ইপেপার । আজবৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ইসির বিরুদ্ধে আর্থিকসহ সুনির্দিষ্ট ৯ অভিযোগ

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:২৬:৩৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২০
  • / ১১২ বার পড়া হয়েছে

রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ চেয়েছেন বিশিষ্ট নাগরিকরা; ইসিকে সরাতে জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি

সমীকরণ প্রতিবেদন:
বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বিরুদ্ধে গুরুতর আর্থিক দুর্নীতি, অনিয়ম, অসদাচরণ, সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের রক্ত ও বঙ্গবন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ এনেছেন দেশের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে এই ইসিকে অপসারণে রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদের কাছে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা চিঠি দিয়ে দাবি জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, গত ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এই ইসি যা করেছে তা গুরুতর অসদাচরণ। সাংবিধানিক পদে থেকে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতি করা হয়েছে তা অতীতের সব রেকর্ডকে হার মানিয়েছে। যদি তাদের আত্মসম্মানবোধ থাকে তাহলে তারা পদত্যাগ করবেন বলে বিশিষ্ট নাগরিকরা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তারা রাষ্ট্রপতির সুবিধামতো সময়ে তার সাথে সরাসরি সাক্ষাতেরও সময় চেয়েছেন ওই চিঠিতে।
গত ১৪ ডিসেম্বর বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির দফতরে বিশিষ্ট নাগরিকদের দাবিসংবলিত চিঠি দেয়ার পর গতকাল শনিবার ওয়েবিনারে নাগরিকসমাজ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জাতির কাছে তাদের সেই দাবিগুলো প্রকাশ করে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতিকে দেয়া চিঠিটি পড়ে শোনান সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) দিলীপ সরকার। ওয়েবিনারে সংযুক্ত থেকে বক্তব্য রাখেনÑ সুজন সম্পাদক অধ্যাপক ড. বদিউল আলম মজুমদার, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মণ্ডল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমদ প্রমুখ।
রাষ্ট্রপতিকে দেয়া চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৬(৩) অনুচ্ছেদে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল (কাউন্সিল) গঠনের বিধান রয়েছে। সংবিধানের ৯৬(৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যে ক্ষেত্রে কাউন্সিল অথবা অন্য কোনো সূত্র হতে প্রাপ্ত তথ্যে রাষ্ট্রপতির এইরূপ বুঝবার কারণ থাকে যে, কোনো বিচারক (খ) গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হতে পারেন, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করতে ও তার তদন্ত ফল জ্ঞাপন করবার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন। চিঠিতে বলা হয়, সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিধান রয়েছে। ১১৮(৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদ কর্তৃক প্রণীত যেকোনো আইনের বিধানাবলি-সাপেক্ষে নির্বাচন কমিশনারদের কর্মের শর্তাবলি রাষ্ট্রপতি আদেশের দ্বারা যেরূপ নির্ধারণ করবেন সেইরূপ হবে। তবে শর্ত থাকে যে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক যেরূপ পদ্ধতি ও কারণে অপসারিত হতে পারেন, সেরূপ পদ্ধতিতে ও কারণ ব্যতীত কোনো নির্বাচন কমিশনার অপসারিত হবেন না। চিঠিতে বলা হয়, কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সদস্যগণ ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বিভিন্নভাবে গুরুতর অসদাচরণে লিপ্ত হয়েছেন, যা অভিশংসনযোগ্য অপরাধ। একইভাবে তারা বিভিন্নভাবে আইন ও বিধিবিধান লঙ্ঘন করে গুরুতর অসদাচরণ করে চলেছেন। চিঠিতে আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মসহ কমিশনের গুরুতর অসদাচরণের অন্য কয়েকটি ক্ষেত্র চিহ্নিহ্নত করা হয়।
ইসির বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি এবং অর্থসংশ্লিষ্ট গুরুতর অসদাচারণ তিনটি হলো, বিশেষ বক্তা হিসেবে বক্তৃতা দেয়ার নামে দুই কোটি টাকার মতো আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম, নির্বাচন কমিশনের কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় চার কোটি আট লাখ টাকার অসদাচরণ ও অনিয়ম এবং নিয়মবহির্ভূতভাবে তিনজন কমিশনারের তিনটি গাড়ি ব্যবহারজনিত আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম। এ ছাড়া অন্যান্য গুরুতর অসদাচরণ ও ছয়টি অনিয়ম হলোÑ ইভিএম ক্রয় ও ব্যবহার, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম, খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম এবং সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম। চিঠিতে আরও বলা হয়, এসব গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিনীত আবেদন জানানো হয়। একই সাথে অন্যান্য অসদাচারণ ও অনিয়মের অভিযোগগুলো বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও অন্যান্য সংস্থার প্রাথমিক অনুসন্ধানের ভিত্তিতে এবং প্রমাণসাপেক্ষে তদন্তের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে প্রেরণের অনুরোধ জানানো হয়। অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে সামনাসামনি অবগত করার জন্য রাষ্ট্রপতির সুবিধামতো সময়ে একটি সাক্ষাতের আয়োজনের জন্য তাকে অনুরোধ জানানো হয়।
চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেনÑ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান, ড. আকবর আলি খান, অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ও রাশেদা কে চৌধুরী, মানবাধিকার কর্মী ড. হামিদা হোসেন, সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম, মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির, সেন্ট্রাল উইমেন্স ভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক পারভীন হাসান, টিআইবির ড. ইফতেখারুজ্জামান, অধ্যাপক আহমেদ কামাল, অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমদ, অ্যাডভোটেক জেড আই খান পান্না, ড. শাহদীন মালিক, অধ্যাপক সি আর আবরার, আলোকচিত্র শিল্পী ড. শহিদুল আলম, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মণ্ডল, স্থপতি মোবাশ্বের হাসান, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, ব্রতির শারমিন মুরশিদ, অ্যাডভোকেট জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, গোলাম মোর্তজা প্রমুখ।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এই ইসির উচিত পদত্যাগ করা। তারা মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের রক্ত, বঙ্গবন্ধু ও সংবিধানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাই তাদেরকে অপসারণ করে বিচারের আওতায় আনা জরুরি। তিনি বলেন, এই কমিশনের আমলে দেশে নির্বাচনব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে, চলছে নির্বাচন নির্বাচন খেলা। এই খেলা বন্ধ করতে হলে তাদের অপসারণ করে বিচারের আওতায় আনার কোনো বিকল্প নেই। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন যেভাবে অনিয়ম করছে তা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানকে বর্তমান কমিশন অবমাননা ও কলঙ্কিত করেছে। তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের উচিত পদত্যাগ করা, নিজেদের আত্মসম্মানবোধের পরিচয় দেয়া।
আবদুল লতিফ মণ্ডল বলেন, বিশিষ্ট নাগরিকদের এই চিঠি নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাবেন পরামর্শের জন্য। কিন্তু বাস্তবে যা দেখেছি সেটি আদৌ প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবে কি না! তাই উচিত হবে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও এই ধরনের দাবি ও অনুরোধ সম্বলিত চিঠি আমাদের পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা। অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, সংবিধান অনুযায়ী যে দিন নির্বাচন হওয়ার কথা, সে দিন নির্বাচন হতে হবে। কিন্তু এই কমিশনের আমলে তা হয়নি। তিনি বলেন, এই নির্বাচন কমিশনের আমলে যা ঘটেছে তা নজিরবিহীন। যে নির্বাচন যে দিন হওয়ার কথা ছিল, নির্বাচন হয়েছে তার আগের দিন রাতে। নির্বাচন দিনে হওয়ার কথা ছিল, হয়ে গেছে আগের দিন রাতে। ফলে এই কমিশন গুরুতরভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। ড. শাহদীন মালিক বলেন, গত ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এই ইসি যা করেছে তা গুরুতর অসদাচরণ। তারা আর্থিক অনিয়মও করেছে। রাষ্ট্রপতি এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তাদেরকে অপসারণ করতে পারেন। কোনো সাড়া পাওয়া না গেলে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের যা করা দরকার ছিল আমরা করেছি। এখন সরকার যদি এত সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ পাওয়ার পরেও ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে জনগণ তার বিচার করবে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

ইসির বিরুদ্ধে আর্থিকসহ সুনির্দিষ্ট ৯ অভিযোগ

আপলোড টাইম : ১০:২৬:৩৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২০

রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ চেয়েছেন বিশিষ্ট নাগরিকরা; ইসিকে সরাতে জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি

সমীকরণ প্রতিবেদন:
বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বিরুদ্ধে গুরুতর আর্থিক দুর্নীতি, অনিয়ম, অসদাচরণ, সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের রক্ত ও বঙ্গবন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ এনেছেন দেশের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে এই ইসিকে অপসারণে রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদের কাছে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা চিঠি দিয়ে দাবি জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, গত ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এই ইসি যা করেছে তা গুরুতর অসদাচরণ। সাংবিধানিক পদে থেকে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতি করা হয়েছে তা অতীতের সব রেকর্ডকে হার মানিয়েছে। যদি তাদের আত্মসম্মানবোধ থাকে তাহলে তারা পদত্যাগ করবেন বলে বিশিষ্ট নাগরিকরা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তারা রাষ্ট্রপতির সুবিধামতো সময়ে তার সাথে সরাসরি সাক্ষাতেরও সময় চেয়েছেন ওই চিঠিতে।
গত ১৪ ডিসেম্বর বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির দফতরে বিশিষ্ট নাগরিকদের দাবিসংবলিত চিঠি দেয়ার পর গতকাল শনিবার ওয়েবিনারে নাগরিকসমাজ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জাতির কাছে তাদের সেই দাবিগুলো প্রকাশ করে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতিকে দেয়া চিঠিটি পড়ে শোনান সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) দিলীপ সরকার। ওয়েবিনারে সংযুক্ত থেকে বক্তব্য রাখেনÑ সুজন সম্পাদক অধ্যাপক ড. বদিউল আলম মজুমদার, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মণ্ডল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমদ প্রমুখ।
রাষ্ট্রপতিকে দেয়া চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৬(৩) অনুচ্ছেদে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল (কাউন্সিল) গঠনের বিধান রয়েছে। সংবিধানের ৯৬(৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যে ক্ষেত্রে কাউন্সিল অথবা অন্য কোনো সূত্র হতে প্রাপ্ত তথ্যে রাষ্ট্রপতির এইরূপ বুঝবার কারণ থাকে যে, কোনো বিচারক (খ) গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হতে পারেন, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করতে ও তার তদন্ত ফল জ্ঞাপন করবার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন। চিঠিতে বলা হয়, সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিধান রয়েছে। ১১৮(৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদ কর্তৃক প্রণীত যেকোনো আইনের বিধানাবলি-সাপেক্ষে নির্বাচন কমিশনারদের কর্মের শর্তাবলি রাষ্ট্রপতি আদেশের দ্বারা যেরূপ নির্ধারণ করবেন সেইরূপ হবে। তবে শর্ত থাকে যে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক যেরূপ পদ্ধতি ও কারণে অপসারিত হতে পারেন, সেরূপ পদ্ধতিতে ও কারণ ব্যতীত কোনো নির্বাচন কমিশনার অপসারিত হবেন না। চিঠিতে বলা হয়, কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সদস্যগণ ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বিভিন্নভাবে গুরুতর অসদাচরণে লিপ্ত হয়েছেন, যা অভিশংসনযোগ্য অপরাধ। একইভাবে তারা বিভিন্নভাবে আইন ও বিধিবিধান লঙ্ঘন করে গুরুতর অসদাচরণ করে চলেছেন। চিঠিতে আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মসহ কমিশনের গুরুতর অসদাচরণের অন্য কয়েকটি ক্ষেত্র চিহ্নিহ্নত করা হয়।
ইসির বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি এবং অর্থসংশ্লিষ্ট গুরুতর অসদাচারণ তিনটি হলো, বিশেষ বক্তা হিসেবে বক্তৃতা দেয়ার নামে দুই কোটি টাকার মতো আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম, নির্বাচন কমিশনের কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় চার কোটি আট লাখ টাকার অসদাচরণ ও অনিয়ম এবং নিয়মবহির্ভূতভাবে তিনজন কমিশনারের তিনটি গাড়ি ব্যবহারজনিত আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম। এ ছাড়া অন্যান্য গুরুতর অসদাচরণ ও ছয়টি অনিয়ম হলোÑ ইভিএম ক্রয় ও ব্যবহার, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম, খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম এবং সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম। চিঠিতে আরও বলা হয়, এসব গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিনীত আবেদন জানানো হয়। একই সাথে অন্যান্য অসদাচারণ ও অনিয়মের অভিযোগগুলো বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও অন্যান্য সংস্থার প্রাথমিক অনুসন্ধানের ভিত্তিতে এবং প্রমাণসাপেক্ষে তদন্তের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে প্রেরণের অনুরোধ জানানো হয়। অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে সামনাসামনি অবগত করার জন্য রাষ্ট্রপতির সুবিধামতো সময়ে একটি সাক্ষাতের আয়োজনের জন্য তাকে অনুরোধ জানানো হয়।
চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেনÑ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান, ড. আকবর আলি খান, অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ও রাশেদা কে চৌধুরী, মানবাধিকার কর্মী ড. হামিদা হোসেন, সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম, মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির, সেন্ট্রাল উইমেন্স ভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক পারভীন হাসান, টিআইবির ড. ইফতেখারুজ্জামান, অধ্যাপক আহমেদ কামাল, অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমদ, অ্যাডভোটেক জেড আই খান পান্না, ড. শাহদীন মালিক, অধ্যাপক সি আর আবরার, আলোকচিত্র শিল্পী ড. শহিদুল আলম, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মণ্ডল, স্থপতি মোবাশ্বের হাসান, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, ব্রতির শারমিন মুরশিদ, অ্যাডভোকেট জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, গোলাম মোর্তজা প্রমুখ।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এই ইসির উচিত পদত্যাগ করা। তারা মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের রক্ত, বঙ্গবন্ধু ও সংবিধানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাই তাদেরকে অপসারণ করে বিচারের আওতায় আনা জরুরি। তিনি বলেন, এই কমিশনের আমলে দেশে নির্বাচনব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে, চলছে নির্বাচন নির্বাচন খেলা। এই খেলা বন্ধ করতে হলে তাদের অপসারণ করে বিচারের আওতায় আনার কোনো বিকল্প নেই। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন যেভাবে অনিয়ম করছে তা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানকে বর্তমান কমিশন অবমাননা ও কলঙ্কিত করেছে। তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের উচিত পদত্যাগ করা, নিজেদের আত্মসম্মানবোধের পরিচয় দেয়া।
আবদুল লতিফ মণ্ডল বলেন, বিশিষ্ট নাগরিকদের এই চিঠি নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাবেন পরামর্শের জন্য। কিন্তু বাস্তবে যা দেখেছি সেটি আদৌ প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবে কি না! তাই উচিত হবে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও এই ধরনের দাবি ও অনুরোধ সম্বলিত চিঠি আমাদের পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা। অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, সংবিধান অনুযায়ী যে দিন নির্বাচন হওয়ার কথা, সে দিন নির্বাচন হতে হবে। কিন্তু এই কমিশনের আমলে তা হয়নি। তিনি বলেন, এই নির্বাচন কমিশনের আমলে যা ঘটেছে তা নজিরবিহীন। যে নির্বাচন যে দিন হওয়ার কথা ছিল, নির্বাচন হয়েছে তার আগের দিন রাতে। নির্বাচন দিনে হওয়ার কথা ছিল, হয়ে গেছে আগের দিন রাতে। ফলে এই কমিশন গুরুতরভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। ড. শাহদীন মালিক বলেন, গত ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এই ইসি যা করেছে তা গুরুতর অসদাচরণ। তারা আর্থিক অনিয়মও করেছে। রাষ্ট্রপতি এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তাদেরকে অপসারণ করতে পারেন। কোনো সাড়া পাওয়া না গেলে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের যা করা দরকার ছিল আমরা করেছি। এখন সরকার যদি এত সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ পাওয়ার পরেও ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে জনগণ তার বিচার করবে।