রাজনীতিতে গণতন্ত্র সম্মেলন বিতর্ক

সমীকরণ প্রতিবেদন:
যুক্তরাষ্ট্রে আয়োজিত গণতন্ত্র সম্মেলনে এবারও বাংলাদেশ দাওয়াত পায়নি। যদিও দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও নেপাল আমন্ত্রণ পেয়েছে। এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রথম গণতন্ত্র শীর্ষ সম্মেলনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ১১০টি আমন্ত্রিত দেশের তালিকায়ও ছিল না বাংলাদেশ। পালটাপালটি কর্মসূচির কারণে কয়েক মাস রাজনীতিতে উত্তাপের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে এখন নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিএনপি বলছে দেশে গণতন্ত্র নেই, মানবাধিকার নেই বলে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে গেছে; আর এজন্যই গণতন্ত্র সম্মেলনে দাওয়াত পায়নি। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল বলছে, ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। মূলত বিএনপি বিশ্বদরবারে অভিযোগ করে কোনো লাভ হয়নি। অনেক চেষ্টা করেও তারা বিদেশিদের সাথে বৈঠক করতে পারেনি, এজন্য তারা উলটাপালটা বকছে।
পালটাপালটি কর্মসূচি পিছু ছাড়ছে না দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির। পালটাপালটি কর্মসূচি থেকে দু’দলকে সরে আসার আহ্বান রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা জানালেও বিএনপি বলছে, তাদের কর্মসূচিতে আসা নেতাকর্মীদের ভয় দেখাতেই আওয়ামী লীগ পালটা কর্মসূচি দিচ্ছে। আর আওয়ামী লীগ বলছে, বিএনপি কর্মসূচির নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে জনগণের জান-মালের যেন ক্ষতি না করতে পারে, সেজন্য শান্তি সমাবেশ নিয়ে রাজপথে আছে তারা। মোট কথা, দু’দল কেউ কাউকে ছাড় দিতে চাচ্ছে না। গতকালও ঢাকায় বিএনপি পদযাত্রা কর্মসূচি, আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশ এবং যুবলীগ প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। অন্যদিকে বেলা ৩টায় মোহাম্মদপুরের হাজী মকবুল হোসেন কলেজ মাঠে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তারা সব ওয়ার্ডে সতর্ক পাহারায় ছিলেন।
গতকাল শুক্রবার বিকালে গোপীবাগে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচিপূর্বক বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আজকে বাংলাদেশ গণতন্ত্র সম্মেলনের দাওয়াত পাচ্ছে না। এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক। এই সরকার রাজনীতি করছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে। তাই দেশের এ পরিণতি। বলতে দ্বিধা নেই, আওয়ামী লীগ একটি সন্ত্রাসী দল। সেটা এখন পুরো বিশ্বের কাছে প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের সোজা কথা- এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে আমরা আর যাব না।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা হেঁটে পথযাত্রায় মানুষকে বার্তা দিয়ে যাব। আর সময় নেই, রাজপথে নেমে আসতে হবে। অনেক হয়েছে; এই সরকার বিনা ভোটে মানুষের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন চালের দাম বাড়ছে, মানুষ ডিম কিনেও খেতে পারছে না। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। কোথাও কোনো শান্তি নেই। দেশের জনগণ গরিব হয়ে যাচ্ছে আর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা ধনী হচ্ছে। এই সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করছে। র‌্যাবকে ব্যবহার করেছিল, এখন তাদের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। তারা এখন পুলিশকে ব্যবহার করছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের আন্দোলনের ১০ নেতাকর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রাত হলেই পুলিশ পাড়ায় পাড়ায় আমাদের নেতাকর্মীদের আটক করছে। তবুও তারা আমাদের দমাতে পারছে না। কারণ বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতি করছে না, জনগণের অধিকার আদায়ের রাজনীতি করছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ এখন আমাদের আন্দোলনকে ভয় পায়। এই সরকারকে বলব, এখনো সময় আছে সরে যান। এ সরকারের পদত্যাগ দাবি এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আন্দোলনে সব সময় দেশের জনগণ জয়ী হয়েছে; এবারও জয়ী হবে। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে এ সংবিধান দিয়ে দেশ পরিচালিত হতে পারে না। আমাদের ২৭ দফায় বলেছি সংবিধান সংশোধনের কথা। সব মানুষের অংশগ্রহণের নির্বাচনের জন্য আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেছি। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘দেশে আজ গণতন্ত্র নেই, এটি বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত। তাই বাংলাদেশ গণতন্ত্র সম্মেলনে দাওয়াত পায়নি। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া বলেই বিএনপির কর্মসূচির দিনে শান্তি সমাবেশের নামে তারা পালটা কর্মসূচি দিচ্ছে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আজ আন্দোলন একটি পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। আমরা গত কয়েক মাস ধরে রাস্তায় আন্দোলন করছি। তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে এই ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করতে হবে। তিনি আরও বলেন, বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো ঢাকায় এসে বার্তা দিয়ে যাচ্ছে। তারা গণতন্ত্রের অধিকারের কথা বলে যাচ্ছে। তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। বাংলাদেশকে আজ গণতন্ত্র সম্মেলনে যাওয়ার সুযোগ দিচ্ছে না। তাই আমাদের রাস্তায় সিদ্ধান্ত হবে দেশকে বাঁচাতে। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, আমরা অতীতে অনেক বক্তব্য দিয়েছি; অনেক সমাবেশ করেছি কিন্তু এই সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হচ্ছে না। এই পদযাত্রার মাধ্যমে আমরা দেশের মানুষকে জানিয়ে দিতে চাই, বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আন্দোলন করছে না। বিএনপি রাজপথে মিছিল করছে, আন্দোলন করছে জনগণের অধিকারের জন্য। প্রতিবেশী দেশের সাথে সরকার আঁতাত করে একটি দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। তার উদাহরণ আদানি গ্রুপ। তারা কিছু দিক বা না দিক, তাদের কোটি কোটি টাকা দিয়ে দিতে হবে। এ সরকার থাকা অবস্থায় মানুষের মুক্তি মিলবে না। এজন্য চাই খালেদা জিয়ার মুক্তি, তারেক রহমানের দেশে ফিরে আসা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। এবার আমরা অন্য কোনো সরকারের অধীনে নির্বাচন করব না। একটি দেশ এসে বলে গেল আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেবে। তাদের বলব, আওয়ামী লীগকে নয়, দেশের জনগণকে সমর্থন দিন।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আমার-আপনার এবং জনগণের কথা এক— এই সরকারের পদত্যাগ। আমরা এ সরকারের অধীনে নির্বাচন করব না। কারো ভোট কাউকে দিতে দেব না। সরকার যদি জনগণের শক্তিকে বিশ্বাস। করে, তাহলে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দিক । আমরা জোর করে ক্ষমতায় আসতে চাই না। আজ শনিবার চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কুমিল্লা ও ফরিদপুর মহানগরে পদযাত্রা করবে বিএনপি। এই কর্মসূচি সফল করতে কেন্দ্রীয় নেতারা দেশের বিভিন্ন মহানগরে অবস্থান করছেন। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বলেছেন, প্রশাসন ও পুলিশবাহিনী দেশের উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং করতে দিচ্ছে না। তারা সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করছে। পুলিশবাহিনী ‘জনগণের পুলিশ’ হতে পারেনি। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে সবার প্রতি সমান আচরণ করা হচ্ছে না। জনগণকে মনের কথা প্রকাশ করতে দিচ্ছে না। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। এ অবস্থায় দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই সরকারের পতনের জন্য দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে হবে।
গণতন্ত্র সম্মেলনের পরোয়া শেখ হাসিনা করে না : গণতন্ত্র সম্মেলনের পরোয়া শেখ হাসিনার সরকার করে না বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র সম্মেলনে কাকে দাওয়াত দিল আর না দিল, তার পরোয়া শেখ হাসিনা করে না। কে আমন্ত্রণ করল, কোথায় সম্মেলন- সেটা নিয়ে আমাদের ভাবার সময় নেই।’ গতকাল শুক্রবার মোহাম্মদপুরে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ আয়োজিত শান্তি সমাবেশে বক্তব্য দেন ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘আমার দেশে গণতন্ত্র ঠিকমতো চালাচ্ছি কি না, আমার দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচন হচ্ছে কি না, জনগণ স্বাধীনভাবে কথা বলছে কি না- সেটিই আমার দেশের গণতন্ত্র।’ অনেক চেষ্টা করেও বিএনপি মার্কিন প্রতিনিধিদলের সাক্ষাৎ পায়নি উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ডোনাল্ড লু, ডেরেক শোলে এলেন; কিন্তু বিএনপির সাথে বৈঠক হয়নি। তারা দিনরাত পড়েছিল মার্কিন দূতাবাসে যদি একবার সাক্ষাৎ মেলে; কিন্তু সাক্ষাৎ হয়নি। এজন্য তাদের মন খারাপ।
বিএনপিকে উদ্দেশ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ভারতকে তো আমাদের সাথে অনেক আগেই জড়িয়ে দিয়েছে। এখন আমেরিকাও নেই। যাবেন কোথায়? বিদেশের বন্ধুরা নেই, দেশের জনগণও নেই। বিএনপি এখন বন্ধুহীন। তাহলে উপায়টা কী। ঘরে বসে বসে, শুয়ে শুয়ে হিন্দি সিরিয়াল দেখবেন। আর জানালা দিয়ে পুলিশের গতিবিধি দেখবেন। কত জায়গায় গেলেন নিষেধাজ্ঞার জন্য। কত তদবির করলেন, এলো কী নিষেধাজ্ঞা।
ওবায়দুল কাদের বলেন, নষ্ট রাজনীতির হোতা হচ্ছে নষ্ট বিএনপি। তারা রাজনীতির বিষফোঁড়া। তাদের হাতে গণতন্ত্র নিরাপদ নয়, নিরাপত্তা নিরাপদ নয়, আইনশৃঙ্খলা নিরাপদ নয়। এরা সুযোগ পেলেই মানুষ পোড়ায়, বাস ভাঙচুর করে, নারী ধর্ষণ করে। বাংলাদেশের নারীরা সতর্ক হয়ে যান। বিএনপি ক্ষমতায় এলে এই দেশকে আফগানিস্তান বানাবে। শেখ হাসিনাই এ দেশের নারীদের সম্মানিত করেছেন। অন্য একটি অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন দাবি করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র সম্মেলনের প্রথম পর্বে সম্ভবত দুর্বল গণতন্ত্রের দেশগুলোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং সে কারণে বাংলাদেশ আমন্ত্রণ পায়নি। তিনি বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে স্থিতিশীল গণতন্ত্র বিরাজ করছে। এটি অত্যন্ত স্বচ্ছ গণতন্ত্র। জনগণ সুষ্ঠু ও মুক্তভাবে ভোট দিতে পারছে। আমাদের দেশে সব মানুষ ভোট দিতে পারে।