ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

আন্দোলনকারীদের ঠেকাতে জলকামান টিয়ার শেল, লাঠি

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:৪১:৩৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৯ এপ্রিল ২০১৮
  • / ৪২৩ বার পড়া হয়েছে

কোটা সংস্কারের দাবিতে শাহবাগে সমাবেশ সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের ডাক
সমীকরণ ডেস্ক: সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কারসহ পাঁচ দফা দাবিতে প্রায় ছয় ঘণ্টা রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরুদ্ধ করে রাখার পর চাকরিপ্রত্যাশী হাজারো তরুণকে লাঠিপেটা, রাবার বুলেট, জলকামান ও মুহুর্মুহু কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে সরিয়ে দিয়েছে পুলিশ। এতে শতাধিক আহত হয়েছে বলে দাবি আন্দোলনকারীদের। ব্যাপক পুলিশি অ্যাকশনের প্রতিবাদে আজ সোমবার থেকে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। তবে শাহবাগে পুলিশের অ্যাকশনে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হলেও একই সময় দেশের অন্যান্য জেলায়ও গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করে জেলাপর্যায়ের চাকরিপ্রত্যাশী তরুণ আন্দোলনকারীরা। রাত ১টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন এলাকা ও উপাচার্যের বাসভবনের সামনে কয়েক হাজার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী অবস্থান করছিল। গতকাল রবিবার দুপুর আড়াইটা থেকে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরুদ্ধ করে বিক্ষোভ করার সময় আন্দোলনকারীদের পুলিশ সরে যেতে বললেও তারা অনড় ছিল। জাতীয় সংসদের অধিবেশন থেকে এই আন্দোলনের দাবির ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত তারা অবরোধ চালিয়ে যাবে বলেও ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সন্ধ্যার পরই আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। রাত ৮টার দিকে পুলিশের ব্যাপক অ্যাকশনে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় আন্দোলনকারীরা। পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ও লাঠিপেটায় আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি কর্তব্যরত কয়েকজন সংবাদকর্মীও আহত হয়েছেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে অন্তত পাঁচজনকে আটক করেছে। তাদের থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। একই দাবিতে গতকাল ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে কর্মসূচি পালন করেছে ময়মনসিংহের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এতে ঢাকার সঙ্গে ময়মনসিংহের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। রংপুরে গণপদযাত্রা ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।


সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে প্রথম কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে শাহবাগ মোড় থেকে আন্দোলনকারীদের সরানোর চেষ্টা করে পুলিশ। এরপর ব্যাপকভাবে লাঠিপেটা শুরু হয়। পৌনে ৮টার দিকে শাহবাগ মোড় থেকে পুলিশ একযোগে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে। একই সঙ্গে চলে লাঠিপেটা। এ সময় আন্দোলনকারীরা চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে অবস্থান নেয়। শাহবাগ মোড়ের দক্ষিণ পাশে জাতীয় গণগ্রন্থাগারের উল্টো দিকে শাহবাগ থানার ফটকের সামনে দাঁড়িয়েও পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে।
একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা শাহবাগ মোড়সংলগ্ন পুলিশ বক্সে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশি হামলার মুখে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) সংলগ্ন রাজু ভাস্কর্যের দিকে দৌড় দেয়। লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাসের শেলের আঘাতে গণগ্রন্থাগারের সামনে ঢাকা ট্রিবিউনের সংবাদকর্মী ফাহিম রেজা নূর, প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আসিফুর রহমান, ইউএনবির প্রতিনিধি ইমরান হোসেন, বাসসের প্রতিনিধি কামরুজ্জামান রেজা এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিনিধি তারেক হাসান নির্ঝর ও কালের কণ্ঠ’র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মেহেদী হাসান আহত হন।
বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুনের দাবি, পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ও লাঠিপেটায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। তবে এ ঘটনায় ব্যারিস্টার আওলাদ হোসেন (৫০), বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আকরাম হোসেন (২৬), মো. রফিক (২৪), রাফি আলামিন (২২), রাজ (২৩), সোহেল (২৫), ওমর ফারুক (২৫), খোরশেদ (২৬), মাহিম (২২), আসলামসহ (২৩) বেশ কয়েকজন আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আহতদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবুবকর সিদ্দিকের (২২) চোখের কোণে রাবার বুলেট লেগে জখমের সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া বিজয় ৭১ হলের আইইআর বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের বুকে রাবার বুলেটে জখমের সৃষ্টি হয়। তাঁরাও ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসা নিয়েছেন। ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া জানান, হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে অনেকে চলে গেছে, আবার কেউ কেউ চিকিৎসা নিচ্ছে। তাদের কেউ গুরুতর আহত নয়।


ঢামেক হাসপাতালের (ক্যাজুয়ালটি) জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. আলাউদ্দিন জানান, আহতরা সবাই আশঙ্কামুক্ত। গতকাল রাত ১২টা পর্যন্ত টিএসসি ও কবি কাজী নজরুল ইসলামের মাজারের সামনের সড়কে আন্দোলনকারীরা বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করছিল। তখনো শাহবাগ মোড়ে থেকে থেকে পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ার শব্দ পাওয়া যায়। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। চারুকলা ইনস্টিটিউটের ভেতরেও পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে, এতে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের প্রস্তুতিতে বিঘ্ন ঘটে। পুলিশি অ্যাকশনে রাত ৯টার পর প্রায় ফাঁকা হয়ে যায় শাহবাগ মোড় এলাকা। ডিএমপির রমনা জোনের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার রাতে বলেন, ‘চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলনে বাধা দেওয়া হয়নি। জনদুর্ভোগ যাতে না হয়, সে জন্য তাদের রাস্তার মাঝ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ পুলিশি অ্যাকশনের আগে সরেজমিনে দেখা গেছে, আন্দোলনকারীদের অনেকের হাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি, হাতে হাতে নানা রঙের প্ল্যাকার্ড, তাতে লেখা ‘১০ শতাংশের বেশি কোটা নয়’, ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় কোটা বৈষম্যের ঠাঁই নাই’; কোনো কোনো প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বৈষম্য থাকবে না’, আবার কোনোটায় লেখা ‘জেগেছে তরুণ জেগেছে দেশ, কোটামুক্ত বাংলাদেশ।’ তারা সেøাগান দেয়, ‘কোটা প্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক।’ সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের মূল দাবিতে পূর্বঘোষিত গণপদযাত্রা দুপুরেই রূপ নিয়েছিল অবরোধে। চাকরিপ্রত্যাশীরা শাহবাগ চত্বর দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। শাহবাগ থানার সামনে বিআরটিসির একটি দোতলা বাস রেখে দোয়েল চত্বরসহ বিভিন্ন দিক হয়ে আসা যানবাহন আটকে দেয় আন্দোলনকারীরা। শাহবাগ হয়ে চলাচল করতে না পারায় বিভিন্ন দিক থেকে আসা শাহবাগমুখী যানবাহনগুলো যার যার মতো ফেরত যাওয়ার চেষ্টা করে। তাতে মৎস্য ভবন, হাইকোর্ট মোড়, টিএসসি, রোকেয়া হলের সামনের সড়ক, রূপসী বাংলা মোড়, মিন্টো রোডসহ বিভিন্ন সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়। বিকেলে কোটা সংস্কারের বিষয়ে জাতীয় সংসদের অধিবেশন থেকে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত অবরোধ অব্যাহত থাকবে বলে ঘোষণা দেন আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসান আল মামুন। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী দুপুর ২টায় ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’-এর ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হয়। সমাবেত দু-তিন হাজার আন্দোলনকারী একটি পদযাত্রা নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে দিয়ে নীলক্ষেত হয়ে কাঁটাবন দিয়ে শাহবাগে এসে অবস্থান নেয়। পুলিশ তাদের কয়েক দফা সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছে এবং তাদের ওপর হামলা হলেও তারা স্থান ত্যাগ করবে না বলে পুলিশ কর্মকর্তাদের জানায়। অবরোধের কারণে ভোগান্তিতে পড়া যাত্রী ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুল মালেক বলেন, ‘আন্দোলনের ফলে আমাদের গাড়ি মৎস্য ভবনের কাছে থেমে যায়। হেঁটে পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। তবে এতে কোনো কষ্ট নাই। এই আন্দোলনকে আমরা সমর্থন জানাই। আমরাও চাই কোটাব্যবস্থার সংস্কার হোক।’
প্রসঙ্গত, কোটা সংস্কারসহ পাঁচ দফা দাবিতে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও জেলা পর্যায়ে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছে চাকরিপ্রত্যাশীরা। তাদের দাবিগুলো হলো সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন কোটা ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নিয়ে আসা, কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে শূন্যপদে মেধাতালিকা থেকে নিয়োগ দেওয়া, কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা না নেওয়া, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণ করা এবং চাকরি নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার না করা। কোটা সংস্কার আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা গতকাল গণপদযাত্রার ডাক দিয়েছিল। পরে এটি অবরোধে রূপ নেয়।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আন্দোলনকারীদের ঠেকাতে জলকামান টিয়ার শেল, লাঠি

আপলোড টাইম : ১০:৪১:৩৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৯ এপ্রিল ২০১৮

কোটা সংস্কারের দাবিতে শাহবাগে সমাবেশ সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের ডাক
সমীকরণ ডেস্ক: সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কারসহ পাঁচ দফা দাবিতে প্রায় ছয় ঘণ্টা রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরুদ্ধ করে রাখার পর চাকরিপ্রত্যাশী হাজারো তরুণকে লাঠিপেটা, রাবার বুলেট, জলকামান ও মুহুর্মুহু কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে সরিয়ে দিয়েছে পুলিশ। এতে শতাধিক আহত হয়েছে বলে দাবি আন্দোলনকারীদের। ব্যাপক পুলিশি অ্যাকশনের প্রতিবাদে আজ সোমবার থেকে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। তবে শাহবাগে পুলিশের অ্যাকশনে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হলেও একই সময় দেশের অন্যান্য জেলায়ও গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করে জেলাপর্যায়ের চাকরিপ্রত্যাশী তরুণ আন্দোলনকারীরা। রাত ১টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন এলাকা ও উপাচার্যের বাসভবনের সামনে কয়েক হাজার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী অবস্থান করছিল। গতকাল রবিবার দুপুর আড়াইটা থেকে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরুদ্ধ করে বিক্ষোভ করার সময় আন্দোলনকারীদের পুলিশ সরে যেতে বললেও তারা অনড় ছিল। জাতীয় সংসদের অধিবেশন থেকে এই আন্দোলনের দাবির ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত তারা অবরোধ চালিয়ে যাবে বলেও ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সন্ধ্যার পরই আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। রাত ৮টার দিকে পুলিশের ব্যাপক অ্যাকশনে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় আন্দোলনকারীরা। পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ও লাঠিপেটায় আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি কর্তব্যরত কয়েকজন সংবাদকর্মীও আহত হয়েছেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে অন্তত পাঁচজনকে আটক করেছে। তাদের থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। একই দাবিতে গতকাল ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে কর্মসূচি পালন করেছে ময়মনসিংহের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এতে ঢাকার সঙ্গে ময়মনসিংহের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। রংপুরে গণপদযাত্রা ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।


সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে প্রথম কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে শাহবাগ মোড় থেকে আন্দোলনকারীদের সরানোর চেষ্টা করে পুলিশ। এরপর ব্যাপকভাবে লাঠিপেটা শুরু হয়। পৌনে ৮টার দিকে শাহবাগ মোড় থেকে পুলিশ একযোগে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে। একই সঙ্গে চলে লাঠিপেটা। এ সময় আন্দোলনকারীরা চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে অবস্থান নেয়। শাহবাগ মোড়ের দক্ষিণ পাশে জাতীয় গণগ্রন্থাগারের উল্টো দিকে শাহবাগ থানার ফটকের সামনে দাঁড়িয়েও পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে।
একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা শাহবাগ মোড়সংলগ্ন পুলিশ বক্সে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশি হামলার মুখে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) সংলগ্ন রাজু ভাস্কর্যের দিকে দৌড় দেয়। লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাসের শেলের আঘাতে গণগ্রন্থাগারের সামনে ঢাকা ট্রিবিউনের সংবাদকর্মী ফাহিম রেজা নূর, প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আসিফুর রহমান, ইউএনবির প্রতিনিধি ইমরান হোসেন, বাসসের প্রতিনিধি কামরুজ্জামান রেজা এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিনিধি তারেক হাসান নির্ঝর ও কালের কণ্ঠ’র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মেহেদী হাসান আহত হন।
বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুনের দাবি, পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ও লাঠিপেটায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। তবে এ ঘটনায় ব্যারিস্টার আওলাদ হোসেন (৫০), বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আকরাম হোসেন (২৬), মো. রফিক (২৪), রাফি আলামিন (২২), রাজ (২৩), সোহেল (২৫), ওমর ফারুক (২৫), খোরশেদ (২৬), মাহিম (২২), আসলামসহ (২৩) বেশ কয়েকজন আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আহতদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবুবকর সিদ্দিকের (২২) চোখের কোণে রাবার বুলেট লেগে জখমের সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া বিজয় ৭১ হলের আইইআর বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের বুকে রাবার বুলেটে জখমের সৃষ্টি হয়। তাঁরাও ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসা নিয়েছেন। ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া জানান, হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে অনেকে চলে গেছে, আবার কেউ কেউ চিকিৎসা নিচ্ছে। তাদের কেউ গুরুতর আহত নয়।


ঢামেক হাসপাতালের (ক্যাজুয়ালটি) জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. আলাউদ্দিন জানান, আহতরা সবাই আশঙ্কামুক্ত। গতকাল রাত ১২টা পর্যন্ত টিএসসি ও কবি কাজী নজরুল ইসলামের মাজারের সামনের সড়কে আন্দোলনকারীরা বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করছিল। তখনো শাহবাগ মোড়ে থেকে থেকে পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ার শব্দ পাওয়া যায়। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। চারুকলা ইনস্টিটিউটের ভেতরেও পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে, এতে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের প্রস্তুতিতে বিঘ্ন ঘটে। পুলিশি অ্যাকশনে রাত ৯টার পর প্রায় ফাঁকা হয়ে যায় শাহবাগ মোড় এলাকা। ডিএমপির রমনা জোনের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার রাতে বলেন, ‘চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলনে বাধা দেওয়া হয়নি। জনদুর্ভোগ যাতে না হয়, সে জন্য তাদের রাস্তার মাঝ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ পুলিশি অ্যাকশনের আগে সরেজমিনে দেখা গেছে, আন্দোলনকারীদের অনেকের হাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি, হাতে হাতে নানা রঙের প্ল্যাকার্ড, তাতে লেখা ‘১০ শতাংশের বেশি কোটা নয়’, ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় কোটা বৈষম্যের ঠাঁই নাই’; কোনো কোনো প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বৈষম্য থাকবে না’, আবার কোনোটায় লেখা ‘জেগেছে তরুণ জেগেছে দেশ, কোটামুক্ত বাংলাদেশ।’ তারা সেøাগান দেয়, ‘কোটা প্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক।’ সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের মূল দাবিতে পূর্বঘোষিত গণপদযাত্রা দুপুরেই রূপ নিয়েছিল অবরোধে। চাকরিপ্রত্যাশীরা শাহবাগ চত্বর দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। শাহবাগ থানার সামনে বিআরটিসির একটি দোতলা বাস রেখে দোয়েল চত্বরসহ বিভিন্ন দিক হয়ে আসা যানবাহন আটকে দেয় আন্দোলনকারীরা। শাহবাগ হয়ে চলাচল করতে না পারায় বিভিন্ন দিক থেকে আসা শাহবাগমুখী যানবাহনগুলো যার যার মতো ফেরত যাওয়ার চেষ্টা করে। তাতে মৎস্য ভবন, হাইকোর্ট মোড়, টিএসসি, রোকেয়া হলের সামনের সড়ক, রূপসী বাংলা মোড়, মিন্টো রোডসহ বিভিন্ন সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়। বিকেলে কোটা সংস্কারের বিষয়ে জাতীয় সংসদের অধিবেশন থেকে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত অবরোধ অব্যাহত থাকবে বলে ঘোষণা দেন আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসান আল মামুন। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী দুপুর ২টায় ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’-এর ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হয়। সমাবেত দু-তিন হাজার আন্দোলনকারী একটি পদযাত্রা নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে দিয়ে নীলক্ষেত হয়ে কাঁটাবন দিয়ে শাহবাগে এসে অবস্থান নেয়। পুলিশ তাদের কয়েক দফা সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছে এবং তাদের ওপর হামলা হলেও তারা স্থান ত্যাগ করবে না বলে পুলিশ কর্মকর্তাদের জানায়। অবরোধের কারণে ভোগান্তিতে পড়া যাত্রী ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুল মালেক বলেন, ‘আন্দোলনের ফলে আমাদের গাড়ি মৎস্য ভবনের কাছে থেমে যায়। হেঁটে পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। তবে এতে কোনো কষ্ট নাই। এই আন্দোলনকে আমরা সমর্থন জানাই। আমরাও চাই কোটাব্যবস্থার সংস্কার হোক।’
প্রসঙ্গত, কোটা সংস্কারসহ পাঁচ দফা দাবিতে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও জেলা পর্যায়ে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছে চাকরিপ্রত্যাশীরা। তাদের দাবিগুলো হলো সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন কোটা ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নিয়ে আসা, কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে শূন্যপদে মেধাতালিকা থেকে নিয়োগ দেওয়া, কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা না নেওয়া, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণ করা এবং চাকরি নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার না করা। কোটা সংস্কার আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা গতকাল গণপদযাত্রার ডাক দিয়েছিল। পরে এটি অবরোধে রূপ নেয়।