সমীকরণ প্রতিবেদন:
কয়েক লাখ তৌহিদী জনতার উপস্থিতিতে আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নামাজের জানাজা গতকাল শনিবার বেলা সোয়া ২টায় হাটহাজারীতে অনুষ্ঠিত হয়। চট্টলার ইতিহাসে স্মরণকালের বৃহৎ এ জানাজায় ইমামতি করেন আল্লামা শফীর বড় ছেলে মাওলানা মো. ইউছুপ। জানাজা শেষে আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে দাফন করা হয় দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার গোরস্থান ‘মাকবরায়ে জামেয়া’য়।
জানাজার সময় মাদরাসা মাঠ, ভবনসমূহ, পৌর বাজার এবং চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়কের প্রায় এক কিলোমিটার লোকে লোকারণ্য হয়ে যাওয়ায় মাদরাসা মাঠ থেকে আল্লামা শাহ আহমদ শফীর লাশ নিয়ে যাওয়া হয় মাদরাসার সামনে পশ্চিম পাশে জেলা পরিষদ ডাকবাংলো চত্বরে। ডাকবাংলো চত্বর সামনে রেখে মাদরাসা মাঠ, মাদরাসা ভবন, আবাসিক ভবন ও মহাসড়কের উপস্থিত জনতা শান্তিপূর্ণভাবে জানাজায় অংশগ্রহণ করেন। জানাজায় উপস্থিত ছিলেন পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন জেলা, চট্টগ্রাম মহানগর ও স্থানীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নেতারা।
নামাজে জানাজায় শরিক হওয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কওমি মাদরাসার ওস্তাদ, ছাত্র ও ভক্ত-জনতা উপস্থিত হয়েছেন। দুপুর ১২টার আগেই মাদরাসা চত্বর, ভবনসমূহ, আশপাশের রাস্তাঘাট কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। হাটহাজারী পৌরসভার পুরো বাজার পরিপূর্ণ হয়ে যায়।
জানাজা শেষে আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে নিয়ে যাওয়া হয় শেষ ঠিকানা ‘মাকবরায়ে জামেয়া’য়। মাদরাসার উত্তর-পশ্চিম কোণে উত্তর মসজিদের বাইরে মিম্বরের সামনেই চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়কের সাথে লাগানো এ কবরে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। মাদরাসার নিজস্ব কবরে চিরশায়িত হয়ে ইতিহাস হয়ে থাকবেন কওমি আঙিনার এ বটবৃক্ষ, শতবর্ষী আলোচিত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির, আল্লামা শাহ আহমদ শফী।
আল্লামা শফী দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী বড় মাদরাসার মহাপরিচালক (মুহতামিম) পদে ছিলেন ১৯৮৬ সাল থেকে টানা ৩৪ বছর। তিনি ১৬ সেপ্টেম্বর মাদরাসার শিক্ষা সচিব ও হেফাজতের প্রচার সম্পাদক ছেলে মাওলানা আনাস মাদানীকে বহিষ্কার করেন এবং ১৭ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার নিজে পদত্যাগ করে সম্পূর্ণরুপে নিজেকে দায়িত্বমুক্ত করেন। এরপর অসুস্থ হয়ে প্রথমে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল পরে এয়ারবাসে করে রাজধানী ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে পদত্যাগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন।
ঢাকা থেকে তার লাশ হাটহাজারীতে পৌঁছে সকাল সোয়া ৯টায়। ভোর থেকেই এক নজর দেখার জন্য মাদরাসা মাঠে ও আশপাশে সমবেত হন ভক্ত জনতা ও প্রিয় ছাত্র শিক্ষকরা। ঢাকা থেকে সড়ক পথে বিশেষ অ্যাম্বুলেন্সে হাটহাজারীতে পৌঁছার পর আল্লামা আহমদ শফীর লাশ প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় মাদরাসার উত্তর পাশে নিজস্ব বাসভবনে শোকাহত পরিবারের সদস্যদের দেখানোর জন্য। সেখানে প্রায় পৌনে ১ ঘণ্টা রেখে পরিবারের সদস্যরা শেষবারের মতো দেখে নেন তাদের আপনজনকে। ১০টার দিকে আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে পরিবারের সদস্যরা শেষ বিদায় জানান।
এরপর সকাল ১০টায় লাশ নিয়ে আসা হয় তিন যুগের কর্মস্থল দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসা ক্যাম্পাসে। এ সময় ক্যাম্পাসজুড়ে, ভবনে, ছাদে ও রাস্তায় অপেক্ষমাণ লক্ষাধিক ভক্তের অশ্রুসিক্ত নয়নে দেখা মেলে আল্লামা আহমদ শফীর লাশবাহী গাড়িটির। ক্যাম্পাসের ভিতর দিয়ে লাশ নিয়ে রাখা হয় মাদরাসার দক্ষিণ গেটে। সেখানে হিমগাড়িতে রেখে দর্শক-ভক্তদের দেখার সুযোগ করে দেয়া হয় আল্লামা শাহ আহমদ শফীর লাশ। মাদরাসার নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে সকাল সাড়ে ১০টার পর থেকে সারি সারি হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে দেখা শুরু করেন হুজুরের ভক্ত ছাত্র শিক্ষকসহ তৌহিদী জনতা।
এ দিকে হাটহাজারীতে আল্লামা শাহ আহমদ শফীর জানাজা ঘিরে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়কে সাধারণ যান চলাচল বন্ধ ছিল। দোকানপাটে খাবার শেষ হয়ে যায় দুপুরের আগেই। ভাদ্র মাসের প্রচণ্ড গরমে পৌরসভার রাস্তায় রাস্তায় স্থানীয়দের উদ্যোগে পিপাসায় কাতর তৌহিদী জনতার জন্য ঠাণ্ডা পানি খাওয়ানোর আয়োজন ছিল চোখে পড়ার মতো।
হাটহাজারী পৌর এলাকা ও মাদরাসার আশপাশে মোতায়েন ছিল কয়েক শ’ পুলিশ ও র্যাব সদস্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারিতে সুশৃঙ্খলভাবে নামাজে জানাজার মধ্য দিয়ে লাখ লাখ মানুষের বিশাল এ সমাবেশের সমাপ্তি ঘটে। জানাজা-পূর্ব সমবেত লাখ লাখ মানুষের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, সাবেক মন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, আল্লামা শফীর বড় ছেলে মাওলানা ইউছুপ।