পৃথিবীব্যাপী সুপেয় পানির সংকট ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বর্তমানে দেশের প্রায় সকল স্থানে সুপেয় পানির সংকট রয়েছে। উপকূল অঞ্চলের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততা রয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চল, পাহাড়ী অঞ্চল, খরাপ্রবণ অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। ফলে বছরের সবসময় যথেষ্ট পানি পাওয়া যায় না। পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক ও আয়রন দেখা যাচ্ছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক। এছাড়া পানিতে অদৃশ্য ভাইরাসেরও অস্তিত্ব রয়েছে। যা থেকে প্রতিদিন ডায়রিয়া, আমাশয়ের শিকার হচ্ছে শিশুসহ অসংখ্য নারী-পুরুষ।
পানির এই ভয়াবহ সংকট আমরা নিজেরাই তৈরি করেছি। বলা চলে আমরা নিজেরাই নিজেদের বিপজ্জনক পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছি। সে দিন বেশি দূরে নয়, যেদিন চাইলেও আমরা সহজে নিরাপদ পানি পান করতে পারব না। কারণ নিরাপদ পানির সংস্থান দিন দিন কমে যাচ্ছে। পৃথিবীর ৩ ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল হলেও সুপেয় পানির পরিমাণ মাত্র ১ শতাংশ। বাকি ৯৭ ভাগ সমুদ্রের নোনা জল, যা পানের অযোগ্য। ১ ভাগ বরফ হয়ে জমাটবদ্ধ, অবশিষ্ট ১ ভাগ পৃথিবীর উপরিভাগের খাল, বিল, নদীতে রয়েছে। নানা কারণে ভূ-পৃষ্ঠের পানিও পান করার মতো নয়। ভূ-গর্ভস্থ পানিই আমাদের পানীয় জলের একমাত্র ভরসা। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় হলো আমাদের অপরিণামদর্শী আচরণের কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরও সংকটের মধ্যে পড়ে গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভূ-গর্ভস্থ পানির যথেচ্ছ ব্যবহার। চাষাবাদ, শিল্প-কলকারখানা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও পান করার জন্য ইচ্ছেমতো ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হচ্ছে। এ কারণে ভূ-গর্ভস্থের পানির স্তর অতি দ্রুততার সাথে নিচে নেমে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগেও ৫০-১০০ ফুট নিচে পানি পাওয়া যেত। এখন প্রায় দেশের সকল স্থানে পানির স্তর ২৫০ থেকে ১০০০ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে।
আমরা জানি, ভূ-গর্ভস্থের পানির পরিমাণ অপরিসীম নয়। ভূ-গর্ভস্থের পানির পরিমাণ সীমিত। আমাদের দেশে দিন দিন জনসংখ্যা বাড়ছে, শিল্পায়ন হচ্ছে। এর সাথে সাথে নগরায়নের ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সকলের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিতকরণ পানির অপচয় ও ইচ্ছেমত পানি উত্তোলনের কারণে ইতঃমধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভূ-গর্ভের পানির পরিমাণ ক্রমশ নিঃশেষ হতে চলেছে। অন্যদিকে মাটির উপরে বিষাক্ত ও ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারে মাটি ও মাটির সাথে মিশে প্রতিনিয়ত ভূ-গর্ভস্থের পানি হয়ে যাচ্ছে দূষিত। বর্জ্য পানি ও আবর্জনার কারণে নদী নালা, খাল-বিলের পানির অবস্থাও করুণ। অতিরিক্ত অপচনশীল আবর্জনা ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের কারণে বৃষ্টির পানি পরিশোধিত হয়ে মাটির নিচে যাওয়ার প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
চার দশক আগেও আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ পুকুর, নদী খাল-বিলের পানি খেয়ে জীবন ধারণ করতো। এখন আমাদের অবস্থা এমন যে, মাটির উপরের পানি দূষিত। আবার মাটির নিচের পানিও কমে যাচ্ছে, যেটুকু আছে তাও আবার আমাদের অসচেতনতায় প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে। বলা চলে আমরা নিরাপদ খাবার পানির সবগুলো উৎস হারানোর অবস্থায় উপনীত।
এ সংকট মোকাবিলা করে সকলের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত হওয়া জরুরি। সারা বিশ্বের মানুষকে সচেতন ও উদ্যোগী করার জন্য জাতিসংঘ ১৯৯৩ সাল থেকে বিশ্ব পানি দিবস পালন করে আসছে। ২০২৩ সালে সারাবিশ্বে পানি সংকটকে মোকাবিলা করার জন্য ‘পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করো’ প্রতিপাদ্য করে ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস পালিত হচ্ছে। দৈনিক ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানা গেছে, আমাদের দেশের শতকরা ৫৯ ভাগ মানুষ নিরাপদ খাবার পানি পায়। বাকি ৪১ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৭ কোটি মানুষ নিরাপদ খাবার পানি থেকে বঞ্চিত। জাতিসংঘের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাংলাদেশে সকলের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সকলের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিতকরণে সরকারকে বর্তমানের তুলনায় দ্বিগুণ/তিনগুণ হারে প্রয়োজন অনুযায়ী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি আমাদেরকে পানির অপচয় রোধ করতে হবে। ভূ-পৃষ্ঠের পানির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে, একইসাথে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার হ্রাস করতে হবে। জমিতে ক্ষতিকর কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। ময়লা পানি ও আবর্জনা দিয়ে নদী-নালার পানিকে দূষিত করা চলবে না। শহরে গ্রামে সব জায়গায় ময়লা পানি ও আবর্জনা রাখার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করতে হবে। ব্যবহৃত পানির পুনর্ব্যবহারসহ প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন পদক্ষেপ যত দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে, সমস্যার চিত্র পরিবর্তন তত ত্বরান্বিত হবে। দেশের সকল শিশু, নারী, পুরুষ নিরাপদ পানি পান করার সুযোগ পাবে এবং সকলের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত হবে। আশা করা যায়, বিশ্ব পানি দিবসের অনুষ্ঠানসমূহে অংশগ্রহণকারীরা এ বিষয়ে সচেতন হয়ে প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালনে উদ্যোগী হবেন।
-শাহেদ জামাল, উন্নয়নকর্মী।