আইনে ‘আটক’ শিক্ষানীতি
- আপলোড টাইম : ১০:৩১:৫৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২১ জানুয়ারী ২০১৯
- / ৩১৫ বার পড়া হয়েছে
সমীকরণ প্রতিবেদন: ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করার কথা ছিল আট বছরের মধ্যে, অর্থাৎ ২০১৮ সাল নাগাদ। কিন্তু নির্ধারিত সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও জাতীয় শিক্ষানীতির বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। তবে এই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে প্রয়োজন ছিল একটি শিক্ষা আইনের। কিন্তু ছয় বছর ধরে নানা জটিলতায় আটকে আছে শিক্ষা আইনও। জাতীয় শিক্ষানীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তিন স্তরবিশিষ্ট শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন। সে অনুযায়ী অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা এবং এর পরবর্তী স্তর হবে উচ্চশিক্ষা। এ ছাড়া দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার লক্ষ্যে স্থায়ী ‘এডুকেশন সার্ভিস কমিশন’ করার প্রস্তাবও আছে শিক্ষানীতিতে। এসবের কোনোটিই এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, গত সরকারের শেষ তিন বছরে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার উদ্যোগ নিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু দুই মন্ত্রণালয়ের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের কারণে সেই উদ্যোগ আর আলোর মুখ দেখেনি। প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত না হওয়ায় ২০০৯ সাল থেকে চালু হওয়া প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষাও চালু আছে। তবে এই পরীক্ষা নিয়ে খুবই চিন্তিত অভিভাবকরা। এতে শিশুদের ওপর অত্যধিক চাপ পড়ছে বলেও মনে করছেন অভিভাবকরা। জানা যায়, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা চালু করতে শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ ও মেরামত, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, বিদ্যালয়ের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির সুরাহা, শিক্ষার্থী স্থানান্তর প্রক্রিয়া, বিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়, আসবাবপত্র ও শিক্ষা উপকরণের বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব হয়নি এখনো। এ ছাড়া বর্তমানে প্রচলিত নি¤œ মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় একীভূত করার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের মধ্যে সমন্বয় করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত সপ্তাহে সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলেন, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপারটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হবে।
শিক্ষাবিদদের মতে, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে অনেক শিক্ষার্থীই বিদ্যালয় ছাড়ে। তবে প্রাথমিক শিক্ষা যদি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হয় তাহলে তারা সে পর্যন্তও পড়বে। তাই ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতিতেও প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে বিষয়টি এখনো সীমাবদ্ধ আছে মন্ত্রণালয়ের কমিটি ও উপকমিটির সভার মধ্যেই।
জানা যায়, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে এখন সবচেয়ে বড় বাধা অদক্ষ শিক্ষক। কারণ বর্তমানে চালু থাকা সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা বেশির ভাগ শিক্ষকই বোঝেন না। ফলে শিক্ষার্থীরাও সৃজনশীল অনুধাবন করতে পারছে না। এত দিন এমপিওভুক্ত স্কুলে টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হতো শিক্ষক। সম্প্রতি বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যদিও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দিতে স্থায়ী এডুকেশন সার্ভিস কমিশন করার কথা বলা আছে শিক্ষানীতিতে।
খসড়া আইনে অসঙ্গতি : জানা যায়, গত বছরের জুন মাসে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের আলোকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ১২ ধরনের পর্যবেক্ষণ দিয়ে তৃতীয়বারের মতো ফেরত পাঠায় শিক্ষা আইনের খসড়া। ওই খসড়ায় নানা অসংগতি এবং বিদ্যমান কয়েকটি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু ধারা-উপধারা থাকায় সেটি ফেরত পাঠানো হয়। শিক্ষাসংক্রান্ত বিদ্যমান সব আইন একত্র করে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে বলেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কিন্তু সে লক্ষ্যে এখনো খুব একটা উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি।
প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করা নিয়ে জটিলতা : গত ২৮ অক্টোবর সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে তখনকার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এখনো প্রস্তুত হতে পারেনি। তাই আমরা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তাদের হাতে ন্যস্ত করতে পারিনি।’ তবে একই দিনে অপর এক অনুষ্ঠানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমরা প্রস্তুত নই, এটা সঠিক নয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রস্তুত আছে। মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিলেই আমরা কাজ শুরু করব।’
তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি সভা হয়েছিল ২০১৬ সালের ১৬ মে। এতে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী। সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, মন্ত্রিসভার পর্যালোচনা ও পরবর্তী সিদ্ধান্ত না পাওয়া পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্তই থাকবে। তবে ওই বছরই উভয় মন্ত্রীর উপস্থিতিতে এক সভায় হঠাৎ করেই প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ওই সিদ্ধান্তের পরপরই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে দায়িত্ব আসে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষার সঙ্গে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা আয়োজনের। তবে একসঙ্গে ৫৫ লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা আয়োজন করতে গিয়ে ‘মহাসাগরে’ পড়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তারা জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা আয়োজনে অপারগতা প্রকাশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় ২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর। ফলে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে বহাল থাকে।
তবে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে ডা. দীপু মনি ও শিক্ষা উপমন্ত্রী হিসেবে মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন দপ্তরপ্রধানদের সঙ্গে বসেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁরা জানছেন। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি গতকাল রবিবার বলেন, ‘শিক্ষা আইন নিয়ে আমরা জানার চেষ্টা করেছি। অনেকখানি কাজ এগিয়েছে। অবশ্যই শিক্ষা আইন হবে। আর শিক্ষানীতি বাস্তবায়নেও আমরা কাজ করব। তবে এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে আমাদের আরো কিছুটা সময় লাগবে।’