শান্তি প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসেনি কেউ; ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের লক্ষণ নেই

সম্পাদকীয়

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের বছরপূর্তি হতে চলছে দু’দিন পর। এ যুদ্ধ নিয়ে এখন অনিশ্চয়তা আরও বেড়েছে। অথচ শুরুতে রাশিয়া একটি স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে নেমেছিল। প্রথমে মস্কো সেই ভাষ্য দিয়েছিল। এখন এটি জয়-পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হবে না; তা নিশ্চিত বলা যায়। সমূহ আশঙ্কা রয়েছে এর মাধ্যমে ইউরোপে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাতে জড়িয়ে পড়তে পারে পরাশক্তিগুলো। ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত করতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
একুশ শতকে উন্নত দেশগুলো মানবতা চর্চার যে বুলি আওড়িয়েছে; এ যুদ্ধ প্রমাণ করে, কেউ তা বিশ্বাস করে না। প্রত্যেকের রয়েছে একটি নিজস্ব এজেন্ডা, সেখানে মানবতার মূল্য খুব সামান্য। আসলে শক্তিশালী দেশগুলো প্রত্যেকে শান্তির বদলে নিজের স্বার্থসিদ্ধিতে ইউক্রেন যুদ্ধ ব্যবহার করছে, ইতোমধ্যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিলেও এটি যে পশ্চিমাদের ছায়াযুদ্ধ, সন্দেহাতীতভাবে তা বলা যায়। চীন ও ভারতের মতো দেশ এ থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করাকেও সর্বাধিক প্রাধান্য দিচ্ছে। যুদ্ধের সুযোগে চীন ও ভারত বাজারদরের চেয়ে কম দামে রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি তেল কিনছে। এ ব্যবসায় যাতে অবাধে চালাতে না পারে সে জন্য সমুদ্রপথে রাশিয়ার তেল সরবরাহের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জি-সেভেনভুক্ত দেশগুলো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সেই সাথে এসব দেশ রাশিয়ান তেল কেনার দর ৬০ ডলার নির্ধারণ করে দেয়। গত বছর ডিসেম্বরের শেষে ইকোনমিক টাইমস এ খবর দেয়। বাস্তবে দেখা গেল- চীন ও ভারতের মতো দেশগুলো সুযোগ নিয়ে রাশিয়া থেকে আরো কম দামে তেল কিনছে। এমনকি শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার কাছ থেকে উৎপাদন খরচের চেয়ে ১২-১৫ ডলার কমে ভারত তেল কিনছে। এই কর্ম করতে গিয়ে ভারতের পশ্চিমা মিত্ররা দিল্লির ওপর ভীষণ খেপেছে।
অবস্থা পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, যুদ্ধের মাঠ আরো গরম হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ দফায় দফায় ইউক্রেনকে অর্থ, অস্ত্র এবং গোলাবারুদ সরবরাহ করছে। জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সর্বাধুনিক ট্যাংক সরবরাহ পেতে যাচ্ছে। কয়েক বছরের মধ্যে দেশ দু’টি থেকে আরও বেশি সংখ্যায় এর জোগান পাবে। এর সাথে যুদ্ধবিমান সরবরাহ নিয়েও কথা উঠেছে। রাশিয়ার আক্রমণ ঠেকাতে ট্যাংক ও বিমানবিধ্বংসী প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আগেই দেয়া হয়েছে। সে কারণে যতটা সহজে ইউক্রেনকে পরাভূত করার আশা করেছিল মস্কো; সেটি হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন শঙ্কা প্রকাশ করছেন, চীন ভবিষ্যতে রাশিয়াকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করবে। সংবাদমাধ্যম সিবিএসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, চীনা কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যে প্রাণঘাতী নয়, এমন অস্ত্র রাশিয়াকে দিয়েছে। এবার প্রাণঘাতী অস্ত্র সরবরাহ করবে। জার্মানিতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ ব্যাপারে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেন ব্লিঙ্কেন। আরও অভিযোগ আনা হয়, চীনা একটি কোম্পানি রাশিয়াকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেছে। অন্য দিকে, এর জবাবে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, এ যুদ্ধের কিভাবে অবসান হবে তা নিয়ে একটি ডকুমেন্ট প্রকাশ করবে বেইজিং। তবে চীনের এই শান্তিবাদী কথার বাস্তবতা দৃশ্যমান নয়।
যুদ্ধ অবসানে বৈশ্বিক শক্তিগুলো কী করেছে তার ইতিবাচক কোনো জবাব নেই। একটি স্বাধীন দেশকে আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে আক্রমণ করা যেমন গুরুতর অন্যায়; তেমনি আক্রান্ত পক্ষকে অস্ত্র সরবরাহ করাও এর সমাধান নয়। অন্যদিকে, যারা এ সুযোগে নিজস্ব লাভ বাগিয়ে নিচ্ছে, তারা মূলত ‘ঘরে আগুন ধরার সুবাদে আলু পোড়া খাচ্ছে।’ এটি নিরেট স্বার্থপরতা ছাড়া আর কিছু নয়। বিশ্বকে আরেকটি ভয়াবহ যুদ্ধের ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে হলে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনতে হবে। পক্ষগুলোকে নিরাপত্তা উদ্বেগের বিষয়টি সর্বাধিক প্রাধান্য দিতে হবে। প্রয়োজনে নিজের স্বার্থ কিছুটা হলেও ছাড় দিতে হবে। এ ধরনের অবস্থান এখনো কোনো পক্ষ থেকে প্রস্তাব আকারে আসেনি।