৫ শিক্ষার্থী সাময়িক বহিষ্কার, প্রভোস্টকে প্রত্যাহারের নির্দেশ

সমীকরণ প্রতিবেদনঃ
কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীকে পাশবিক ও অমানবিক নির্যাতনের ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী জড়িত শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরীসহ পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করে তাদের সব একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ ছাড়া দেশরতœ শেখ হাসিনা হল প্রভোস্টকে অবিলম্বে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চে এ আদেশ দেন।
পাঁচ শিক্ষার্থী হলেন- ইবি ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা, ছাত্রলীগ কর্মী ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগের তাবাসসুম ইসলাম, আইন বিভাগের একই শিক্ষাবর্ষের ইসরাত জাহান মীম, ফাইন আর্টস বিভাগের হালিমা খাতুন উর্মী ও ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের মোয়াবিয়া। অন্তরা ছাড়া সবাই ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।
আদালত বলেছেন, তদন্ত প্রতিবেদনগুলোর ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়টির আইন ও বিধিবিধান অনুসারে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে। সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত পাঁচ শিক্ষার্থীকে সব ধরনের শিক্ষাকার্যক্রম থেকে ‘সাসপেন্ড’ করতে এবং ক্যাম্পাসের বাইরে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হলো। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের শৃঙ্খলা বিষয়ক কার্যধারার প্রয়োজনে তাদের ডাকা যাবে। এ ছাড়া দু’টি প্রতিবেদন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে সিলগালা করে পাঠানোর আদেশ দিয়ে প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জড়িত শিক্ষার্থী, অবহেলা করা হল প্রশাসনসহ অন্যদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিধি অনুসারে ব্যবস্থা নিয়ে কর্তৃপক্ষের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসা পর্যন্ত ৫ ছাত্রীকে সব শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ও ক্যাম্পাসের বাইরে রাখতে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া ঘটনার সময় নির্যাতিত ছাত্র ফুলপরীর ভিডিও করা চারুকলা বিভাগ ২০২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থী হালিমা আক্তার উর্মির মোবাইল ফোন সংগ্রহ করে ধারণ করা ভিডিও উদ্ধার করে আদালতে দাখিল করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি নির্ভয়ে স্বাভাবিক শিক্ষা জীবন চালিয়ে নিতে তিন দিনের মধ্যে হলে ফুলপরীর জন্য সিট বরাদ্দ দিতে বলা হয়েছে। আর কুষ্টিয়ার এসপি ও পাবনার এসপিসহ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ফুলপরীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। ঘটনার সাক্ষীদেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
আদালত বলেছেন, তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি প্রভোস্ট, হাউজ টিউটরসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে দায়িত্বে অবহেলা খুঁজে পেয়েছে। হল থেকে প্রভোস্টকে অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হলো। প্রভোস্টসহ তাদের সবার বিরুদ্ধে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেবে কর্তৃপক্ষ।
র‌্যাগিংয়ের নামে অমানবিক নির্যাতনের ঘটনায় হাইকোর্টের উদ্বেগ : এ দিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতির নামে কিংবা রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে কিছু উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থী নবাগতদের র‌্যাগিংয়ের নামে অমানবিক নির্যাতন করার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, এ কাজের মাধ্যমে উচ্ছৃঙ্খল ছাত্ররা দলের পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত করছে।
আদালত বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা খবরে দেখা যাচ্ছে, সম্প্রতি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্টভাবে আবাসিক হল ও হোস্টলে কিছু উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থী তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের অপব্যবহার করে অপ্রত্যাশিত ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে। এসব শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরে ঢুকে সাধারণ শিক্ষার্থী বিশেষ করে নবাগতদের নির্যাতন করে। এ ধরনের অবাধ্য ছাত্ররা শিক্ষার মানসম্মত পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করে। এমনকি তাদের দলীয় শৃঙ্খলাও ভঙ্গ করে। এর মাধ্যমে তারা দলের পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত করছে। আদালত আরো বলেন, বিচার তো আমরা করছি না। বিচার করবে বিশ্ববিদ্যালয়, তারা রিপোর্ট পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখে সিদ্ধান্ত দেবে। আমরা উদ্বিগ্ন অন্য সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে। অনেক সময় রাজনৈতিক আশ্রয়ের অপব্যবহার করে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস নষ্ট করে দিচ্ছে। ‘ছাত্র রাজনীতি বন্ধ কর’ এ সব কথাও উঠতে পারে। তবে ছাত্র রাজনীতির যে প্রয়োজন, সেটি আমরা আমাদের ইতিহাস থেকে দেখেছি। কিন্তু এটাকে নষ্ট করার জন্য, ক্ষুণœ করার জন্য অনেকে না বুঝে করে, অনেকে বুঝে করে। এটা থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এ দিন শুনানি শেষে দু’টি তদন্ত প্রতিবেদন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে সিলগালা করে পাঠানোর আদেশ দিয়ে ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জড়িত শিক্ষার্থী, অবহেলা করা হল প্রশাসনসহ অন্যদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিধি অনুসারে ব্যবস্থা নিতে কর্তৃপক্ষের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
আদালত আগামী ৮ মের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও রেজিস্ট্রারকে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন। সে দিন প্রয়োজনীয় আদেশের জন্য তারিখ রেখেছেন আদালত।
আদালত রিটকারি আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, আমরা বিষয়টি মনিটরিংয়ে রাখবো। আপনিও এ বিষয়ে খেয়াল রাখবেন। কোনো সমস্যার উদ্ভব হলে আদালতকে জানাবেন। তখন আমরা প্রয়োজনীয় আদেশ দেবো।
আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন রিটকারী আইনজীবী গাজী মো: মহসীন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। এ ছাড়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে রয়েছেন আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক। এর আগে মঙ্গলবার ওই ঘটনায় করা দু’টি কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযুক্ত ছাত্রলীগের সহসভাপতি অন্তরাসহ অন্তত ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এ ছাড়া হল প্রভোস্টসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চরম ব্যর্থতা ও অবহেলা এবং প্রক্টরের উদাসীনতার কথা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর অভিযোগ পাওয়ার পরও কোনো ব্যবস্থা নেননি বলে বিচারিক তদন্তে অভিযোগ উঠে এসেছে। বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চে এ বিষয়ে দু’টি প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর আদেশের জন্য বুধবার দিন রাখেন। একই সঙ্গে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত আইন ও বিধি সংগ্রহ করতে এবং ইবির কোনো আইনজীবী থাকলে তাকে জানাতে বলা হয়েছে।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, অন্তরা প্রত্যেককে নির্দেশ দেয় প্রত্যেকে যেন ফুলপরীকে একটা একটা চড় মারে। আর লিমা ফুলপরীর মোবাইল কেড়ে নেয় এবং সবাই অন্তরার পা ধরতে ফুলপরীকে বাধ্য করে। এ ছাড়া প্রভোস্ট হলে থাকা অবস্থাতেই অন্তরা, তাবাসসুম, মীম, উর্মি, মোয়াবিয়াসহ অন্যরা ফুলপরীকে হাত ধরে টানাটানি করে হেনস্তা করে। এক পর্যায়ে প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বরাবরে মুচলেকা দিতে বাধ্য করে।
প্রতিবেদনে এ ঘটনায় প্রভোস্ট ড. শামসুল আলম, সহকারী রেজিস্ট্রার আব্দুর রাজ্জাক, কর্মকর্তা হালিমা খাতুন, একজন আয়া, ডাইনিং ম্যানেজার সোহেল রানা, হাউজ টিউটর মোমিতা আক্তার, ইসরাত জাহানদের দায়িত্বে চরম অবহেলা এবং ফুলপরী ইস্যুতে ব্যাপক গাফিলতি ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। তা ছাড়া প্রক্টর শাহাদাত হোসেন আজাদের উদাসীনতার কথাও উল্লেখ করা হয়।
অন্য দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী সানজিদা চৌধুরী অন্তরার নির্দেশে পরিসংখ্যান বিভাগের ২০২১-২০২২ সেশনের শিক্ষার্থী ফুলপরীকে র‌্যাগিং ও শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন করা হয়। এই অমানবিক, পাশবিক, শারীরিক, ন্যক্কারজনক, জঘন্য ঘটনার সাথে সরাসরি চারুকলা বিভাগ ২০২০-২০২১ সেশনের শিক্ষার্থী হালিমা আক্তার উর্মি, আইন বিভাগের ২০২০-২০২১ সেশনের ইসরাত জাহান মীম, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২০-২১ সেশনের তাবাসসুম ইসলাম এবং মোয়াবিয়া জড়িত ছিলেন।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি এ ঘটনায় একজন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও একজন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তার সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। কমিটি করে পরবর্তী সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসককে এ নির্দেশ দেয়া হয়। বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলের পাশাপাশি কয়েক দফা নির্দেশনাসহ এ আদেশ দেন।
দু’কূলই হারাল নির্যাতনকারীরা: ইবির নবীন শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুনকে নির্যাতনের ঘটনায় দু’কূলই হারাল নির্যাতনকারীরা। হাইকোর্টের নির্দেশনার কারণে এক দিকে শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছে না তারা। হল থেকে বহিষ্কার করায় থাকতে পারছে না সেখানেও। অন্য দিকে গতকাল তাদের ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এতে ছাত্র রাজনীতি থেকেও ছিটকে পড়ছে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষরিত চিঠিতে নির্যাতনকারীদের সংগঠন থেকে গতকাল বহিষ্কার করা হয়।