ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

এবার পুলিশ বাহিনীতে আরও কঠোর শুদ্ধি অভিযান

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:১৪:১৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৯ অগাস্ট ২০২০
  • / ২৬১ বার পড়া হয়েছে

অপরাধের ধরন অনুযায়ী শ্রেণিভিত্তিক তালিকা তৈরির কাজ চলছে
সমীকরণ প্রতিবেদন:
নিজ দলের পর এবার পুলিশ বাহিনীতে আরও কঠোর শুদ্ধি অভিযান শুরু করছে সরকার। অপরাধ অনুযায়ী অপরাধী পুলিশ সদস্যদের শ্রেণীভিত্তিক তালিকা তৈরির কাজ চলছে। যার মধ্যে ঘুষখোর, তদবিরবাজ, মাদকাসক্ত ও মাদক কারবারে জড়িত ও মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা আদায়কারী, ক্ষমতা অপব্যবহারসহ নানা ধরনের অপরাধ অনুযায়ী তালিকাটি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই উর্ধতন ত্রিশ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে পদোন্নতি বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের ইতোমধ্যেই শাস্তি দেয়া হয়েছে। তাদের বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত আছে। যার মধ্যে পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তাও রয়েছেন। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যার পর পুলিশে আবারও শুদ্ধি অভিযানের প্রয়োজন অনুভব করছে বাহিনীটি। সম্প্রতি নানা অপকর্মে দুই শতাধিক পুলিশ সদস্যকে বরখাস্তসহ নানা ধরনের শাস্তি দেয়া হয়েছে। গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছে ৫০ জনের বেশি। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৪ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে। সেসব অভিযোগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতর তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে। সম্প্রতি অভিযোগের হার বেড়েছে।
সরকারের একটি দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নিজ দলে শুদ্ধি অভিযান চালানোর কঠোর ঘোষণা দেয়া হয় অনেক আগেই। তারই ধারাবাহিকতায় গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবে ‘ক্যাসিনো’ চালানোর অভিযোগে যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে আটক করা হয়। গ্রেফতার করা হয় ঢাকার ক্যাসিনোগুলোর নিয়ন্ত্রক ঢাকা মহানগর যুবলীগের (দক্ষিণ) সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট, তার সহযোগী কাউন্সিলর ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক ওরফে সাঈদ, যুবলীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক ওরফে আরমান, নির্বাহী সদস্য জাকির হোসেন, ঢাকা উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি এস এম রবিউল ইসলাম ওরফে সোহেল, ক্যাসিনো ব্যবসার বাইরে ঠিকাদারি থেকে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক জি কে শামীম, গে-ারিয়া আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক ও তার সহোদর ভাই রূপন ভূঁইয়াকে। তাদের কাছ থেকে বিপুল স্বর্ণ ও অর্থ জব্দ করা হয়। গ্রেফতারের পর দল থেকে তাদের আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়।
এর আগে ২০১২ সালের ৩১ জুলাই ডেসটিনির রফিকুল আমীন, মোহাম্মদ হোসেনসহ প্রতিষ্ঠানটির ২২ জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর কলাবাগান থানায় দুটি মামলা করে দুদক। ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ (এমএলএম) ও ট্রি-প্ল্যান্টেশন প্রকল্পের নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করে। হাসপাতালের পর্দা কেনার নামে ১০ কোটি টাকা, রূপপুর পারমাণিক বিদ্যুত কেন্দ্রে বালিশ কাণ্ডে সঙ্গে জড়িতদেরও গ্রেফতার করা হয়। কাউকেই ছাড় দেয়া হয়নি। বিশেষ ওই সূত্রটি বলছে, ওই সময়ই সরকারের তরফ থেকে প্রতিটি বাহিনীতে শুদ্ধি অভিযান চালানোর কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়। যার মধ্যে পুলিশ বাহিনী অন্যতম। কারণ সারাদেশে পুলিশের নেটওয়ার্ক আছে। সবচেয়ে বেশি সদস্যের এই বাহিনীর চেন অব কমান্ড সঠিকভাবে ধরে রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়। সে মোতাবেক বাহিনীর প্রতিটি ইউনিটের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা শাখাকে আরও শক্তিশালী ও ঢেলে সাজানোর কথা বলা হয়। সর্বশেষ কক্সাবাজারে সিনহা হত্যার পর সেই বিষয়টি আবারও সামনে চলে এসেছে।
সরকারের নির্দেশনা পাওয়ার পরেই পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ পুলিশ সদর দফতরে পুলিশের প্রতিটি ইউনিট প্রধানের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে বিশেষ এক ঘোষণা জারি করেন। তিনি বলেন, যারা পুলিশ বাহিনীতে চাকরি করে রাতারাতি কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক হবেন বলে ভাবছেন বা সেই লক্ষ্য নিয়ে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। তাদের পুলিশ বাহিনীতে জায়গা নেই। তারা ইচ্ছে করলে পুলিশের চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করতে পারেন। এখানেই শেষ নয়, যেসব পুলিশ সদস্য মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের চাকরিচ্যুত করার প্রকাশ্য ঘোষণা দেন পুলিশ প্রধান ও ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম। পুলিশ বাহিনীতে ডোপ টেস্ট চালু করার প্রক্রিয়া চলছে। এটি চাকরির আগে এবং পরেও করা হবে। কোন পুলিশ সদস্যের প্রতি সন্দেহ হলেই তাকে ডোপ টেস্ট বা মাদকাসক্ত কিনা তা পরীক্ষা করা হবে। যার রক্তে বা দেহে মাদক সেবনের আলামত পাওয়া যাবে, তাকে চাকরিচ্যুত করতে ন্যূনতম ভাবা হবে না। শুধু তাই নয়, নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি বাণিজ্যের সঙ্গে কোন পুলিশ সদস্য জড়িত থাকলে তার শাস্তি নিশ্চিত। এক্ষেত্রে কোন ডাক দোহাই মানা হবে না। এমন বাণিজ্যের সঙ্গে ত্রিশ পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে তদন্ত চলছে। এছাড়া যেসব পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, ক্ষমতার অপব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে সারাদেশ থেকে ১৩ হাজার ৬শ’ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সিকিউরিটি সেলে অভিযোগ জমা পড়ে ছিল। ২০১৭ সালে সে সংখ্যা বেড়ে প্রায় ১৬ হাজারে গিয়ে ঠেকেছে। গড়ে প্রতিবছর ১৫ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সিকিউরিটি সেলে অভিযোগ জমা পড়ে। তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় এবং ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ পুলিশ সদস্যের ব্যক্তির দায় বাহিনী নেবে না বলে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন। কিছু পুলিশ সদস্যের কারণে পুরো বাহিনী দায় নিতে পারে না। প্রয়োজনে তাদের বাহিনী থেকে ছেঁটে ফেলা হবে। এক্ষেত্রে কোন ধরনের ছাড় দেয়া হবে না। সম্প্রতি কক্সবাজারে মেজর সিনহা হত্যার ঘটনায় ওসি পুলিশসহ তার সহযোগীদের ছেঁটে ফেলা হয়েছে। ঘটনার গভীর তদন্ত চলছে। ওসি প্রদীপসহ তার সহযোগীদেরও ছেঁটে ফেলা দেয়ার নির্দেশ এসেছে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। পুলিশ সদর দফতরের ভাষ্য মোতাবেক, পুলিশ কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে ৯৫ থেকে ৯৭ ভাগই সৎ এবং নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। বিশেষ করে গত ১০ বছরে পুলিশে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটা স্বচ্ছতা তৈরি হয়েছে। এটি দুর্নীতির উৎস বন্ধের অন্যতম একটি ধাপ। তারপরেও ফেনীতে মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সময় ওসি মোয়াজ্জেমের ঘটনা কিংবা ডিআইজি মিজানের ঘটনা ছিল আলোচনায়। তাদের প্রত্যেককেই শাস্তির আনা হয়েছে। কাউকেই ছাড়া হয়নি।
একজন দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শুদ্ধি অভিযানের একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও পরিকাঠামো গঠনের কাজ চলছে। সে মোতাবেক সারাদেশে দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এবারের তালিকা হবে অপরাধীদের মতো। যেমন ছিনতাইকারী, ডাকাত, খুনী, অস্ত্র ব্যবসায়ী বা মাদক ব্যবসায়ীদের যেভাবে পৃথক পৃথক তালিকা করে পুলিশ। সেই একই পদ্ধতিতে পুলিশের ঘুষখোর, তদবিরবাজ, পদোন্নতি ব্যবসা, ক্ষমতার অপব্যবহার, মানবাধিকার লঙ্ঘন, জমি দখল, মাদক ব্যবসা, মাদক সেবনকারী ও মাদকাসক্ত, মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা আদায়সহ নানা শ্রেণীতে ভাগ করা হবে। যে পুলিশ সদস্য যে অপরাধের সঙ্গে জড়িত হবে, তাকে সেই তালিকায় রাখা হবে। আবার যারা একাধিক ধরনের অপরাধ করবে তাদের নাম শ্রেণীভিত্তিক একাধিক তালিকায়ও থাকবে। এবারই প্রথম অপরাধী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পরেই তাদের বিষয়ে প্রাথমিকভাবে কি সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, সে বিষয়ে একটি পরিষ্কার কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা হচ্ছে।
পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. সোহেল রানা জানান, পুলিশের প্রতিটি ইউনিটের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা ইউনিট ঢেলে সাজানোর নির্দেশ জারি করেছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ। অপেক্ষাকৃত সৎ ও নিষ্ঠাবান পুলিশ কর্মকর্তাদের দিয়ে পুলিশের প্রতিটি ইউনিটের র্পূর্ণাঙ্গ অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা শাখা গঠনের কথা বলা হয়েছে। আর যেসব পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে, সেগুলোর তদন্ত চলছে। তদন্ত মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে। ঘুষ, দুর্নীতি, পদোন্নতি বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্যসহ নানা অবৈধ কর্মকান্ডে যেসব পুলিশ সদস্য জড়িত থাকবে তাদের কপালে নিশ্চিত দুঃখ আছে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

এবার পুলিশ বাহিনীতে আরও কঠোর শুদ্ধি অভিযান

আপলোড টাইম : ০৯:১৪:১৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৯ অগাস্ট ২০২০

অপরাধের ধরন অনুযায়ী শ্রেণিভিত্তিক তালিকা তৈরির কাজ চলছে
সমীকরণ প্রতিবেদন:
নিজ দলের পর এবার পুলিশ বাহিনীতে আরও কঠোর শুদ্ধি অভিযান শুরু করছে সরকার। অপরাধ অনুযায়ী অপরাধী পুলিশ সদস্যদের শ্রেণীভিত্তিক তালিকা তৈরির কাজ চলছে। যার মধ্যে ঘুষখোর, তদবিরবাজ, মাদকাসক্ত ও মাদক কারবারে জড়িত ও মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা আদায়কারী, ক্ষমতা অপব্যবহারসহ নানা ধরনের অপরাধ অনুযায়ী তালিকাটি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই উর্ধতন ত্রিশ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে পদোন্নতি বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের ইতোমধ্যেই শাস্তি দেয়া হয়েছে। তাদের বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত আছে। যার মধ্যে পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তাও রয়েছেন। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যার পর পুলিশে আবারও শুদ্ধি অভিযানের প্রয়োজন অনুভব করছে বাহিনীটি। সম্প্রতি নানা অপকর্মে দুই শতাধিক পুলিশ সদস্যকে বরখাস্তসহ নানা ধরনের শাস্তি দেয়া হয়েছে। গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছে ৫০ জনের বেশি। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৪ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে। সেসব অভিযোগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতর তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে। সম্প্রতি অভিযোগের হার বেড়েছে।
সরকারের একটি দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নিজ দলে শুদ্ধি অভিযান চালানোর কঠোর ঘোষণা দেয়া হয় অনেক আগেই। তারই ধারাবাহিকতায় গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবে ‘ক্যাসিনো’ চালানোর অভিযোগে যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে আটক করা হয়। গ্রেফতার করা হয় ঢাকার ক্যাসিনোগুলোর নিয়ন্ত্রক ঢাকা মহানগর যুবলীগের (দক্ষিণ) সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট, তার সহযোগী কাউন্সিলর ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক ওরফে সাঈদ, যুবলীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক ওরফে আরমান, নির্বাহী সদস্য জাকির হোসেন, ঢাকা উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি এস এম রবিউল ইসলাম ওরফে সোহেল, ক্যাসিনো ব্যবসার বাইরে ঠিকাদারি থেকে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক জি কে শামীম, গে-ারিয়া আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক ও তার সহোদর ভাই রূপন ভূঁইয়াকে। তাদের কাছ থেকে বিপুল স্বর্ণ ও অর্থ জব্দ করা হয়। গ্রেফতারের পর দল থেকে তাদের আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়।
এর আগে ২০১২ সালের ৩১ জুলাই ডেসটিনির রফিকুল আমীন, মোহাম্মদ হোসেনসহ প্রতিষ্ঠানটির ২২ জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর কলাবাগান থানায় দুটি মামলা করে দুদক। ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ (এমএলএম) ও ট্রি-প্ল্যান্টেশন প্রকল্পের নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করে। হাসপাতালের পর্দা কেনার নামে ১০ কোটি টাকা, রূপপুর পারমাণিক বিদ্যুত কেন্দ্রে বালিশ কাণ্ডে সঙ্গে জড়িতদেরও গ্রেফতার করা হয়। কাউকেই ছাড় দেয়া হয়নি। বিশেষ ওই সূত্রটি বলছে, ওই সময়ই সরকারের তরফ থেকে প্রতিটি বাহিনীতে শুদ্ধি অভিযান চালানোর কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়। যার মধ্যে পুলিশ বাহিনী অন্যতম। কারণ সারাদেশে পুলিশের নেটওয়ার্ক আছে। সবচেয়ে বেশি সদস্যের এই বাহিনীর চেন অব কমান্ড সঠিকভাবে ধরে রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়। সে মোতাবেক বাহিনীর প্রতিটি ইউনিটের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা শাখাকে আরও শক্তিশালী ও ঢেলে সাজানোর কথা বলা হয়। সর্বশেষ কক্সাবাজারে সিনহা হত্যার পর সেই বিষয়টি আবারও সামনে চলে এসেছে।
সরকারের নির্দেশনা পাওয়ার পরেই পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ পুলিশ সদর দফতরে পুলিশের প্রতিটি ইউনিট প্রধানের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে বিশেষ এক ঘোষণা জারি করেন। তিনি বলেন, যারা পুলিশ বাহিনীতে চাকরি করে রাতারাতি কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক হবেন বলে ভাবছেন বা সেই লক্ষ্য নিয়ে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। তাদের পুলিশ বাহিনীতে জায়গা নেই। তারা ইচ্ছে করলে পুলিশের চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করতে পারেন। এখানেই শেষ নয়, যেসব পুলিশ সদস্য মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের চাকরিচ্যুত করার প্রকাশ্য ঘোষণা দেন পুলিশ প্রধান ও ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম। পুলিশ বাহিনীতে ডোপ টেস্ট চালু করার প্রক্রিয়া চলছে। এটি চাকরির আগে এবং পরেও করা হবে। কোন পুলিশ সদস্যের প্রতি সন্দেহ হলেই তাকে ডোপ টেস্ট বা মাদকাসক্ত কিনা তা পরীক্ষা করা হবে। যার রক্তে বা দেহে মাদক সেবনের আলামত পাওয়া যাবে, তাকে চাকরিচ্যুত করতে ন্যূনতম ভাবা হবে না। শুধু তাই নয়, নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি বাণিজ্যের সঙ্গে কোন পুলিশ সদস্য জড়িত থাকলে তার শাস্তি নিশ্চিত। এক্ষেত্রে কোন ডাক দোহাই মানা হবে না। এমন বাণিজ্যের সঙ্গে ত্রিশ পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে তদন্ত চলছে। এছাড়া যেসব পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, ক্ষমতার অপব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে সারাদেশ থেকে ১৩ হাজার ৬শ’ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সিকিউরিটি সেলে অভিযোগ জমা পড়ে ছিল। ২০১৭ সালে সে সংখ্যা বেড়ে প্রায় ১৬ হাজারে গিয়ে ঠেকেছে। গড়ে প্রতিবছর ১৫ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সিকিউরিটি সেলে অভিযোগ জমা পড়ে। তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় এবং ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ পুলিশ সদস্যের ব্যক্তির দায় বাহিনী নেবে না বলে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন। কিছু পুলিশ সদস্যের কারণে পুরো বাহিনী দায় নিতে পারে না। প্রয়োজনে তাদের বাহিনী থেকে ছেঁটে ফেলা হবে। এক্ষেত্রে কোন ধরনের ছাড় দেয়া হবে না। সম্প্রতি কক্সবাজারে মেজর সিনহা হত্যার ঘটনায় ওসি পুলিশসহ তার সহযোগীদের ছেঁটে ফেলা হয়েছে। ঘটনার গভীর তদন্ত চলছে। ওসি প্রদীপসহ তার সহযোগীদেরও ছেঁটে ফেলা দেয়ার নির্দেশ এসেছে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। পুলিশ সদর দফতরের ভাষ্য মোতাবেক, পুলিশ কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে ৯৫ থেকে ৯৭ ভাগই সৎ এবং নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। বিশেষ করে গত ১০ বছরে পুলিশে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটা স্বচ্ছতা তৈরি হয়েছে। এটি দুর্নীতির উৎস বন্ধের অন্যতম একটি ধাপ। তারপরেও ফেনীতে মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সময় ওসি মোয়াজ্জেমের ঘটনা কিংবা ডিআইজি মিজানের ঘটনা ছিল আলোচনায়। তাদের প্রত্যেককেই শাস্তির আনা হয়েছে। কাউকেই ছাড়া হয়নি।
একজন দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শুদ্ধি অভিযানের একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও পরিকাঠামো গঠনের কাজ চলছে। সে মোতাবেক সারাদেশে দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এবারের তালিকা হবে অপরাধীদের মতো। যেমন ছিনতাইকারী, ডাকাত, খুনী, অস্ত্র ব্যবসায়ী বা মাদক ব্যবসায়ীদের যেভাবে পৃথক পৃথক তালিকা করে পুলিশ। সেই একই পদ্ধতিতে পুলিশের ঘুষখোর, তদবিরবাজ, পদোন্নতি ব্যবসা, ক্ষমতার অপব্যবহার, মানবাধিকার লঙ্ঘন, জমি দখল, মাদক ব্যবসা, মাদক সেবনকারী ও মাদকাসক্ত, মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা আদায়সহ নানা শ্রেণীতে ভাগ করা হবে। যে পুলিশ সদস্য যে অপরাধের সঙ্গে জড়িত হবে, তাকে সেই তালিকায় রাখা হবে। আবার যারা একাধিক ধরনের অপরাধ করবে তাদের নাম শ্রেণীভিত্তিক একাধিক তালিকায়ও থাকবে। এবারই প্রথম অপরাধী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পরেই তাদের বিষয়ে প্রাথমিকভাবে কি সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, সে বিষয়ে একটি পরিষ্কার কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা হচ্ছে।
পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. সোহেল রানা জানান, পুলিশের প্রতিটি ইউনিটের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা ইউনিট ঢেলে সাজানোর নির্দেশ জারি করেছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ। অপেক্ষাকৃত সৎ ও নিষ্ঠাবান পুলিশ কর্মকর্তাদের দিয়ে পুলিশের প্রতিটি ইউনিটের র্পূর্ণাঙ্গ অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা শাখা গঠনের কথা বলা হয়েছে। আর যেসব পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে, সেগুলোর তদন্ত চলছে। তদন্ত মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে। ঘুষ, দুর্নীতি, পদোন্নতি বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্যসহ নানা অবৈধ কর্মকান্ডে যেসব পুলিশ সদস্য জড়িত থাকবে তাদের কপালে নিশ্চিত দুঃখ আছে।