সিদ্দিক বাজার ট্র্যাজেডি : নিহত ২০

সমীকরণ প্রতিবেদন:

পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাফে কুইন ভবন থেকে গতকাল বুধবার বিকালে আরও দুইজনের লাশ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। ভবনের বেজমেন্ট থেকে দুজন পুরুষের লাশ উদ্ধারের পর অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দিনমণি শর্মা এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, বিস্ফোরণের ঘটনায় এ পর্যন্ত ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে ১৭ জনের মরদেহ পরিবারের সদস্যরা বুঝে পেয়েছেন। বাকি লাশ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। আহত হয়েছেন শতাধিক। যাদের অর্ধেকের বেশি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে ৩১ জনের অবস্থা গুরুতর। এর আগে গত মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৪টায় পুরান ঢাকার বংশাল থানার সিদ্দিক বাজারের নর্থ সাউথ সড়কের ১৮০/১ নম্বর ‘ক্যাফে কুইন’ এবং লাগোয়া ১৮০ নম্বর ৫ তলা ভবনের নিচতলায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শী শামীম বলেন, আমি রাস্তার ঠিক পূর্ব পাশে ছুরিটোলা প্রাথমিক বিদ্যালয় লাগোয়া ৯ তলা একটি বাণিজ্যিক ভবনের আটতলায় দর্জির কাজ করছিলাম। মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে আচমকা বিকট শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। আমি দৌড়ে বারান্দায় যাই। বারান্দা থেকে ঘটনাস্থলের দূরত্ব প্রায় দুইশ’ গজ সামনে। সবকিছুই চোখের সামনেই ঘটছিল। যা স্পষ্ট দেখাও যাচ্ছিল। দেখি, পুরান ঢাকার বংশাল থানাধীন সিদ্দিক বাজারের ৬ নম্বর সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণির নর্থ সাউথ সড়কের ১৮০/১ নম্বর সাততলা ক্যাফে কুইন নামে ভবনের নিচতলায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়েছে। বিস্ফোরণে বাড়িটির তিনতলা পর্যন্ত যাবতীয় মালামাল রাস্তায় ছিটকে পড়ছে। তখন রাস্তায় প্রচুর লোকজন চলাচল করছিল। ভবনটির লোহার শাটার উড়ে গিয়ে রাস্তায় চলন্ত একটি ছোট পিকআপ ভ্যানের ওপর পড়ে। পিকআপে থাকা ৫ জন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তিনজন। তাদের একজন মুখে লোহার জিনিসপত্র লেগে গুরুতর আহত হয়েছেন। অপর একজনের হাত কেটে পড়েছে। তাদের সঙ্গে থাকা একজনের পা কেটে পড়ে গেছে। এমন অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে। আহতদের চিৎকারে মানুষ পাগলের মতো দৌড়াদৌড়ি করছিল। কেউ কেউ রাস্তায় লাশ পড়ে ছিল। স্থানীয়রা জানান, ভবনটির মালিক রেজাউল করিম।

ভবনটি লাগোয়া ১৮০ নম্বর ৫ তলা বাড়ির নিচতলায় দেয়াল পুরোপুরি ধসে পড়ে। দুটি ভবনে একসঙ্গে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। চোখের পলকে ভবন দুটি থেকে ছিটকে পড়ে স্যানেটারি জিনিসপত্র। এই বাড়িটির নিচতলায় ব্যবসায়ী দোকান ছিল। আর দ্বিতীয়তলা থেকে চতুর্থতলা পর্যন্ত ব্র্যাক ব্যাংকের গুলিস্তান শাখার কার্যালয়। তখন ব্যাংক চলছিল। পঞ্চমতলায় একটি পরিবার বসবাস করত। মুহূতের মধ্যেই তারা কে কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না। স্থানীয়রা জানান, ভবনটির মালিক মরহুম নূর হোসেন। বুধবার সরেজমিন দেখা গেছে, প্রথম ভবনটির নিচতলায় যে সেপটিক ট্যাংকে প্রথম বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটেছে, তার ওপর ছিল বাংলাদেশ স্যানেটারি নামে একটি দোকান। দোকানটির মালিক কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ঘটনার সময় তিনি আসরের নামাজ আদায় করার জন্য বাইরে বের হন। দোকানে ছিলেন ম্যানেজার স্বপন (৪২)। তিনি দোকানে ফিরতে ফিরতেই সব শেষ। বুধবার বেলা তিনটা পর্যন্ত স্বপনের কোনো হদিস মেলেনি। ঢাকা মেডিকেল থেকে শুরু করে সম্ভাব্য সব জায়গায় স্বপনের সন্ধান করেও তাকে পাওয়া যায়নি। স্বপনের লাশ ট্যাংকির পানিতে ডুবে আছে কিনা বা অন্য কোথাও আছে কিনা তা জানার জন্য অধীর আগ্রহে বসেছিলেন তিনি।

দেখা গেছে, ক্যাফে কুইন নামে ভবনটির পেছনের অংশ হেলে দেবে গেছে। এজন্য ভবনটি পেছন দিকে অন্তত এক ফুট হেলে গেছে। একই লাইনে থাকা সব ভবন একটির সঙ্গে আরেকটি লাগানো। দু-একটি ভবনের মাঝামাঝি জায়গায় কয়েক ইঞ্চির মতো জায়গা ফাঁকা আছে। ভবনটি হেলে যাওয়ার কারণে দক্ষিণ দিকের ফাতেমা ভিলা নামে ৯ তলা ভবনটিও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ ভবনটিও কয়েক ইঞ্চি হেলে গেছে। তবে নিখুঁতভাবে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। আর বিস্ফোরিত ভবন দুটির পেছনে থাকা ১৮১ নম্বর ৯ তলা ভবনটির তিনতলা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবনটির নিচতলার একটি দেয়াল পুরোপুরি ধসে পড়েছে। ভবনটিতে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অফিস আছে।

এদিকে বুধবার দুপুরে ঢাকার সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বিস্ফোরণের পর সিদ্দিক বাজারের ওই ভবনের বেজমেন্ট ও নিচতলায় যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। ভবনটি এখন ঝুঁকিপূর্ণ ইমারতে পরিণত হয়েছে। ভবনের ওপরে চাপ পড়লে সেটি ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য স্টেবল (স্থিতিশীল) অবস্থা তৈরি করে এরপর অভিযান শুরু করা হবে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণগুলোর কারণ খুঁজতে আপাতত বিদেশি কোনো বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন নেই বলেও জানান তিনি। মন্ত্রী বলেন, ফায়ার সার্ভিস এবং বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটসহ স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি ঢাকা ও চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বিস্ফোরণের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত তৈরি করতে সক্ষম। এজন্য বিদেশি কারও সহযোগিতার প্রয়োজন নেই। মন্ত্রী বলেন, কী কারণে ঘটনা ঘটেছে তা তদন্তের পর জানা যাবে। কেউ যেন ইমারতের অনুমোদন ছাড়া ভবন নির্মাণ না করে। যারা অনুমতি না নিয়ে ভবন নির্মাণ করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অন্যদিকে, এদিন বেলা সোয়া ১১টায় গুলিস্তানে বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের সামনে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ডক্টর কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা ধ্বংসস্তূপ পর্যবেক্ষণ করেছি। কী কারণে এমন ঘটনা ঘটল, এটা তদন্ত করা দরকার। এটি স্বাভাবিক কেমিক্যাল বিস্ফোরণের ঘটনা নাকি অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকান্ড সেটা তদন্তের প্রয়োজন আছে। একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আমরা অনেকগুলো প্রাণ হারিয়েছি। এটি মর্মান্তিক ঘটনা। এ ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। ঘটনাটি কেন অন্তর্ঘাতমূলক মনে হলো- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্তের আগে চূড়ান্ত কোনো কিছু বলার অবস্থা আসেনি। তবে আমি অবাক হচ্ছি বেজমেন্টের একটি বিস্ফোরণে বহুতল ভবনের একাধিক তালা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। এটা কী ধরনের বিস্ফোরক, সেটা বের করা প্রয়োজন। এটা অন্তর্ঘাতমূলক ঘটনা নাও হতে পারে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে যে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে এবং সাইন্সল্যাবে যে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, এটা কিসের ইঙ্গিত- সেটা ভালো করে বোঝার দরকার। যে যেখানে আছেন, সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। যে কোনো ধরনের সন্দেহজনক কিছু দেখলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করতে হবে।

এদিকে বুধবার সকাল থেকেই ঘটনাস্থলে অবস্থান নেয় পুলিশ ও র‌্যাবের অতিরিক্ত সদস্য। পুলিশ ও র‌্যাবের ডগ স্কোয়াড ও বম্ব ডিজপোজাল ইউনিট, সেনাবাহিনীর বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ, বিএসটিআই (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট), ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য সংস্থার লোকজন পুরো এলাকায় অবস্থান নেয়। বেলা ২টায় পুলিশের ডগ স্কোয়াড প্রথম দফায় তল্লাশি অভিযান চালায়। এরপর পর্যায়ক্রমে পুলিশের বম্ব ডিসপোজাল টিম, র‌্যাবের ডগ স্কোয়াড ও বম্ব ডিসপোজাল টিম ঘটনাস্থলে তল্লাশি অভিযান চালায়। র‌্যাবের বম্ব ডিসপোজাল টিমের প্রধান অতিরিক্ত পরিচালক মেজর মশিউর রহমান বলেন, তল্লাশিতে এখন পর্যন্ত বিস্ফোরণের প্রকৃত কোনো কারণ সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে সেপটিক ট্যাংকের গ্যাস ও গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে জমা হওয়া গ্যাসের কারণে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দাবি করেছেন, গ্যাস লাইনে কোনো লিকেজ ছিল না।

বিএসটিআইর উপপরিচালক সাংবাদিকদের বলেন, প্রকৃতপক্ষে কী কারণে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটেছে, তা জানতে ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। সংগৃহীত আলামত পরীক্ষার পর সুনির্দিষ্ট করে বিস্ফোরণের কারণ জানা যাবে। ঘটনাস্থলের সেপটিক ট্যাংক থেকে তিনি তিনটি ছোট পস্নাস্টিক বোতল দিয়ে পানি সংগ্রহ করে নিয়ে যান। পানি পরীক্ষা করলেই ঘটনাস্থলে বিস্ফোরণ কী কারণে হয়েছে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি আরও বলেন, যদি জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ হয় অথবা কোনো রাসায়নিক পদার্থের কারণে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলেও পানি পরীক্ষা করেই তা নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে কবে নাগাদ সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হবে তিনি নিশ্চিত করে কিছু জানাতে পারেননি।

বুধবারও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দুপুরে ডিএমপি কমিশনার পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক খন্দকার গোলাম ফারুক সাংবাদিকদের বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা নাকি, অন্য কিছু তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে সার্বিক পর্যালোচনায় বিস্ফোরণের ঘটনাটি একটি দুর্ঘটনা বলে মনে হচ্ছ। তারপরও নিউমার্কেটে ভয়াবহ বিস্ফোরণে তিনজনের মৃত্যুর পর আবার একই ধরনের বিস্ফোরণে ব্যাপক হতাহতের ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দুটি ভবনে ঠিক একই সময় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্তে জানা গেছে, চমকপ্রদ তথ্য। তিনি বলছেন, পাশাপাশি দুটি ভবনের সেপটিক ট্যাংক একটি। অর্থাৎ দুটি ভবনের সামনের দিকে দেয়ালের নিচে সেপটিক ট্যাংকের অবস্থান। ভবন দুটি অন্তত ৪৫ বছরের পুরনো। জরাজীর্ণ ভবন। ভবনের অনেক জায়গায় এখনো পলেস্তরা লাগানো হয়নি। খুবই নিম্নমানের জিনিসপত্র দিয়ে ভবনটি দুটি নির্মাণ করা হয়েছে। এখনো ভবনের অনেক জায়গায় ইটের ওপর সিমেন্ট লাগানো হয়নি। ভবনে শ্যাওলা জমে আছে। ভবনের ওপরের দিকে বট পাকুড়ের গাছ গজিয়ে আছে। ভবনটি প্রায় একই সময় নির্মিত হয়েছে। দুই ভবনের মালিক নিজেদের মধ্যে সমন্বয় ও সমঝোতার ভিত্তিতে জায়গা ও টাকা বাঁচানোর জন্য একটি বড় সেপটিক ট্যাংক তৈরি করেছেন। বাড়ি নির্মাণের ৪৫ বছর পার হয়ে গেলেও অদ্যাবধি সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করা হয়নি। যে কারণে সেপটিক ট্যাংকে গ্যাস জমে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। কারণ ভবন দুটি তুলনামূলকভাবে অনেক দুর্বল। যে কারণে ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহত বেশি হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ক্যাফে কুইনের নিচতলায় সেপটিক ট্যাংকে বিস্ফেরণের পর পাশের ভবনের দেয়াল ভেঙ্গে গেছে। বিস্ফোরণের পর আগুন লেগে গেলে দুটি ভবনে থাকা বৈদ্যুতিক সরঞ্জামে ভয়াবহ বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনাটি ঘটে। বিস্ফোরণে ভবনের বাসিন্দাদের চেয়ে সামনের রাস্তায় চলাচলকারী মানুষ হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটেছে। কারণ বিস্ফোরণে ছিটকে ভবনের ইট-পাথরসহ অন্যান্য মালামাল চলন্ত মানুষের মাথায় গিয়ে আঘাত করেছে। প্রচন্ড আঘাতে এবং আগুনে পুড়ে অধিকাংশজনের মৃত্যু হয়েছে।

বুধবার দুপুরে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরিচালক (জোন-৫) হামিদুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের বলেন, বুধবার সরকারি ছুটি থাকায় ভবন দুটি সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ভবন দুটি আবাসিক না বাণিজ্যিক তাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। ফাইলপত্র দেখে বলতে হবে। বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তার দাবি, ভবনটির অনুমোদনের সময় রাজউক ছিল না। প্রায় ৪৫ বছর আগে ভবন দুটির অনুমোদন দেওয়া। ভবনের ফাইল খুঁজে বের করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরপর বিস্তারিত বলা যাবে। ভবনে বিস্ফোরণে হতাহতের দায় কিছুটা হলেও নানাভাবে রাজউকের ঘাড়ে বর্তায় বলেও তিনি স্বীকার করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিস্ফোরণ সম্পর্কিত তথ্য জানতে ভবন দুটির অনেক ব্যবসায়ীকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তাদের ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তবে তাদের গ্রেপ্তার বা আটক করা হয়নি। এ ব্যাপারে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবি প্রধান ডিআইজি মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, তারা কাউকে আটক করেননি। তবে বিস্ফোরণ সম্পর্কিত তথ্য জানতে বাড়ির মালিক, দোকান মালিকসহ অনেককেই ডাকা হয়েছে। আহতদের সঙ্গে কথা বলে প্রকৃত তথ্য জানার চেষ্টাও অব্যাহত আছে। বিস্ফোরণের ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা নাকি অন্য কোনো কিছু সে বিষয়টিও জানার চেষ্টা চলছে।

ফায়ার সার্ভিসের গঠিত ৫ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক দিনমণি শর্মা জানান, বুধবার বিকালে তল্লাশি অভিযানে বিস্ফোরিত ভবনের বেজমেন্ট থেকে আরও দুইজনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। তাদের একজনের নাম মমিন উদ্দিন সুমন (৪৪) এবং অপর জনের নাম রবিন হোসেন শান্ত (২০) বলে জানা গেছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ সূত্রে জানা গেছে, বিস্ফোরণে নিহত অন্যরা হলেন, সুমন (২১), পিতা- মমিন (শনাক্তকারী), বাড়ি ঢাকার বংশাল থানাধীন ১নং সুরিটোলায়। গ্রামের বাড়ি কুমিলস্না জেলার মেঘনা থানা এলাকায়। ইসহাক মৃধা (৩৫), পিতার নাম মৃত দুলাল মৃধা। বাড়ি বরিশাল জেলার কাজীরহাট থানাধীন চর সন্তোষপুর গ্রামে। তিনি ঢাকার ঢাকেশ্বরীর রোডের ২ নম্বর বাড়িতে থাকতেন। পুরান ঢাকার ইসলামপুরে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। নিহতের ফুফাতো ভাই হুমায়ুন কবির খান ইসহাকের লাশ গ্রহণ করেন এবং এসব তথ্য জানান। মুনসুর হোসেন (৪০), পিতার নাম মোশাররফ হোসেন। বাড়ি ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানাধীন পশ্চিমপাড়ায়। লাশ গ্রহণ করেন তার ভায়রা মুরাদ হোসেন। ইসমাইল (৪২), পিতার নাম মৃত মো. হোসেন আলী। বাড়ি পুরান ঢাকার বংশাল থানাধীন আলু বাজারের লুৎফর রহমান লেনের ৯৭ নম্বর বাড়িতে। লাশ শনাক্ত করেন ভাই আব্দুল কুদ্দুস। আল আমিন (২৩), পিতার নাম বিলস্নাল হোসেন। বাড়ি চাঁদপুর জেলার মতলব থানাধীন পশ্চিম লালপুর গ্রামে। নিহতের ভাই হাবিবুর রহমান লাশ শনাক্ত করেন। আল আমিন বিবিএ শিক্ষার্থী ছিলেন বলেন তার ভাই জানান। রাহাত (১৮), পিতার নাম জাহাঙ্গীর আলম। বাড়ি ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ থানাধীন দক্ষিণ চুনকুটিয়া মাস্টারবাড়ি। নিহতের ভাই রাকিবুল হাসান লাশ গ্রহণ করেন। মমিনুল ইসলাম (৩৮), পিতার নাম আবুল হাশেম। বাড়ি ঢাকার চকবাজার থানাধীন ইসলামবাগের ১১৫/৭/৫ নম্বরে। নদী বেগম (৩৬), স্বামীর নাম মৃত মমিনুল ইসলাম। বাড়ি ঢাকার চকবাজার থানাধীন ১১৫/৭/৫ নম্বর ইসলাম বাগে। চাচা জয়নাল আবেদীন স্বামী-স্ত্রীর লাশ শনাক্ত করেন। মাঈন উদ্দিন (৫০), পিতার নাম মৃত ছমির উদ্দিন আকন। বাড়ি মুন্সীগঞ্জ সদর থানাধীন সৈয়দপুর গ্রামে। পিতার লাশ শনাক্ত করেন মাহমুদুল হাসান। নাজমুল হোসেন (২৫), পিতার নাম ইউনুছ হোসেন। বাড়ি ঢাকার বংশাল থানাধীন ৪৭নং কে পি ঘোষ স্ট্রিটে। খালাতো ভাই শোভন তার লাশ শনাক্ত করেন। তিনি আজাদ স্যানেটারি দোকানের কর্মচারী ছিলেন। ওবায়দুল হাসান বাবুল (৫৫), পিতার নাম মৃত শেখ সাহেব আলী। বাড়ি মানিকগঞ্জ সদর থানাধীন চর বেউথা গ্রামে। মেয়ের জামাই চাতক শিকদার লাশ শনাক্ত করেন। আবু জাফর সিদ্দিক (৩৪), পিতার নাম মৃত মোজাম্মেল হক। বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া থানাধীন বালুয়াকান্দি গ্রামে। খালাতো ভাই রাশেদুল হাসান লাশ শনাক্ত করেন। আকুতি বেগম (৭০), স্বামী মৃত আনোয়ার হোসেন। বাড়ি ঢাকার বংশাল থানাধীন ১৮/১ আগামাসি লেনে। খালাতো ভাই শাজাহান সাজু লাশ শনাক্ত করেন। ইদ্রিস মীর (৬০), পিতার নাম মৃত কালাচান মীর। বাড়ি যাত্রাবাড়ী থানাধীন মীরহাজারীবাগ এলাকায়। ছেলে রিফাত লাশ শনাক্ত করেন। নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া (৫৫), পিতার নাম মৃত আলী মোহাম্মদ ভূঁইয়া। বাড়ি ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানাধীন মাতুয়াইল এলাকায়। ভাই তাজুল ইসলাম লাশ শনাক্ত করেন। হৃদয় (২০), তিনি ঢাকার বংশাল থানাধীন সিদ্দিক বাজারের জাবেদ গলিতে থাকতেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বুধবার বিকাল নাগাদ ১৭ জনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ২০ জন চি?কিৎসাধীন আছেন। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আছেন দগ্ধ ১১ জন। তারা আশঙ্কামুক্ত নন বলে চিকিৎসকদের দাবি। বিস্ফোরণের পর পরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। তিনি জানান, বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ জানতে ৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে দ্রুত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে। সদস্য সচিব করা হয়েছে দিনমণি শর্মাকে। অপর সদস্যরা হলেন- ফায়ার সার্ভিস ট্রেনিং কমপ্লেক্সের ভাইস প্রিন্সিপাল আনোয়ারুল হক ও উপ-সহকারী পরিচালক শামস আরমান। কমিটিকে ৫ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

এদিকে মঙ্গলবার রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটি বিশেষজ্ঞ টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তারা ক্ষতিগ্রস্ত ভবনসহ আশপাশের সব ভবন পরীক্ষা করেন। পরীক্ষা শেষে তারা বিস্ফোরিত ভবন দুটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেন।