ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

এরকম ঈদ আগে কখনো দেখিনি, আর যেন না আসে

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:১৪:১৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ মে ২০২০
  • / ২১৫ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক:
চুয়াডাঙ্গা শহরের সাদেক আলী মল্লিক পাড়ার বাসিন্দা শিলা খানের বাড়িতে প্রতিবছর ঈদের দুপুরে আত্মীয়-স্বজনের বেড়াতে আসা নিয়মিত একটা ব্যাপার। ঈদের আগের দিন থেকে তিনি রান্নাবান্না শুরু করেন। কিন্তু এই বছর তাঁর বাড়িতে ঈদ হয়েছে অন্যভাবে। তিনি বলেন, ‘মনেই হচ্ছে না কোনো ঈদ কাটাচ্ছি। আত্মীয়-স্বজন কেউ আসেনি, আমাদেরও কারো বাসায় যাওয়া হবে না। গত বছর এই দিনে বাসাভর্তি মেহমান ছিল। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে যেন অন্যসব দিনের মতোই আজকের দিনটা। এবার তেমন কিছু রান্নাও করিনি, খাওয়ার লোকও নেই।’ আরও অনেক পরিবারের ঈদ উদ্যাপনের গল্পটা একই রকম। এই বছর আলাদা ধরনের এক ঈদুল ফিতর কাটালেন চুয়াডাঙ্গাসহ দেশের মানুষেরা। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে লকডাউন চলছে। ঘরে বসে সবাইকে ঈদ উদ্যাপনের পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশে মোট কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৩৬ হাজার ৭৫১ জন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এই রোগে ৫২২ জন মারা গেলেন। চুয়াডাঙ্গাতেও এ সংখ্যা কম নয়। মোট ৮৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন। ১ জন মারা গেছেন।
ঈদগাহের পরিবর্তে মসজিদে ঈদের জামাত:
ঈদের জামাত ঐতিহ্য অনুযায়ী ঈদগাহে হওয়ার রেওয়াজ থাকলেও, এই প্রথমবারের মতো মসজিদে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে অনেকে মসজিদের ঈদের জামাতেও অংশ নেননি। চুয়াডাঙ্গার বেশ কয়েকটি মসজিদে খবর নিয়ে জানা গেছে, সেখানে একাধিক জামাতের আয়োজন করা হয়েছে, যাতে ভিড় বেশি না হয়। সবাইকে মাঝখানে অন্তত এক ফুট জায়গা রেখে দাঁড়াতে বলা হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গার প্রতি মসজিদেই ঈদের জামাত হলেও এর দৃশ্যপট ছিল ভিন্ন। আগে থেকেই জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ঈদের নামাজকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সে অনুযায়ী মুসল্লিদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তাঁদের নামাজ পড়তে দেখা গেছে। তবে অনেকেই শারীরিক ও সামাজিক দূরুত্বের কথা চিন্তা করে মসজিদে নামাজ পড়তে যাননি।
কোর্টপাড়ার সেলিমুল হাবিব বায়তুল মামুর জামে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি মসজিদে নামাজ পড়েছি। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সবাই নামাজে অংশ নিয়েছি। মসজিদের প্রবেশপথে জীবাণুনাশক টানেল বসানো হয়েছিল। কোনো কোলাকুলি বা এ ধরণের কিছু আমরা কেউ করিনি। এমনকি আত্মীয়-স্বজন বা প্রতিবেশীদের বাড়িতে যেমন যাইনি, তেমনি আমাদের বাড়িতেও সেটা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।’
আবার কিছু কিছু স্থানে মসজিদের পরিবর্তে অনেক ভবনের ছাদেও ঈদের জামাতের আয়োজন করতে দেখা গেছে। তাঁদেরই একজন মুক্তিপাড়ার বাসিন্দা আবুল হোসেন। তিনি বলছেন, ‘আমার ৪২ বছরের জীবনে কোনো দিন ভাবিনি যে ঈদের নামাজ বাড়িতে পড়তে হবে। এটা অবিশ্বাস্য। গত বছরেও এটা আমরা কল্পনা করিনি। সারা জীবন ঈদগাহে সবার সঙ্গে নামাজ পড়েছি’। ঈদের জামাতের পর কোলাকুলি আর স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে বেড়ানোর মধ্য দিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগির রেওয়াজ থাকলেও এ বছর তেমন কোনো আয়োজনই দেখা যায়নি। কাউকে কোলাকুলি করতেও দেখা যায়নি। প্রায় সবাই মাস্ক ব্যবহার করছেন। এমনকি অনেকের হাতে ছিল গ্লাভস।
পুরোনো কাপড়েই বেশির ভাগ মানুষের ঈদ:
ঈদের আগে নতুন কাপড়-চোপড় কেনা এবং ঈদের দিন সেগুলো পড়ে বের হওয়া একটা প্রচলিত ব্যাপার। কিন্তু এই ঈদে সেখানেও ব্যতিক্রম হয়েছে। দোকান-পাট কয়েকদিনের জন্য খোলা হলেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে অনেকেই কেনাকাটা করতে যাননি। ফলে অনেক পরিবারের সদস্যরা পুরোনো কাপড় পড়েই এই বছর ঈদ উদ্যাপন করছেন।
ঈদ সালামি পায়নি শিশুরা:
ঈদের দিন বড়দের সালাম করে সালামি আদায় যেন ঈদের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ। আবার সালাম না করলেও সালামি আদায় করতেই হবে। কিন্তু সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে গিয়ে এই বছর সালাম করার বা সালামি আদায়েও আকাল দেখা গিয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র অন্তর গত বছর সালাম করেই আড়াই হাজার টাকা আয় করেছিল। কিন্তু এই ঈদে সে শুধু বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাঁচ শ টাকা পেয়েছে। তার ঈদটা সালামি না পাওয়ার এই টেনশনেই ভালো যায়নি বলছিল সে। অন্তর আরও বলে, ‘’বাসায় কেউ তো আসছেই না। কাকে সালাম করব। কারো বাসাতে যাওয়ার উপায়ও নেই।’
পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুরতে যায়নি অনেকে:
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুরতেও বের হয়নি তেমন কেউ। চুয়াডাঙ্গা রেলপাড়ার বাসিন্দা তারিকুজ্জামান। তিনি বলেন, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোথাও বেড়াতে যায়নি। শুধু এক দিন ঘুরতে গিয়ে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নিতে চাই না। বরং ঘরে থেকে টেলিফোনে সবার খোঁজখবর নেব। সুস্থ থাকার জন্য একটা বছর ঈদের আনন্দ না হয় একটু কমই হোক।
ঝড় যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা:
ঈদের মাত্র কয়েকদিন আগে গত বুধবার (২০ মে) চুয়াডাঙ্গাসহ বাংলাদেশে আঘাত করে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পান। সেই ঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির মুখে পড়ে চুয়াডাঙ্গা জেলা। গাড়াবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা ছকিনা খাতুন বলেন, ‘আমার ঘর-দরজা সব পড়ে গেছে। এই ঈদ আর ঈদ নেই। এত দিন সবকিছু বন্ধ থাকার পর আবার ঝড়।’ ঈদ না আসলেও পারত। এক বেলা খাবার জোগাড় করাই তার জন্যে এখন কঠিন হয়ে উঠেছে। এদিক-সেদিক থেকে কুড়িয়ে আনা শাক-সবজি রান্না করে কোনোরকম খাচ্ছেন তিনি। আরেকজন সামাদ আলী। তাঁর মুরগির খামার এখন ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ঝড়ে গাছ পড়ে মুরগি মারা গেছে। এই খামারই আমাদের ইনকাম ছিল। এই ছাড়া ইনকামের কোনো সোর্স নেই। মাঠে কোনো জমি-জায়গা নেই। এবার ঈদ বলে আমাদের কিছু নেই।’ একই সঙ্গে আরও কয়েকটি ঘটনা ব্যথিত করেছে গোটা জেলাকে। ঈদের আগের দিন অর্থাৎ চাঁদরাতে দামুড়হুদা উপজেলার কুতুবপুর মুন্সিপুর সীমান্তে সাইফুল ইসলাম নামের এক এনজিও কর্মকর্তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তাঁকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। চাঁদরাতে মাংস কিনতে বের হয়েছিলেন তিনি। আর এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন থেকে শুরু মরদেহ দাফনের সম্পূর্ণ কার্যক্রমে দামুড়হুদা থানা পুলিশ ও নিহতের পরিবারের ঈদ উৎসব ফিকে হয়ে গেছে।
খবর পাওয়া যায়, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ফুলবাড়িয়া গ্রামে ঈদের জামাত মসজিদে হবে না, ঈদগাহে এ নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছে। গত রোববার ঈদের আগের দিনগত রাতে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার শংকরচন্দ্র ইউনিয়নের ফুলবাড়িয়া গ্রামে মাঝেরপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ফুলবাড়িয়া মাঝেরপাড়া জামে মসজিদের ইমাম ছানোয়ার হোসেনকে (৫৫) রক্তাক্ত জখম করা হয়েছে। আহত ছানোয়ার হোসেন ফুলবাড়িয়া মাঝেরপাড়ার মৃত আলামিন জমাদ্দারের ছেলে। এ ঘটনায় পুলিশ রাতেই অভিযুক্ত ইলিয়াছ হোসেনকে আটক করলেও পরদিন তাঁকে মুচলেকায় মুক্তি দেওয়া হয়।
এদিকে, ঈদের দিন দুই মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে এক যুবকের মৃত্যুর খবরটিও নাড়া দিয়েছে সবার মনে। আলমডাঙ্গায় দুটি মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে রাশেদুজ্জামান টোকন (৩০) নামের এক যুবক নিহত হয়। আহত হয় আরও দুজন। ঈদের দিন সোমবার দুপুরে উপজেলার বন্দর রামনগরে এ দুর্ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা জানান, রাশেদুজ্জামান টোকন সাহেবপুর গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে। ঈদের দিন দুপুরে টোকন দুই চাচাতো ভাই রিফাত ও শামীমকে নিয়ে মোটরসাইকেলে ঘুরতে বের হন। ফুফার বাড়ি বন্দর রামনগর ঘুরে তাঁরা মোটরসাইকেলযোগে বাড়ি ফিরছিলেন। বন্দর রামনগর মোড়ে পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা আরেকটি মোটরসাইকেলের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। দুর্ঘটনায় আহত তিনজনকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক রাশেদুজ্জামান টোকনকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত রিফাত ও শামীমকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
সবমিলিয়ে দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর আমরা উদ্যাপন করেছি পবিত্র ঈদুল ফিতর। প্রতি বছর এ ঈদ আনন্দের বার্তা বয়ে আনলেও এ বছর বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে এক অন্য আবহ নিয়ে এসেছে। যাইহোক, প্রত্যেকটি ঈদ সবার জীবনে বয়ে নিয়ে আসুক অনাবিল শান্তি আর আনন্দ। মানুষের মধ্যকার সব ধরণের বিভেদ চিরতরে দূর হয়ে যাক। ঈদের মূলমন্ত্র হোক মানবতার কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করা।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

এরকম ঈদ আগে কখনো দেখিনি, আর যেন না আসে

আপলোড টাইম : ০৯:১৪:১৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ মে ২০২০

নিজস্ব প্রতিবেদক:
চুয়াডাঙ্গা শহরের সাদেক আলী মল্লিক পাড়ার বাসিন্দা শিলা খানের বাড়িতে প্রতিবছর ঈদের দুপুরে আত্মীয়-স্বজনের বেড়াতে আসা নিয়মিত একটা ব্যাপার। ঈদের আগের দিন থেকে তিনি রান্নাবান্না শুরু করেন। কিন্তু এই বছর তাঁর বাড়িতে ঈদ হয়েছে অন্যভাবে। তিনি বলেন, ‘মনেই হচ্ছে না কোনো ঈদ কাটাচ্ছি। আত্মীয়-স্বজন কেউ আসেনি, আমাদেরও কারো বাসায় যাওয়া হবে না। গত বছর এই দিনে বাসাভর্তি মেহমান ছিল। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে যেন অন্যসব দিনের মতোই আজকের দিনটা। এবার তেমন কিছু রান্নাও করিনি, খাওয়ার লোকও নেই।’ আরও অনেক পরিবারের ঈদ উদ্যাপনের গল্পটা একই রকম। এই বছর আলাদা ধরনের এক ঈদুল ফিতর কাটালেন চুয়াডাঙ্গাসহ দেশের মানুষেরা। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে লকডাউন চলছে। ঘরে বসে সবাইকে ঈদ উদ্যাপনের পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশে মোট কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৩৬ হাজার ৭৫১ জন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এই রোগে ৫২২ জন মারা গেলেন। চুয়াডাঙ্গাতেও এ সংখ্যা কম নয়। মোট ৮৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন। ১ জন মারা গেছেন।
ঈদগাহের পরিবর্তে মসজিদে ঈদের জামাত:
ঈদের জামাত ঐতিহ্য অনুযায়ী ঈদগাহে হওয়ার রেওয়াজ থাকলেও, এই প্রথমবারের মতো মসজিদে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে অনেকে মসজিদের ঈদের জামাতেও অংশ নেননি। চুয়াডাঙ্গার বেশ কয়েকটি মসজিদে খবর নিয়ে জানা গেছে, সেখানে একাধিক জামাতের আয়োজন করা হয়েছে, যাতে ভিড় বেশি না হয়। সবাইকে মাঝখানে অন্তত এক ফুট জায়গা রেখে দাঁড়াতে বলা হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গার প্রতি মসজিদেই ঈদের জামাত হলেও এর দৃশ্যপট ছিল ভিন্ন। আগে থেকেই জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ঈদের নামাজকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সে অনুযায়ী মুসল্লিদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তাঁদের নামাজ পড়তে দেখা গেছে। তবে অনেকেই শারীরিক ও সামাজিক দূরুত্বের কথা চিন্তা করে মসজিদে নামাজ পড়তে যাননি।
কোর্টপাড়ার সেলিমুল হাবিব বায়তুল মামুর জামে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি মসজিদে নামাজ পড়েছি। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সবাই নামাজে অংশ নিয়েছি। মসজিদের প্রবেশপথে জীবাণুনাশক টানেল বসানো হয়েছিল। কোনো কোলাকুলি বা এ ধরণের কিছু আমরা কেউ করিনি। এমনকি আত্মীয়-স্বজন বা প্রতিবেশীদের বাড়িতে যেমন যাইনি, তেমনি আমাদের বাড়িতেও সেটা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।’
আবার কিছু কিছু স্থানে মসজিদের পরিবর্তে অনেক ভবনের ছাদেও ঈদের জামাতের আয়োজন করতে দেখা গেছে। তাঁদেরই একজন মুক্তিপাড়ার বাসিন্দা আবুল হোসেন। তিনি বলছেন, ‘আমার ৪২ বছরের জীবনে কোনো দিন ভাবিনি যে ঈদের নামাজ বাড়িতে পড়তে হবে। এটা অবিশ্বাস্য। গত বছরেও এটা আমরা কল্পনা করিনি। সারা জীবন ঈদগাহে সবার সঙ্গে নামাজ পড়েছি’। ঈদের জামাতের পর কোলাকুলি আর স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে বেড়ানোর মধ্য দিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগির রেওয়াজ থাকলেও এ বছর তেমন কোনো আয়োজনই দেখা যায়নি। কাউকে কোলাকুলি করতেও দেখা যায়নি। প্রায় সবাই মাস্ক ব্যবহার করছেন। এমনকি অনেকের হাতে ছিল গ্লাভস।
পুরোনো কাপড়েই বেশির ভাগ মানুষের ঈদ:
ঈদের আগে নতুন কাপড়-চোপড় কেনা এবং ঈদের দিন সেগুলো পড়ে বের হওয়া একটা প্রচলিত ব্যাপার। কিন্তু এই ঈদে সেখানেও ব্যতিক্রম হয়েছে। দোকান-পাট কয়েকদিনের জন্য খোলা হলেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে অনেকেই কেনাকাটা করতে যাননি। ফলে অনেক পরিবারের সদস্যরা পুরোনো কাপড় পড়েই এই বছর ঈদ উদ্যাপন করছেন।
ঈদ সালামি পায়নি শিশুরা:
ঈদের দিন বড়দের সালাম করে সালামি আদায় যেন ঈদের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ। আবার সালাম না করলেও সালামি আদায় করতেই হবে। কিন্তু সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে গিয়ে এই বছর সালাম করার বা সালামি আদায়েও আকাল দেখা গিয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র অন্তর গত বছর সালাম করেই আড়াই হাজার টাকা আয় করেছিল। কিন্তু এই ঈদে সে শুধু বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাঁচ শ টাকা পেয়েছে। তার ঈদটা সালামি না পাওয়ার এই টেনশনেই ভালো যায়নি বলছিল সে। অন্তর আরও বলে, ‘’বাসায় কেউ তো আসছেই না। কাকে সালাম করব। কারো বাসাতে যাওয়ার উপায়ও নেই।’
পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুরতে যায়নি অনেকে:
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুরতেও বের হয়নি তেমন কেউ। চুয়াডাঙ্গা রেলপাড়ার বাসিন্দা তারিকুজ্জামান। তিনি বলেন, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোথাও বেড়াতে যায়নি। শুধু এক দিন ঘুরতে গিয়ে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নিতে চাই না। বরং ঘরে থেকে টেলিফোনে সবার খোঁজখবর নেব। সুস্থ থাকার জন্য একটা বছর ঈদের আনন্দ না হয় একটু কমই হোক।
ঝড় যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা:
ঈদের মাত্র কয়েকদিন আগে গত বুধবার (২০ মে) চুয়াডাঙ্গাসহ বাংলাদেশে আঘাত করে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পান। সেই ঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির মুখে পড়ে চুয়াডাঙ্গা জেলা। গাড়াবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা ছকিনা খাতুন বলেন, ‘আমার ঘর-দরজা সব পড়ে গেছে। এই ঈদ আর ঈদ নেই। এত দিন সবকিছু বন্ধ থাকার পর আবার ঝড়।’ ঈদ না আসলেও পারত। এক বেলা খাবার জোগাড় করাই তার জন্যে এখন কঠিন হয়ে উঠেছে। এদিক-সেদিক থেকে কুড়িয়ে আনা শাক-সবজি রান্না করে কোনোরকম খাচ্ছেন তিনি। আরেকজন সামাদ আলী। তাঁর মুরগির খামার এখন ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ঝড়ে গাছ পড়ে মুরগি মারা গেছে। এই খামারই আমাদের ইনকাম ছিল। এই ছাড়া ইনকামের কোনো সোর্স নেই। মাঠে কোনো জমি-জায়গা নেই। এবার ঈদ বলে আমাদের কিছু নেই।’ একই সঙ্গে আরও কয়েকটি ঘটনা ব্যথিত করেছে গোটা জেলাকে। ঈদের আগের দিন অর্থাৎ চাঁদরাতে দামুড়হুদা উপজেলার কুতুবপুর মুন্সিপুর সীমান্তে সাইফুল ইসলাম নামের এক এনজিও কর্মকর্তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তাঁকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। চাঁদরাতে মাংস কিনতে বের হয়েছিলেন তিনি। আর এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন থেকে শুরু মরদেহ দাফনের সম্পূর্ণ কার্যক্রমে দামুড়হুদা থানা পুলিশ ও নিহতের পরিবারের ঈদ উৎসব ফিকে হয়ে গেছে।
খবর পাওয়া যায়, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ফুলবাড়িয়া গ্রামে ঈদের জামাত মসজিদে হবে না, ঈদগাহে এ নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছে। গত রোববার ঈদের আগের দিনগত রাতে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার শংকরচন্দ্র ইউনিয়নের ফুলবাড়িয়া গ্রামে মাঝেরপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ফুলবাড়িয়া মাঝেরপাড়া জামে মসজিদের ইমাম ছানোয়ার হোসেনকে (৫৫) রক্তাক্ত জখম করা হয়েছে। আহত ছানোয়ার হোসেন ফুলবাড়িয়া মাঝেরপাড়ার মৃত আলামিন জমাদ্দারের ছেলে। এ ঘটনায় পুলিশ রাতেই অভিযুক্ত ইলিয়াছ হোসেনকে আটক করলেও পরদিন তাঁকে মুচলেকায় মুক্তি দেওয়া হয়।
এদিকে, ঈদের দিন দুই মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে এক যুবকের মৃত্যুর খবরটিও নাড়া দিয়েছে সবার মনে। আলমডাঙ্গায় দুটি মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে রাশেদুজ্জামান টোকন (৩০) নামের এক যুবক নিহত হয়। আহত হয় আরও দুজন। ঈদের দিন সোমবার দুপুরে উপজেলার বন্দর রামনগরে এ দুর্ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা জানান, রাশেদুজ্জামান টোকন সাহেবপুর গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে। ঈদের দিন দুপুরে টোকন দুই চাচাতো ভাই রিফাত ও শামীমকে নিয়ে মোটরসাইকেলে ঘুরতে বের হন। ফুফার বাড়ি বন্দর রামনগর ঘুরে তাঁরা মোটরসাইকেলযোগে বাড়ি ফিরছিলেন। বন্দর রামনগর মোড়ে পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা আরেকটি মোটরসাইকেলের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। দুর্ঘটনায় আহত তিনজনকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক রাশেদুজ্জামান টোকনকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত রিফাত ও শামীমকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
সবমিলিয়ে দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর আমরা উদ্যাপন করেছি পবিত্র ঈদুল ফিতর। প্রতি বছর এ ঈদ আনন্দের বার্তা বয়ে আনলেও এ বছর বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে এক অন্য আবহ নিয়ে এসেছে। যাইহোক, প্রত্যেকটি ঈদ সবার জীবনে বয়ে নিয়ে আসুক অনাবিল শান্তি আর আনন্দ। মানুষের মধ্যকার সব ধরণের বিভেদ চিরতরে দূর হয়ে যাক। ঈদের মূলমন্ত্র হোক মানবতার কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করা।