
সমীকরণ প্রতিবেদন:
ভয়াবহ ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় নিহতের সংখ্যা ৩৬ হাজার ছাড়িয়েছে। গত কয়েক দিন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবকসহ বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনী পুরোদমে উদ্ধারকাজ চালালেও আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে উদ্ধার অভিযানের গতি। বিশ্বের ৭০টিরও বেশি দেশ উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছে। ধ্বংসস্তূপের কংক্রিট সরালেই মিলছে লাশ। জাতিসঙ্ঘ সতর্ক করেছে মৃতের চূড়ান্ত সংখ্যা এ পর্যন্ত হিসাবের দ্বিগুণ হতে পারে। সংস্থাটি বলেছে, ভূমিকম্পের ফলে সিরিয়ায় ৫৩ লাখ মানুষ গৃহহীন হতে পারে। এখন তুরস্ক ও সিরিয়ায় প্রায় ৯ লাখ লোকের জরুরি খাদ্যের (গরম খাবারের) প্রয়োজন। সিরিয়ার সরকার তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত এলাকায় মানবিক সহায়তা বিতরণের অনুমোদন দিয়েছে। এর আগে তুর্কিয়ে প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান বলেছেন, ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা দেশের ১৯৯৯ সালের ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্পের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডব্লিউএইচওর কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, নিহত মানুষের সংখ্যা আরো বাড়বে। তুরস্কের দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কর্তৃপক্ষ এএফইডি জানিয়েছে, ছয় হাজারের বেশি ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গাজিয়ান্তেপ শহর।
ভূমিকম্পের পরে ১৭০০ আফটারশক রেকর্ড করা হয়েছে। প্রথম দিকে অনেককে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হলেও সময় যত গড়িয়েছে জীবিত উদ্ধারের আশা ততই কমেছে। ভূমিকম্প আঘাত হানার দেড় শ’ ঘণ্টা পার হয়েছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে খাবার-পানি ছাড়া ধ্বংসস্তূপের নিচে বেঁচে থাকা অলৌকিক ছাড়া আর কিছুই না। তাই উদ্ধারকারীরা বলছেন, এখন শুধু লাশই পাওয়া যাবে। যদিও সোমবার মোস্তফা সারিগুল (৩৫) নামে এক যুবককে জীবিত উদ্ধার করা হয়। আভসারোগলু নামের এক উদ্ধারকর্মী বলেন, তুরস্কের প্রাচীন শহর আন্তাকিয়াতে ধসে পড়া অ্যাপার্টমেন্টের নিচে চাপা পড়েছিল আমার বোন, তার স্বামী ও তাদের দুই সন্তান। ৭ ফেব্রুয়ারি রাত পর্যন্ত তারা জীবিত ছিল। কিন্তু ধ্বংসস্তূপের গভীরে থাকা একটি জেনারেটর থেকে আগুন লাগার পর তাদের আর কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। কাঁদতে কাঁদতে আভসারোগলু বলেন, পাঁচ দিন পর ১২ ফেব্রুয়ারি ভবনটির অবশিষ্টাংশ সরিয়ে আমার বোন ও তার পরিবারের সদস্যদের লাশ বের করে আনার চেষ্টা করি, কিন্তু লাশ তো দূরের কথা, তাদের কোনো চিহ্নই খুঁজে পাইনি। সম্ভবত তারা সবাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, আগুন লেগে যাওয়া ব্লকটিতে প্রায় ৮০ জন বাস করতেন। তাদের মধ্যে আগুন লাগার আগে ২১ জনকে উদ্ধার করা হয়। পরে ১২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। কিন্তু কিছু লাশের অবস্থা এতটাই ভয়াবহ ছিল, সেগুলোর হাড় ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি।
ভূমিকম্পে ধসে পড়া বেশ কয়েকটি ভবনেই এমন আগুন লাগার খবর পাওয়া গেছে। সেসব ভবনের নিচে চাপা পড়া মানুষগুলোর অবস্থাও হয়তো একই রকম। হাড় ছাড়া হয়তো তাদের শরীরের আর কোনো অংশই অবশিষ্ট থাকবে না। ঐতিহাসিকভাবে অ্যান্টিওক নামে পরিচিত তুরস্কের হাতায়া প্রদেশের প্রাচীন শহর আন্তাকিয়ায় ধসে পড়া ভবনগুলো দেখে ধ্বংসের মাত্রা বোঝা কঠিন। ভয়াবহ ভূমিকম্প ও শত শত আফটার শক সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় প্রতিটি ভবনেই রয়েছে বড় বড় ফাটল, কিছু ভবনের অর্ধেকটা টিকে আছে, আবার কোনোটা ঝুঁকিপূর্ণভাবে হেলে পড়েছে। অর্ধেক ধসে পড়া ভবনগুলোর দেয়াল যেন মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া প্রাণগুলোর অস্তিত্ব প্রকাশ করে। এসব ভবনের প্রায় প্রতিটিতেই ভাঙা কংক্রিট ও পেঁচানো রডে বেঁধে থাকা আসবাবপত্র, হাস্যোজ্জ্বল পারিবারিক ছবির অ্যালবাম, জামাকাপড় ও খোলা আলমারি চোখে পড়ে। কত হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা এক ছাদের নিচে ভাগাভাগি করেছেন মারা যাওয়া মানুষগুলো। এখন সেসব শুধুই স্মৃতি। জীবন কতটা অনিশ্চিত, এ ভবনগুলো যেন তা বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। আন্তাকিয়ায় উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া ভারতীয় দলের এক উদ্ধারকারী বলেন, চার দিন ধরে আমরা শুধু লাশই উদ্ধার করছি। এখন পর্যন্ত একজন জীবিত মানুষকেও খুঁজে পাইনি। আমরা জীবিত কাউকে উদ্ধারের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু তা আর সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। পাশের রাস্তায় এক নারীকে ভারাক্রান্ত মুখে মাটিতে শুইয়ে রাখা লাশের পাশে বসে থাকতে দেখা যায়। চোখে-মুখে তার রাজ্যের চিন্তা। বিড় বিড় করে বলতে থাকেন, নিজেকে ঠিক রাখতে হবে, নিজেকে ঠিক রাখতে হবে। এ দিকে তুর্কিয়ে সরকার জোর দিয়ে বলেছে, ভয়াবহ এ ভূমিকম্পের প্রভাব প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ মানুষের ওপর পড়েছে। প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়র এরদোগান এক বছরের মধ্যে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত সব এলাকা পুনর্র্র্নিমাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। দেশটির দুর্যোগ ও জরুরি সেবা সংস্থা এএফএডি বাস্তুচ্যুতদের থাকার জন্য আন্তাকিয়া শহরের বাইরে তাঁবুর ব্যবস্থা করেছে। অন্য দিকে, সিরীয় শরণার্থীদের স্থানীয় ফুটবল স্টেডিয়ামে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শহরের বাইরে একটি প্রদর্শনী কেন্দ্রে ২৬টি বিদেশী ও তুর্কি সংস্থা ত্রাণসহায়তা সরবরাহের কাজ করছে। ডব্লিউএইচও’র শীর্ষ কর্মকর্তা অ্যাডেলহেইড মার্শাং বলেন, ‘ভূমিকম্প যেসব অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছে, তার মানচিত্র অনুসারে বলা যায় যে দুই কোটি ৩০ লাখ মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এদের মধ্যে ৫০ লাখ মানুষ অরক্ষিত অবস্থায় আছে। তিনি আরো বলেন, তুরস্ক এবং উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার ভূমিকম্পকবলিত অঞ্চলে বেসামরিক অবকাঠামো ও স্বাস্থ্যসেবার সাথে সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেনেভায় ডব্লিউএইচওর নির্বাহী কমিটিকে মার্শাং বলেছেন, ‘ডব্লিউএইচও মনে করে যে সিরিয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন জরুরি পণ্যের অভাব দেখা দেবে। এমনকি দেশটিতে মধ্যমেয়াদি সময়ের জন্য আরো এমন সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওই অঞ্চলে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত আফটারশক হতে পারে। সিএনএনের আবহাওয়াবিদ ক্যারেন ম্যাগিনিস ব্যাখ্যা করে জানিয়েছেন, ভূকম্পনের বৈশিষ্ট্যের কারণে আফটারশক পরের কয়েক সপ্তাহ, এমনকি কয়েক মাস পর্যন্তও অনুভূত হতে পারে।
বিশ্বকাপের ভ্রাম্যমাণ হোটেল তুরস্ক-সিরিয়ায় পাঠাচ্ছে কাতার : এএফপি জানায়, বিশ্বকাপের সময় ব্যবহৃত ১০ হাজার ভ্রাম্যমাণ কেবিন ও কাফেলা তুরস্ক ও সিরিয়ায় পাঠাচ্ছে কাতার। এটি ভয়াবহ ভূমিকম্পে ঘরবাড়ি হারানো মানুষের আশ্রয়ে কাজে লাগবে। কাতারের কর্মকর্তারা রোববার এমন কথা জানান। কাতারের এক কর্মকর্তা বলেন, তুরস্ক ও সিরিয়ায় জরুরি প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে আমরা তাদের জনগণকে তাৎক্ষণিক সহায়তা প্রদানের অংশ হিসেবে কেবিন এবং কাফেলা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। গত বছর কাতার যখন ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল তখন কয়েক সপ্তাহ ধরে এসব ভ্রাম্যমাণ হোটেল ও তাঁবুগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল। এর প্রথম চালান গতকাল সোমবার তুরস্কের উদ্দেশে দোহা বন্দর ত্যাগ করার কথা। আগামীতে আরো চালান পাঠানো হবে।
নিরাপত্তা ঝুঁকিতে তুরস্ক ছাড়ল ইসরাইলি উদ্ধারকারী দল: সিএনএন জানায়, উদ্ধারসহায়তায় তুরস্কে আসে ইসরাইলের ‘ইউনাইটেড হাটজালা’ নামে একটি অনুসন্ধান ও স্বেচ্ছাসেবী দল। কিন্তু নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ দেখিয়ে ছয় দিন পর রোববার তুরস্ক ত্যাগ করেছে তারা। ইউনাইটেড হাটজালার প্রধান নির্বাহী এলি পোলাক এবং উদ্ধার অভিযানের ভাইস প্রেসিডেন্ট ডড মাইসেল এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ‘সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তারা তুরস্ক ছেড়ে গেছে। আমাদের কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টি সবার আগে।’ একই কারণে জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার উদ্ধারকারী দলও তুরস্ক ছেড়ে চলে যায়। তারা আরো জানান, ‘আমরা জানতাম সিরীয় সীমান্তের কাছে অবস্থিত তুরস্কের এই অঞ্চলে আমাদের দল পাঠানোতে নির্দিষ্ট স্তরের ঝুঁকি ছিল। জীবন রক্ষার স্বার্থে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছি।’ এ নিয়ে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করা হলে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে ইসরাইলের দ্বিতীয় দল ‘ইসরাএইড’ এখনো তুরস্কে উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রেখেছে।