চুয়াডাঙ্গার কৃতী সন্তান ও বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সহযোগিতা অব্যাহত
শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টায় বদলে যাচ্ছে সদর হাসপাতালের দৃশ্যপট- আপলোড টাইম : ০৯:১৮:৪৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২১ অগাস্ট ২০২৪
- / ৭২ বার পড়া হয়েছে
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল দীর্ঘদিন ধরে অবহেলা এবং সঠিক তত্ত্বাবধানের অভাবে ন্যায্য চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত ছিল সাধারণ রোগীরা। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, হাসপাতালের স্টাফ এবং স্বেচ্ছাসেবকদের স্বেচ্ছাচারিতা, ওয়ার্ডের রোগীদের থেকে সেবার নামে টাকা আদায়, সবমিলিয়ে হাসপাতালের চিত্র ছিল শোচনীয়। তবে শিক্ষার্থীদের একটি উদ্যোগে এই চিত্র বদলাতে শুরু করেছে। জেলার কৃতী সন্তান ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অনুপ্রেরণা, সহযোগিতা এবং নেতৃত্বে উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রেরণা ও সাহসকে কাজে লাগিয়ে হাসপাতালের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছেন। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে হাসপাতালের পরিবেশ ও সেবার মানোন্নয়ন হচ্ছে।
সরেজমিন ও রোগীদের অভিযোগে জানা যায়, হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের নষ্ট লাইট, ফ্যান এবং অনুপযোগী টয়লেটসহ অবকাঠামোগত সমস্যা রোগীদের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। এর সাথে যুক্ত ছিল নার্সদের দুর্ব্যবহার, যা পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে চুয়াডাঙ্গায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-গণআন্দোলন ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, রাজনৈতিক সংগঠন ও নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপ এক বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।
চুয়াডাঙ্গা জেলার কৃতী সন্তান ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দিকনির্দেশনায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা সদর হাসপাতালের এই অব্যবস্থাপনা নিয়ে সরব হয়। গত ১০ আগস্ট সকালে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সরাসরি হাসপাতালে গিয়ে প্রায় ৩ ঘণ্টাব্যাপী তদারকি করে। উঠে আসে দীর্ঘদিন ধরে অব্যবস্থাপনায় থাকা হাসপাতালটির চিত্র। যেখানে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা স্থানীয় জনগণের জন্য চরম দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে এবং তা কর্তৃপক্ষের নজরে আনে।
পরবর্তীতে ১৭ আগস্ট শিক্ষার্থীরা জেলা সিভিল ডা. সার্জন ডা. সাজ্জাৎ হাসান, চুয়াডাঙ্গা বক্ষব্যধি ক্লিনিকের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. ফাহেত্ আকরাম এবং সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. ওয়াহিদ মাহমুদ রবিন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। এসময় শিক্ষার্থীরা হাসপাতালের ত্রুটি তুলে ধরে তা সমাধানে কর্মপন্থা নির্ধারণ করেন। চুয়াডাঙ্গার কৃতী সন্তান বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সাহিদ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলহাজ্ব সাহিদুজ্জামান টরিকের সহযোগিতায় সংশ্লিষ্ট উচ্চপর্যায়ের কর্তৃপক্ষকেও এই বিষয়ে অবহিত করে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা। এরপর থেকেই হাসপাতালের পুরাতন ও সম্প্রসারিত নতুন ভবনের চিত্র পাল্টাতে শুরু করে।
চুয়াডাঙ্গা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রোভার স্কাউট, স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন বাঁধন, রেড ক্রিসেন্ট, বিএনসিসি ও সংযোগসহ এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, দেয়াল লিখন ও ছবির আর্ট কর্মসূচিতে। তাদের অঙ্কিত বিভিন্ন গ্রাফিতি হাপসাতালের সৌন্দর্য্যকে কয়েকগুন বৃদ্ধি করেছে।
এছাড়াও শিক্ষার্থীরা হাসপাতালের জরুরি বিভাগসহ ওয়ার্ডের বিভিন্ন স্থানে দালাল অপসারণে কাজ করে। এবং বর্তমানে হাসপাতালটি দালালমুক্ত হয়েছে। রোগীদের থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া বন্ধ হওয়ায় তারা খুশি। এছাড়া ওয়ার্ডের পরিবেশ, টয়লেট ও বেসিন পরিষ্কার ও ব্যবহার উপযোগী হওয়ায় রোগী ও তাদের স্বজনদের ভোগান্তিও অনেকটা কমে গেছে। তবে এই পরিবর্তন ধরে রাখা কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই সংশয় রয়েছে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের মতো একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের সব কার্যক্রমে নজরদারি করা এবং সেগুলোকে যথাযথভাবে পরিচালনা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নিজেদের দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। শিক্ষার্থীরা যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা যদি হাসপাতালে স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে, তবে এটি একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
শিক্ষার্থীদের দাবি, তারা এই আন্দোলন চালিয়ে যাবে যতদিন না পর্যন্ত নিশ্চিত হয় যে, সদর হাসপাতাল তার সেবার মান বজায় রাখতে পারছে। তাদের বক্তব্য অনুসারে হাসপাতালের কর্মচারী ও সেবাদানকারী কর্মকর্তাদেরও তাদের কাজে মনোযোগী হওয়া উচিত। শুধুমাত্র আন্দোলনের ফলেই যদি সাময়িক পরিবর্তন আসে, তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। এজন্য কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সেগুলো নিয়মিতভাবে মনিটরিং করতে হবে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাফ্ফাতুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা নিজেরাই ভুক্তভোগী। আমাদের পরিবারের লোকজন এখানে এসে যখন সেবা পায় না, তখন আমাদের কষ্ট হয়। তাই আমরা চাই, এই হাসপাতালটা সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুক, আর কোনো দালাল যেন এখানে না থাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ ধরনের উদ্যোগ শুধু একটি জেলার নয়, পুরো দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।’
গতকাল মঙ্গলবার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগীর স্বজন সৈকত ইসলাম বলেন, ‘আগে এখানে আসলে শুধু টাকা চাইত। এখন সেটা নেই। পরিবেশও অনেক ভালো। চিকিৎসা পাওয়াটা সহজ হয়েছে।’ অন্য রোগীরা মনে করছেন যে, শিক্ষার্থীদের এই উদ্যোগ শুধু তাদের জন্য নয়, ভবিষ্যতেও অনেকের উপকারে আসবে। এছাড়া অনেকে এই পরিবর্তনকে যুগান্তকারী হিসেবে অভিহিত করছেন।
অপর এক রোগীর স্বজন বলেন, ‘পূর্বের থেকে টয়লেট পরিষ্কার থাকায় একটি বড় সমস্যার কিছুটা সমাধান হয়েছে। এটুকু সুবিধা পেলে আমরা খুশি। এ ধরনের উদ্যোগ আরও বেশি প্রয়োজন, যাতে করে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা আরও উন্নত হতে পারে।’
হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. ওয়াহিদ মাহমুদ রবিন বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের এই উদ্যোগ খুবই প্রশংসনীয়। আমরা তাদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করছি এবং রোগীদের সেবায় কোনো ত্রুটি রাখতে চাই না। আমাদের লক্ষ্য হলো, এই পরিবর্তনকে স্থায়ী করা এবং রোগীদের জন্য সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করা। তবে জনবল সংকট হাসপাতালের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
জেলা সিভিল সার্জন ডা. সাজ্জাৎ হাসান বলেন, ‘হাসপাতালের পরিবেশ উন্নত করতে শিক্ষার্থীরা যে ভূমিকা পালন করেছে, তা অনন্য। আমরা চাই এই পরিবর্তন স্থায়ী হোক, আর সে জন্য আমরা প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এ ধরনের আন্দোলন যদি দেশের প্রতিটি হাসপাতালে শুরু হয়, তাহলে স্বাস্থ্যসেবার মান অনেক উন্নত হবে। সদর হাসপাতালে শিক্ষার্থীদের এই উদ্যোগ সমাজে একটি উদাহরণ স্থাপন করেছে এবং জনগণের জন্য আরও উন্নত সেবা প্রদানের লক্ষ্য নিয়ে হাসপাতালটি এখন কাজ করে যাচ্ছে।’