ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

গণতন্ত্রে পরমতসহিষ্ণুতা অপরিহার্য

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:৩৩:২০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ জানুয়ারী ২০১৯
  • / ৩০৩ বার পড়া হয়েছে

ইদানীং লক্ষ করছি, কথাবার্তা ও আচার আচরণে আমরা যেন অসহিঞ্চু হয়ে পড়ছি। বাকসংযম, বিচার-বিবেচনা, পরমতসহিষ্ণুতা ও বিনয় আমাদের মাঝ থেকে ক্রমশঃ লোপ পাচ্ছে। আমরা আমাদের চারিত্রিক মাধুর্য দিন দিন হারিয়ে ফেলছি। সকলের মাঝে নিজেকে জাহির করার ও অন্যকে ঘায়েল করার একটা প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। সভা সমিতি বা বক্তৃতা বিবৃতিতেও এর ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয় না। পোস্টারের মধ্যে কার নাম যাবে, কার নাম উপরে থাকবে অথবা কে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করবেন, কে প্রধান বক্তা হবেন বা কে সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন এসব ছোট খাটো বিষয়কে কেন্দ্র করেও কম সংঘাত হয় না। যেহেতু একজন বয়সে নিজেকে বড় মনে করেন আর একজন নিজেকে ধন-সম্পদের দিক দিয়ে সকলের থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন, অন্যজন সুবক্তা হিসাবে নিজেকে ভাবেন সেহেতু তারা কেন পোস্টারে বা ডায়াসে অতিথি বা বক্তা হিসাবে প্রাধান্য পাবেন না?
এসব নিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত কম দেখা যায় না। কোনো কোনো সামাজিক সভা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মাঝে মাঝে উপস্থিত থাকতে হয়। কোথায় বসব-সামনে না পিছনে একথা ভাবতেই ছোটকালে বাবা যে কথাগুলো উপদেশ আকারে বলতেন তা মনে পড়ে যায়। বাবা বলতেন, ‘এমন জায়গায় বসবে না যে উঠে যেতে হয় আর এমন কথা বলো না যে পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়’। জান্নাতবাসী বাবার কথা চিরদিন মনে রেখে বসা ও কথা বলার ব্যাপারে সজাগ থাকতে চেষ্টা করে আসছি। কিন্তু তারপরও মাঝে মধ্যে ব্যতিক্রম হয়। দীর্ঘদিন থেকে সাংবাদিকতা, লেখালেখি ও সামাজিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত আছি তাই সবাই জানেন, চিনেন আর এ কারণে কেউ কেউ ভালবেসে বা সম্মান দেখিয়ে সামনের সিটে বা মঞ্চে বসার জন্য পীড়াপীড়ি করে থাকেন। অগত্যা তা মেনে নিতে হয় আর সুযোগ পেলে দু’একটা কথা বলতেও হয়।
সাধারণত দেখা যায় রাজনৈতিক কর্মী বা সংগঠন দ্বারা কোনো রাজনৈতিক সভার আয়োজন করা হলে তাতে কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন যার প্রচারের জন্য সভার আয়োজন বা যিনি সভার আয়োজনে অর্থ যোগান দেন তাকে প্রধান অতিথি হিসাবে সম্মান দেখানো বা তার নামে গগন বিদারী শ্লোগান যেমন ‘অমুক ভাই এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে’- এসব সাধারনত করা হয়ে থাকে। এসব আয়োজকদের সমর্থনপুষ্ট ব্যক্তিরাই সভাকক্ষে বসার ও বক্তৃতা করার সুযোগ পান। এসব অখ্যাত-অজ্ঞাতদের একঘেঁয়ে একই ভাষায় বক্তৃতা শুনতে শুনতে কান ঝালা পালা হয়ে যায়। যে বুদ্ধিজীবী বা গুণবান ব্যক্তির বক্তব্য শোনার জন্য লোকজন উদগ্রীব হয়ে বসে থাকেন তিনি আর বক্তৃতা করার সময় সুযোগ ও পরিবেশ পানই না। অবেশেষে হতাশ হয়ে লোকজনদের ফিরে যেতে দেখা যায়। অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পৃথিবীতে বড় বড় কথা, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কথা, বড় বড় রাজনীতিবিদ বা রাষ্ট্রনায়করা লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে ধীরে সুস্থেই বলেছেন। আমাদের কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতাদের দেখি কথার কোনো গুরুত্ব নেই। ভাষার নেই সৌন্দর্য্য, এক নাগাড়ে হাত মাথা নেড়ে চিৎকার করে বক্তৃতা দিয়ে থাকেন। বক্তার হাত পা ও মাথা নাড়া দেখে ও অপরপক্ষের প্রতি কটাক্ষপূর্ণ কথামালা শুনে উপস্থিত শ্রোতারা হাততালি দিয়ে থাকেন। অবশ্য এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের দেশে পান্ডিত্যপূর্ণ বা বুদ্ধিদীপ্ত ধীরলয়ের ভাষণ রাজনৈতিক সভা সমিতিতে অচল। সুন্দর করে প্রাঞ্জল ভাষায়, সাবলীল ভাষায় আস্তে আস্তে বক্তৃতা করলে কেউ শুনতে চায় না। এখন হচ্ছে প্রচার, প্রসার ও প্রভাব বিস্তারের যুগ। রাজনীতির দ্বারা মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। রাজনৈতিক ধারায় আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। রাজনীতির ধারা জনগণের কল্যাণ আসে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতির মান কি বা কত তা বলতেও লজ্জা অনুভূত হয়। হেন কথা নেই যা আমাদের এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ বলেন না, হেন কটু কথা নেই যা একে অপরের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেন না, হেন অন্যায় কাজ নেই যা করেন না। এহেন অবস্থায় দু’টো কথা আমাদের রাজনীতি ও কোনো কোনো রাজনীতিবিদের জন্য কতটুকু সত্যি হতে পারে তা বিবেচনা করা যেতে পারে। ‘রাজনীতি হচ্ছে নীতিহীনদের বিপদ কালের শেষ অবলম্বন’ বলেছেন আমেরিকার এক প্রখ্যাত দার্শনিক। ভারতের প্রাক্তন প্রধান নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশনও রাজনীতির উপর কটাক্ষ করেছেন।
গণতন্ত্রের কথা আমরা মুখে বলি অথচ নিজেরা চর্চা করি না। ধীরে ধীরে অনেক ছোট বড়
উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র আপনার প্রণালীতে জণগণের রাষ্ট্রীয় ও সমাজ চেতনাকে ক্রমশঃ স^চ্ছ করে তোলে, প্রতিটি মানুষকে আপনার মর্যাদা সম্বন্ধে সচেতন করে। আপনার দৃষ্টি শক্তিতেও মানুষকে করে তুলে আস্থাবান। জনশক্তিতে বিশ্বাস যেমন গণতন্ত্রের মূলকথা, জনচেতনার উন্নয়ন, মানবাত্মার উদ্বোধনও তেমনি গণতন্ত্রের প্রধান কর্ম। আর এভাবেই গণতান্ত্রিক রীতি মানুষের আদি ও সর্বশেষ কথা। কিন্তু সত্যি বলতে কি আমাদের রাজনীতির সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই। আমাদের অনেক নেতা অন্যায় করে সাধু সাজতে চেষ্টা করেন, দুর্নীতি করে সৎ দেখাতে চান। সুতরাং তাদের দ্বারা জনচেতনার উন্নয়ন বা মানবাত্মার উদ্বোধন আশা করা যায় না। আর এজন্যই দেশে এত সঙ্কট, এত রেষারেষি, হানাহানি ও হিংসার রাজনীতি। আসলে ঈর্ষা-বিদ্বেষ থেকে অহিংসায় উপনীত হওয়ার মধ্যেই আছে পূর্ণ মানবত্ব। সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে পূর্ণ মানবত্ব অর্জনের মাধ্যমে। সমাজকে যন্ত্রের মত ব্যবহার করে ছাচে ফেলে মানুষ তৈরি করে সে অবস্থায় উপনীত হওয়া যায় না। অন্তরের পবিত্রতা, পরিশুদ্ধতার মধ্যেই আছে পরম কাম্য, সুখ ও শান্তি। মানুষকে কাছে টানবার, মানুষকে স্বীকার করবার, মানুষকে মানুষ বলে বুকে গ্রহণ করবার এ সহজাত মাধুর্য এবং ওদার্যের তুলনা আজকাল বিরল। রাজনীতি করলে যে হিংসা থাকতে হবে, প্রতিহিংসা পরায়ন হতে হবে তার ধরা বাঁধা কোনো নিয়ম নেই। রাজনীতিতে উদার নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি শত্রুর প্রতি ক্ষমাশীল হওয়া একজনকে মহৎ করে তোলে।  কোনো একজন মনীষী বলেছেন, THE BEST THING TO GIVE YOUR ENEMY IS FORGIVENESS : TO AN OPPONENT TOLERACE: TO A FRIEND- YOUR HEART : TO YOUR CHILD, A GOOD EXAMPLE : TO A FATHER, OBEDIENCE : TO YOUR MOTHER CONDUCT THAT WILL MAKE HER PROUD OF YOU : TO YOURSELF, RESPECT : TO ALL MEN CHARITY.. শত্রুর প্রতি ক্ষমা, প্রতিপক্ষের প্রতি সহনশীলতা, বন্ধুকে নিজের অন্তর, সন্তানকে মহৎ উদাহরণ, পিতার প্রতি বাধ্যতা, মাতার প্রতি এমন আচরণ যার জন্য তিনি গর্ববোধ করেন, নিজেকে স¤মান করা ও মানুষকে দান করা। এ সবই প্রত্যেকের কাম্য হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের সমাজে যেন সবই বিপরীত। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী আমেরিকার মহান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন ছিলেন শান্ত বিনয়ী, নিরহংকার ও ক্ষমতাশীল মানুষ। লিঙ্কন কাজের চাপে এমনই খেয়ালশূন্য থাকতেন যে কখনো কখনো একপায়ে জুতা পরেই বের হয়ে যেতেন। তাঁর জামার কলার কাটা আর কখনও কোটে ধুলোর পাহাড় পড়ে থাকতো। লিঙ্কনের বিরাট দীর্ঘ চেহারা, লম্বা কান আর নাক দেখে একজন আইনবিদ মন্তব্য করেন, ‘এ রকম বেয়ারা চেহারার কুৎসিত পুরুষ আমি জীবনে কখনও দেখিনি।’ অথচ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকা কালে নিগ্রোদের সমান অধিকার প্রদানসহ তিনি যে সমস্ত মহৎ কাজ করে গেছেন বিশ্বের অন্য কোনো রাষ্ট্র নায়কদের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। শত্রু ও প্রতিপক্ষের প্রতি এ মানুষটি যে কত সহিষ্ণুতা ও হৃদয়ের উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন তারও কোনো তুলনা নেই। লিঙ্কনের ঈঅইওঘঊঞ সহযোগীদের প্রায় অধিকাংশই বিশাল আকাশের মতো। নিরহংকার সহজ সরল লিঙ্কনকে সব সময়ই তাঁরা বিদ্রুপ ও ঈর্ষা করতেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রেসিডেন্ট হতে না পারায় সিউয়ার্ড লিঙ্কনকে জনসমক্ষে হেয় করতে চাইতেন। কিন্তু এতদসত্তেও লিঙ্কন তাকে জউইছউঝঅছঢ ঘঊ জঝঅঝউ নিযুক্ত করেছিলেন।
লিঙ্কন হাসিমুখে সিউয়ার্ড এর ঔদ্ধত্য সহ্য করতেন এবং তাঁর কোনো কাজে বাধা দিতেন না। অনন্য ছিলেন ক্যাবিনেটের অর্থ অফিসের সেক্রেটারী মি. চেজ। কিন্তু সবচেয়ে বেশি শত্রুতা করতেন ও সুযোগ পেলে লিঙ্কনকে হেয় করতেন সমর বিভাগের সেক্রেটারি মি. স্ট্যানটন। তিনি ছিলেন অহংকারী, উচ্চাভিলাষী ও গোয়ার ধরনের। কিন্তু এতদসত্তে¦ও লিঙ্কন জানতেন স্ট্যানটন ছিলেন সৎ ও শৃংখলাপরায়ন কঠোর এক ব্যক্তিত্ব। আর লিঙ্কনের গুলিবিদ্ধ দেহের পাশে দাঁড়িয়ে স্ট্যানটন সেদিন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলেছিলেন ‘বিশ্বের একজন শ্রেষ্ঠ শাসনকর্তা আজ এখানে শায়িত হয়েছেন।’ অর্থ দফতরের সেক্রেটারি লিঙ্কনকে একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। কিন্তু মি. চেজের সততা, ধর্মের প্রতি আসক্তি ও বহু ভাষায় পান্ডিত্যের জন্য লিঙ্কন তাকে ভালবাসতেন। আর এজন্যই মি. চেজ ক্যাবিনেট থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে পদত্যাগ করার পরও লিঙ্কন তাকে আমেরিকার প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ করেন। সেক্রেটারি অব স্টেট মি. সিউয়ার্ড লিঙ্কনকে অকথ্য গালি দিয়ে চিঠি লিখেন ও তাঁকে একজন ‘মুদি খানার দোকানদার’ বলে ব্যঙ্গ করেন। লিঙ্কনের অন্য একজন ক্যাবিনেট সচিব ক্যাবিনেট মিটিংয়ে লিঙ্কনের সামনাসামনি শূকর, কুত্তা, জারজ সন্তান বলে গালি দিলেও লিঙ্কন নিরবে তা সহ্য করেন এবং বলেন যে তুমি এখন রাগান্বিত, যখন রাগ কমে যাবে তখন নিশ্চয় তোমার এ উদ্ধত আচরণের জন্য অনুতপ্ত হবে। অহংকারী ঈর্ষাকাতর সিউয়ার্ড চেজ, স্ট্যানটন প্রমুখকে ইতিহাস মনে রাখেনি। তারা সবাই ছিলেন মহান লিঙ্কনের পাশে ক্ষুদ্র কীটমাত্র। ইতিহাস যুগে যুগে নোংরা কীটের মতো মানুষদের আঁস্তাকুড়েই নিক্ষেপ করেছে কিন্তু যতদিন মানব সভ্যতা থাকবে, গণতন্ত্র থাকবে মহান আব্রাহাম লিঙ্কনদের নাম ততদিন ইতিহাসে স^র্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। মানুষও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে লিঙ্কনের সে বিখ্যাত উক্তি:WITH MALICE TOWARDS NONE, WITH CHARITY FOR ALL, WITH FIRMNESS IN THE RIGHT, AS GOD GIVES TO SEE THE RIGHT, LET US DRIVE ON TO FINISH THE WORK WE ARE IN এবং গণতন্ত্র সম্বন্ধে সে বহু কথিত বিখ্যাত উক্তি GOVERNMENT OF THE PEOPLE BY THE PEOPLE AND FOR THE PEOPLE.

আফতাব চৌধুরী
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

গণতন্ত্রে পরমতসহিষ্ণুতা অপরিহার্য

আপলোড টাইম : ১০:৩৩:২০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ জানুয়ারী ২০১৯

ইদানীং লক্ষ করছি, কথাবার্তা ও আচার আচরণে আমরা যেন অসহিঞ্চু হয়ে পড়ছি। বাকসংযম, বিচার-বিবেচনা, পরমতসহিষ্ণুতা ও বিনয় আমাদের মাঝ থেকে ক্রমশঃ লোপ পাচ্ছে। আমরা আমাদের চারিত্রিক মাধুর্য দিন দিন হারিয়ে ফেলছি। সকলের মাঝে নিজেকে জাহির করার ও অন্যকে ঘায়েল করার একটা প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। সভা সমিতি বা বক্তৃতা বিবৃতিতেও এর ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয় না। পোস্টারের মধ্যে কার নাম যাবে, কার নাম উপরে থাকবে অথবা কে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করবেন, কে প্রধান বক্তা হবেন বা কে সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন এসব ছোট খাটো বিষয়কে কেন্দ্র করেও কম সংঘাত হয় না। যেহেতু একজন বয়সে নিজেকে বড় মনে করেন আর একজন নিজেকে ধন-সম্পদের দিক দিয়ে সকলের থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন, অন্যজন সুবক্তা হিসাবে নিজেকে ভাবেন সেহেতু তারা কেন পোস্টারে বা ডায়াসে অতিথি বা বক্তা হিসাবে প্রাধান্য পাবেন না?
এসব নিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত কম দেখা যায় না। কোনো কোনো সামাজিক সভা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মাঝে মাঝে উপস্থিত থাকতে হয়। কোথায় বসব-সামনে না পিছনে একথা ভাবতেই ছোটকালে বাবা যে কথাগুলো উপদেশ আকারে বলতেন তা মনে পড়ে যায়। বাবা বলতেন, ‘এমন জায়গায় বসবে না যে উঠে যেতে হয় আর এমন কথা বলো না যে পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়’। জান্নাতবাসী বাবার কথা চিরদিন মনে রেখে বসা ও কথা বলার ব্যাপারে সজাগ থাকতে চেষ্টা করে আসছি। কিন্তু তারপরও মাঝে মধ্যে ব্যতিক্রম হয়। দীর্ঘদিন থেকে সাংবাদিকতা, লেখালেখি ও সামাজিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত আছি তাই সবাই জানেন, চিনেন আর এ কারণে কেউ কেউ ভালবেসে বা সম্মান দেখিয়ে সামনের সিটে বা মঞ্চে বসার জন্য পীড়াপীড়ি করে থাকেন। অগত্যা তা মেনে নিতে হয় আর সুযোগ পেলে দু’একটা কথা বলতেও হয়।
সাধারণত দেখা যায় রাজনৈতিক কর্মী বা সংগঠন দ্বারা কোনো রাজনৈতিক সভার আয়োজন করা হলে তাতে কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন যার প্রচারের জন্য সভার আয়োজন বা যিনি সভার আয়োজনে অর্থ যোগান দেন তাকে প্রধান অতিথি হিসাবে সম্মান দেখানো বা তার নামে গগন বিদারী শ্লোগান যেমন ‘অমুক ভাই এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে’- এসব সাধারনত করা হয়ে থাকে। এসব আয়োজকদের সমর্থনপুষ্ট ব্যক্তিরাই সভাকক্ষে বসার ও বক্তৃতা করার সুযোগ পান। এসব অখ্যাত-অজ্ঞাতদের একঘেঁয়ে একই ভাষায় বক্তৃতা শুনতে শুনতে কান ঝালা পালা হয়ে যায়। যে বুদ্ধিজীবী বা গুণবান ব্যক্তির বক্তব্য শোনার জন্য লোকজন উদগ্রীব হয়ে বসে থাকেন তিনি আর বক্তৃতা করার সময় সুযোগ ও পরিবেশ পানই না। অবেশেষে হতাশ হয়ে লোকজনদের ফিরে যেতে দেখা যায়। অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পৃথিবীতে বড় বড় কথা, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কথা, বড় বড় রাজনীতিবিদ বা রাষ্ট্রনায়করা লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে ধীরে সুস্থেই বলেছেন। আমাদের কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতাদের দেখি কথার কোনো গুরুত্ব নেই। ভাষার নেই সৌন্দর্য্য, এক নাগাড়ে হাত মাথা নেড়ে চিৎকার করে বক্তৃতা দিয়ে থাকেন। বক্তার হাত পা ও মাথা নাড়া দেখে ও অপরপক্ষের প্রতি কটাক্ষপূর্ণ কথামালা শুনে উপস্থিত শ্রোতারা হাততালি দিয়ে থাকেন। অবশ্য এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের দেশে পান্ডিত্যপূর্ণ বা বুদ্ধিদীপ্ত ধীরলয়ের ভাষণ রাজনৈতিক সভা সমিতিতে অচল। সুন্দর করে প্রাঞ্জল ভাষায়, সাবলীল ভাষায় আস্তে আস্তে বক্তৃতা করলে কেউ শুনতে চায় না। এখন হচ্ছে প্রচার, প্রসার ও প্রভাব বিস্তারের যুগ। রাজনীতির দ্বারা মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। রাজনৈতিক ধারায় আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। রাজনীতির ধারা জনগণের কল্যাণ আসে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতির মান কি বা কত তা বলতেও লজ্জা অনুভূত হয়। হেন কথা নেই যা আমাদের এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ বলেন না, হেন কটু কথা নেই যা একে অপরের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেন না, হেন অন্যায় কাজ নেই যা করেন না। এহেন অবস্থায় দু’টো কথা আমাদের রাজনীতি ও কোনো কোনো রাজনীতিবিদের জন্য কতটুকু সত্যি হতে পারে তা বিবেচনা করা যেতে পারে। ‘রাজনীতি হচ্ছে নীতিহীনদের বিপদ কালের শেষ অবলম্বন’ বলেছেন আমেরিকার এক প্রখ্যাত দার্শনিক। ভারতের প্রাক্তন প্রধান নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশনও রাজনীতির উপর কটাক্ষ করেছেন।
গণতন্ত্রের কথা আমরা মুখে বলি অথচ নিজেরা চর্চা করি না। ধীরে ধীরে অনেক ছোট বড়
উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র আপনার প্রণালীতে জণগণের রাষ্ট্রীয় ও সমাজ চেতনাকে ক্রমশঃ স^চ্ছ করে তোলে, প্রতিটি মানুষকে আপনার মর্যাদা সম্বন্ধে সচেতন করে। আপনার দৃষ্টি শক্তিতেও মানুষকে করে তুলে আস্থাবান। জনশক্তিতে বিশ্বাস যেমন গণতন্ত্রের মূলকথা, জনচেতনার উন্নয়ন, মানবাত্মার উদ্বোধনও তেমনি গণতন্ত্রের প্রধান কর্ম। আর এভাবেই গণতান্ত্রিক রীতি মানুষের আদি ও সর্বশেষ কথা। কিন্তু সত্যি বলতে কি আমাদের রাজনীতির সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই। আমাদের অনেক নেতা অন্যায় করে সাধু সাজতে চেষ্টা করেন, দুর্নীতি করে সৎ দেখাতে চান। সুতরাং তাদের দ্বারা জনচেতনার উন্নয়ন বা মানবাত্মার উদ্বোধন আশা করা যায় না। আর এজন্যই দেশে এত সঙ্কট, এত রেষারেষি, হানাহানি ও হিংসার রাজনীতি। আসলে ঈর্ষা-বিদ্বেষ থেকে অহিংসায় উপনীত হওয়ার মধ্যেই আছে পূর্ণ মানবত্ব। সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে পূর্ণ মানবত্ব অর্জনের মাধ্যমে। সমাজকে যন্ত্রের মত ব্যবহার করে ছাচে ফেলে মানুষ তৈরি করে সে অবস্থায় উপনীত হওয়া যায় না। অন্তরের পবিত্রতা, পরিশুদ্ধতার মধ্যেই আছে পরম কাম্য, সুখ ও শান্তি। মানুষকে কাছে টানবার, মানুষকে স্বীকার করবার, মানুষকে মানুষ বলে বুকে গ্রহণ করবার এ সহজাত মাধুর্য এবং ওদার্যের তুলনা আজকাল বিরল। রাজনীতি করলে যে হিংসা থাকতে হবে, প্রতিহিংসা পরায়ন হতে হবে তার ধরা বাঁধা কোনো নিয়ম নেই। রাজনীতিতে উদার নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি শত্রুর প্রতি ক্ষমাশীল হওয়া একজনকে মহৎ করে তোলে।  কোনো একজন মনীষী বলেছেন, THE BEST THING TO GIVE YOUR ENEMY IS FORGIVENESS : TO AN OPPONENT TOLERACE: TO A FRIEND- YOUR HEART : TO YOUR CHILD, A GOOD EXAMPLE : TO A FATHER, OBEDIENCE : TO YOUR MOTHER CONDUCT THAT WILL MAKE HER PROUD OF YOU : TO YOURSELF, RESPECT : TO ALL MEN CHARITY.. শত্রুর প্রতি ক্ষমা, প্রতিপক্ষের প্রতি সহনশীলতা, বন্ধুকে নিজের অন্তর, সন্তানকে মহৎ উদাহরণ, পিতার প্রতি বাধ্যতা, মাতার প্রতি এমন আচরণ যার জন্য তিনি গর্ববোধ করেন, নিজেকে স¤মান করা ও মানুষকে দান করা। এ সবই প্রত্যেকের কাম্য হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের সমাজে যেন সবই বিপরীত। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী আমেরিকার মহান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন ছিলেন শান্ত বিনয়ী, নিরহংকার ও ক্ষমতাশীল মানুষ। লিঙ্কন কাজের চাপে এমনই খেয়ালশূন্য থাকতেন যে কখনো কখনো একপায়ে জুতা পরেই বের হয়ে যেতেন। তাঁর জামার কলার কাটা আর কখনও কোটে ধুলোর পাহাড় পড়ে থাকতো। লিঙ্কনের বিরাট দীর্ঘ চেহারা, লম্বা কান আর নাক দেখে একজন আইনবিদ মন্তব্য করেন, ‘এ রকম বেয়ারা চেহারার কুৎসিত পুরুষ আমি জীবনে কখনও দেখিনি।’ অথচ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকা কালে নিগ্রোদের সমান অধিকার প্রদানসহ তিনি যে সমস্ত মহৎ কাজ করে গেছেন বিশ্বের অন্য কোনো রাষ্ট্র নায়কদের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। শত্রু ও প্রতিপক্ষের প্রতি এ মানুষটি যে কত সহিষ্ণুতা ও হৃদয়ের উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন তারও কোনো তুলনা নেই। লিঙ্কনের ঈঅইওঘঊঞ সহযোগীদের প্রায় অধিকাংশই বিশাল আকাশের মতো। নিরহংকার সহজ সরল লিঙ্কনকে সব সময়ই তাঁরা বিদ্রুপ ও ঈর্ষা করতেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রেসিডেন্ট হতে না পারায় সিউয়ার্ড লিঙ্কনকে জনসমক্ষে হেয় করতে চাইতেন। কিন্তু এতদসত্তেও লিঙ্কন তাকে জউইছউঝঅছঢ ঘঊ জঝঅঝউ নিযুক্ত করেছিলেন।
লিঙ্কন হাসিমুখে সিউয়ার্ড এর ঔদ্ধত্য সহ্য করতেন এবং তাঁর কোনো কাজে বাধা দিতেন না। অনন্য ছিলেন ক্যাবিনেটের অর্থ অফিসের সেক্রেটারী মি. চেজ। কিন্তু সবচেয়ে বেশি শত্রুতা করতেন ও সুযোগ পেলে লিঙ্কনকে হেয় করতেন সমর বিভাগের সেক্রেটারি মি. স্ট্যানটন। তিনি ছিলেন অহংকারী, উচ্চাভিলাষী ও গোয়ার ধরনের। কিন্তু এতদসত্তে¦ও লিঙ্কন জানতেন স্ট্যানটন ছিলেন সৎ ও শৃংখলাপরায়ন কঠোর এক ব্যক্তিত্ব। আর লিঙ্কনের গুলিবিদ্ধ দেহের পাশে দাঁড়িয়ে স্ট্যানটন সেদিন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলেছিলেন ‘বিশ্বের একজন শ্রেষ্ঠ শাসনকর্তা আজ এখানে শায়িত হয়েছেন।’ অর্থ দফতরের সেক্রেটারি লিঙ্কনকে একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। কিন্তু মি. চেজের সততা, ধর্মের প্রতি আসক্তি ও বহু ভাষায় পান্ডিত্যের জন্য লিঙ্কন তাকে ভালবাসতেন। আর এজন্যই মি. চেজ ক্যাবিনেট থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে পদত্যাগ করার পরও লিঙ্কন তাকে আমেরিকার প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ করেন। সেক্রেটারি অব স্টেট মি. সিউয়ার্ড লিঙ্কনকে অকথ্য গালি দিয়ে চিঠি লিখেন ও তাঁকে একজন ‘মুদি খানার দোকানদার’ বলে ব্যঙ্গ করেন। লিঙ্কনের অন্য একজন ক্যাবিনেট সচিব ক্যাবিনেট মিটিংয়ে লিঙ্কনের সামনাসামনি শূকর, কুত্তা, জারজ সন্তান বলে গালি দিলেও লিঙ্কন নিরবে তা সহ্য করেন এবং বলেন যে তুমি এখন রাগান্বিত, যখন রাগ কমে যাবে তখন নিশ্চয় তোমার এ উদ্ধত আচরণের জন্য অনুতপ্ত হবে। অহংকারী ঈর্ষাকাতর সিউয়ার্ড চেজ, স্ট্যানটন প্রমুখকে ইতিহাস মনে রাখেনি। তারা সবাই ছিলেন মহান লিঙ্কনের পাশে ক্ষুদ্র কীটমাত্র। ইতিহাস যুগে যুগে নোংরা কীটের মতো মানুষদের আঁস্তাকুড়েই নিক্ষেপ করেছে কিন্তু যতদিন মানব সভ্যতা থাকবে, গণতন্ত্র থাকবে মহান আব্রাহাম লিঙ্কনদের নাম ততদিন ইতিহাসে স^র্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। মানুষও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে লিঙ্কনের সে বিখ্যাত উক্তি:WITH MALICE TOWARDS NONE, WITH CHARITY FOR ALL, WITH FIRMNESS IN THE RIGHT, AS GOD GIVES TO SEE THE RIGHT, LET US DRIVE ON TO FINISH THE WORK WE ARE IN এবং গণতন্ত্র সম্বন্ধে সে বহু কথিত বিখ্যাত উক্তি GOVERNMENT OF THE PEOPLE BY THE PEOPLE AND FOR THE PEOPLE.

আফতাব চৌধুরী
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট