সমীকরণ প্রতিবেদন:
বাংলাদেশের রাজনীতি ফের সংঘাতময় হয়ে উঠছে। মঙ্গলবার ঢাকা ও রাজশাহীর সংঘাতসহ গত কয়েকদিনের সংঘাত-সংঘর্ষ সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। বিএনপি শনিবার নতুন কর্মসূচি দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশের পরিবর্তে প্রতিরোধ কর্মসূচি শুরু করেছে।বিশ্লেষক এবং মানবাধিকার কর্মীরা মনে করছেন, রাজনীতি যেভাবে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে তাতে সংঘাত আরো বাড়বে। রাজনৈতিক দলগুলো নমনীয় না হলে উন্নয়ন সহযোগীদের চেষ্টাও তেমন কাজে আসবে বলে তারা মনে করছেন না। পটুয়াখালী, খুলনা এবং নেত্রকোনার পর বৃহস্পতিবার ঢাকা ও রাজশাহীর ঘটনা আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ঢাকার ধানমন্ডিতে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। একটি বিআরটিসি বাসে আগুন দেয়া হয়েছে। রাজশাহীতে বিএনপি অফিসে তালা লাগিয়ে দিয়েছে পুলিশ। বিএনপি নেতারা সাম্প্রতিক এই সংঘাতের জন্য আওয়ামী লীগ এবং পুলিশকে দায়ী করেছে। তাদের কথা- যে কোনো পরিস্থিতিতে তারা আন্দোলন আরো জোরদার করবে। আর আওয়ামী লীগ বলছে, ইচ্ছকৃতভাবে সংঘাত সৃষ্টি করে বিএনপি দেশে একটি অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। তাদের প্রতিরোধ করবে আওয়ামী লীগ। দুই দলের মুখোমুখি অবস্থান: আওয়ামী লীগ আপাতত বিএনপিকে কোনো ধরনের ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়। রাজশাহীতে জনসভায় বিএনপি নেতার শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকির ঘটনা উল্লেখ করে আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, “বিএনপির উচিত ছিল ওই নেতাকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া, কিন্তু তারা সেটা করেনি। ওই নেতা যা বলেছেন তা আসলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও তারেক জিয়ারই কথা। তাই আমরা এখন থেকে আর শান্তি সমাবেশ নয়, বিএনপি-জামায়াতকে প্রতিরোধ করবো।” তার কথা, “ঢাকার ধানমন্ডিসহ কয়েকদিনে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা বিএনপি পরিকল্পিতভাবেই করেছে। নয়তো বিএনপির লোকজনের হাতে ধানমন্ডিতে বাঁশের লাঠি আসলো কীভাবে?” তিনি স্বীকার করেন, পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে তাতে দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তবে এরজন্য তিনি বিএনপিকে দায়ী করে বলেন, “আমরা জনগণকে সাথে নিয়ে তাদের প্রতিরোধ করবো। তারা যাতে কোনো অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে আমরা তা দেখবো।” আওয়ামী লীগই যদি প্রতিরোধ করে তাহলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনির কাজ কী? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আইন-শৃঙ্খলা বাহিনি তাদের কাজ করবে। কিন্তু দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব।” আপাতত বিএনপির সঙ্গে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই- এমন মত ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ” খুনিদের সাথে কিসের আলোচনা? আর বিএনপি যদি এইসব অরাজকতা বন্ধ করে নির্বাচনে আসে, অতীতের ভুল স্বীকার করে, তখন আলোচনার বিষয়ে নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী ভেবে দেখবেন।” এর জবাবে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, “দেশের এই পরিস্থিতির জন্য সরকার ও আওয়ামী লীগ দায়ী। পরিস্থিতি আরো সংঘাতময় হতে পারে সরকারের কারণে। বিএনপির পদযাত্রা সমাবেশে হামলা হচ্ছে। নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তারা জোর করে ক্ষমতা দখলে রাখতে চায়। কিন্তু এসব করে আমাদের দমানো যাবে না। এই সরকারকে বিদায় করতে আমরা আরো কঠোর কর্মসূচি দেবো।” ধানমন্ডির ঘটনা সরকার পুলিশকে দিয়ে ঘটিয়েছে – এমন দাবি করে তিনি বলেন, “তারা শুধু মিছিল, সমাবেশে নয়, নেতা-কর্মীদের বাড়ি-ঘরেও হামলা করছে। তারা দেশকে একাট সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়ে ফায়দা নিতে চাইছে। তারা আমাদের কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে পরিস্থিতি আরো খারাপ করছে। সংঘাত বাড়াচ্ছে।” তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী তো নিজেই বলেছেন, আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন না। আর আলোচনার কী আছে? আমাদের দাবি মেনে সরকার পদত্যাগ করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলেই তো ঝামেলা মিটে যায়। আলোচনা করার তো আর দরকার নেই।” এদিকে ২৬ মে বিএনপির চলমান পদযাত্রা কর্মসূচি শেষ হচ্ছে। শনিবার তাদের নতুন কর্মসূচি দেয়ার কথা রয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, কর্মসূচ হবে এক দফার- এই সরকারের বিদায়।
সংঘাত অনিবার্য?
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, “মৃত্যুর হুমকি আর প্রতিরোধের হুমকি এই দুই মিলিয়ে পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে যাচ্ছে। রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পরিস্থিতি জটিল করছে। গত কয়েকদিনে যে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে তাতে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে বলেই মনে হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতাদের ভাষাও যুদ্ধংদেহী। আগেও আমরা নির্বাচনের আগে দেশে সংঘাত অরাজকতা দেখেছি।” তিনি মনে করেন, “ধানমন্ডির সংঘাতের ঘটনা পুলিশ চাইলে এড়াতে পারতো। কিন্তু পুলিশকে দীর্ঘদিন ধরে দলীয়ভাবে ব্যবহার করায় তাদের মধ্যে দলীয় আচরণ ঢুকে গেছে। তাদের অতীতে কোনো শক্ত বার্তা দেয়া হয়নি। এখনই শক্ত বার্তা না দেয়া হলে তাদের আচরণে কোনো পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না।” তার কথা, ” দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে তো সংকট আছেই। এটা নিয়ে প্রধান দুই দল দুই দিকে অবস্থান করছে। এখন পর্যন্ত আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে বাধ্য।” আর রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, “দুইটি দলই যদি অনঢ় অবস্থানে থাকে, তাহলে তো সংঘাত হবেই। তাদের মধ্যে কোনো আলোচনা বা সমঝোতার লক্ষণ দেখছি না। আর বাংলাদেশে এটা কোনো নতুন ঘটনা নয়। নির্বাচনের আগে আমরা অতীতেও এই ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতি দেখেছি।” তিনি বলেন, “এই ধরনের পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করতে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি পক্ষও কাজ করে। তাদের নানা ধরনের স্বার্থ থাকে। তারা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তাদের স্বার্থ আদায় করতে চায়।” নূর খান আরো মনে করেন, “আসলে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা না থাকলে বিদেশিরা তেমন কিছু করতে পারে না।তারপরও তাদের গণতন্ত্র, নির্বাচন, সুশাসন নিয়ে কথা থাকে। সেটা কাজে দেয়। তারা ভিতরে ভিতরে হয়তো একটা সমঝোতার পথ দেখাতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের বিষয় বাংলাদেশের লোকজনকেই সমাধান করতে হবে।” আর শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন মনে করেন, “বিদেশিদের অন্য উদ্দেশ্যও থাকে। তারপরও ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে আন্দোলনের বাইরেও বিদেশিদের একটা রোল ছিল। ওয়ান ইলেভেনের সময় টু মাইনাস থিওরি থেকে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রণেভঙ্গ দেয়ার পিছনেও তারা সক্রিয় ছিলেন।”