সমীকরণ প্রতিবেদন:
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আএমএফ) থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ পাওয়ার শর্ত পূরণে সীমিত পরিসরে ঋণের সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। এজন্য সংশোধন হচ্ছে মুদ্রানীতি। আগামী ১৫ জানুয়ারি নতুন বছরের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এমন এক সময়ে এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হচ্ছে যখন ঋণ নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা করতে আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ আসছেন ঢাকায়। আগামী ১৪ জানুয়ারি শনিবার ঢাকায় পৌঁছাবেন তিনি। ফিরে যাবেন ১৮ জানুয়ারি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এ জন্য বেড়ে গেছে আমদানিকৃত পণ্যের দাম। পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে। সব মিলেই পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এ জন্য গত কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে চলে গেছে। আর এ মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জের মধ্যেই আগামী ১৫ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মুদ্রানীতি ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মুদ্রানীতিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে আইএমএফরের ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে ঋণের সুদ বাড়ানো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের পরামর্শে দীর্ঘ দিন ধরে ঋণের সুদহার এক অঙ্কের ঘরে অর্থাৎ ৯ শতাংশের মধ্যে ধরে রেখেছে। ডলার সঙ্কটের কারণে গত জুলাইয়ে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ চেয়ে আইএমএফকে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। এ ঋণ দেয়া হবে কি না তা বিবেচনায় নিতে গত ২৬ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় সরকারের বিভিন্ন দফতরের সাথে দুই সপ্তাহের বৈঠক করে গেছে আইএমএফের দল। ঋণ দেয়ার পূর্ব শর্ত হিসেবে অর্থনীতি খাত সংস্কারসহ বেশ কিছু শর্ত দেয়া হয়েছিল। শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম শর্ত ছিল ঋণের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশ তুলে দেয়া। অর্থাৎ সুদহার বাজারভিত্তিক করা। অন্যান্য শর্তগুলোর মধ্যে ছিল বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব পদ্ধতি ঠিক করা, জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পদ্ধতি কার্যকর করা, আয়কর আইন সংসদে পাস করা, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা, আদায়ের অযোগ্য খেলাপি ঋণ বিষয়ে আলাদা কোম্পানি গঠন করা, করছাড়ের ওপর বিশদ নিরীক্ষা করা, বাজেটের নির্দিষ্ট অংশ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির জন্য রাখা, ভর্তুকি কমানো, বাজেট থেকে সঞ্চয়পত্রকে আলাদা করা, নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনা, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানো, ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের হিসাবপদ্ধাতি ঠিক করার প্রক্রিয়া হাতে নেয়া হয়েছে। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ থেকে ইতোমধ্যে ব্যবহৃত প্রায় সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার বাদ দিতে হবে। অপর দিকে, দৃশ্যমান সংশোধনীর মধ্যে এবার নতুন মুদ্রানীতিতে ঋণের সুদহার সীমিত পরিসরে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মুদ্রানীতি প্রণয়নের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সীমিত পরিসরে ঋণের সুদহার বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হবে। কারণ, এমনিতেই মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। ঋণের সুদহার বাড়লে একদিকে টাকার প্রবাহ কমে যাবে, এটা যেমন ঠিক, তেমনি আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এতে মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দেবে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই সীমিত পরিসরে ঋণের সুদহার বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হবে। অপরদিকে ইতোমধ্যে ভর্তুকি কমাতে জ্বালানি তেলের দাম প্রায় ৪৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে। দুই/ একদিনের মধ্যেই বিদ্যুতের দাম বাড়তে পারে। এ ছাড়া মোটা দাগে তিন শর্তের আওতায় ২৪টি উপশর্ত রয়েছে। অক্টোবর-নভেম্বর সফরকালে দেয়া আইএমএফের এসব শর্ত পরিপালনের অগ্রগতি জানতে আইএমএফের একটি মিশন আগামী ১৪ জানুয়ারি ঢাকায় আসছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সফরকালে আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সাথে বৈঠক করবেন। ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে যাবেন তিনি। আইএমএফের ডিএমডি ১৮ জানুয়ারি যাবেন পদ্মা সেতু দেখতে এবং ওই দিনই তিনি ঢাকা ছাড়বেন। অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, ২৯ জানুয়ারি বসবে আইএমএফের পর্ষদ বৈঠক এবং আইএমএফের ডিএমডি বাংলাদেশ সফর করে চলে যাওয়ার পরই ঋণ প্রস্তাব উঠবে পর্ষদে। পর্ষদে প্রস্তাবটি তারই উত্থাপন করার সম্ভাবনা রয়েছে। পর্ষদ অনুমোদন দেয়ার পরই ঋণের শর্তগুলো প্রকাশ করবে আইএমএফ। চূড়ান্ত চুক্তি হবে ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়ার আগে আগে। পর্ষদের অনুমোদনের বড়জোর ১০ দিনের মধ্যে পাওয়া যাবে ঋণের প্রথম কিস্তি ৪৫ কোটি ৪৫ লাখ ৩১ হাজার ডলার। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এটা পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। সাত কিস্তির এ ঋণের সর্বশেষ কিস্তির ঋণ পাওয়া যাবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে। ঋণের গড় সুদহার হবে ২ দশমিক ২ শতাংশ।
