
ঝিনাইদহ জেলাজুড়ে দুর্নীতি-অনিয়ম, প্রণোদনার তালিকায় ডিলারের কর্মচারীর নাম
ঝিনাইদহ অফিস:
প্রণোদনার কৃষি যন্ত্রপাতি পেয়েছিলেন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ফুরসুন্ধি ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামের মৃত খোদাবক্সের ছেলে হায়দার আলী। কিন্তু তিনি সেটি ব্যবহার করেন না। সেটি এখন রয়েছে মধুহাটি গ্রামে। তাঁর বাড়িতে নেই কৃষি ভর্তুকির পাওয়ারট্রিলার। একইভাবে পেয়েছিলেন ভবানীপুর গ্রামের সুশিল বিশ্বাসের ছেলে শৈলেন বিশ্বাস ও আজিম মণ্ডলের ছেলে সাহাবুদ্দিন। কিন্তু প্রণোদনার টাকায় পাওয়া সিডার এবং পাওয়ারট্রিলার তাঁদের বাড়িতে নেই।
সরেজমিনে ঘুরে এমন ভয়ংকর তথ্য মিলেছে সদর উপজেলায়। শুধু ঝিনাইদহ সদর উপজেলাতেই নয়, অন্যান্য উপজেলাতে কৃষি প্রণোদনার টাকা নয়-ছয় করার অভিযোগ উঠেছে। ফলে প্রকৃত কৃষক পরিবার সরকারের এই সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তথ্য নিয়ে জানা গেছে, ২০২১ সালের জুন থেকে শুরু হওয়া ৫ বছর মেয়াদী প্রকল্পে এ পর্যন্ত ঝিনাইদহে ১০ কোটি টাকার বেশি প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। প্রকল্প শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রণোদনার তালিকা প্রস্তুত নিয়ে স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম করা হয়। কৃষি বিভাগের সঙ্গে একটি ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট এই প্রণোদনা বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ উঠেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, যাদেরকে প্রণোদনার টাকায় পাওয়ারট্রিলার, সিডার ও হারভেস্টার প্রদান করা হয়েছে, তাদের বাড়িতে এসব কৃষি যন্ত্রপাতি নেই। ভবানীপুর গ্রামের হায়দার আলী তাদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু তার স্ত্রী শিউলি বেগম জানান, তাদের পাওয়ারট্রিলার সদর উপজেলার মধুহাটি গ্রামে তার দেবরের বাড়িতে রয়েছে। অন্যদিকে সাহাবুদ্দিনের স্ত্রী লিপি খাতুন জানান, তার স্বামী সাহাবুদ্দিন ঝিনাইদহের সেচ বিতানে কাজ করেন। তারা এই পাওয়ারট্রিলার পেলেও শোরুম থেকে নিয়ে আসেননি।
শৈলেন ডাক্তার জানান, আগে থেকেই তার একটি পাওয়ারট্রিলার ছিল। তাই নতুনটা তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। একসাথে দুইটা রেখে লাভ কি? পার্শ্ববর্তী জিথড় গ্রামের মৃত বাবর আলী বিশ্বাসের ছেলে সাবেক মেম্বার মোস্তফার বাড়িতে পাওয়ারট্রিলারের খোঁজে গেলে জানা যায় একই ইউনিয়নের মাড়ুন্দি গ্রামের তুকামের কাছে তিনি সেটি বিক্রি করে দিয়েছেন। এই গ্রামের বর্তমান ইউপি সদস্য আসাদুজ্জামান টিপুর আগে থেকেই একটি পাওয়ারট্রিলার রয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে তিনি নতুন আরেকটি পেয়েছেন। তবে তার নিজের যেই টাকা দেওয়ার কথা ছিল, তার একটি টাকাও তিনি দেননি। শো-রুমের মালিক তার টাকা দিয়ে পাওয়ারট্রিলার তুলে তিনি নিজ দায়িত্বে বিক্রি করে দিয়ে কিছু নগদ টাকা তাকে দিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে আসাদুজ্জামান টিপু মেম্বার জানান, তিনি যদি জানতেন এই পাওয়ারট্রিলার নিয়ে এমন হবে তাহলে তিনি নিতেন না। সামন্য কিছু টাকার জন্যে তিনি দুর্নামের ভাগিদার হতে রাজি নন। একই গ্রামের মৃত শঙ্করের ছেলে সঞ্জিত ও মৃত নিরঞ্জনের ছেলে সুরঞ্জনও এই কৃষি অফিস থেকে প্রণোদনার পাওয়ারট্রিলার পেয়েছেন। সঞ্জিতের পাওয়ারট্রিলার বিক্রি করে দিয়েছেন। সঞ্জিতের ছেলে জানান, তার ভাই বিদেশ যাওয়ার জন্য টাকার প্রয়োজন ছিল, তাই বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। সুরঞ্জন জানান, তার আগে থেকেই একটি পাওয়ারট্রিলার রয়েছে। তাই তিনি নতুনটা কিছুদিন আগে বিক্রি করে দিয়েছেন। তার ভাগ্নে কৃষি অফিসে চাকরি করেন বলেও তিনি জানান।
তথ্য নিয়ে আরও জানা গেছে, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হরিশংকরপুর, ঘোড়শাল, সুরাট, পাগলাকানাই, সাগান্না, পোড়াহাটি, হলিধানী ও পৌর এলাকায় হারভেস্টার, পাওয়ারট্রিলার বা রাইস প্লান্টার দেওয়া হয়েছে। হরিণাকুণ্ডু, শৈলকুপা, কালীগঞ্জ ও মহেশপুরেও প্রণোদনার টাকায় কেনা কৃষি যন্ত্রপাতি নিয়ে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি হয়েছে। ঝিনাইদহ শহরের জিন্নাহ মার্কেটের কামাল মেশিনারিজের দোকানে প্রণোদনার পাওয়ারট্রিলার বিক্রির জন্য রাখা হয়। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানের নামে এসব পাওয়ারট্রিলার বরাদ্দ করে এনে কালো বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে এমন অভিযোগ উঠেছে।
কৃষি যন্ত্রপাতি কেনা নিয়ে ঝিনাইদহ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহিদুল করিম জানান, প্রণোদনায় প্রাপ্ত কৃষি যন্ত্রপাতিগুলো ৩ বছরের আগে বিক্রি বা হস্তান্তর করতে পারবেন না। ঝিনাইদহে যন্ত্রের প্রকারভেদে সরকার একেক রকমের প্রণোদনা দিচ্ছেন। একটি হারভেস্টারের সরকার বর্তমানে ১৪ থেকে সাড়ে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি দিচ্ছেন। সিডারে বর্তমানে ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি দিচ্ছে। শুধু পাওয়ারট্রিলারে ৫০ হাজার টাকা, পাওয়ার থ্রেসারে ৪৮ হাজার, রিপারে ৯০ হাজার, বেড প্লান্টারে ৯০ হাজার ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। প্রতিবছর উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে কৃষি অফিসে আবেদন করতে বলা হয়। আবেদনের ভিত্তিতে তালিকা তৈরি করে কমিটির মাধ্যমে ঢাকায় পাঠানো হয়। পাশ হয়ে আসলে বিতরণ করা হয়। মেশিনের দাম সব প্রকল্প অফিস থেকে পাশ হয়ে আসে।
ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আজগার আলী জানান, ‘কৃষক যদি পাওয়ার পরে বিক্রি করে ফেলেন, তাহলে আমরা কি করবো। আমরা তো কৃষকের ভালোর জন্যই দিচ্ছি।’ এই বিষয়ে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনওদের সাথে কথা বলতে বলেন। ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সাদিয়া জেরিন জানান, তিনি গত ডিসেম্বরে ঝিনাইদহে যোগদান করেছেন। তার যোগদানের পরে প্রণোদনার কোনো যন্ত্রপাতি বিতরণ করা হয়নি। তবে যেহেতু প্রশ্ন উঠেছে, এই বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখবেন তিনি।
ঝিনাইদহের অগ্নিবীণা সড়কের সেচ বিতান ও বিসমিল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং মেশিনারিজ থেকেই এই কৃষি যন্ত্রপাতিগুলো সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এর মধ্য সেচ বিতান থেকেই বেশিরভাগ করা হয়েছে। সেচ বিতানের কর্মচারী সাহাবুদ্দিন নিজে কৃষক, কাজ না করলেও তিনি পেয়েছেন প্রণোদনার পাওয়ারট্রিলার। অন্যান্য সকল ইউনিয়ন বা এলাকা থেকে ফুরসুন্ধি ইউনিয়নের মানুষের নাম বেশি রয়েছে তালিকায়।
জানা গেছে, সেচ বিতানের মালিক রিপনের বাড়ি ফুরসুন্ধি ইউনিয়নে। তার চেষ্টাতেই এই ইউনিয়নের লোকজনের নাম বেশি এসেছে। সেচ বিতানের মালিক রিপন অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, তিনি নিজের টাকা দিয়ে কারো নামে প্রণোদনার যন্ত্রপাতি উত্তোলন করেননি। জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মালিক আলমগীর হোসেন জানান, ঝিনাইদহের বাজারে যে পাওয়ারট্রিলারগুলো পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গার। এগুলো ঝিনাইদহের নয়।
ঝিনাইদহ জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আলম জানান, ‘আমরা প্রণোদনার পাওয়ারট্রিলারসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি বাজারে বিক্রি হচ্ছে, এমন তথ্যের ভিত্তিতে জেলার বিভিন্ন জায়গায় তদন্ত করেছি। অনেকগুলো জায়গায় এর সত্যতা পেয়েছি। আমরা আরও তদন্ত করব। এই বিষয়ে আমরা মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর কাছে জানাবো।’ সমন্বিত ব্যবস্থার কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম জানান, ‘সারাদেশে খুব সচ্ছভাবে এই প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে। ঝিনাইদহে কিছু অনিয়মের তথ্য আমি শুনেছি। আমরা তদন্ত করব। সত্যতা পেলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’