ইপেপার । আজমঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

আমদানি পণ্যের মূল্যে আগুনের আঁচ

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৪:৩৯:৪২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২৩
  • / ৯ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ প্রতিবেদন:
ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও সংকটের কারণে আমদানিকৃত খাদ্যসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের মূল্যে আগুনের আঁচ লেগেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বেশকিছু পণ্যের দাম কমলেও দেশে এসব জিনিসের মূল্য ঊচ্চলাফে বাড়ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী দুই-এক মাসের মধ্যেই বিদেশ থেকে আমদানি করা বেশিরভাগ পণ্যই সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। বাজার পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা করছেন পর্যবেক্ষকরা। এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুধু বিদেশ থেকে আনা জিনিসপত্রই নয়, দেশে উৎপাদনকৃত সব ভোগ্যপণ্যের দামও আকাশচুম্বি হয়ে উঠতে পারে। তাদের ভাষ্য, তারা শিল্প-কারখানার জন্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ও প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আনতে পারছেন না। বিশেষ করে অনিয়মিত ব্যবহার্য জিনিসপত্র তৈরির কাঁচামালের এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) একরকম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পগুলোও খুঁড়িয়ে চললেও ছোট শিল্প-কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এতে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিল্পমালিকরাও বিষয়টি স্বীকার করে জানান, ডলার সংকটের কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অনিয়মিত ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের এলসি খুলতে গড়িমসি করছে। ফলে বিপুলসংখ্যক শিল্প-কারখানা কাঁচামাল সংকটে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে পারছে না। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে এরই মধ্যে অনেকে কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে। কেউ কেউ শিল্প-কারখানার অর্ধেক কিংবা এক-তৃতীয়াংশ ইউনিট বন্ধ করে দিয়েছে। এতে চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতি দিন দিন বাড়ছে। আগামীতে পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকবে- তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন শিল্পমালিকরা। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনও এ বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। সরকারি এই সংস্থাটির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, দেশে ডলারের দাম ও সংকট না কমলে মার্চ-এপ্রিল নাগাদ আমদানিকৃত পণ্যের সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়বে। এতে বিদেশ থেকে আনা অনিয়মিত ও নিত্য ভোগ্যপণ্যের দাম এক-তৃতীয়াংশ বাড়বে। এমনকি এই কোটাও ছাড়িয়ে যেতে পারে।
সম্প্রতি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় ট্যারিফ কমিশনের উপ-পরিচালক মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, এপ্রিলের দিকে আমদানি করা পণ্যের দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বাড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম না বাড়লেও ডলার সংকটের কারণে দেশে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। এদিকে ব্যবসায়ী নেতাদের ভাষ্য, স্বাভাবিকভাবে এলসি খোলা না গেলে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়বে- এটাই স্বাভাবিক। তারা জানান, আমদানি না হওয়ায় আদা-রসুনের ॥হদাম বেড়েছে। ভারত থেকে রসুন আমদানি বন্ধ ছিল। চীন থেকেও আমদানি হচ্ছে না। আদা-রসুন আমদানিতে এলসি স্বাভাবিক না হলে দাম আরও বাড়বে। বাজার স্বাভাবিক রাখতে হলে, এলসি জটিলতা কাটানোর পাশাপাশি শুল্ক প্রত্যাহার করে পণ্য আমদানি বাড়ানোর পরামর্শ দেন তারা। ব্যবসায়ী নেতাদের অভিযোগ, দেশে কোনো কিছুর দাম বাড়লেই বাজার সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয়। অথচ এর নেপথ্য কারণ খুঁজে দেখা হয় না। এ ছাড়া বাজার মনিটরিংয়েও শক্তিশালী কোনো টিম নেই। ফলে সাধারণ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাদের ভাষ্য, অসাধু ব্যবসায়ীদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। তবে তারা প্রভাবশালী। এ কারণেই তারা যে কোনো সময় বাজার অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। তাই গণহারে ব্যবসায়ীদের দোষারোপ না করে ওই সিন্ডিকেটকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
এদিকে, আমদানিকারকরা জানান, ডলারের দাম বাড়ায় এমনিতেই তারা গ্যাঁড়াকলে পড়েছেন। এর ওপর কিছু কিছু পণ্যের শুল্ক-কর বাড়ানোয় তা ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের একজন আমদানিকারকের ভাষ্য, গত বছরের জুন মাসে দেশে যেসব চিনি বাজারজাত হয়, এর কাঁচামাল টনপ্রতি ৪৪৮ ডলার দরে বিশ্ববাজার থেকে আনা হয়। তখন তারা প্রতি কেজিতে গড়ে ১৯ টাকা শুল্ক-কর পরিশোধ করেছেন। কিন্তু নভেম্বর মাসে বাজারজাত হওয়া চিনির কাঁচামালে টনপ্রতি দাম পড়ে ৪৪৫ ডলার। কম দামে কেনার পরও প্রতি কেজি চিনিতে জুন মাসের তুলনায় ছয় টাকা বাড়তি শুল্ক-কর দিতে হয়েছে। এতে প্রতি কেজি চিনিতে শুল্ক-কর বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ টাকা। এ ছাড়া জুন মাসে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৬ টাকা ৭৩ পয়সা। এরপর দফায় দফায় ডলারের দাম বাড়ানো হয়েছে। নভেম্বরে ডলারের দাম বাড়িয়ে ১০৬ টাকা ১৭ পয়সায় নির্ধারণ করা হয়। এই দাম ধরেই কাস্টমস বিভাগ আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক-কর নির্ধারণ করে টাকায়। এতে পণ্যের করভার বেড়েছে। যে কারণে কম দামে পণ্য কেনার পরও ব্যবসায়ীদের রাজস্ব বেশি দিতে হচ্ছে। আমদানিকারকদের ভাষ্য, চিনির মতো যেসব ভোগ্যপণ্যে করভার রয়েছে, সেগুলোর প্রতিটিতে এখন আগের তুলনায় শুল্ক-কর বেশি দিতে হচ্ছে। কোম্পানিগুলো আপাতত এই বাড়তি শুল্ক-কর পরিশোধ করলেও যা পরে ক্রেতাদের ঘাড়েই চাপছে। চিনির মতো বেশকিছু আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ারও বড় কারণ ডলারের উচ্চ দামজনিত শুল্ক-কর।
অন্যদিকে ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র খুলতে হিমশিম খাওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরেন আমদানিকারকরা। তারা জানান, কাঠখড় পুড়িয়ে যারা ঋণপত্র খুলতে পারছেন, তাদের বাড়তি কমিশন দিতে হচ্ছে। ঋণপত্র খোলার জন্য বিদেশি ব্যাংকের কনফার্মেশন (নিশ্চিতকরণ) পাওয়ার খরচও এখন আগের তুলনায় দুই-তিন গুণ বেশি। এ প্রসঙ্গে টি কে গ্রুপের পরিচালক মো. শফিউল আথহার তাছলিম বলেন, ঋণপত্র খোলায় বাড়তি কমিশন থেকে শুরু করে নিত্যপণ্য বাজারজাত করা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই খরচ বেড়েছে। ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে করভার বেড়েছে। এ ছাড়া উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কারণেও খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহণ খরচও ঊর্ধ্বমুখী। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার কিছুটা স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে। সে তুলনায় ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে দেশে আমদানি ব্যয় বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে রেখে জরুরি খাদ্যপণ্যের আমদানি ও সরবরাহ যাতে ঠিক থাকে, সেটাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কারণ, বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক সময়ের মতো পণ্য সরবরাহ, চাহিদা পূরণ ও আমদানি ব্যয় মেটানোর ক্ষেত্রে রাশ টানার সময় এসেছে। আবার বাজার ব্যবস্থাপনায় নজরদারি বাড়ানো উচিত, যাতে আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে বাজার মূল্যের পার্থক্য খুব বেশি না হয়। সরকারের নীতিনির্ধারকদের দাবি, ডলারের দাম ও সংকটের কারণে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রেখে পরিস্থিতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তা পর্যালোচনা করছে। এরই মধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় ভোজ্যতেল ও চিনিসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের এলসি মার্জিন কমিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশ দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, বাজারে যাতে পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি এবং দাম সহনীয় থাকে, এর জন্য ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে নগদ মার্জিনের হার ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। যাতে ঋণপত্র খোলা সহজ ও ব্যয় কমে আসে। বাজার মূল্যে স্থিতিশীল থাকে এবং বাজারে যথেষ্ট পণ্য সরবারহ থাকে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে দেশে দেশে খাদ্যের দাম বেড়ে গেছে। এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্যের আমদানি বাড়াতে হচ্ছে। এতে দামও বেড়েছে। যাতে বাজারে খাদ্য সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে, এ জন্য আগে থেকে সরকার বিভিন্ন রকম উদ্যোগ নিচ্ছে। এই সার্কুলার এরই অংশ।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আমদানি পণ্যের মূল্যে আগুনের আঁচ

আপলোড টাইম : ০৪:৩৯:৪২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২৩

সমীকরণ প্রতিবেদন:
ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও সংকটের কারণে আমদানিকৃত খাদ্যসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের মূল্যে আগুনের আঁচ লেগেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বেশকিছু পণ্যের দাম কমলেও দেশে এসব জিনিসের মূল্য ঊচ্চলাফে বাড়ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী দুই-এক মাসের মধ্যেই বিদেশ থেকে আমদানি করা বেশিরভাগ পণ্যই সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। বাজার পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা করছেন পর্যবেক্ষকরা। এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুধু বিদেশ থেকে আনা জিনিসপত্রই নয়, দেশে উৎপাদনকৃত সব ভোগ্যপণ্যের দামও আকাশচুম্বি হয়ে উঠতে পারে। তাদের ভাষ্য, তারা শিল্প-কারখানার জন্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ও প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আনতে পারছেন না। বিশেষ করে অনিয়মিত ব্যবহার্য জিনিসপত্র তৈরির কাঁচামালের এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) একরকম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পগুলোও খুঁড়িয়ে চললেও ছোট শিল্প-কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এতে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিল্পমালিকরাও বিষয়টি স্বীকার করে জানান, ডলার সংকটের কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অনিয়মিত ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের এলসি খুলতে গড়িমসি করছে। ফলে বিপুলসংখ্যক শিল্প-কারখানা কাঁচামাল সংকটে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে পারছে না। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে এরই মধ্যে অনেকে কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে। কেউ কেউ শিল্প-কারখানার অর্ধেক কিংবা এক-তৃতীয়াংশ ইউনিট বন্ধ করে দিয়েছে। এতে চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতি দিন দিন বাড়ছে। আগামীতে পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকবে- তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন শিল্পমালিকরা। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনও এ বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। সরকারি এই সংস্থাটির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, দেশে ডলারের দাম ও সংকট না কমলে মার্চ-এপ্রিল নাগাদ আমদানিকৃত পণ্যের সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়বে। এতে বিদেশ থেকে আনা অনিয়মিত ও নিত্য ভোগ্যপণ্যের দাম এক-তৃতীয়াংশ বাড়বে। এমনকি এই কোটাও ছাড়িয়ে যেতে পারে।
সম্প্রতি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় ট্যারিফ কমিশনের উপ-পরিচালক মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, এপ্রিলের দিকে আমদানি করা পণ্যের দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বাড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম না বাড়লেও ডলার সংকটের কারণে দেশে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। এদিকে ব্যবসায়ী নেতাদের ভাষ্য, স্বাভাবিকভাবে এলসি খোলা না গেলে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়বে- এটাই স্বাভাবিক। তারা জানান, আমদানি না হওয়ায় আদা-রসুনের ॥হদাম বেড়েছে। ভারত থেকে রসুন আমদানি বন্ধ ছিল। চীন থেকেও আমদানি হচ্ছে না। আদা-রসুন আমদানিতে এলসি স্বাভাবিক না হলে দাম আরও বাড়বে। বাজার স্বাভাবিক রাখতে হলে, এলসি জটিলতা কাটানোর পাশাপাশি শুল্ক প্রত্যাহার করে পণ্য আমদানি বাড়ানোর পরামর্শ দেন তারা। ব্যবসায়ী নেতাদের অভিযোগ, দেশে কোনো কিছুর দাম বাড়লেই বাজার সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয়। অথচ এর নেপথ্য কারণ খুঁজে দেখা হয় না। এ ছাড়া বাজার মনিটরিংয়েও শক্তিশালী কোনো টিম নেই। ফলে সাধারণ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাদের ভাষ্য, অসাধু ব্যবসায়ীদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। তবে তারা প্রভাবশালী। এ কারণেই তারা যে কোনো সময় বাজার অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। তাই গণহারে ব্যবসায়ীদের দোষারোপ না করে ওই সিন্ডিকেটকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
এদিকে, আমদানিকারকরা জানান, ডলারের দাম বাড়ায় এমনিতেই তারা গ্যাঁড়াকলে পড়েছেন। এর ওপর কিছু কিছু পণ্যের শুল্ক-কর বাড়ানোয় তা ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের একজন আমদানিকারকের ভাষ্য, গত বছরের জুন মাসে দেশে যেসব চিনি বাজারজাত হয়, এর কাঁচামাল টনপ্রতি ৪৪৮ ডলার দরে বিশ্ববাজার থেকে আনা হয়। তখন তারা প্রতি কেজিতে গড়ে ১৯ টাকা শুল্ক-কর পরিশোধ করেছেন। কিন্তু নভেম্বর মাসে বাজারজাত হওয়া চিনির কাঁচামালে টনপ্রতি দাম পড়ে ৪৪৫ ডলার। কম দামে কেনার পরও প্রতি কেজি চিনিতে জুন মাসের তুলনায় ছয় টাকা বাড়তি শুল্ক-কর দিতে হয়েছে। এতে প্রতি কেজি চিনিতে শুল্ক-কর বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ টাকা। এ ছাড়া জুন মাসে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৬ টাকা ৭৩ পয়সা। এরপর দফায় দফায় ডলারের দাম বাড়ানো হয়েছে। নভেম্বরে ডলারের দাম বাড়িয়ে ১০৬ টাকা ১৭ পয়সায় নির্ধারণ করা হয়। এই দাম ধরেই কাস্টমস বিভাগ আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক-কর নির্ধারণ করে টাকায়। এতে পণ্যের করভার বেড়েছে। যে কারণে কম দামে পণ্য কেনার পরও ব্যবসায়ীদের রাজস্ব বেশি দিতে হচ্ছে। আমদানিকারকদের ভাষ্য, চিনির মতো যেসব ভোগ্যপণ্যে করভার রয়েছে, সেগুলোর প্রতিটিতে এখন আগের তুলনায় শুল্ক-কর বেশি দিতে হচ্ছে। কোম্পানিগুলো আপাতত এই বাড়তি শুল্ক-কর পরিশোধ করলেও যা পরে ক্রেতাদের ঘাড়েই চাপছে। চিনির মতো বেশকিছু আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ারও বড় কারণ ডলারের উচ্চ দামজনিত শুল্ক-কর।
অন্যদিকে ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র খুলতে হিমশিম খাওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরেন আমদানিকারকরা। তারা জানান, কাঠখড় পুড়িয়ে যারা ঋণপত্র খুলতে পারছেন, তাদের বাড়তি কমিশন দিতে হচ্ছে। ঋণপত্র খোলার জন্য বিদেশি ব্যাংকের কনফার্মেশন (নিশ্চিতকরণ) পাওয়ার খরচও এখন আগের তুলনায় দুই-তিন গুণ বেশি। এ প্রসঙ্গে টি কে গ্রুপের পরিচালক মো. শফিউল আথহার তাছলিম বলেন, ঋণপত্র খোলায় বাড়তি কমিশন থেকে শুরু করে নিত্যপণ্য বাজারজাত করা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই খরচ বেড়েছে। ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে করভার বেড়েছে। এ ছাড়া উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কারণেও খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহণ খরচও ঊর্ধ্বমুখী। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার কিছুটা স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে। সে তুলনায় ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে দেশে আমদানি ব্যয় বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে রেখে জরুরি খাদ্যপণ্যের আমদানি ও সরবরাহ যাতে ঠিক থাকে, সেটাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কারণ, বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক সময়ের মতো পণ্য সরবরাহ, চাহিদা পূরণ ও আমদানি ব্যয় মেটানোর ক্ষেত্রে রাশ টানার সময় এসেছে। আবার বাজার ব্যবস্থাপনায় নজরদারি বাড়ানো উচিত, যাতে আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে বাজার মূল্যের পার্থক্য খুব বেশি না হয়। সরকারের নীতিনির্ধারকদের দাবি, ডলারের দাম ও সংকটের কারণে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রেখে পরিস্থিতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তা পর্যালোচনা করছে। এরই মধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় ভোজ্যতেল ও চিনিসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের এলসি মার্জিন কমিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশ দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, বাজারে যাতে পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি এবং দাম সহনীয় থাকে, এর জন্য ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে নগদ মার্জিনের হার ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। যাতে ঋণপত্র খোলা সহজ ও ব্যয় কমে আসে। বাজার মূল্যে স্থিতিশীল থাকে এবং বাজারে যথেষ্ট পণ্য সরবারহ থাকে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে দেশে দেশে খাদ্যের দাম বেড়ে গেছে। এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্যের আমদানি বাড়াতে হচ্ছে। এতে দামও বেড়েছে। যাতে বাজারে খাদ্য সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে, এ জন্য আগে থেকে সরকার বিভিন্ন রকম উদ্যোগ নিচ্ছে। এই সার্কুলার এরই অংশ।