ইপেপার । আজবৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

এমপি হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান গ্রেপ্তার

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:৪৮:২৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ অক্টোবর ২০২০
  • / ১৭৯ বার পড়া হয়েছে

নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মেরে রক্তাক্ত, স্ত্রীকে তুলে নেয়ার হুমকি : ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা

বাড়িতে অভিযান : অস্ত্র মাদক অবৈধ ওয়াকিটকির মামলায় দেহরক্ষীসহ এক বছরের কারাদণ্ড
সমীকরণ প্রতিবেদন:
নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইরফান সেলিম ও তার দেহরক্ষী জাহিদকে এক বছর করে কারাদন্ড দিয়েছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে রাজধানীর চকবাজার এলাকার ২৬ দেবীদাস ঘাট লেনের হাজী সেলিমের বাসায় দিনভর অভিযান পরিচালনা করে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম গ্রেফতার দুজনকে অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে ছয় মাস এবং মাদক রাখার দায়ে আরও ছয় মাস করে কারাদন্ড দেন। এ সময় ওই বাসা থেকে ৩৮টি ওয়াকিটকি, ৪টি ভিএইচএফ সেট (ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি), ১টি হ্যান্ডকাপ, ১০ ক্যান বিদেশি বিয়ার, ৩টি হাই ফ্রিকোয়েন্সি ওয়ারলেস সেট, ১টি একনলা বন্দুক, ১টি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। এর আগে সকালে ইরফান সেলিমের গাড়িচালক মীজানুর রহমানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গতকালই মীজানুরকে আদালতের নির্দেশে এক দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
র‌্যাব বলছে, পুরান ঢাকায় সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে ‘চান সরদার দাদা বাড়ি’ নামের ওই বাড়িতে ২৪ ঘণ্টা মনিটরিংয়ের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিসহ অত্যাধুনিক কন্ট্রোল রুম। কন্ট্রোল রুমে রয়েছে আধুনিক ভিপিএস (ভার্চুয়াল প্রাইভেট সার্ভার), ৩৮টি ওয়াকিটকি, ড্রোনসহ বিভিন্ন ডিভাইস। রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (ভিভিআইপি) নিরাপত্তায় নিয়োজিত এলিট বাহিনীর কাছে যেসব সরঞ্জাম থাকে, সে রকম সরঞ্জাম পাওয়া গেছে।
গত রবিবার সন্ধ্যার পর রাজধানীর কলাবাগান ক্রসিংয়ের কাছে মারধরের শিকার হন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহম্মেদ খান। তার মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয় সংসদ সদস্য স্টিকার লাগানো একটি গাড়ি। ওই গাড়ি থেকে দু-তিন জন নেমে ওয়াসিফ আহম্মেদ খানকে ফুটপাথে ফেলে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। পরে ট্রাফিক পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে। পথচারীরা এ দৃশ্য ভিডিও করেন, যা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। ধানমন্ডি থানা পুলিশ এসে ঘটনাস্থল থেকে গাড়িটি থানায় নিয়ে যায়। বর্তমানে গ্রেফতার মীজান ও গাড়ি ধানমন্ডি থানায় রয়েছে। পুলিশ এরই মধ্যে নিশ্চিত হয়েছে গাড়িটি সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের। এ ঘটনায় গতকাল সকাল পৌনে ৮টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা হয়। হাজী সেলিমের ছেলে কাউন্সিলর ইরফানসহ চারজনের নাম উল্লেখ করে মামলাটি করেন মারধরের শিকার নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফ আহম্মেদ খান।
গতকাল সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে অভিযান আংশিক সমাপ্ত করে গণমাধ্যমকর্মীদের র?্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই আমরা এ বাসায় অভিযান পরিচালনা করেছি। রবিবার রাতে ফৌজদারি অপরাধসহ আরও কিছু তথ্য আমাদের কাছে ছিল। এরই মধ্যে আমরা এ বাসায় অত্যাধুনিক কন্ট্রোল রুম ও টর্চার সেলের সন্ধান পেয়েছি। বিটিআরসির অনুমতি না নিয়েই রেডিওফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করা হতো। ৩৮টি ওয়াকিটকির বাইরে ৪টি হাইফ্রিকোয়েন্সি ‘ভিএইচএফ’ও জব্দ করেছে র‌্যাবের আভিযানিক দল। প্রাথমিক তদন্তেই আমরা জানতে পেরেছি এ কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে পুরান ঢাকায় চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস পরিচালনা করা হতো।’ আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইরফান সেলিম ও জাহিদকে অবৈধ অস্ত্র এবং মাদক রাখার দায়ে ছয় মাস করে এক বছরের কারাদন্ড দিয়েছেন। পরে র‌্যাব বাদী হয়ে অস্ত্র ও মাদক মামলা করবে। অভিযানকালে আমরা এ বাসায় ১টি একনলা বন্দুক, ১টি পিস্তল, ১টি হ্যান্ডকাফ, বিদেশি মদ, বিয়ার পেয়েছি।’
এর আগে সকাল ১০টার দিকে ধানমন্ডি থানার পরিদর্শক (অপারেশন) রবিউল ইসলাম এ মামলার তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, মারধর ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলাটি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম, তার বডিগার্ড মোহাম্মদ জাহিদ, মদিনা গ্রুপের প্রটোকল অফিসার এ বি সিদ্দিক দিপু ও গাড়িচালক মীজানুর রহমানের নাম উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও দু-তিন জনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, উদ্ধার করা গাড়িটি সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের। তিনি গাড়িতে ছিলেন না। তার ছেলে ও নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন। পুলিশ তার গাড়ি ও নৌবাহিনীর কর্মকর্তার মোটরসাইকেল রাতেই ধানমন্ডি থানায় নিয়ে যায়। গাড়িচালক মীজানুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী গতকাল বলেন, তিনি রাস্তায় জটলা থেকে মুঠোফোনে ভিডিও করেন। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, আহত এক ব্যক্তি নিজেকে লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ বলে পরিচয় দেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, তিনি স্ত্রীসহ মোটরবাইকে ফিরছিলেন। ওই গাড়ি তার মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। তিনি তখনই মোটরসাইকেল থামান এবং নিজের পরিচয় দেন। গাড়ি থেকে নেমে দুই ব্যক্তি তাকে মারধর করেন। গতকাল সরেজমিনে চকবাজারের দেবীদাস ঘাট লেনের হাজী সেলিমের বাসার সামনে গিয়ে দেখা যায় বেলা সাড়ে ১১টার দিকে র‌্যাব দেবীদাস ঘাট লেন এলাকায় একে একে র‌্যাবের গাড়ি প্রবেশ করছে। মুহূর্তের মধ্যে ওই এলাকার চারদিকে র‌্যাব সদস্যরা অবস্থান নেন। বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। উৎসুক লোকজন আশপাশ এলাকায় অবস্থান নেয় কী হতে যাচ্ছে ওই বাসায় তা দেখার জন্য। ক্রমেই বাড়তে থাকে মানুষের ভিড়।
বিকাল সোয়া ৩টার দিকে লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, ইরফান সেলিম ও জাহিদ তাদের হেফাজতে রয়েছেন। অভিযান এখনো চলছে। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে এ বাড়িতে অভিযান চালানো হচ্ছে। অভিযান শেষে জানানো হবে বাসা থেকে কী পাওয়া গেছে। তবে গতকাল যে ঘটনায় এদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে সেই ঘটনাস্থলে দুজনই উপস্থিত ছিলেন। আভিযানিক দল সম্পর্কে আশিক বিল্লাহ আরও জানান, অভিযানে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন, র‌্যাবের একটি গোয়েন্দা টিম রয়েছে। এ ছাড়া র‌্যাব-৩ ও ১০-এর সদস্যরা রয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ঘটনাপ্রবাহের ভিত্তিতেই এ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। চান সরদার দাদা বাড়ির পাশেই একটি বাড়িতে ইরফানের টর্চার সেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। বিকেল ৫টার দিকে গণমাধ্যমকর্মীদের নয় তলা ভবনটিতে নিয়ে যান র‌্যাব সদস্যরা। ভবনের তিন তলায় ঢুকতেই উত্তর পাশে চোখে পড়ে অত্যাধুনিক ডেকোরেশনের সরঞ্জামসংবলিত বেডরুম। এখানেই খাটের তোশকের নিচে র‌্যাব সদস্যরা পেয়েছেন ১টি অবৈধ বিদেশি পিস্তল। এ ছাড়া মিলেছে বিদেশি মদ ও বিয়ার। এ রুমেই মাঝেমধ্যে অবস্থান করতেন ইরফান সেলিম। চতুর্থ তলার এক ইউনিটের ফ্ল্যাটে ৩টি রুম। উত্তর পাশের ২টি রুমে র‌্যাবের আভিযানিক দল সন্ধান পেয়েছে ১টি অত্যাধুনিক কন্ট্রোল রুমের। সেখান থেকে ৩৮টি ওয়াকিটকি, ১টি হাইরেঞ্জের দুরবিন, ১টি এয়ারগান, ৪ কিলোমিটার ক্ষমতাসম্পন্ন ৪টি ভিএইচএফ সেট, সিসিটিভির মনিটরসহ বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস উদ্ধার করা হয়। পরে সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে র‌্যাব মুখপাত্র আশিক বিল্লাহ গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কথা বলেন। রাত ৮টা ৭ মিনিটে গ্রেফতার দুজনকে কেরানীগঞ্জ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যান র‌্যাব সদস্যরা।
মামলায় যা উল্লেখ করা হয়েছে
ওয়াসিফ আহম্মেদ এজাহারে অভিযোগ করেন, গত রোববার নীলক্ষেত থেকে বই কিনে মোটরসাইকেলে করে তিনি মোহাম্মদপুরের বাসায় ফিরছিলেন। সঙ্গে তার স্ত্রীও ছিলেন। ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনে তার মোটরসাইকেলটি পেছন থেকে ধাক্কা দেয় একটি গাড়ি। ওয়াসিফ আহম্মেদ মোটরসাইকেল থামিয়ে গাড়িটির গ্লাসে নক করে নিজের পরিচয় দিয়ে ধাক্কা দেওয়ার কারণ জানতে চান। তখন এক ব্যক্তি বের হয়ে তাকে গালিগালাজ করেন। তারা গাড়ি নিয়ে কলাবাগানের দিকে যান। মোটরসাইকেল নিয়ে ওয়াসিফ আহম্মেদও তাদের পেছনে পেছনে যান। কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডে গাড়িটি থামলে ওয়াসিফ তার মোটরসাইকেল নিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়ান। তখন তিন-চার জন লোক গাড়ি থেকে নেমে বলতে থাকেন, ‘তোর নৌবাহিনী/সেনাবিহিনী বাইর করতেছি, তোর লেফটেন্যান্ট/ক্যাপ্টেন বাইর করতেছি। তোকে আজ মেরেই ফেলব’ এই কথা বলে তাকে কিলঘুসি দিতে থাকেন। পরে ট্রাফিক পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করেন এবং হামলাকারীরা পালিয়ে যান।
যা ঘটেছিল
রবিবার সন্ধ্যায় কলাবাগানের ট্রাফিক সিগন্যালে ১টি কালো রঙের ল্যান্ড রোভার জিপ (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-৫৭৩৬) থেকে দু-তিন ব্যক্তি নেমে এসে এক ব্যক্তিকে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। আক্রান্ত বক্তিকে বাঁচাতে তার স্ত্রী এগিয়ে এলে তিনিও রেহাই পাননি হামলাকারীদের হাত থেকে। হামলায় গুরুতর আহত ওই ব্যক্তির একটি দাঁতও পড়ে যায়। সড়কে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ এগিয়ে এলে পালিয়ে যায় হামলাকারীরা। তখন শোনা যায় হামলার শিকার ওই ব্যক্তির নাম মো. ওয়াসিফ আহম্মেদ খান। তিনি নৌবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট। বর্তমানে ডেপুটেশনে ‘এসএসএফ’ (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স)-এ দায়িত্ব পালন করছেন। পথচারীদের ধারণ করা ওই দৃশ্য মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। সেখানে নৌবাহিনীর এই কর্মকর্তাকে রক্তাক্ত মুখে বলতে শোনা যায়, তিনি পরিচয় দেওয়ার পরও তাকে মারধর করা হয়েছে। তার স্ত্রীর গায়েও হাত দিয়েছে। পরে ধানমন্ডি থানা পুলিশ এসে ঘটনাস্থল থেকে জিপ গাড়িটি থানায় নিয়ে যায়। তখন জানা যায় গাড়িটি সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের। হামলার নির্দেশদাতা তারই ছেলে মোহাম্মদ ইরফান সেলিম।
রিমান্ডে গাড়িচালক
নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় গাড়িচালক মীজানুর রহমানকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছে আদালত। পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক আবু সুফিয়ান মো. নোমান এ অনুমতি দেন। এর আগে পুলিশ আসামি মীজানুর রহমানকে আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। আদালত উভয় পক্ষের শুনানি গ্রহণ করে তাকে এক দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেয়।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

এমপি হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান গ্রেপ্তার

আপলোড টাইম : ১০:৪৮:২৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ অক্টোবর ২০২০

নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মেরে রক্তাক্ত, স্ত্রীকে তুলে নেয়ার হুমকি : ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা

বাড়িতে অভিযান : অস্ত্র মাদক অবৈধ ওয়াকিটকির মামলায় দেহরক্ষীসহ এক বছরের কারাদণ্ড
সমীকরণ প্রতিবেদন:
নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইরফান সেলিম ও তার দেহরক্ষী জাহিদকে এক বছর করে কারাদন্ড দিয়েছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে রাজধানীর চকবাজার এলাকার ২৬ দেবীদাস ঘাট লেনের হাজী সেলিমের বাসায় দিনভর অভিযান পরিচালনা করে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম গ্রেফতার দুজনকে অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে ছয় মাস এবং মাদক রাখার দায়ে আরও ছয় মাস করে কারাদন্ড দেন। এ সময় ওই বাসা থেকে ৩৮টি ওয়াকিটকি, ৪টি ভিএইচএফ সেট (ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি), ১টি হ্যান্ডকাপ, ১০ ক্যান বিদেশি বিয়ার, ৩টি হাই ফ্রিকোয়েন্সি ওয়ারলেস সেট, ১টি একনলা বন্দুক, ১টি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। এর আগে সকালে ইরফান সেলিমের গাড়িচালক মীজানুর রহমানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গতকালই মীজানুরকে আদালতের নির্দেশে এক দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
র‌্যাব বলছে, পুরান ঢাকায় সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে ‘চান সরদার দাদা বাড়ি’ নামের ওই বাড়িতে ২৪ ঘণ্টা মনিটরিংয়ের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিসহ অত্যাধুনিক কন্ট্রোল রুম। কন্ট্রোল রুমে রয়েছে আধুনিক ভিপিএস (ভার্চুয়াল প্রাইভেট সার্ভার), ৩৮টি ওয়াকিটকি, ড্রোনসহ বিভিন্ন ডিভাইস। রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (ভিভিআইপি) নিরাপত্তায় নিয়োজিত এলিট বাহিনীর কাছে যেসব সরঞ্জাম থাকে, সে রকম সরঞ্জাম পাওয়া গেছে।
গত রবিবার সন্ধ্যার পর রাজধানীর কলাবাগান ক্রসিংয়ের কাছে মারধরের শিকার হন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহম্মেদ খান। তার মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয় সংসদ সদস্য স্টিকার লাগানো একটি গাড়ি। ওই গাড়ি থেকে দু-তিন জন নেমে ওয়াসিফ আহম্মেদ খানকে ফুটপাথে ফেলে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। পরে ট্রাফিক পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে। পথচারীরা এ দৃশ্য ভিডিও করেন, যা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। ধানমন্ডি থানা পুলিশ এসে ঘটনাস্থল থেকে গাড়িটি থানায় নিয়ে যায়। বর্তমানে গ্রেফতার মীজান ও গাড়ি ধানমন্ডি থানায় রয়েছে। পুলিশ এরই মধ্যে নিশ্চিত হয়েছে গাড়িটি সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের। এ ঘটনায় গতকাল সকাল পৌনে ৮টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা হয়। হাজী সেলিমের ছেলে কাউন্সিলর ইরফানসহ চারজনের নাম উল্লেখ করে মামলাটি করেন মারধরের শিকার নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফ আহম্মেদ খান।
গতকাল সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে অভিযান আংশিক সমাপ্ত করে গণমাধ্যমকর্মীদের র?্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই আমরা এ বাসায় অভিযান পরিচালনা করেছি। রবিবার রাতে ফৌজদারি অপরাধসহ আরও কিছু তথ্য আমাদের কাছে ছিল। এরই মধ্যে আমরা এ বাসায় অত্যাধুনিক কন্ট্রোল রুম ও টর্চার সেলের সন্ধান পেয়েছি। বিটিআরসির অনুমতি না নিয়েই রেডিওফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করা হতো। ৩৮টি ওয়াকিটকির বাইরে ৪টি হাইফ্রিকোয়েন্সি ‘ভিএইচএফ’ও জব্দ করেছে র‌্যাবের আভিযানিক দল। প্রাথমিক তদন্তেই আমরা জানতে পেরেছি এ কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে পুরান ঢাকায় চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস পরিচালনা করা হতো।’ আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইরফান সেলিম ও জাহিদকে অবৈধ অস্ত্র এবং মাদক রাখার দায়ে ছয় মাস করে এক বছরের কারাদন্ড দিয়েছেন। পরে র‌্যাব বাদী হয়ে অস্ত্র ও মাদক মামলা করবে। অভিযানকালে আমরা এ বাসায় ১টি একনলা বন্দুক, ১টি পিস্তল, ১টি হ্যান্ডকাফ, বিদেশি মদ, বিয়ার পেয়েছি।’
এর আগে সকাল ১০টার দিকে ধানমন্ডি থানার পরিদর্শক (অপারেশন) রবিউল ইসলাম এ মামলার তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, মারধর ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলাটি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম, তার বডিগার্ড মোহাম্মদ জাহিদ, মদিনা গ্রুপের প্রটোকল অফিসার এ বি সিদ্দিক দিপু ও গাড়িচালক মীজানুর রহমানের নাম উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও দু-তিন জনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, উদ্ধার করা গাড়িটি সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের। তিনি গাড়িতে ছিলেন না। তার ছেলে ও নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন। পুলিশ তার গাড়ি ও নৌবাহিনীর কর্মকর্তার মোটরসাইকেল রাতেই ধানমন্ডি থানায় নিয়ে যায়। গাড়িচালক মীজানুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী গতকাল বলেন, তিনি রাস্তায় জটলা থেকে মুঠোফোনে ভিডিও করেন। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, আহত এক ব্যক্তি নিজেকে লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ বলে পরিচয় দেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, তিনি স্ত্রীসহ মোটরবাইকে ফিরছিলেন। ওই গাড়ি তার মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। তিনি তখনই মোটরসাইকেল থামান এবং নিজের পরিচয় দেন। গাড়ি থেকে নেমে দুই ব্যক্তি তাকে মারধর করেন। গতকাল সরেজমিনে চকবাজারের দেবীদাস ঘাট লেনের হাজী সেলিমের বাসার সামনে গিয়ে দেখা যায় বেলা সাড়ে ১১টার দিকে র‌্যাব দেবীদাস ঘাট লেন এলাকায় একে একে র‌্যাবের গাড়ি প্রবেশ করছে। মুহূর্তের মধ্যে ওই এলাকার চারদিকে র‌্যাব সদস্যরা অবস্থান নেন। বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। উৎসুক লোকজন আশপাশ এলাকায় অবস্থান নেয় কী হতে যাচ্ছে ওই বাসায় তা দেখার জন্য। ক্রমেই বাড়তে থাকে মানুষের ভিড়।
বিকাল সোয়া ৩টার দিকে লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, ইরফান সেলিম ও জাহিদ তাদের হেফাজতে রয়েছেন। অভিযান এখনো চলছে। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে এ বাড়িতে অভিযান চালানো হচ্ছে। অভিযান শেষে জানানো হবে বাসা থেকে কী পাওয়া গেছে। তবে গতকাল যে ঘটনায় এদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে সেই ঘটনাস্থলে দুজনই উপস্থিত ছিলেন। আভিযানিক দল সম্পর্কে আশিক বিল্লাহ আরও জানান, অভিযানে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন, র‌্যাবের একটি গোয়েন্দা টিম রয়েছে। এ ছাড়া র‌্যাব-৩ ও ১০-এর সদস্যরা রয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ঘটনাপ্রবাহের ভিত্তিতেই এ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। চান সরদার দাদা বাড়ির পাশেই একটি বাড়িতে ইরফানের টর্চার সেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। বিকেল ৫টার দিকে গণমাধ্যমকর্মীদের নয় তলা ভবনটিতে নিয়ে যান র‌্যাব সদস্যরা। ভবনের তিন তলায় ঢুকতেই উত্তর পাশে চোখে পড়ে অত্যাধুনিক ডেকোরেশনের সরঞ্জামসংবলিত বেডরুম। এখানেই খাটের তোশকের নিচে র‌্যাব সদস্যরা পেয়েছেন ১টি অবৈধ বিদেশি পিস্তল। এ ছাড়া মিলেছে বিদেশি মদ ও বিয়ার। এ রুমেই মাঝেমধ্যে অবস্থান করতেন ইরফান সেলিম। চতুর্থ তলার এক ইউনিটের ফ্ল্যাটে ৩টি রুম। উত্তর পাশের ২টি রুমে র‌্যাবের আভিযানিক দল সন্ধান পেয়েছে ১টি অত্যাধুনিক কন্ট্রোল রুমের। সেখান থেকে ৩৮টি ওয়াকিটকি, ১টি হাইরেঞ্জের দুরবিন, ১টি এয়ারগান, ৪ কিলোমিটার ক্ষমতাসম্পন্ন ৪টি ভিএইচএফ সেট, সিসিটিভির মনিটরসহ বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস উদ্ধার করা হয়। পরে সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে র‌্যাব মুখপাত্র আশিক বিল্লাহ গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কথা বলেন। রাত ৮টা ৭ মিনিটে গ্রেফতার দুজনকে কেরানীগঞ্জ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যান র‌্যাব সদস্যরা।
মামলায় যা উল্লেখ করা হয়েছে
ওয়াসিফ আহম্মেদ এজাহারে অভিযোগ করেন, গত রোববার নীলক্ষেত থেকে বই কিনে মোটরসাইকেলে করে তিনি মোহাম্মদপুরের বাসায় ফিরছিলেন। সঙ্গে তার স্ত্রীও ছিলেন। ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনে তার মোটরসাইকেলটি পেছন থেকে ধাক্কা দেয় একটি গাড়ি। ওয়াসিফ আহম্মেদ মোটরসাইকেল থামিয়ে গাড়িটির গ্লাসে নক করে নিজের পরিচয় দিয়ে ধাক্কা দেওয়ার কারণ জানতে চান। তখন এক ব্যক্তি বের হয়ে তাকে গালিগালাজ করেন। তারা গাড়ি নিয়ে কলাবাগানের দিকে যান। মোটরসাইকেল নিয়ে ওয়াসিফ আহম্মেদও তাদের পেছনে পেছনে যান। কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডে গাড়িটি থামলে ওয়াসিফ তার মোটরসাইকেল নিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়ান। তখন তিন-চার জন লোক গাড়ি থেকে নেমে বলতে থাকেন, ‘তোর নৌবাহিনী/সেনাবিহিনী বাইর করতেছি, তোর লেফটেন্যান্ট/ক্যাপ্টেন বাইর করতেছি। তোকে আজ মেরেই ফেলব’ এই কথা বলে তাকে কিলঘুসি দিতে থাকেন। পরে ট্রাফিক পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করেন এবং হামলাকারীরা পালিয়ে যান।
যা ঘটেছিল
রবিবার সন্ধ্যায় কলাবাগানের ট্রাফিক সিগন্যালে ১টি কালো রঙের ল্যান্ড রোভার জিপ (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-৫৭৩৬) থেকে দু-তিন ব্যক্তি নেমে এসে এক ব্যক্তিকে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। আক্রান্ত বক্তিকে বাঁচাতে তার স্ত্রী এগিয়ে এলে তিনিও রেহাই পাননি হামলাকারীদের হাত থেকে। হামলায় গুরুতর আহত ওই ব্যক্তির একটি দাঁতও পড়ে যায়। সড়কে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ এগিয়ে এলে পালিয়ে যায় হামলাকারীরা। তখন শোনা যায় হামলার শিকার ওই ব্যক্তির নাম মো. ওয়াসিফ আহম্মেদ খান। তিনি নৌবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট। বর্তমানে ডেপুটেশনে ‘এসএসএফ’ (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স)-এ দায়িত্ব পালন করছেন। পথচারীদের ধারণ করা ওই দৃশ্য মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। সেখানে নৌবাহিনীর এই কর্মকর্তাকে রক্তাক্ত মুখে বলতে শোনা যায়, তিনি পরিচয় দেওয়ার পরও তাকে মারধর করা হয়েছে। তার স্ত্রীর গায়েও হাত দিয়েছে। পরে ধানমন্ডি থানা পুলিশ এসে ঘটনাস্থল থেকে জিপ গাড়িটি থানায় নিয়ে যায়। তখন জানা যায় গাড়িটি সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের। হামলার নির্দেশদাতা তারই ছেলে মোহাম্মদ ইরফান সেলিম।
রিমান্ডে গাড়িচালক
নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় গাড়িচালক মীজানুর রহমানকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছে আদালত। পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক আবু সুফিয়ান মো. নোমান এ অনুমতি দেন। এর আগে পুলিশ আসামি মীজানুর রহমানকে আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। আদালত উভয় পক্ষের শুনানি গ্রহণ করে তাকে এক দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেয়।