সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সরকার
- আপলোড টাইম : ১০:১৭:১৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৪
- / ৩৪ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বহুত্ববাদী গণতন্ত্রে উত্তরণ নিশ্চিতে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ তৈরি করতে তার সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল শনিবার নয়াদিল্লিতে আয়োজিত ‘তৃতীয় ভয়েস অব গ্লোবাল সাউথ সামিটে’ ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এ মন্তব্য করেন তিনি। ড. ইউনূস ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ সামিটে ভার্চুয়ালি অংশ নেয়া নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, ফিজি, ওমান ও ভিয়েতনামের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের দ্রুত বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান; নয়তো তারা গুরুত্বপূর্ণ কিছু মিস করতে পারেন বলেও উল্লেখ করেন।
এর আগে গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ঢাকা থেকে এই বৈঠকে যোগ দেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নেয়ার পর এটাই তার প্রথম বহুপক্ষীয় কোনো অনুষ্ঠানে যোগদান। রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান পর্যায়ে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অধিবেশনটি সঞ্চালনা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস অউর সবকা প্রয়াস’ দর্শনের প্রচারে এই অনন্য উদ্যোগটি শুরু হয়েছিল। আর এটি মূলত ভারতের ‘বসুদেব কুটুম্বকমের’ দর্শন। এটি গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং অগ্রাধিকারগুলোকে একটি সাধারণ প্ল্যাটফর্মে ব্যাপক পরিসরে ভাগ করে নেয়ার পরিকল্পনার অংশ। ভারত ২০২৩ সালের ১২ ও ১৩ জানুয়ারি প্রথম ভয়েস অব গ্লোবাল সাউথ সামিট (ভিওজিএসএস) এবং একই বছরের ১৭ নভেম্বর দ্বিতীয় ভয়েস অব গ্লোবাল সাউথ সামিটের আয়োজন করেছিল। তবে দুটো সামিটই ভার্চুয়াল ফরম্যাটে আয়োজন করা হয়েছিল। শীর্ষ সম্মেলনের পূর্ববর্তী উভয় আয়োজনে গ্লোবাল সাউথ থেকে ১০০টিরও বেশি দেশ অংশগ্রহণ করেছিল। অধিবেশনের প্রতিপাদ্য এবং সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘অ্যান এমপাওয়ারড গ্লোবাল সাউথ ফর এ সাসটেইনেবল ফিউচার।’
প্রসঙ্গত, এই সামিটে যোগ দেয়ার জন্য ড. ইউনূসকে আমন্ত্রণ জানান মোদি। গত শুক্রবার দুই দেশের নেতার মধ্যে এক ফোনালাপের সময় এই আমন্ত্রণ জানান তিনি। তখনই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ঢাকা থেকে ভার্চুয়ালি সম্মেলনে যোগ দেয়ার বিষয়ে রাজি হন প্রধান উপদেষ্টা। এসময় ফোনালাপে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ায় ড. ইউনূসকে অভিনন্দন জানান মোদি। অন্তর্বর্তী সরকারকে শুভকামনা জানিয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে কাজ করার কথা ব্যক্ত করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার ইচ্ছাও ব্যক্ত করেন তিনি। ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, তিনি তাকে দীর্ঘদিন ধরে চেনেন। অধ্যাপক ইউনূসের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। তার নেতৃত্ব বাংলাদেশের মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। ফোনালাপে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার বিষয়টি উত্থাপন করলে ড. ইউনূস জানান, সংখ্যালঘুসহ দেশের প্রতিটি নাগরিককে সুরক্ষা দেয়ার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সরকার। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার খবর অতিরঞ্জিত করা হয়েছে জানিয়ে মাঠপর্যায় থেকে সংবাদ প্রকাশ করতে ভারতীয় সাংবাদিকদের বাংলাদেশ সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানান তিনি।
গতকাল সামিটে অংশ নিয়ে দেয়া বক্তৃতায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আপনারা সবাই জানেন, গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশ একটি দ্বিতীয় বিপ্লবের সাক্ষী হয়েছে। আমাদের বীর ছাত্রদের নেতৃত্বে এবং জনসাধারণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে যা সম্ভব হয়েছে। ড. ইউনূস বলেন, আপনাদের দ্রুত ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। নয়তো গুরুত্বপূর্ণ কিছু মিস করতে পারেন। ঢাকার অনেকটা অংশ পরিণত হয়েছে বিশ্বের গ্রাফিতি রাজধানীতে। তরুণ শিক্ষার্থী ও ১২ থেকে ১৩ বছর বয়সি শিশুরা ৪০০ বছরের পুরনো এই শহরের দেয়ালে নতুন গণতান্ত্রিক পরিবেশবান্ধব বাংলাদেশের চিত্র দিয়ে রাঙিয়ে তুলছে। এজন্য কোনো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা বা দিকনির্দেশনা নেই। কারো কাছ থেকে বাজেট সাপোর্ট পায়নি তারা। এটা দ্বিতীয় বিপ্লবের লক্ষ্যের প্রতি তাদের আবেগ ও অঙ্গীকারের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। তারা রং এবং ব্রাশ কেনার জন্য দোকানে যায়। তারা তাদের নিজস্ব বিষয় এবং নিজস্ব বার্তা তৈরি করে। তারা যে বার্তা আঁকছে তা যে কাউকে শিহরিত করবে। তরুণদের স্বপ্ন সত্যি করাই আমাদের কাজ।
ড. ইউনূস মনে করেন, গ্লোবাল সাউথের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তরুণ ও শিক্ষার্থীদের অবশ্যই সরকারের কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ তরুণ। এরা সমাজের সবচেয়ে ক্ষমতাধর অংশ। তারা আলাদা। তারা একটি নতুন বিশ্ব গড়তে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তরুণ ও শিক্ষার্থীরা সক্ষম এবং প্রযুক্তিগতভাবে তারা আগের প্রজন্মের চেয়ে অনেক এগিয়ে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. ইউনূস বলেন, তারা সব অসম্ভব সম্ভব করতে পারে। তারা উদ্যোক্তা। তারা যে চাকরি চায়, সেটা উপভোগ করার কারণে নয়। বরং তারা অন্য কিছু করতে পারছে না তাই। কারণ আমাদের সব দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা তাদের চাকরির জন্য প্রস্তুত করে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সব মানুষই সৃজনশীল জীব হিসেবে জন্মগ্রহণ করে। তারা স্বভাবজাত উদ্যোক্তা। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে শুধু চাকরি প্রার্থী তৈরি ও তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য। আমাদের ব্যবস্থাটি পুনরায় সাজাতে হবে। অধ্যাপক ইউনূস পরিবেশগত ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে সামাজিক ব্যবসা গড়ে তুলতে গ্লোবাল সাউথের নেতাদের একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বুড়ো হওয়ার অর্থ এই নয়- আপনাকে অবসর নিতে হবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে হবে। রাষ্ট্রের নির্ধারিত মানুষের আয়ু অনুযায়ী সৃজনশীলতা কখনো থেমে থাকে না। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত থামে না। আমরা এক সঙ্গে কাজ করে দেখতে পারি কীভাবে সমাজকে সব মানুষের সৃজনশীলতার সহায়ক করে তোলা যায়, যতদিন তারা বেঁচে থাকবে।
ড. ইউনূস ইতিহাস উদ্বৃত করে বলেন, ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য বাংলাদেশি ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছিল। এটি সারাবিশ্বে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারের জন্য সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করেছিল। প্রায় সাত দশক পর আমাদের ছাত্র- নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় বিপ্লব গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মর্যাদা, সমতা এবং অংশীদারত্বমূলক সমৃদ্ধির জন্য তাদের কণ্ঠস্বর উত্থাপন করতে গ্লোবাল সাউথজুড়ে যুবকদের অনুপ্রাণিত করছে। অধ্যাপক ড. ইউনূস বলেন, আমি সবচেয়ে বয়স্ক ‘তরুণ’ হিসেবে এ বিপ্লবে অংশ নিতে পেরে এবং তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহায়তা করতে পেরে সম্মানিত বোধ করছি। তাদের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। তাদের সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করি। প্রধান উপদেষ্টা আরো বলেন, সম্পদের একমুখী পথ থাকা উচিত নয়। আমাদের অবশ্যই সব মানুষের, বিশেষ করে নারী ও যুবকদের জন্য আর্থিক সেবা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা একে অপরের কাছ থেকে শিখতে পারি, কীভাবে এটি সফলভাবে করা যায়। এ বিষয়ে বহু দেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এক্ষেত্রে আমাদের আরো এগিয়ে যেতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী দক্ষিণ কোরিয়া :
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী দক্ষিণ কোরিয়া। গতকাল শনিবার দক্ষিণ কোরিয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের বরাত দিয়ে দেশটির ঢাকার দূতাবাস এ তথ্য জানায়। দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, কোরিয়ান সরকার আশা করে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা দ্রুত শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে। কোরিয়া-বাংলাদেশ সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ও অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করার জন্য আমরা উন্মুখ। প্রসঙ্গত, গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।