সমীকরণ প্রতিবেদন:
আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির (জাপা) ভূমিকা কী হবে তা নির্ধারণে মঙ্গলবার দলের কেন্দ্রীয় কমিটি এবং জেলা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের যৌথসভা হয়েছে। এতে বক্তৃতা করা ৫৯ নেতার দুইজন বাদে বাকিরা আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে বর্জনের পক্ষে বলেন। সভা সূত্র আরও জানায়, আগের দিন পাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের চিঠির প্রসঙ্গ টেনে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, ‘যদি সংলাপ না করা হয়, তাহলে সরকারের উপর নিশ্চিতভাবে বড় ধরনের স্যাংশন আসতে পারে।’
রাজধানীর কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টায় শুরু হয়ে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলে জাপার যৌথসভা। বুধবার আগামী নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হতে পারে। গতকাল সোমবার শর্তমুক্ত সংলাপের তাগিদ দিয়ে চিঠি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। চাওয়া পূরণ না হলে চিঠিতে নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারির দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জি এম কাদের।
জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে জাপা চেয়ারম্যান এবং দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বক্তৃতা করেন যৌথসভায়। সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা উপস্থিত থাকলেও বক্তৃতা করেননি। জি এম কাদের তৃণমূলের নেতাদের বক্তব্যের নোট এবং তাঁদের কাছ থেকে লিখিত প্রশ্ন নেন। পরে বক্তব্যে এর উত্তর দেন বলে জাপা সূত্র জানিয়েছে। আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচন নিয়ে দলের নেতাদের মতামত শোনা হয়েছে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জি এম কাদেরকে।’
জাপা সূত্রটি জানিয়েছে, রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বা বিএনপিবিহীন নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিপক্ষে মতামত দেন। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করা যায় না। আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে অপমান অপদস্থ করছে।’ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জাপার সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলামও সরকারি দলের উপর ক্ষোভ ঝাড়েন। তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টি সম্মান পায় না। দলের এমপিরা পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের জন্য কাজ করতে পারে না।
একই অভিমত জানিয়ে আওয়ামী লীগের জোটে না যেতে এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে তা বর্জনের দাবি জানান সিরাজগঞ্জ জেলার সভাপতি আমিনুল ইসলাম ঝন্টু।’
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা জাপার সভাপতি নুরুছ ছফা সরকার বলেন, ‘নির্বাচন অবাধা নিরপেক্ষ না হলে, সেই ভোটে অংশ নিলে জাতীয় পার্টি দালাল হিসেবে চিহ্নিত হবে।’ জাপার এমপি আহসান আদেলুর রহমান বলেন, ‘বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জনমত সরকারের বিরুদ্ধে।’ যে দুই নেতা আওয়ামী লীগের পক্ষে বলেন, তাদের একজন ঢাকা মহানগর উত্তর জাপার সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম পাঠান। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে না থাকলে বিপাকে পড়তে হবে।’ তখন বাকি নেতারা দালাল! দালাল! দুয়োধ্বনি দেন।
তখন জাপা মহাসচিব প্রশ্ন করেন, ‘তাহলে আমরা কার সঙ্গে যাব?’ সভা সূত্র জানিয়েছে, সেই সময়ে সভা থেকে কয়েকজন নেতা বলেন, ‘বিএনপি! বিএনপি!’ কয়েকজন নেতা বিএনপি, বিএনপি ধ্বনি দেন। এ সময় জি এম কাদের বলেন, ‘বিএনপি যে মূল্যায়ন করবে, তারই বা কী নিশ্চয়তা আছে।’ তৃণমূলের নেতাদের উদ্দেশ্যে মুজিবুল হক চন্নু বলেন, ‘শুধু আবেগ দিয়ে রাজনীতি হয় না। দলের সিদ্ধান্ত মানতে হবে।’ এ সময় তৃণমূলের নেতারা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে গেলে ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে হবে। ২০-২৫টা আসন দিয়ে হবে না। ১০০ আসন এবং ১০টি মন্ত্রিত্ব দিতে হবে।’
জাপার একজন জ্যেষ্ঠ নেতা নিশ্চিত করেছেন, জেলা পর্যায়ের নেতারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তবে নির্বাচনে অংশ না নেওয়া ছাড়া পথ খোলা নেই। তিনি বলেন, ‘মার্কিন চাওয়া পূরণে আওয়ামী লীগ সংলাপ ডাকতে পারে। তাতে বিএনপি অংশ নিতে পারে। দলটি নির্বাচনেও অংশ নিতে পারে। সেক্ষেত্রেও জাপাকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে হবে।’
সমাপনী বক্তব্যে নেতাদের উদ্দেশ্যে জি এম কাদের বলেন, ‘আপনাদের বেশিরভাগই বলেছেন জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগ অন্যায় করেছে। সম্মান, মর্যাদা দেয়নি। তার মানে বলতে চাইছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে যাওয়া ঠিক হবে না।’ তখন উপস্থিত নেতারা জী! জী! বলে ধ্বনি দেন। জি এম কাদের বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌছেছে, সব বড় রাজনৈতিক দল খাদের কিনারায় রয়েছে। একটু বেহিসেবি পদক্ষেপ নিলে, গভীর খাদে পড়তে হবে। আওয়ামী লীগও যদি কোনোক্রমে পিছলে যায় ক্ষমতা থেকে, বহুদিন ধরে মাশুল দিতে হবে। বিএনপি নিজেদের সিদ্ধান্ত সঠিক প্রমাণ করতে না পারলে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। জাতীয় পার্টি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে, দল হিসেবে অনেক উপরে উঠে যাবে। ভুল করলে অস্তিত্ব সংকট হতে পারে।’
জাপা বছরের শুরুতে জানিয়েছিল সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। জি এম কাদের নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘অক্টোবরের পর নভেম্বর চলে যাচ্ছে, এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। যেহেতু পরিস্থিতি এখনও অত্যন্ত অস্পষ্ট। বর্তমানে অত্যাচারের শিকার হয়েছি। এমপিরা পর্যন্ত নিগৃহীত হয়েছেন। ক্ষমতার বাইরে থেকে নানাভাবে অপমানের শিকার হয়েছি। জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের সুযোগ দেওয়া তো দূরের কথা, সম্মান পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।’
তৃণমূলের নেতারা যে মতামত দিয়েছেন তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবেন জানিয়ে জাপা চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নেব না। জাতীয় পার্টিকে এতদিন দুর্বল করে রাখা গেছে, কারণ ঐক্যবদ্ধ ছিলাম না। যখনই সিদ্ধান্ত নিতে গেছি, আমাদেরই কিছু লোক সমস্যা করেছে। এতে সবার ধারণা হয়েছে, জাতীয় পার্টিকে ভাঙা যায়। বিএনপিকে কিন্তু চেষ্টা করেও ভাঙা যায়নি। তারা যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তা কিন্তু বাস্তবায়ন করছে।’
জি এম কাদের সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘একচেটিয়া ক্ষমতা জোর করে দখল করে রাখবেন, মানুষের কথা শুনবেন না, মানুষ ভোট দিতে পারছে না, এটা দেশের মানুষ মানতে পারছে না। এখন মার্কিন সরকারও বলছে, নিঃশর্ত সংলাপ করতে। তা না হলে ভিসা নিষেধাজ্ঞাসহ, শাস্তিমূলক যে ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশের করার কথা, তা বাস্তবায়ন করবে। সুষ্ঠু নির্বাচন যদি না হয়, সরকার যদি সংলাপ না করে, তাহলে নির্বাচনে গেলে, স্যাংশন আসছে। যদি আলাপ-আলোচনা করে তাহলে সরকারের উপর ডেফেনেটলি বড় ধরনের স্যাংশন আসতে পারে।’