সমীকরণ প্রতিবেদন: বর্তমানে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। দিন দিন এ রিজার্ভ নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ। এক বছর আগে ঠিক এ সময়ে নতুন উচ্চতায় ছিল বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার। সে অবস্থা এখন আর নেই। আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণের নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বরং এ ব্যয় আরও বেড়েছে। যার কারণে চাপ বাড়ছে রিজার্ভের ওপর। ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি ঘিরে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাস, পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত শ্রীলংকার খেলাপি হয়ে যাওয়া আর ডলারের চড়া মূল্য– এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার বর্তমান রিজার্ভ যথেষ্ট কি না, সেই আলোচনা সামনে এসেছে। বাংলাদেশের রিজার্ভ দিয়ে এক সময় আট মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব ছিল। সে সক্ষমতা এখন কমে হয়েছে চার মাসেরও কম। মূলত আমদানি ব্যয় মেটাতেই শেষ হচ্ছে রিজার্ভ। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এখনই সতর্ক না হলে অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। কাগজে–কলমে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এ হিসাব নিয়ে আছে বিতর্ক। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রকৃত রিজার্ভের অঙ্ক ৩২ বিলিয়ন ডলার। তাদের যুক্তি হচ্ছে ৭ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা ইডিএফ ফান্ড এবং সবুজ রূপান্তর তহবিল বা জিটিএফ ও শ্রীলংকার ঋণ বাদ দিতে হবে। এরপর প্রকৃত রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩২ বিলিয়ন ডলার। শ্রীলংকাকে ২০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার আশ্বাস রয়েছে বাংলাদেশের। প্রশ্ন হচ্ছে এ ৩২ বিলিয়ন ডলার দিয়ে কত মাসের আদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
জানতে চাইলে অর্থনীতির বিশ্লেষক গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘৩২ বিলিয়ন ডলার দিয়ে আমাদের চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। গত বছর এ সময়ে রিজার্ভের যে পরিমাণ ছিল তা দিয়ে আট মাসের ব্যয় মেটানো সম্ভব হতো।‘ তিনি বলেন, ‘রিজার্ভ কমতে সময় কিন্তু বেশি লাগে না। আর কিছু দিন পরেই আমরা ক্রিটিক্যাল লেভেলে চলে যাব।‘ এদিকে, রিজার্ভের অর্থ ব্যবহার কমিয়ে আনতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তার সুফল নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে আরও কঠোর হওয়ার সুযোগ আছে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘যারা পেনশন রিটায়ারমেন্টে চলে যাচ্ছেন তাদের যাওয়া উচিত। এক্সটেনশন দেওয়া ঠিক হবে না। বিভিন্নভাবে ব্যয় সংকোচন করতে হবে। দেশে সরকারের অনেক মন্ত্রণালয় আছে যেগুলো না থাকলেও চলে। যেমন– পাট মন্ত্রণালয়। এটি না থাকলেও চলে। কারণ আমরা কোনো পাট রপ্তানি করি না। যার জন্য একটি মন্ত্রণালয় দরকার হবে। আমাদের সরকার আছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আছে, বিজিএমইএ আছে এ জন্য আলাদাভাবে বস্ত্র মন্ত্রণালয়েরও কোনো প্রয়োজন পড়ে বলে আমি মনে করি না।‘ রিজার্ভকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে প্রধান উৎস রেমিট্যান্স। অর্থাৎ বিদেশ থেকে পাঠানো অর্থপ্রবাহ বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ে। অন্যদিকে তা রপ্তানি আয়েও ভূমিকা রাখে। তাই রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে আরও কর্মী সহায়ক হওয়া দরকার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রিজার্ভ বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রবাসী আয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ আয় আনার ক্ষেত্রে বৈধ চ্যানেলে যেন আসে সেটা দেখতে হবে। রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে যে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে তার সঙ্গে যেন কার্ব মার্কেটের বেশি পার্থক্য না হয় তাও দেখতে হবে।
পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, ‘আমাদের দেশ থেকে প্রচুর কর্মী এখন বিদেশে যাচ্ছে। রপ্তানি আয়ও প্রচুর বাড়ছে। সুতরাং এ মুহূর্তে রিজার্ভ সংকটে আছে তা আমি মনে করি না।‘ পরিসংখ্যান ঘেটে দেখা গেছে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৯ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। এরপর থেকে রিজার্ভ বাড়তে বাড়তে গত বছরের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। এরপর আমদানি বাড়তে থাকায় এই রিজার্ভ কমতে শুরু করে। এক বছর আগে ৬ জুলাই রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৬ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। গত ২০২১–২২ অর্থবছরের শেষ দিন ৩০ জুন রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪১ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার। ঈদের ছুটির আগে ৭ জুলাই ছিল ৪২ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। ঈদের আগে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহে ঢল নামার পরও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণে এই সূচক ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। বাজার ‘স্থিতিশীল‘ করতে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় নতুন অর্থবছরেও বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সোমবারও ১০ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২২–২৩ অর্থবছরের ১৮ দিনে (১ থেকে ১৮ জুলাই) ৬৮ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর বিপরীতে বাজার থেকে ৬ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা) তুলে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে রিজার্ভ দুই বছর পর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসার পর আর ওপরে উঠছে না।
এদিকে বিশ্ব বাজারে পণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে হু–হু করে বাড়ছে আমদানি ব্যয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে আমদানি নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের লাগাম টানা হলেও এ খাতে ব্যয় কমানো সম্ভব হচ্ছে না। উলটো আমদানি ব্যয় আরও বেড়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত এই ১১ মাসে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। একই সময়ে এলসি খোলা বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। ১১ মাসের হিসাবে আমদানি ব্যয় বাড়লেও গত কয়েক মাসের তুলনায় মে মাসে আমদানি ব্যয় বাড়ার হার কিছুটা কমেছে। সার্বিকভাবে আমদানি ব্যয় বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রবল চাপে পড়েছে। সূত্র জানায়, করোনার পর আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম প্রথম দফায় বেড়েছে। গত ২৪ ফেব্রম্নয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে পণ্যের দাম দ্বিতীয় দফায় আরও একবার বাড়ে। এতে কোনো কোনো পণ্যের দাম ৩৬ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে সার্বিকভাবে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। যে হারে আমদানি ব্যয় বেড়েছে, ওই হারে রপ্তানি আয় বাড়েনি। একইসঙ্গে রেমিট্যান্স প্রবাহও কমেছে। এসব মিলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে খরচ বেড়েছে বেশি। বাড়তি বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দেওয়া হচ্ছে রিজার্ভ থেকে। এতে রিজার্ভে টান পড়েছে। যে কারণে আমদানি ব্যয় কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রথমে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ছাড়া বাকি সব পণ্যে ২৫ শতাংশ এলসি মার্জিন আরোপ করে। এতেও আমদানি নিয়ন্ত্রণে না এলে এলসি মার্জিন বাড়িয়ে ৫০ ও ৭৫ শতাংশ আরোপ করে। তাতেও পুরো সুফল না মেলায় মার্জিন আরও বাড়িয়ে বিলাসী পণ্যে শতভাগ করা হয়। একই সঙ্গে এসব পণ্য আমদানিতে ঋণ বিতরণ বন্ধ করে দেয়। এর আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে বিলাসী পণ্যে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করা হয়। ব্যাংকগুলো থেকে বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে ডলারের জোগান বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২০–২১ অর্থবছরের জুলাই–মে মাসে আমদানি ব্যয় বেড়েছিল ১৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। ২০২০–২১ অর্থবছরের জুলাই মে মাসে আমদানির এলসি খোলা বেড়েছিল ২২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। গত মে মাসে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ১৯ শতাংশ, এপ্রিলে সাড়ে ২৩ শতাংশ ও মার্চে সাড়ে ২৫ শতাংশ। সূত্র জানায়, ওই সময়ে ডলারের হিসাবে আমদানি ব্যয় বাড়লেও পণ্য আমদানি কম হয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় এখন আগের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করে কম পণ্য আমদানি করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, শিল্পের কাঁচামালের দাম বাড়ায় এখন বেশি ডলার দিয়ে কম পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। আগে ১০০ ডলার দিয়ে যে কাঁচামাল আমদানি করা যেত। এখন তা আনতে কমপক্ষে ১৫০ থেকে ১৭০ ডলার লাগে। ফলে রপ্তানিতে যে ২০ শতাংশ বা তারও কম মার্জিন বা মুনাফা থাকে তাও এখন আমদানিতে ব্যয় করতে হচ্ছে। অতিরিক্ত ডলার আর হাতে থাকছে না। আগে রপ্তানিকারকরা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি ডলার ব্যাংকের কাছে বিক্রি করত। সেই ডলার দিয়ে ব্যাংক অন্য গ্রাহকদের এলসি খুলতে পারত। এখন রপ্তানিকারকদের কাছে অতিরিক্ত ডলার থাকছে না। যে কারণে তারাও ব্যাংকে ডলারের জোগান বাড়াতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে ওষুধসামগ্রী। ২০২০–২১ অর্থবছরের জুলাই–মে মাসের তুলনায় গত অর্থবছরে একই সময়ে ওষুধের আমদানি বেড়েছে ৫১৮ শতাংশ। করোনার সময়ে যেসব ওষুধ ও চিকিৎসা উপকরণ আমদানি করা হয়েছে সেগুলোর অনেক দেনা পরিশোধ স্থগিত ছিল। এখন সেগুলো পরিশোধ করতে হচ্ছে বলে আমদানি ব্যয় এ খাতে বেশি বেড়েছে। চাল আমদানি ব্যয় বেড়েছে ১০০ শতাংশ, গম ৩২ শতাংশ, চিনি ৪৩ শতাংশ। এছাড়া ভোজ্যতেল আমদানিতে ৫৭ শতাংশ, সুতা ৩৫ শতাংশ, মিক্স সুতা ১০৬ শতাংশ, কাপড় ৪৭ শতাংশ, রাসায়নিক পণ্য ৮৫ শতাংশ, সার ১২২ শতাংশ, খাদ্যসামগ্রী ১৪১ শতাংশ বেশি ব্যয় করতে হয়েছে। অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, পরিকল্পনা করে জনশক্তি রপ্তানি করা গেলে ও অবৈধ পথে আসা প্রবাসী আয় ঠেকানো গেলে বৈধ পথে প্রবাসী আয়ও ভালো আসবে। এতে আমদানি বাড়লেও রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হবে না। এরই মধ্যে বিলাসপণ্য আমদানি ঠেকাতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের সংকট মোকাবিলায় সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। এছাড়া কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে। সংকট বা চাপ আরও বাড়ার আগে দ্রম্নত বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।