
পুলিশ বাহিনীর প্রতি দেশের জনগণের আস্থা যেকোনো সময়ের চেয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে তলানিতে। লক্ষণীয়, মাঝে মধ্যে এই বাহিনীর অনেক সদস্য এমন সব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন, যা তাদের ঔদ্ধত্যের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। এমনও দেখা যায়, আইনের লোক হয়ে অবলীলায় বেআইনি কাজ করছেন তারা। এর সর্বশেষ নজির গত বুধবার দেশের সর্বোচ্চ আদালত অঙ্গনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিক-আইনজীবীদের ওপর নির্দয় আচরণ; যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক নির্বাচন নিয়ে আগের দিন মঙ্গলবার থেকে সর্বোচ্চ আদালত অঙ্গনে আইনজীবীদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। বুধবার সকালে তা রূপ নেয় সঙ্ঘাত-সংঘর্ষে। দিনভর তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন ঘিরে। খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন ১০-১২ জন সাংবাদিক। পুলিশ সাংবাদিকদের ক্যামেরা, মাইক্রোফোন কেড়ে নিয়ে তাদের হেনস্তা ও মারধর করেছে। এমন পরিস্থিতিতে দুই ঘণ্টা দেরিতে শুরু হওয়া ভোট প্রথম দিন বিকেল ৫টায় শেষ হয়। ভোটে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা অংশ নিচ্ছেন না। তারা বলছেন, অবৈধ নির্বাচন কমিশনের অধীনে ভোট হতে পারে না। একতরফা নির্বাচন হতে দেবেন না বলেও ঘোষণা দেন তারা। তাদের অভিযোগ, আগের রাতে ভোট কেটে রাখেন আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা। অন্যদিকে আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের অভিযোগ, নির্বাচনে হেরে যাওয়ার ভয়ে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা বিশৃঙ্খলা তৈরি করেন। তারা সুপ্রিম কোর্টে হামলা ভাঙচুর করেছেন। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে গত সোমবার সমিতির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান মনসুরুল হক পদত্যাগ করলে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। পাল্টাপাল্টি ইসি কমিটি গঠন করেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। এর জেরে বুধবার ভোট নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। পুলিশের উপস্থিতিতে আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে দু’পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নেয়। এ সময় সংবাদ সংগ্রহে গণমাধ্যম কর্মীরা সেখানে ছুটে গেলে পুলিশ অতর্কিতে হামলা চালায়। তাদের পরিচয়পত্র ও মাইক্রোফোন এবং ক্যামেরা থাকা সত্ত্বেও হামলা থেকে কেউ রেহাই পাননি। পুলিশ অশ্রাব্য ভাষায় সাংবাদিকদের গালিগালাজ করে সংবাদ সংগ্রহে বাধা দেয়। হামলায় সাংবাদিকরা আহত হয়ে মিলনায়তন থেকে বেরিয়ে গেলেও দু’জন ক্যামেরা পারসনকে আটকে রাখা হয়। পরে তাদের উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনার নিন্দা করে সাংবাদিকদের সংগঠন বিএফইউজের বিবৃতিতে বলা হয়, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকদের ওপর লাঠিচার্জ ও মারধর করেছে পুলিশ। হামলাকারী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানো হয়। ডিআরইউর বিবৃতিতে বলা হয়, পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় এ ধরনের হামলা স্বাধীন ও মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠায় অন্তরায়। হামলার সাথে জড়িত পুলিশ সদস্যদের তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করে বিভাগীয় শাস্তি নিশ্চিত ও সাংবাদিকদের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনার দাবিও জানানো হয়। আমরা মনে করি, সাংবাদিকদের ওপর নির্বিচারে এ ধরনের হামলা স্বাধীন সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের ওপর ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ। তবে সবার এ কথাও স্মরণে রয়েছে, গত দেড় দশক ধরে আমাদের দেশে সাংবাদিকতার পরিবেশ কতটুকু নিরাপদ ও মুক্ত, তা বৈশ্বিক যেকোনো সূচক দেখলে সহজে বোঝা যায়। তবু বলতেই হয়, সব বাড়াবাড়ির একটি সীমা আছে। তাই দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকদের ওপর হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অনতিবিলম্বে হামলাকারী পুলিশ সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না করলে এই বাহিনীর এমন আচরণের রাশ টানা যাবে না। তবে হতাশার কথা হলো- বর্তমান সরকার নিজেদের ক্ষমতা সংহত করতে পুলিশের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তাই এ কথা বলা অযৌক্তিক হবে না যে, হয়তো সরকার দেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে যেসব পুলিশ সদস্য অমার্জনীয় বলপ্রয়োগের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে।