ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

গাংনীতে ইবি ছাত্রীর মৃত্যু, মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে গড়মিলের অভিযোগ

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৭:৩৯:৪৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
  • / ১৯ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ প্রতিবেদক:
মেহেরপুরের গাংনীর ইবি ছাত্রী নিশাত তাসনিম উর্মি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ থেকে আসামিদের অব্যাহতি চেয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। প্রতিবেদনে প্রাথমিক সুরতহাল রিপোর্টের উপস্থিতি নেই। আসামি পক্ষের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন মামলার বাদী। এ ঘটনায় জনমনে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। অনুসন্ধানে, মামলার এজাহার, সুরতহাল প্রতিবেদন, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ও চূড়ান্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে নানা গড়মিল পাওয়া গেছে। এজাহারে উল্লেখিত সাক্ষীদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি। একটি সাদা কাগজে দুজন সাক্ষীর স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ইবি ছাত্রী উর্মিকে স্বামীর বাড়িতে শারীরিক নির্যাতন ও শ^াসরোধে হত্যা করে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার নাটক সাজানো হয়। উর্মির স্বামীর বসতঘরের জানালার পর্দা টাঙানো হুকের সাথে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার করা হয়েছে বলে দাবি করেছে তার স্বামী পক্ষের লোকজন। পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন মরদেহ উদ্ধারের পর সেই স্থানটি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। এমন একটি স্থানে কোনোভাবেই আত্মহত্যা করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছিলেন সকলেই। মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার সময় আত্মহত্যার দাবিকৃত স্থানটি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ কারো মতামত নেননি মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা গাংনী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহীন মিয়া।
এদিকে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘটনার সময় উর্মির স্বামী এবং হত্যা মামলার প্রধান আসামি আশফাকুজ্জামান প্রিন্স নিজ ঘরেই ঘুমিয়ে ছিলেন বলে দাবি করেছেন মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা। ঘটনার সময় উল্লেখ করা হয়েছে রাত সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে। এ সময়ে বাড়ির সব মানুষ ঘুমিয়ে থাকার বিষয়টিও সন্দেহজনক। মরদেহ উদ্ধারের পর গাংনী থানার এসআই শাহীন মিয়া সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, উর্মির গলার ডান দিকে আঙ্গুলের কালো দাগ রয়েছে। পিঠে ও কোমরে মারধর করা কালশিরা চিহ্ন বিদ্যমান। শরীরের কোথাও তরল পদার্থ নির্গত হওয়ার চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
এদিকে ময়নাতদন্তের রিপোর্টের সঙ্গে সুরতহাল রিপোর্টের কোনো মিল নেই। মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শাহীন মিয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে সুরতহাল রিপোর্টের গলার দাগের বিষয়টিও এড়িয়ে গেছেন। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন সঠিক হয়নি মর্মে আগেই অভিযোগ করেছেন মামলার বাদী। ভিসেরা রিপোর্ট তৈরির জন্য উর্মির শরীরের প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ড। দীর্ঘ ২২ দিন সেই উপকরণ হাসপাতালে ফেলে রেখেছিলেন তারা। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন মিডিয়ায় সংবাদ প্রচার ও প্রকাশ হলে টনক নড়ে মেডিকেল বোর্ডের। পরে মনগড়া একটি ময়নাতদন্ত করে আত্মহত্যা বলে প্রতিবেদন দেয় বলে অভিযোগ করেছেন মামলার বাদী গোলাম কিবরিয়া। স্থানীয়দের দাবি, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন যেহেতু বিতর্কিত হয়েছে, তাই পুলিশের তদন্তে উর্মির মৃত্যু রহস্য উন্মোচন হবে বলে আশা ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত প্রতিবেদন আরও হতাশাজনক। তাহলে কি ভুক্তভোগী কোনো মানুষ ন্যায়বিচার পাবে না? না টাকা আর ক্ষমতার কাছে ঘটনা পাল্টে গেছে?
উর্মির মরদেহ উদ্ধারের পরদিন গাংনী থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) ও এসআই শাহীন মিয়া বিভিন্ন মিডিয়ায় দেওয়া সাক্ষাতকারে হত্যাকাণ্ড বলে সন্দেহের কথা বলেছিলেন। এর সপক্ষে তারা উর্মির শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের দাগের কথা উল্লেখ করেন। বিশেষ করে গলায় আঙ্গুলের ছাপ থাকার বিষয়টি তারা গলাটিপে হত্যাকাণ্ডের দিকে ইঙ্গিত বহন করছে বলে জানান। তাছাড়া যৌতুকের কারণে যে উর্মিকে প্রায়ই নির্যাতন করা হতো তার প্রমাণ পাওয়ার কথাও বলেছিলেন তারা। অপরদিকে প্রিন্সের পরিবার আত্মহত্যা বলে দাবি করলেও আত্মহত্যার স্থানটি নিয়ে জোরালো সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন এসআই শাহীন মিয়া। অথচ চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আত্মহত্যা দাবিকৃত স্থানটি সম্পর্ক তিনি কোনো নির্দিষ্ট যুক্তি দাঁড় করাতে পারেননি। অন্যদিকে যৌতুকের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।
জানা গেছে, উর্মির পিতা গোলাম কিবরিয়া যৌতুকের নগদ টাকা দিতে না পেরে উর্মির নামে এক বিঘা জমি রেজিস্ট্রি করে দেন ২০১৯ সালে। যার দলিল প্রিন্সের কাছেই ছিল। এই জমি বিক্রি করে স্বামী প্রিন্স প্রাইভেট কার কেনার জন্য স্ত্রী উর্মির উপর নির্যাতন করত। পরে প্রিন্সের পিতা তাকে প্রাইভেটকার কিনে দেন। এ নিয়ে প্রিন্স ও তার বাবা মায়ের রোষানলে পড়ে উর্মি। এর জের ধরেই প্রায় প্রতিদিনই নির্যাতন সইতে হতো উর্মিকে। মামলার এজাহারে বাদি গোলাম কিবরিয়া দলিলটি প্রিন্সের বাড়িতে থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। অথচ তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শাহীন মিয়া দলিলের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।
এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শাহীন জানান, মামলার প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেন ও বিবাদী এবং স্বাক্ষূদের জবানবন্দী নেওয়া হয়েছে। চার্জশিটে সবকিছু উল্লেখ করা হয়েছে। ফাইনাল চার্জশিট প্রদান ও উর্মির আত্মহত্যা প্ররোচনাকারী হিসেবে তার স্বামীকে দেখিয়ে আদালতে ফাইনাল প্রতিবেদন দাখিলের অনুমতি চাওয়া হয়েছে। তদন্তে কোনো অনিয়ম করা হয়নি।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

গাংনীতে ইবি ছাত্রীর মৃত্যু, মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে গড়মিলের অভিযোগ

আপলোড টাইম : ০৭:৩৯:৪৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

সমীকরণ প্রতিবেদক:
মেহেরপুরের গাংনীর ইবি ছাত্রী নিশাত তাসনিম উর্মি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ থেকে আসামিদের অব্যাহতি চেয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। প্রতিবেদনে প্রাথমিক সুরতহাল রিপোর্টের উপস্থিতি নেই। আসামি পক্ষের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন মামলার বাদী। এ ঘটনায় জনমনে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। অনুসন্ধানে, মামলার এজাহার, সুরতহাল প্রতিবেদন, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ও চূড়ান্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে নানা গড়মিল পাওয়া গেছে। এজাহারে উল্লেখিত সাক্ষীদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি। একটি সাদা কাগজে দুজন সাক্ষীর স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ইবি ছাত্রী উর্মিকে স্বামীর বাড়িতে শারীরিক নির্যাতন ও শ^াসরোধে হত্যা করে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার নাটক সাজানো হয়। উর্মির স্বামীর বসতঘরের জানালার পর্দা টাঙানো হুকের সাথে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার করা হয়েছে বলে দাবি করেছে তার স্বামী পক্ষের লোকজন। পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন মরদেহ উদ্ধারের পর সেই স্থানটি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। এমন একটি স্থানে কোনোভাবেই আত্মহত্যা করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছিলেন সকলেই। মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার সময় আত্মহত্যার দাবিকৃত স্থানটি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ কারো মতামত নেননি মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা গাংনী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহীন মিয়া।
এদিকে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘটনার সময় উর্মির স্বামী এবং হত্যা মামলার প্রধান আসামি আশফাকুজ্জামান প্রিন্স নিজ ঘরেই ঘুমিয়ে ছিলেন বলে দাবি করেছেন মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা। ঘটনার সময় উল্লেখ করা হয়েছে রাত সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে। এ সময়ে বাড়ির সব মানুষ ঘুমিয়ে থাকার বিষয়টিও সন্দেহজনক। মরদেহ উদ্ধারের পর গাংনী থানার এসআই শাহীন মিয়া সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, উর্মির গলার ডান দিকে আঙ্গুলের কালো দাগ রয়েছে। পিঠে ও কোমরে মারধর করা কালশিরা চিহ্ন বিদ্যমান। শরীরের কোথাও তরল পদার্থ নির্গত হওয়ার চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
এদিকে ময়নাতদন্তের রিপোর্টের সঙ্গে সুরতহাল রিপোর্টের কোনো মিল নেই। মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শাহীন মিয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে সুরতহাল রিপোর্টের গলার দাগের বিষয়টিও এড়িয়ে গেছেন। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন সঠিক হয়নি মর্মে আগেই অভিযোগ করেছেন মামলার বাদী। ভিসেরা রিপোর্ট তৈরির জন্য উর্মির শরীরের প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ড। দীর্ঘ ২২ দিন সেই উপকরণ হাসপাতালে ফেলে রেখেছিলেন তারা। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন মিডিয়ায় সংবাদ প্রচার ও প্রকাশ হলে টনক নড়ে মেডিকেল বোর্ডের। পরে মনগড়া একটি ময়নাতদন্ত করে আত্মহত্যা বলে প্রতিবেদন দেয় বলে অভিযোগ করেছেন মামলার বাদী গোলাম কিবরিয়া। স্থানীয়দের দাবি, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন যেহেতু বিতর্কিত হয়েছে, তাই পুলিশের তদন্তে উর্মির মৃত্যু রহস্য উন্মোচন হবে বলে আশা ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত প্রতিবেদন আরও হতাশাজনক। তাহলে কি ভুক্তভোগী কোনো মানুষ ন্যায়বিচার পাবে না? না টাকা আর ক্ষমতার কাছে ঘটনা পাল্টে গেছে?
উর্মির মরদেহ উদ্ধারের পরদিন গাংনী থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) ও এসআই শাহীন মিয়া বিভিন্ন মিডিয়ায় দেওয়া সাক্ষাতকারে হত্যাকাণ্ড বলে সন্দেহের কথা বলেছিলেন। এর সপক্ষে তারা উর্মির শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের দাগের কথা উল্লেখ করেন। বিশেষ করে গলায় আঙ্গুলের ছাপ থাকার বিষয়টি তারা গলাটিপে হত্যাকাণ্ডের দিকে ইঙ্গিত বহন করছে বলে জানান। তাছাড়া যৌতুকের কারণে যে উর্মিকে প্রায়ই নির্যাতন করা হতো তার প্রমাণ পাওয়ার কথাও বলেছিলেন তারা। অপরদিকে প্রিন্সের পরিবার আত্মহত্যা বলে দাবি করলেও আত্মহত্যার স্থানটি নিয়ে জোরালো সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন এসআই শাহীন মিয়া। অথচ চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আত্মহত্যা দাবিকৃত স্থানটি সম্পর্ক তিনি কোনো নির্দিষ্ট যুক্তি দাঁড় করাতে পারেননি। অন্যদিকে যৌতুকের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।
জানা গেছে, উর্মির পিতা গোলাম কিবরিয়া যৌতুকের নগদ টাকা দিতে না পেরে উর্মির নামে এক বিঘা জমি রেজিস্ট্রি করে দেন ২০১৯ সালে। যার দলিল প্রিন্সের কাছেই ছিল। এই জমি বিক্রি করে স্বামী প্রিন্স প্রাইভেট কার কেনার জন্য স্ত্রী উর্মির উপর নির্যাতন করত। পরে প্রিন্সের পিতা তাকে প্রাইভেটকার কিনে দেন। এ নিয়ে প্রিন্স ও তার বাবা মায়ের রোষানলে পড়ে উর্মি। এর জের ধরেই প্রায় প্রতিদিনই নির্যাতন সইতে হতো উর্মিকে। মামলার এজাহারে বাদি গোলাম কিবরিয়া দলিলটি প্রিন্সের বাড়িতে থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। অথচ তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শাহীন মিয়া দলিলের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।
এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শাহীন জানান, মামলার প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেন ও বিবাদী এবং স্বাক্ষূদের জবানবন্দী নেওয়া হয়েছে। চার্জশিটে সবকিছু উল্লেখ করা হয়েছে। ফাইনাল চার্জশিট প্রদান ও উর্মির আত্মহত্যা প্ররোচনাকারী হিসেবে তার স্বামীকে দেখিয়ে আদালতে ফাইনাল প্রতিবেদন দাখিলের অনুমতি চাওয়া হয়েছে। তদন্তে কোনো অনিয়ম করা হয়নি।