়িত্ব পালন’ করছে। এখন মানবাধিকার গ্রুপের প্রশ্ন, এসব অভিযোগ যদি সত্য না হয় তা হলে প্রকৃত ঘটনা কী? গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের ব্যাপারে সরকারের কাছে কী তথ্য রয়েছে? তাদের ভাগ্য জানতে সরকার কী করেছে? এমনকি সরকার এসব ঘটনা তদন্তে কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কি না। এসব প্রশ্নের জবাব সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সর্বশেষ এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার পরিষদকে জবাব দেয়া হবে।’ গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও রয়েছেন। অভিযোগ একচেটিয়া অস্বীকার করে এলেও সরকার এসব ব্যাপারে কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি এ পর্যন্ত।
৩০ আগস্ট গুম দিবস উপলক্ষে কিছু কার্যক্রম আমরা দেখতে পাচ্ছি। দেখা যাবে, আবার চার দিকে নীরবতা নেমে আসবে। দুঃখজনকভাবে আমরা হয়তো দেখব, আবারো কোনো গুমের ঘটনা। আবারো কোনো বাবা-মা তার সন্তান হারাচ্ছেন কিংবা সন্তানরা হারাচ্ছেন প্রিয় বাবাকে। আমরা আশা করব, সরকার বিষয়টিকে আর উপেক্ষা করবে না। গুমের প্রতিটি ঘটনার ব্যাপারে সঠিক তদন্ত করার ব্যবস্থা করা হবে সরকারের পক্ষ থেকে। যারা বেঁচে আছে তাদের ফেরত দেয়া হবে স্বজনদের কাছে এবং এ থেকে সরকার নিজে দায়মুক্ত হবে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

গুম দিবসের প্রত্যাশা

আপলোড টাইম : ০৮:২৯:৩২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ অগাস্ট ২০২১

ফেরত আসবে হারিয়ে যাওয়া মানুষ
একজন মানুষ যদি বিচারের পর দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাগারে থাকেন, স্বজনরা এর বাস্তবতা বোঝেন। এর একটি যৌক্তিক হিসাব-নিকাশ তারা করতে পারেন। নির্ধারিত মেয়াদের সাজা ভোগের পর আপনজন নিজেদের মধ্যে ফিরে আসবেন সবার সেই প্রত্যাশা থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ‘অনন্তকাল’ অপেক্ষার অনিশ্চয়তা থাকে না। একজন ব্যক্তির গুম হয়ে যাওয়া মানে, একটি পরিবার ও তার স্বজনদের জন্য সীমাহীন দুঃখ ও দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে থাকা। এমন একটা ব্যাপার বাংলাদেশের বহু মানুষকে কুরে কুরে খাচ্ছে; কিন্তু কোনো ধরনের প্রতিকার মিলছে না। বাংলাদেশে বছরের পর বছর গুমের ঘটনা ঘটে চলেছে। সরকার এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীনতা দেখাচ্ছে। তাই এর সঠিক সংখ্যাও জানা যাচ্ছে না। তবে ভুক্তভোগীদের হিসাবে এর আনুমানিক সংখ্যা ছয় শতাধিক। এ ধরনের ৩৪ ব্যক্তি সম্পর্কে জাতিসঙ্ঘ বাংলাদেশ সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে।
‘মায়ের ডাক’ নামের একটি সংগঠনও গুমের শিকার ব্যক্তিদের খোঁজ জানতে চায়। এতে সাধারণত সেসব মায়েরা সংযুক্ত যারা নিজেদের সন্তান হারিয়েছেন। রয়েছেন তাদের স্বজনরাও। তারা বছরের নির্ধারিত দিনগুলোতে হারিয়ে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চোখের পানি ফেলে দুঃখ ও শোক প্রকাশ করে সান্ত্বনা নিতে চান। এর বাইরে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উচ্চহারে গুম নিয়ে কোনো পক্ষ থেকে কোনো ধরনের জোরালো আওয়াজ তোলা হয়নি। বাংলাদেশে বহু মানবাধিকার সংগঠন রয়েছে। তারাও এ নিয়ে খুব একটা সক্রিয়তা দেখায় না। এ দেশে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বেশির ভাগের কার্যক্রম মোটা দাগে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রয়েছে। এসব সংগঠনের বেশির ভাগই মানবাধিকার প্রশ্নে নিজেদের ‘নির্বাচিত প্রতিক্রিয়া’ দেখায়। কখনো তারা পান থেকে চুন খসলে শোরগোল তুলে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে। আবার কখনো সরাসরি মানুষ হত্যা করা হলেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। আমেরিকার নেতৃত্বে মানবাধিকারের পৃষ্ঠপোষকদের আচরণও পক্ষপাতিত্ব ও নানা ধরনের রহস্যে ঘেরা। পশ্চিমারা মানবাধিকার প্রসঙ্গটি দিয়ে তাদের অপছন্দের শাসকদের যতটুকু ঘায়েল করতে চায় সাধারণ মানুষের প্রকৃত মানবাধিকার রক্ষায় সেটি তারা করে না একই মাত্রায়। মানবাধিকার রক্ষার নামে তাদের কাছে থাকা অস্ত্রগুলোর প্রয়োগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ জন্য পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়ছে। তারা ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের নামে আমাদের মতো দেশগুলোতে খুব একটা প্রভাব খাটাতে যে পারবে না তার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
এ দেশে গুমের অনেক ঘটনা প্রকাশ্যে ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে নাগরিকদের। এর পর থেকে তাদের আর খবর পাওয়া যায়নি। অনেক ক্ষেত্রে মানুষের কাছে তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, সরকার এসব তথ্যপ্রমাণ গুম হওয়া ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষায় ব্যবহার করতে চায় না। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সম্প্রদায় গুমের ব্যাপারে কিছু অনুসন্ধান করতে চাইলেও সরকারের সহযোগিতার অভাবে সেটি বেশিদূর এগোতে পারেনি। ২০১৩ সাল থেকে গুমবিষয়ক জাতিসঙ্ঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশে সফরের অনুমতি চায়। এ পর্যন্ত সরকার তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে ওঠা অভিযোগ সরকার শুধু অস্বীকার করেই তার ‘দায়িত্ব পালন’ করছে। এখন মানবাধিকার গ্রুপের প্রশ্ন, এসব অভিযোগ যদি সত্য না হয় তা হলে প্রকৃত ঘটনা কী? গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের ব্যাপারে সরকারের কাছে কী তথ্য রয়েছে? তাদের ভাগ্য জানতে সরকার কী করেছে? এমনকি সরকার এসব ঘটনা তদন্তে কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কি না। এসব প্রশ্নের জবাব সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সর্বশেষ এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার পরিষদকে জবাব দেয়া হবে।’ গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও রয়েছেন। অভিযোগ একচেটিয়া অস্বীকার করে এলেও সরকার এসব ব্যাপারে কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি এ পর্যন্ত।
৩০ আগস্ট গুম দিবস উপলক্ষে কিছু কার্যক্রম আমরা দেখতে পাচ্ছি। দেখা যাবে, আবার চার দিকে নীরবতা নেমে আসবে। দুঃখজনকভাবে আমরা হয়তো দেখব, আবারো কোনো গুমের ঘটনা। আবারো কোনো বাবা-মা তার সন্তান হারাচ্ছেন কিংবা সন্তানরা হারাচ্ছেন প্রিয় বাবাকে। আমরা আশা করব, সরকার বিষয়টিকে আর উপেক্ষা করবে না। গুমের প্রতিটি ঘটনার ব্যাপারে সঠিক তদন্ত করার ব্যবস্থা করা হবে সরকারের পক্ষ থেকে। যারা বেঁচে আছে তাদের ফেরত দেয়া হবে স্বজনদের কাছে এবং এ থেকে সরকার নিজে দায়মুক্ত হবে।