ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

কে হবেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী?

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:১৩:৩৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৯ নভেম্বর ২০২২
  • / ৮ বার পড়া হয়েছে

কে হবেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী?

সমীকরণ প্রতিবেদন: আর একদিন পর মালয়েশিয়ায় ১৫তম সাধারণ নির্বাচন। ফেডারেল পর্যায় ও তিনটি প্রদেশে একসাথে অনুষ্ঠেয় এই নির্বাচনে প্রায় কাছাকাছি শক্তিমত্তা নিয়ে গঠিত জোটগুলোর মধ্যে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে সর্বশেষ নির্বাচনী জরিপগুলোতে। এসব জরিপে আনোয়ার ইব্রাহিম, মহিউদ্দিন ইয়াসিন ও ইসমাইল সাবরি বা জাহিদ হামিদি- এই চারজনের যেকোনো একজন জোট সরকারে নেতৃত্ব দেবেন এমন মত ব্যক্ত করা হয়েছে। কার নেতৃত্বে পরবর্তী কোয়ালিশন সরকার গঠন হবে তা পাকাতান হারাপান, পেরিকাতান ন্যাশনাল ও বারিসান ন্যাশনাল- কোন জোট অধিক আসনে জয়ী হবে তার ওপর নির্ভর করবে। নির্বাচনের একেবারে পূর্বাহ্নে প্রকাশ হওয়া তিনটি জরিপে তিন ধরনের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সব জরিপে অভিন্ন বিষয়টি হলো তিন জোটের কোনোটিই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। নির্বাচনের দিন-তারিখ ঘোষণার আগে মনে হয়েছিল উমনোর নেতৃত্বাধীন বারিসান ন্যাশনালের পক্ষে এবার একটি জোয়ার দেখা যাবে। জহুরসহ কয়েকটি রাজ্যের উপনির্বাচনে বারিসান বেশ ভালো ফল করার পর উজ্জীবিত উমনোর নেতৃত্ব আগাম নির্বাচনের জন্য চাপ সৃষ্টি করে।
এতে অনেকটা বর্ষার মধ্যেই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। নির্বাচনী প্রচারণার শুরুর দিকে জরিপগুলোতে আভাস পাওয়া গিয়েছিল মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বাধীন পাকাতান হারাপান ও ড. জাহিদ হামিদির নেতৃত্বাধীন বারিসান ন্যাশনালের মধ্যে। এ সময় মোট ভোটের এক-চতুর্থাংশ সমর্থন পাকাতান (২৬ শতাংশ) ও বারিসনের (২৪ শতাংশ) প্রতি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। আর একই সময় পেরিকাতানের সমর্থনের অর্ধেকের (১৩ শতাংশ) কাছাকাছি বলে উল্লেখ করা হয় মারদেকা ফাউন্ডেশনের জরিপে। কিন্তু পরে জাতীয়তাবাদী মালয়দের দল বারসাতু ও ইসলামিস্ট পাসের সমন্বয়ে গঠিত পেরিকাতানের সমর্থন মালয় জোটে বাড়তে থাকে। মারদেকা সেন্টারের পরের সপ্তাহের জরিপে পাওয়া যায় নতুন ফল। এই জরিপে দেখা যায় পাকাতান (৩৬ শতাংশ) তিন জোটের মধ্যে কিছুটা এগিয়ে রয়েছে আর বারিসান (২১ শতাংশ) ও পেরিকাতান জোট (২২ শতাংশ) প্রায় কাছাকাছি জনসমর্থন নিয়ে নির্বাচনী লড়াইয়ে রয়েছে।
এমন আভাসও দেয়া হচ্ছে যে বারিসানের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত মালয় প্রধান রাজ্য পাহাংয়ে পেরিকাতান সরকার গঠনের মতো আসন পেতে পারে। সেখানে বারিসানের এক জনপ্রিয় নেতাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি যিনি এখন পেরিকাতানের হয়ে লড়াই করছেন। আর পাসের প্রভাবশালী নেতা ইব্রাহিম তুয়ান মানকে সেখানকার পেরিকাতানের সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
কেলানতান তেরাঙ্গানু ও কেদাহতে আগে থেকেই পেরিকাতানের সরকার ছিল। এই তিন রাজ্যে জোটটি এবারো ভালো করতে পারে। জহুর ও পাহাংয়ে পেরিকাতান ভালো করলে বারিসান আসন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তিন নম্বরে নেমে আসতে পারে। বারিসান বা উমনোর জনপ্রিয়তায় এই ভাটির টানের মূল কারণ হলো দলের মধ্যে একে অন্যকে সাইজ করার প্রবণতা। ইসমাইল সাবরি এক সময় নাজিব ও জাহিদকে সাইড লাইনে সরিয়ে দিতে তাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলোকে দ্রুত সচল করার ব্যাপারে মহিউদ্দিনের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন। এর প্রতিশোধ নিতে নাজিব-জাহিদ বলয় মহিউদ্দিনের প্রতি সমর্থন তুলে নিলে তার সরকারেরও পতন ঘটে। তবে পেরিকাতানের সমর্থনে ইসমাইল সাবরিই প্রধানমন্ত্রী হন।
বারিসান জিতলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন সেটি নিয়েও রয়েছে প্রতিযোগিতা। জাহিদ হামিদি, ইসমাইল সাবরি ও খাইরি জামাল- এই তিনজনই বারিসান জিতলে সরকারের নেতৃত্ব দেয়ার স্বপ্ন দেখছেন। এক দিকে দলের মধ্যে টানাপড়েন অন্য দিকে মালয় কমিউনিটির ভোট বলয়ে পাস ও বারসাতুর শক্ত অবস্থান বারিসানকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে। এই অনিশ্চয়তার পরেও অধিক আসনে জয়ী হওয়ার পর অন্য দল বা জোটের সমর্থন হয়ে দাঁড়াবে মুখ্য। তখন সেই দলের প্রধানমন্ত্রী পছন্দের বিষয়টি সামনে চলে আসতে পারে।
পাকাতান হারাপানের সামনে সে রকম কোনো জোয়ার কোনো সময় ছিল না। তবে এর অঙ্গদলগুলো বিশেষত পিকেআর ডিএপি ও আমানাহ পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনী প্রচারাভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। মালয়দের মধ্যে সুপরিচিত জনপ্রিয় নেতা হলেও আনোয়ার ইব্রাহিম একচেটিয়া মালয় সমর্থন কোনো সময় পাননি। তার জোটের প্রাপ্ত ভোটের বড় অংশই আসে সংখ্যালঘু চীনা ও ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের মধ্য থেকে। এ কারণে কুয়ালালামপুরসহ মিশ্র ভোটের আসনগুলোতে পাকাতান হারাপান ভালো করে। সেলাঙ্গর ও পেনাংয়ে দলটির সরকার রয়েছে। পেরাক বা কেদাহতেও এবার তারা সরকার গঠন করার মতো অবস্থানে চলে যেতে পারে। শেরাটন ষড়যন্ত্রের পর পাকাতান কেন্দ্রে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলে জহুর সাবাহ ও কেদাহ রাজ্যে ক্ষমতা হারায় জোটটি।
এবার আনোয়ার ইব্রাহিম মালয় ভোট তার জোটের দিকে টানার জন্য বিশেষ কৌশল নিয়েছেন। তিনি নিজে পোর্ট ডিকসনের আসন ছেড়ে দিয়ে পেরাকের একটি মালয় প্রধান রাজ্যে প্রার্থী হয়েছেন। পেরাক ও কেদাহতে জোটের সরকার গঠনে বিশেষ জোর দিচ্ছেন। পাকাতানের ব্যাপারে বিরোধিপক্ষের জোর প্রচারণা হলো এই জোট ক্ষমতায় এলে ডিএপি তথা চীনারা রাজনৈতিক ক্ষমতায় শক্তিমান হয়ে উঠবে। এই প্রচারণায় প্রভাবিতরা পাকাতানকে ভোট দিতে চান না। যদিও বারিসান জোটেও চীনা ও ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের দল এমসিএ-এমআইসি রয়েছে। বিএন প্রার্থীদের বর্তমান ১৭৮ জনের তালিকায় এমসিএ থেকে ৪৩ জন, এমআইসি থেকে ১০ জন এবং বিএন মিত্র হিসেবে বিবেচিত দলগুলোর চারজন প্রার্থী রয়েছে। অন্য দিকে পাকাতান হারাপানের ২১৩ জনের তালিকায় পিকেআর ৯৯ ডিএপি ৫৫ এবং আমানাহ ৫৪ মুদা ৬টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। পিএনের ১৭০ আসনের মধ্যে বারসাতু ৮৬ এবং পাস ৬২ চীনাদের দল জেরাকন ২০ আসনে লড়াই করছে। তিন জোটেই চীনা ও ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের দল রয়েছে কিন্তু চীনা আধিপত্যের প্রচারণাটি পাকাতানের ব্যাপারে বেশি।
পাকাতানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি উগ্র প্রচারণা আসছে ইসলামিস্ট দল পাস থেকে। পাস প্রধান আবদুল হাদি আওয়াংয়ের ঘোষিত এজেন্ডাই হলো আনোয়ার ইব্রাহিমকে ক্ষমতায় আসতে না দেয়া। এ জন্য শেরাটন ষড়যন্ত্রের মূল পরিকল্পনা তিনিই করেছিলেন বলে দাবি করা হয়। পাকাতান সরকারের পতনের পর পাসকে সবচেয়ে বড় সুবিধাপ্রাপ্ত দল হিসেবে মনে করা হয়। দলটি গত পার্লামেন্টে ১৮টি আসন পেয়েছিল। এবার তাদের আসন বাড়বে বলে হাদি আওয়াং আশা প্রকাশ করেছেন, যদিও দলের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ নেতা হাদির সাথে বিরোধের কারণে বারিসানের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। দলের সাবেক আধ্যাত্মিক প্রধান কেলানতানের দীর্ঘ সময়ের মুখ্যমন্ত্রী নিক আবদুল আজিজের পরিবারের কেউই এবার মনোনয়ন পাননি পাসের। বলা হচ্ছে তাদের কেউ পাসের মনোনয়ন চাননি।
অর্থনৈতিক ইস্যুগুলো এবারের নির্বাচনে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। বেকারত্ব ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে তরুণ মালয়দের মধ্যে ভীষণ ক্ষোভ রয়েছে। এবারের নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক তরুণ ভোট রয়েছে। তাদের কাছে কর্মসংস্থান একটি বড় ইস্যু। জাতিবাদিতা থেকে তারা মুক্ত না হলেও বৈশ্বিক বাস্তবতা বোঝার বিষয়ে তাদের আগ্রহ কিছুটা বেশি। এটি পাকাতানের জন্য ইতিবাচক হতে পারে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সর্বসম্মত অভিমত হলো দেশের শীর্ষ পদের জন্য লড়াইরত বিশিষ্ট মালয় নেতাদের মধ্যে মাহাথির এখন একজন অতীত ব্যক্তি। ২০১৮ সালের নির্বাচনী সুনামিতে পাকাতান হারাপানকে ক্ষমতায় আনার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন বলে কিছু বিশ্লেষক উল্লেখ করেছিলেন।
তাদের অনেকে এখন তাকে অবিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে মূল্যায়ন করেন। তাদের মতে, শেরাটন মুভে তার ভূমিকায় ‘নায়ক থেকে শূন্যে’ নেমেছেন তিনি, যার মাধ্যমে পিএইচ সরকারের পতন ঘটানো হয়েছিল। মাহাথির এখন জিটিএ নামে একটি ক্ষুদ্র জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সেই শেরাটনের ঘটনার অন্যতম নায়ক পিকেআরের সাবেক উপপ্রধান আজমিন আলিও এখন মাহাথিরের মতোই নির্বাচন নিয়ে চাপে রয়েছেন। আরেক নায়িকা জোরায়দা মূল ধারার সব দল থেকে ছিটকে পড়েছেন
আনোয়ারের অপেক্ষা কি শিগগির শেষ?

আনোয়ারকে এবারের নির্বাচনে প্রতিযোগী মালয় নেতাদের মধ্যে বড় তারকা বলে মনে হচ্ছে। পিকেআর এবং বৃহত্তর পিএইচ জোটকে প্রভাবিত করেছে এমন বিতর্ক সত্ত্বেও, শহুরে এবং অ-মালয় ভোটাররা তাকে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য মালয় নেতা হিসেবে দেখেন, যিনি দেশকে নেতৃত্ব দিতে সবচেয়ে সক্ষম ব্যক্তি।
আপাতত, আনোয়ার এবং তার ডেপুটি রাফিজির উদ্বেগ হবে দুই নেতার প্রতি মালয় ভোটারদের আস্থা ও বিশ্বাস ফেরানো। যদি দু’জন নির্বাচনের দিনে পিকেআরের জন্য মালয় সমর্থনও তৈরি করতে সক্ষম হন, তাহলে পাকাতান হতে পারে এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় বিজয়ী। তবে পাকাতান জোট ১১২ আসনে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশ কম। এ কারণে জোটটিকে অন্য দল বা জোটের সমর্থন পেতে হবে।
বারিসান বা পেরিকাতান থেকে এই সমর্থন পাওয়া সহজ নয়। এমনকি আনোয়ার সাবাহ রাজ্যে বিজয়ীদের সমর্থন পেলেও সারওয়াকের জিপিএস থেকে সমর্থন পাবে বলে মনে হয় না। এই কারণে মালয়েশিয়ার ডিপ স্টেট হিসেবে পরিচিত রাজা ও সুলতানদের সমর্থন নির্বাচনের পর মুখ্য হয়ে উঠতে পারে। আনোয়ার ইব্রাহিম এর আগে এই সমর্থন না পেলেও তার ঘনিষ্ঠরা এবার কিছুটা আশাবাদী। এসব অবশ্য নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত কতটা ভালো ফল পাকাতান করতে পারে তার ওপরই নির্ভর করবে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

কে হবেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী?

আপলোড টাইম : ১০:১৩:৩৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৯ নভেম্বর ২০২২

সমীকরণ প্রতিবেদন: আর একদিন পর মালয়েশিয়ায় ১৫তম সাধারণ নির্বাচন। ফেডারেল পর্যায় ও তিনটি প্রদেশে একসাথে অনুষ্ঠেয় এই নির্বাচনে প্রায় কাছাকাছি শক্তিমত্তা নিয়ে গঠিত জোটগুলোর মধ্যে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে সর্বশেষ নির্বাচনী জরিপগুলোতে। এসব জরিপে আনোয়ার ইব্রাহিম, মহিউদ্দিন ইয়াসিন ও ইসমাইল সাবরি বা জাহিদ হামিদি- এই চারজনের যেকোনো একজন জোট সরকারে নেতৃত্ব দেবেন এমন মত ব্যক্ত করা হয়েছে। কার নেতৃত্বে পরবর্তী কোয়ালিশন সরকার গঠন হবে তা পাকাতান হারাপান, পেরিকাতান ন্যাশনাল ও বারিসান ন্যাশনাল- কোন জোট অধিক আসনে জয়ী হবে তার ওপর নির্ভর করবে। নির্বাচনের একেবারে পূর্বাহ্নে প্রকাশ হওয়া তিনটি জরিপে তিন ধরনের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সব জরিপে অভিন্ন বিষয়টি হলো তিন জোটের কোনোটিই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। নির্বাচনের দিন-তারিখ ঘোষণার আগে মনে হয়েছিল উমনোর নেতৃত্বাধীন বারিসান ন্যাশনালের পক্ষে এবার একটি জোয়ার দেখা যাবে। জহুরসহ কয়েকটি রাজ্যের উপনির্বাচনে বারিসান বেশ ভালো ফল করার পর উজ্জীবিত উমনোর নেতৃত্ব আগাম নির্বাচনের জন্য চাপ সৃষ্টি করে।
এতে অনেকটা বর্ষার মধ্যেই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। নির্বাচনী প্রচারণার শুরুর দিকে জরিপগুলোতে আভাস পাওয়া গিয়েছিল মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বাধীন পাকাতান হারাপান ও ড. জাহিদ হামিদির নেতৃত্বাধীন বারিসান ন্যাশনালের মধ্যে। এ সময় মোট ভোটের এক-চতুর্থাংশ সমর্থন পাকাতান (২৬ শতাংশ) ও বারিসনের (২৪ শতাংশ) প্রতি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। আর একই সময় পেরিকাতানের সমর্থনের অর্ধেকের (১৩ শতাংশ) কাছাকাছি বলে উল্লেখ করা হয় মারদেকা ফাউন্ডেশনের জরিপে। কিন্তু পরে জাতীয়তাবাদী মালয়দের দল বারসাতু ও ইসলামিস্ট পাসের সমন্বয়ে গঠিত পেরিকাতানের সমর্থন মালয় জোটে বাড়তে থাকে। মারদেকা সেন্টারের পরের সপ্তাহের জরিপে পাওয়া যায় নতুন ফল। এই জরিপে দেখা যায় পাকাতান (৩৬ শতাংশ) তিন জোটের মধ্যে কিছুটা এগিয়ে রয়েছে আর বারিসান (২১ শতাংশ) ও পেরিকাতান জোট (২২ শতাংশ) প্রায় কাছাকাছি জনসমর্থন নিয়ে নির্বাচনী লড়াইয়ে রয়েছে।
এমন আভাসও দেয়া হচ্ছে যে বারিসানের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত মালয় প্রধান রাজ্য পাহাংয়ে পেরিকাতান সরকার গঠনের মতো আসন পেতে পারে। সেখানে বারিসানের এক জনপ্রিয় নেতাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি যিনি এখন পেরিকাতানের হয়ে লড়াই করছেন। আর পাসের প্রভাবশালী নেতা ইব্রাহিম তুয়ান মানকে সেখানকার পেরিকাতানের সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
কেলানতান তেরাঙ্গানু ও কেদাহতে আগে থেকেই পেরিকাতানের সরকার ছিল। এই তিন রাজ্যে জোটটি এবারো ভালো করতে পারে। জহুর ও পাহাংয়ে পেরিকাতান ভালো করলে বারিসান আসন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তিন নম্বরে নেমে আসতে পারে। বারিসান বা উমনোর জনপ্রিয়তায় এই ভাটির টানের মূল কারণ হলো দলের মধ্যে একে অন্যকে সাইজ করার প্রবণতা। ইসমাইল সাবরি এক সময় নাজিব ও জাহিদকে সাইড লাইনে সরিয়ে দিতে তাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলোকে দ্রুত সচল করার ব্যাপারে মহিউদ্দিনের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন। এর প্রতিশোধ নিতে নাজিব-জাহিদ বলয় মহিউদ্দিনের প্রতি সমর্থন তুলে নিলে তার সরকারেরও পতন ঘটে। তবে পেরিকাতানের সমর্থনে ইসমাইল সাবরিই প্রধানমন্ত্রী হন।
বারিসান জিতলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন সেটি নিয়েও রয়েছে প্রতিযোগিতা। জাহিদ হামিদি, ইসমাইল সাবরি ও খাইরি জামাল- এই তিনজনই বারিসান জিতলে সরকারের নেতৃত্ব দেয়ার স্বপ্ন দেখছেন। এক দিকে দলের মধ্যে টানাপড়েন অন্য দিকে মালয় কমিউনিটির ভোট বলয়ে পাস ও বারসাতুর শক্ত অবস্থান বারিসানকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে। এই অনিশ্চয়তার পরেও অধিক আসনে জয়ী হওয়ার পর অন্য দল বা জোটের সমর্থন হয়ে দাঁড়াবে মুখ্য। তখন সেই দলের প্রধানমন্ত্রী পছন্দের বিষয়টি সামনে চলে আসতে পারে।
পাকাতান হারাপানের সামনে সে রকম কোনো জোয়ার কোনো সময় ছিল না। তবে এর অঙ্গদলগুলো বিশেষত পিকেআর ডিএপি ও আমানাহ পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনী প্রচারাভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। মালয়দের মধ্যে সুপরিচিত জনপ্রিয় নেতা হলেও আনোয়ার ইব্রাহিম একচেটিয়া মালয় সমর্থন কোনো সময় পাননি। তার জোটের প্রাপ্ত ভোটের বড় অংশই আসে সংখ্যালঘু চীনা ও ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের মধ্য থেকে। এ কারণে কুয়ালালামপুরসহ মিশ্র ভোটের আসনগুলোতে পাকাতান হারাপান ভালো করে। সেলাঙ্গর ও পেনাংয়ে দলটির সরকার রয়েছে। পেরাক বা কেদাহতেও এবার তারা সরকার গঠন করার মতো অবস্থানে চলে যেতে পারে। শেরাটন ষড়যন্ত্রের পর পাকাতান কেন্দ্রে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলে জহুর সাবাহ ও কেদাহ রাজ্যে ক্ষমতা হারায় জোটটি।
এবার আনোয়ার ইব্রাহিম মালয় ভোট তার জোটের দিকে টানার জন্য বিশেষ কৌশল নিয়েছেন। তিনি নিজে পোর্ট ডিকসনের আসন ছেড়ে দিয়ে পেরাকের একটি মালয় প্রধান রাজ্যে প্রার্থী হয়েছেন। পেরাক ও কেদাহতে জোটের সরকার গঠনে বিশেষ জোর দিচ্ছেন। পাকাতানের ব্যাপারে বিরোধিপক্ষের জোর প্রচারণা হলো এই জোট ক্ষমতায় এলে ডিএপি তথা চীনারা রাজনৈতিক ক্ষমতায় শক্তিমান হয়ে উঠবে। এই প্রচারণায় প্রভাবিতরা পাকাতানকে ভোট দিতে চান না। যদিও বারিসান জোটেও চীনা ও ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের দল এমসিএ-এমআইসি রয়েছে। বিএন প্রার্থীদের বর্তমান ১৭৮ জনের তালিকায় এমসিএ থেকে ৪৩ জন, এমআইসি থেকে ১০ জন এবং বিএন মিত্র হিসেবে বিবেচিত দলগুলোর চারজন প্রার্থী রয়েছে। অন্য দিকে পাকাতান হারাপানের ২১৩ জনের তালিকায় পিকেআর ৯৯ ডিএপি ৫৫ এবং আমানাহ ৫৪ মুদা ৬টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। পিএনের ১৭০ আসনের মধ্যে বারসাতু ৮৬ এবং পাস ৬২ চীনাদের দল জেরাকন ২০ আসনে লড়াই করছে। তিন জোটেই চীনা ও ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের দল রয়েছে কিন্তু চীনা আধিপত্যের প্রচারণাটি পাকাতানের ব্যাপারে বেশি।
পাকাতানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি উগ্র প্রচারণা আসছে ইসলামিস্ট দল পাস থেকে। পাস প্রধান আবদুল হাদি আওয়াংয়ের ঘোষিত এজেন্ডাই হলো আনোয়ার ইব্রাহিমকে ক্ষমতায় আসতে না দেয়া। এ জন্য শেরাটন ষড়যন্ত্রের মূল পরিকল্পনা তিনিই করেছিলেন বলে দাবি করা হয়। পাকাতান সরকারের পতনের পর পাসকে সবচেয়ে বড় সুবিধাপ্রাপ্ত দল হিসেবে মনে করা হয়। দলটি গত পার্লামেন্টে ১৮টি আসন পেয়েছিল। এবার তাদের আসন বাড়বে বলে হাদি আওয়াং আশা প্রকাশ করেছেন, যদিও দলের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ নেতা হাদির সাথে বিরোধের কারণে বারিসানের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। দলের সাবেক আধ্যাত্মিক প্রধান কেলানতানের দীর্ঘ সময়ের মুখ্যমন্ত্রী নিক আবদুল আজিজের পরিবারের কেউই এবার মনোনয়ন পাননি পাসের। বলা হচ্ছে তাদের কেউ পাসের মনোনয়ন চাননি।
অর্থনৈতিক ইস্যুগুলো এবারের নির্বাচনে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। বেকারত্ব ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে তরুণ মালয়দের মধ্যে ভীষণ ক্ষোভ রয়েছে। এবারের নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক তরুণ ভোট রয়েছে। তাদের কাছে কর্মসংস্থান একটি বড় ইস্যু। জাতিবাদিতা থেকে তারা মুক্ত না হলেও বৈশ্বিক বাস্তবতা বোঝার বিষয়ে তাদের আগ্রহ কিছুটা বেশি। এটি পাকাতানের জন্য ইতিবাচক হতে পারে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সর্বসম্মত অভিমত হলো দেশের শীর্ষ পদের জন্য লড়াইরত বিশিষ্ট মালয় নেতাদের মধ্যে মাহাথির এখন একজন অতীত ব্যক্তি। ২০১৮ সালের নির্বাচনী সুনামিতে পাকাতান হারাপানকে ক্ষমতায় আনার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন বলে কিছু বিশ্লেষক উল্লেখ করেছিলেন।
তাদের অনেকে এখন তাকে অবিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে মূল্যায়ন করেন। তাদের মতে, শেরাটন মুভে তার ভূমিকায় ‘নায়ক থেকে শূন্যে’ নেমেছেন তিনি, যার মাধ্যমে পিএইচ সরকারের পতন ঘটানো হয়েছিল। মাহাথির এখন জিটিএ নামে একটি ক্ষুদ্র জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সেই শেরাটনের ঘটনার অন্যতম নায়ক পিকেআরের সাবেক উপপ্রধান আজমিন আলিও এখন মাহাথিরের মতোই নির্বাচন নিয়ে চাপে রয়েছেন। আরেক নায়িকা জোরায়দা মূল ধারার সব দল থেকে ছিটকে পড়েছেন
আনোয়ারের অপেক্ষা কি শিগগির শেষ?

আনোয়ারকে এবারের নির্বাচনে প্রতিযোগী মালয় নেতাদের মধ্যে বড় তারকা বলে মনে হচ্ছে। পিকেআর এবং বৃহত্তর পিএইচ জোটকে প্রভাবিত করেছে এমন বিতর্ক সত্ত্বেও, শহুরে এবং অ-মালয় ভোটাররা তাকে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য মালয় নেতা হিসেবে দেখেন, যিনি দেশকে নেতৃত্ব দিতে সবচেয়ে সক্ষম ব্যক্তি।
আপাতত, আনোয়ার এবং তার ডেপুটি রাফিজির উদ্বেগ হবে দুই নেতার প্রতি মালয় ভোটারদের আস্থা ও বিশ্বাস ফেরানো। যদি দু’জন নির্বাচনের দিনে পিকেআরের জন্য মালয় সমর্থনও তৈরি করতে সক্ষম হন, তাহলে পাকাতান হতে পারে এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় বিজয়ী। তবে পাকাতান জোট ১১২ আসনে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশ কম। এ কারণে জোটটিকে অন্য দল বা জোটের সমর্থন পেতে হবে।
বারিসান বা পেরিকাতান থেকে এই সমর্থন পাওয়া সহজ নয়। এমনকি আনোয়ার সাবাহ রাজ্যে বিজয়ীদের সমর্থন পেলেও সারওয়াকের জিপিএস থেকে সমর্থন পাবে বলে মনে হয় না। এই কারণে মালয়েশিয়ার ডিপ স্টেট হিসেবে পরিচিত রাজা ও সুলতানদের সমর্থন নির্বাচনের পর মুখ্য হয়ে উঠতে পারে। আনোয়ার ইব্রাহিম এর আগে এই সমর্থন না পেলেও তার ঘনিষ্ঠরা এবার কিছুটা আশাবাদী। এসব অবশ্য নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত কতটা ভালো ফল পাকাতান করতে পারে তার ওপরই নির্ভর করবে।