
সরকারি বয়ানে গত দেড় দশকে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এই উন্নয়ন সাধারণ মানুষের জীবনে কতটুকু প্রভাব ফেলেছে, বলা মুশকিল। তবে এ কথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, দেশের মুষ্টিমেয় মানুষ বিপুল বিত্তের অধিকারী হয়েছেন। তাদের হাতে প্রচুর অর্থ জমা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে বর্তমানে চলছে অর্থনৈতিক সঙ্কট যার কারণে সাধারণ মানুষের জীবনমানের যেমন ক্রমাবনতি হচ্ছে, তেমনি তাদের জীবনে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট। লক্ষণীয়, মাত্রাতিরিক্ত মূল্যস্ফীতিতে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। ফলে জিনিসপত্রের দাম সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখীর কারণে মানুষ আগের মতো আর সঞ্চয় করতে পারছে না। বরং অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, এক বছরে টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়ন হয়েছে ডলারের বিপরীতে। গত বছরের ১ মার্চ যেখানে প্রতি ডলার পেতে ব্যয় করতে হয়েছে ৮৬ টাকা। সেখানে গত ৬ মার্চ আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে প্রতি ডলার পেতে ব্যয় করতে হয়েছে ১০৬ টাকা ৯৮ পয়সা। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ২৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি করা সব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে পণ্যের উৎপাদনে যার কারণে বেড়ে গেছে মূল্যস্ফীতি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত ডিসেম্বরে যেখানে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৭০ শতাংশ, সেখানে জানুয়ারিতে বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৯২ শতাংশ। অথচ ২০২২ সালের জানুয়ারি শেষে ১২ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। নয়া দিগন্তে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চার কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া ও এতে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ বাজারে ক্রমাগত চাহিদা বৃদ্ধিকে বড় বড় কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। দেশের সার্বিক অর্থনীতির সর্বশেষ তথ্য নিয়ে তৈরি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের এখন টাকার প্রবাহ কমানো ছাড়া অন্য কোনো উপকরণ নেই। তাদের মতে, টাকার প্রবাহ কমিয়ে এখন মূল্যস্ফীতির হার খুব বেশি কমানো যাবে না। বরং টাকার প্রবাহ কমালে বেসরকারি খাতে ঋণ আরো কমে যাবে, তখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরো স্থবির হয়ে পড়বে। এতে মানুষের আয় কমে যাবে। তখন ক্রয়ক্ষমতা কমে গিয়ে দেশের অর্থনীতিতে আরো মন্দা জেঁকে বসবে। এতে সাধারণ মানুষের জীবনমান আরো কমে দুর্ভোগ বর্তমানের চেয়েও তীব্রতর হবে। সঙ্গত কারণে অর্থনীতিবিদদের মতো আমরাও মনে করি, মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে আনতে টাকা পাচার ও হুন্ডি বন্ধ করে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়াতে হবে। অপ্রয়োজনীয় আমদানি কমাতে হবে। এতে টাকার অবমূল্যায়নজনিত মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমানো যাবে। তবে এটি শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সরকারের সব সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের মাধ্যমে এ খাতে কাজ করতে হবে। একই সাথে বাজার তদারকি বাড়াতে হবে। বেশির ভাগ পণ্যের দাম অহেতুক বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা নিবিড় নজরদারির মাধ্যমে কমানো সম্ভব হতে পারে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করলে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমানো সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। একই সাথে বাজার নিয়ন্ত্রণের সাথে যারা জড়িত তাদের ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। তবেই সম্ভব উচ্চ মূল্যস্ফীতির রাশ টানা।