ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

করোনা : ফুল নিয়ে হতাশায় শোলা শিল্পের শ্রমিকেরা

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:২৫:১৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১০ এপ্রিল ২০২০
  • / ২২৫ বার পড়া হয়েছে

ঝিনাইদহ অফিস:
বাংলা নববর্ষ সামনে রেখে শোলা পল্লীর কারিগররা সব প্রস্তুতি শেষ করেছিলেন। ঘরে সাজিয়ে রেখেছেন সোলার তৈরি থোকা থোকা ফুল, কিন্তু বিক্রি নেই। এছাড়া বিয়ে বাড়িতেও এই ফুলশোলা ব্যবহৃত হত। মহাজনেরা বলেই দিয়েছেন আপাতত মাল পাঠাবেন না। এই অবস্থায় ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের নরদিহী গ্রামে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র এই শিল্পের প্রতিবন্ধী ও নারী শ্রমিকেরা তাঁদের পারিশ্রমিক (বেতন) পাচ্ছেন না।
স্থানীয়ভাবে এ শিল্পটির বর্তমান পরিচালক তোফায়েল হোসেন জানান, দেশের এ পরিস্থিতিতে সবকিছু যেমন স্থাবির, তেমনি তাঁর শিল্পটিও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হতে চলেছে। বৈশাখ উপলক্ষে তৈরি করা মালামাল বাড়িতেই পড়ে আছে। মহাজনেরা নতুন করে মাল নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন, এমনকি বকেয়া টাকাও দিচ্ছেন না। এই অবস্থায় কী করবেন, আর কীভাবে অসহায় প্রতিবন্ধী ও নারীদের পারিশ্রমিক দেবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তোফায়েল হোসেন জানান, ২০০৪ সালে তাঁর ভগ্নিপতি প্রতিবন্ধী সিরাজুল ইসলাম এ শোলার কারখানা গড়ে তোলেন। নাম দেন রিগ্যাল হ্যান্ডিক্রাফ্টস অ্যান্ড ড্রাই ফ্লাওয়ার। সিরাজুল ইসলামের বাড়ি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ গ্রামে। তিনি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার নরদিহী গ্রামে এই কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে কয়েক বছর তাঁদের কারখানায় শতাধিক শ্রমিক ফুল তৈরির কাজ করতেন। যাদের মধ্যে কমপক্ষে ২০ জন প্রতিবন্ধী ছিল। সিরাজুল ইসলাম প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থানের জন্য বাড়িতে এই কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। যাঁরা বসে বসে কাজ করতে পারতেন। বর্তমানে সিরাজুল ইসলাম অসুস্থ হওয়ায় কারখানা তিনি দেখাশুনা করেন।
তোফায়েল হোসেন জানান, বর্তমানে কারখানায় ৩০ জন কাজ করেন। যাঁরা শোলা দিয়ে ফুল তৈরি ও ফুলের মালা গাঁথার কাজ করেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে শোলা সংগ্রহ করে সেটাকে কেটে ফুল তৈরির উপযোগী করেন। এরপর মালা তৈরি। অনেকে কারখানায়, আবার অনেকে তাঁদের এখান থেকে শোলা নিয়ে বাড়িতে বসেই ফুল তৈরি করছেন। তিনি জানান, প্রায় ৪০ প্রকারের ফুল ও ফুলের মালা তাঁরা এ শোলা দিয়ে তৈরি করে থাকেন। গ্রামীণ ঐতিহ্য ধরে রাখতেও এই শোলা ফুলের কদর বেশি। তিনি আরও জানান, ফুল তৈরির ক্ষেত্রে প্রথমে শোলা কেটে কাগজ তৈরি করে সেটাকে রোল বানানো হয়। তারপর বেলী, জিনিয়া, গোলাপ, ছোট গোলাপ, গোলাপকুঁড়ি, গন্ধরাজ, রজনীকুঁড়ি, জিরোফুলসহ বিভিন্ন ধরনের ফুল তৈরি করেন। এগুলো সারা বছর চাহিদা থাকলেও পহেলা বৈশাখে চাহিদা দ্বিগুন বেড়ে যায়। যে কারণে তাঁরা এই সময় অতিরিক্ত পরিশ্রম করে ফুল তৈরি করেন। ঘরে মজুদ করেন নানা ধরনের ফুল। যা দিয়ে সাজবে বাংলার তরুণ-তরুণীরা, বরণ করবে বাংলা নববর্ষকে। নববর্ষের মুহূর্তে বেলী, জুঁই, জিনিয়া, পদ্ম, গন্ধরাজ ফুলের চাহিদার যেন শেষ থাকে না।
তোফায়েল হোসেন জানান, এবারও বাংলা নববর্ষ সামনে রেখে তাঁরা অতিরিক্ত ফুল তৈরি করেছেন। ইতিপূর্বে বছরের অন্য সময়ে মাসে ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে। কিন্তু দেশে চায়না ফুলের আগমন ঘটায়, তা কমে মাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার ফুল বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু নববর্ষের সময় বিক্রি হয় লক্ষাধিক টাকার ফুল। এবারও তাঁরা লক্ষাধিক টাকার ফুল মজুদ করেছেন। কিন্তু কোনো বিক্রি নেই। তোফায়েল জানান, তাঁরা এগুলো ঢাকায় পাঠান। সেখানে রং করার পর বিক্রি হয়। অনেক সময় দেশের বাইরেও যায়। কিন্তু এখন ঢাকার মহাজনেরা মাল পাঠাতে নিষেধ করেছেন। সরকারিভাবে পহেলা বৈশাখের সব অনুষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে তাঁদের এই মাল আর বিক্রি হবে না। যাঁরা তাঁর কারখানায় কাজ করেন, তাঁদের পারিশ্রমিক দিতে পারছেন না। ইতিমধ্যে ৩৫ হাজার টাকা বকেয়া হয়ে গেছে। মাস গেলেই তাঁদের ২৫ হাজার টাকা দিতে হয়। টাকা দিতে পারছেন না, তাই অনেকে কাজ ছেড়েও দিচ্ছেন।
কারখানায় কাজ করছিলেন তুলি বেগম। তিনি জানান, সংসারে কাজের পাশাপাশি এই শোলার ফুল তৈরির কাজ করেন তিনি। এখান থেকে মাস শেষে যে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা আয় হয়, তা স্বামীর অসচ্ছল সংসার-সহায়ক হয়। এখন মালামাল বিক্রি না হলে মালিক কীভাবে টাকা দেবেন। আর তাঁদের এই কাজ বন্ধ হলে আবারও সংসার অভাব দেখা দেবে। চায়না খাতুন জানান, তাঁদের এটি ক্ষুদ্রশিল্প হলেও এর সঙ্গে বেশ কয়েকটি পরিবার জড়িয়ে আছে। যাঁরা বাড়িতে অন্য কাজের পাশাপাশি এই কাজ করে সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়েছেন। এই কাজটি বন্ধ হলে অন্য কাজেও যেতে পারবেন না। ফলে সরকারের এই ক্ষুদ্র শিল্পটি বাঁচিয়ে রাখার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তোফায়েল হোসেন জানান, আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মেলায় তাঁদের এই শোলাশিল্প নিয়ে বেশ কয়েকবার স্টল দিয়েছেন। জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারও পেয়েছেন। কিন্তু সরকারি কোনো সহযোগিতা আজও পাননি। অর্থের অভাবে কারখানাও বড় করতে পারছেন না। সহজ শর্তে ঋণ পেলে কারখানা আরও বড় করে অনেকের কর্মসংস্থান করতে পারবেন বলে আশা করেন তিনি।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

করোনা : ফুল নিয়ে হতাশায় শোলা শিল্পের শ্রমিকেরা

আপলোড টাইম : ০৯:২৫:১৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১০ এপ্রিল ২০২০

ঝিনাইদহ অফিস:
বাংলা নববর্ষ সামনে রেখে শোলা পল্লীর কারিগররা সব প্রস্তুতি শেষ করেছিলেন। ঘরে সাজিয়ে রেখেছেন সোলার তৈরি থোকা থোকা ফুল, কিন্তু বিক্রি নেই। এছাড়া বিয়ে বাড়িতেও এই ফুলশোলা ব্যবহৃত হত। মহাজনেরা বলেই দিয়েছেন আপাতত মাল পাঠাবেন না। এই অবস্থায় ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের নরদিহী গ্রামে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র এই শিল্পের প্রতিবন্ধী ও নারী শ্রমিকেরা তাঁদের পারিশ্রমিক (বেতন) পাচ্ছেন না।
স্থানীয়ভাবে এ শিল্পটির বর্তমান পরিচালক তোফায়েল হোসেন জানান, দেশের এ পরিস্থিতিতে সবকিছু যেমন স্থাবির, তেমনি তাঁর শিল্পটিও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হতে চলেছে। বৈশাখ উপলক্ষে তৈরি করা মালামাল বাড়িতেই পড়ে আছে। মহাজনেরা নতুন করে মাল নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন, এমনকি বকেয়া টাকাও দিচ্ছেন না। এই অবস্থায় কী করবেন, আর কীভাবে অসহায় প্রতিবন্ধী ও নারীদের পারিশ্রমিক দেবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তোফায়েল হোসেন জানান, ২০০৪ সালে তাঁর ভগ্নিপতি প্রতিবন্ধী সিরাজুল ইসলাম এ শোলার কারখানা গড়ে তোলেন। নাম দেন রিগ্যাল হ্যান্ডিক্রাফ্টস অ্যান্ড ড্রাই ফ্লাওয়ার। সিরাজুল ইসলামের বাড়ি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ গ্রামে। তিনি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার নরদিহী গ্রামে এই কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে কয়েক বছর তাঁদের কারখানায় শতাধিক শ্রমিক ফুল তৈরির কাজ করতেন। যাদের মধ্যে কমপক্ষে ২০ জন প্রতিবন্ধী ছিল। সিরাজুল ইসলাম প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থানের জন্য বাড়িতে এই কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। যাঁরা বসে বসে কাজ করতে পারতেন। বর্তমানে সিরাজুল ইসলাম অসুস্থ হওয়ায় কারখানা তিনি দেখাশুনা করেন।
তোফায়েল হোসেন জানান, বর্তমানে কারখানায় ৩০ জন কাজ করেন। যাঁরা শোলা দিয়ে ফুল তৈরি ও ফুলের মালা গাঁথার কাজ করেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে শোলা সংগ্রহ করে সেটাকে কেটে ফুল তৈরির উপযোগী করেন। এরপর মালা তৈরি। অনেকে কারখানায়, আবার অনেকে তাঁদের এখান থেকে শোলা নিয়ে বাড়িতে বসেই ফুল তৈরি করছেন। তিনি জানান, প্রায় ৪০ প্রকারের ফুল ও ফুলের মালা তাঁরা এ শোলা দিয়ে তৈরি করে থাকেন। গ্রামীণ ঐতিহ্য ধরে রাখতেও এই শোলা ফুলের কদর বেশি। তিনি আরও জানান, ফুল তৈরির ক্ষেত্রে প্রথমে শোলা কেটে কাগজ তৈরি করে সেটাকে রোল বানানো হয়। তারপর বেলী, জিনিয়া, গোলাপ, ছোট গোলাপ, গোলাপকুঁড়ি, গন্ধরাজ, রজনীকুঁড়ি, জিরোফুলসহ বিভিন্ন ধরনের ফুল তৈরি করেন। এগুলো সারা বছর চাহিদা থাকলেও পহেলা বৈশাখে চাহিদা দ্বিগুন বেড়ে যায়। যে কারণে তাঁরা এই সময় অতিরিক্ত পরিশ্রম করে ফুল তৈরি করেন। ঘরে মজুদ করেন নানা ধরনের ফুল। যা দিয়ে সাজবে বাংলার তরুণ-তরুণীরা, বরণ করবে বাংলা নববর্ষকে। নববর্ষের মুহূর্তে বেলী, জুঁই, জিনিয়া, পদ্ম, গন্ধরাজ ফুলের চাহিদার যেন শেষ থাকে না।
তোফায়েল হোসেন জানান, এবারও বাংলা নববর্ষ সামনে রেখে তাঁরা অতিরিক্ত ফুল তৈরি করেছেন। ইতিপূর্বে বছরের অন্য সময়ে মাসে ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে। কিন্তু দেশে চায়না ফুলের আগমন ঘটায়, তা কমে মাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার ফুল বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু নববর্ষের সময় বিক্রি হয় লক্ষাধিক টাকার ফুল। এবারও তাঁরা লক্ষাধিক টাকার ফুল মজুদ করেছেন। কিন্তু কোনো বিক্রি নেই। তোফায়েল জানান, তাঁরা এগুলো ঢাকায় পাঠান। সেখানে রং করার পর বিক্রি হয়। অনেক সময় দেশের বাইরেও যায়। কিন্তু এখন ঢাকার মহাজনেরা মাল পাঠাতে নিষেধ করেছেন। সরকারিভাবে পহেলা বৈশাখের সব অনুষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে তাঁদের এই মাল আর বিক্রি হবে না। যাঁরা তাঁর কারখানায় কাজ করেন, তাঁদের পারিশ্রমিক দিতে পারছেন না। ইতিমধ্যে ৩৫ হাজার টাকা বকেয়া হয়ে গেছে। মাস গেলেই তাঁদের ২৫ হাজার টাকা দিতে হয়। টাকা দিতে পারছেন না, তাই অনেকে কাজ ছেড়েও দিচ্ছেন।
কারখানায় কাজ করছিলেন তুলি বেগম। তিনি জানান, সংসারে কাজের পাশাপাশি এই শোলার ফুল তৈরির কাজ করেন তিনি। এখান থেকে মাস শেষে যে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা আয় হয়, তা স্বামীর অসচ্ছল সংসার-সহায়ক হয়। এখন মালামাল বিক্রি না হলে মালিক কীভাবে টাকা দেবেন। আর তাঁদের এই কাজ বন্ধ হলে আবারও সংসার অভাব দেখা দেবে। চায়না খাতুন জানান, তাঁদের এটি ক্ষুদ্রশিল্প হলেও এর সঙ্গে বেশ কয়েকটি পরিবার জড়িয়ে আছে। যাঁরা বাড়িতে অন্য কাজের পাশাপাশি এই কাজ করে সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়েছেন। এই কাজটি বন্ধ হলে অন্য কাজেও যেতে পারবেন না। ফলে সরকারের এই ক্ষুদ্র শিল্পটি বাঁচিয়ে রাখার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তোফায়েল হোসেন জানান, আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মেলায় তাঁদের এই শোলাশিল্প নিয়ে বেশ কয়েকবার স্টল দিয়েছেন। জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারও পেয়েছেন। কিন্তু সরকারি কোনো সহযোগিতা আজও পাননি। অর্থের অভাবে কারখানাও বড় করতে পারছেন না। সহজ শর্তে ঋণ পেলে কারখানা আরও বড় করে অনেকের কর্মসংস্থান করতে পারবেন বলে আশা করেন তিনি।